- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 407
- Messages
- 5,564
- Reaction score
- 2,009
- Points
- 3,913
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
হাটে বাজারে
মূল লেখকঃ বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)
মূল লেখকঃ বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল)
পর্ব - ১
ডাক্তার সদাশিব ভট্টাচার্য মাছের বাজারের সামনে তাঁর মোটরটি থামালেন। তারপর ড্রাইভার আলীর দিকে চেয়ে বললেন—“গাড়ি বাঁয়ে দাবাকে রাখো। আর টিফিন-কেরিয়ার ঠো লেকে হামারী সাথ আও।”
“বহুত খু—”
বাঁ দিকের গলি দিয়ে মাছের বাজারে ঢুকলেন সদাশিব। গ্রীষ্মকাল। একটা বেজে গেছে। মাছের বাজার উঠে গেছে প্রায়। একটা বুড়ী মেছুনী কানা-উঁচু পরাতের মতো একটা টুকরিতে কিছু ভোলা মাছ নিয়ে বসে আছে তখনও। মাছগুলোর পেট বেলুনের মতো ফোলা।
অসময়ে ডাক্তারবাবুকে বাজারে দেখে সে একটু শশব্যস্ত হয়ে উঠল। একটু আগেই তো ডাক্তারবাবু এসেছিলেন, আবার এলেন কেন! আলি টিফিন-কেরিয়ার নিয়ে পিছু-পিছু আসছিল, সে নীরবে তার বাঁ হাতের তর্জনী এবং মধ্যমা সংযুক্ত করে ঠোঁটের উপর রাখল, তারপর চোখের ভঙ্গী করে জানিয়ে দিল—টু শব্দটি কোরো না।
সদাশিব ভ্রুকুঞ্চিত করে তাকে প্রশ্ন করলেন—“আবদুল কোথা—”
“আবদুল? গুদামে আছে বোধ হয়। কিংবা হয়তো বাড়ি চলে গেছে।” “আলী দেখ তো—”
“বহুত খু–”
আলী সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বন্ধ করে চলে গেল গুদামের দিকে। আলীর ধরন- ধারণ হাব-ভাব অনেকটা সার্কাসের ক্লাউনের মতো। সদাশিব টিনের শেডের ছায়ার আর একটু সরে গেলেন। তারপর মেছুনীর দিকে চেয়ে জিগ্যেস করলেন—“তোর নাতনী কেমন আছে—”
“ভালো আছে ডাক্তারবাবু”
“যে-কটা ইন্জেক্শন নিতে বলেছিলাম, নিয়েছে?”
বুড়ী অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে পায়ের পাতাটা চুলকোতে লাগল, যেন শুনতে পায়নি। কিন্তু সদাশিব ছাড়বার পাত্র নন।
“দশটা ইন্জেক্শন নিয়েছে?”
“না। নেবার সময় পায়নি। তার স্বামী এসে তাকে নিয়ে গেল যে। কত মানা করলুম—”
গুম হয়ে রইলেন সদাশিব।
তারপর বললেন—“মজাটা পরে বুঝবে। পটাপট পেট থেকে যখন মরা ছেলে বেরুতে থাকবে তখন বুঝবেন বাবাজী—”
মেছুনীর নাতজামাইকেই বাবাজী বলে উল্লেখ করলেন সদাশিব।
আবদুলকে নিয়ে আলী এসে হাজির হল।
আলী আশঙ্কা করছিল বোমার মতো ফেটে পড়বেন ডাক্তারবাবু। তা তিনি পড়লেন না।
আবদুলের দিকে চেয়ে শান্তকণ্ঠে বললেন—“টিফিন-কেরিয়ারে তোমার জন্যে মাছ রান্না করে এনেছি। খাও। আমার সামনে খাও”
আবদুলের চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে সদাশিবের দিকে।
“দেখছ কি, খাও—”
বুড়ী মেছুনী সভয়ে জিগ্যেস করল—“কি হয়েছে ডাক্তারবাবু?”
“আবদুলকে জিগ্যেস কর। যে মাছ ও টাটকা বলে একটু আগে আমাকে বিক্রি করেছিল তা ও নিজেই খেয়ে দেখুক টাটকা কিনা।”
“আমি বুঝতে পারিনি হুজুর। আমি ভেরেছিলাম ভালো করে বরফ দেওয়া আছে, খারাপ হবে না।”
“হয়েছে কিনা খেয়ে দেখ নিজে—”
আলীর হাত থেকে টিফিন-কেরিয়ারটা ছিনিয়ে নিলেন তিনি। তারপর যা করলেন তা অপ্রত্যাশিত। এক টুকরো মাছ বের করে গুঁজে দিলেন সেটা আবদুলের মুখে। তারপর টিফিন-কেরিয়ারটা দড়াম করে ফেলে দিয়ে হনহন করে চলে গেলেন চালপট্টির দিকে।
চালপট্টির এক কোণে ডিম বিক্রি করে রহিম। কালো, বেঁটে, মুখে বসন্তের দাগ। ভুরু প্রায় নেই। তার পাশে বসে আছে তার মেয়ে ফুটফুটে ফুলিয়া। যদিও তার বয়স আট-ন বছর, কিন্তু বসে আছে যেন পাকা গিন্নীর মতো। রহিমের উপর নজর রাখবার জন্যে, তার মা তাকে বসিয়ে রেখে যায়। রহিমের একটু ‘আলু’ দোষ আছে। দবিরগঞ্জের রঙীন-কাপড়-পরা চোখে-কাজল-দেওয়া উন্নতবক্ষা মেয়েগুলো যখন চাটের জন্য ডিম কিনতে আসে, তখন আত্মহারা হয়ে পড়ে রহিম। তাদের বাঁকা চোখের চাউনি আর ঠোঁট-টেপা হাসিতে অভিভূত হয়ে দামই নিতে ভুলে যায় সে অনেক সময়। কেন ভুলে যায় তা জানে হানিফা, রহিমের স্ত্রী। তাই সে ফুলিয়াকে নিযুক্ত করেছে পাহারায়। ফুলিয়া সম্ভবত নিগূঢ় সব খবর জানে না, তবে সে এইটুকু জানে যে তার বাপজান অন্যমনস্ক হয়ে অনেক সময় ন্যায্য পয়সা নিতে ভুলে যায়। অন্যমনস্কতাজনিত এ অন্যায় তাকে সংশোধন করতে হবে, এ জ্ঞানটুকু টনটনে আছে তার।
সদাশিব রহিমকে বলিলেন—“আমাকে দু ডজন ভালো ডিম দিয়ে আয় গাড়িতে; দেখিস যেন পচা না হয়। আবদুল আজ পচা মাছ দিয়েছিল, খেতে পারিনি। ফুলিয়া, তুই দেখিস তোর বাবা যেন না ঠকায়।”
একটা পাঁচটাকার নোট বার করে দিলেন তিনি রহিমকে। ফুলিয়া মিষ্টি হাসি হেসে চাইল ডাক্তারবাবুর দিকে, তারপর ডিম বেছে বেছে জলে ডুবিয়ে দেখতে লাগল যে ডিমটা দিচ্ছে সেটা ভালো কিনা। সদাশিব সানন্দে লক্ষ্য করলেন ফুলিয়া কানে দুটি ছোট মাকড়ি পরেছে। সোনার নয়, রূপার। কিন্তু মানিয়েছে বেশ। কিছুদিন আগে ডাক্তার সদাশিবই তার কান বিধিয়ে দিয়েছিলেন।
“ডিমগুলো নিয়ে আয় গাড়িতে—”
চলে গেলেন তিনি। অন্য কেউ হলে প্রত্যেকটি ডিম ভালো করে দেখে দেখে নিত, কিন্তু সদাশিব দেখলেন না। কখনও দেখেন না, মাঝে মাঝে ঠকেন তবুও দেখেন না। জনশ্রুতি ঘর-পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। কিন্তু অনেকবার ঠকেও সদাশিব ভয় পান না, কারণ তিনি গরু নন, মানুষ। তাই তিনি মানুষকে বিশ্বাস করেন, বিশ্বাস করে আনন্দ পান।
সদাশিব গাড়ির কাছে এসে দেখলেন আবদুল টিফিন-কেরিয়ারটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সদাশিবের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলে সে। সদাশিব থমকে দাঁড়ালেন, নিষ্পলক দৃষ্টিতে ক্ষণকাল চেয়ে রইলেন তার মুখের দিকে, তারপর অপ্রত্যাশিতভাবে অত্যন্ত কোমলকণ্ঠে বললেন- “আজ কি হয়েছিল তোর! অমন পচা মাছটা আমাকে দিলি”
“আমি বুঝতে পারিনি। তাছাড়া মাথারও ঠিক ছিল না—”
“মদ খেয়েছিলি নাকি—”
“না হুজুর। রমজুটা জ্বরে বেহোঁশ হয়ে গিয়েছিল। এখনও জ্বর ছাড়েনি—”
“ওষুধ দাওনি কিছু?”
“না এখনও দিইনি। ভেবেছিলাম এমনি সেরে যাবে—”
সদাশিবের চোখের দৃষ্টিতে আবার আগুন জ্বলে উঠল।
“আমাকে বলনি কেন—”
আবদুল ক্ষণকাল চুপ করে রইল।
তারপর বলল—“আপনাকে বার বার বিরক্ত করতে লজ্জা করে হুজুর
সদাশিব কিছু বললেন না। গুম হয়ে জুলন্ত দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইলেন শুধু।
তারপর বললেন—“এখুনি আমি রমজুকে দেখতে যাব। গাড়িতে উঠে বোস—”
ঠিক এই সময় ফুলিয়া হাজির হল ডিম আর বাকী পয়সা নিয়ে। আলী ডিমগুলো নিয়ে যথাস্থানে রেখে দিল। সদাশিব পয়সাগুলো গুনে দেখলেন না। কেবল একটা এক-আনি তুলে দিয়ে দিলেন ফুলিয়াকে। ফুলিয়া একমুখ হেসে ছুটে চলে গেল। স্মিত দৃষ্টি মেলে তার দিকে চেয়ে রইলেন সদাশিব। তাঁর মনে হল ফুলিয়া নামটা সার্থক হয়েছে ওর। সত্যিই ফুলের মতো।