- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 407
- Messages
- 5,564
- Reaction score
- 2,009
- Points
- 3,913
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
ত্রিভুজ
মূল লেখকঃ হাবিবা সরকার
মূল লেখকঃ হাবিবা সরকার
পর্ব-১
আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের হাজবেন্ড আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। এই গরমে ভদ্রলোকের পরনে কোট-টাই। চোখে চশমা। হাত-পা গুটিয়ে পিঠ টানটান করে সোফায় বসে আছেন।
আমি রুমে ঢুকতেই প্রশ্ন করলেন,
- 'এসি নাই?'
- 'জ্বী না।'
- 'ও, ঢাকা শহরে মানুষ এসি ছাড়া বাস করে কিভাবে!'
ভদ্রলোক প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছলেন।
- 'আপনি..আসলে আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।'
কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বিয়ের পর ঋতু আমাকে ব্লক করেছিল। ফেক আইডি থেকে অসংখ্যবার ওর ওয়ালে ঢুকেছি, এ ভদ্রলোকের সাথে কাপল ছবি দেখেছি।উনাকে আমার অচেনা লাগার কথা নয়। আসলে কি বলে কথা শুরু করব, ভেবে পাচ্ছিলাম না।
- 'আপনার একটা বন্ধু ছিলো ঋতু, মনে আছে?'
- 'জ্বী'
- 'আমি ওর হাজবেন্ড। ঋতু কি এখানে এসেছে?'
- 'মানে?'
- 'ঋতুকে কাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ ওর ফোন সুইচ অফ।'
- 'ওর আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে খোঁজ নিন।থানায় খবর দিন।আমার কাছে এসেছেন কেন?'
- 'দেখুন, আপনার সাথে ঋতুর একসময় খুব ভালো সম্পর্ক ছিল তা আমি জানি।'
- 'ছিলো, সেটা ওর বিয়ের আগে। বিয়ের পর ওর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। বলা ভালো, ঋতুই কোনো যোগাযোগ রাখে নি।'
- 'ও চাইলে আপনি কথা বলতেন?'
ফিকে হাসি হাসলাম।
.
ঋতু, দুই অক্ষরের ছোট্ট একটা নাম অথচ বুকের কতটা গভীরে বসবাস। সবেমাত্র ভার্সিটিতে অ্যাডমিশন নিয়েছি। দুরুদুরু বুকে রোজ ক্লাসে যাই। ক্লাস শেষ হবার পর সোজা মেসে ফিরি।
দুই মাস কেটে যাবার পরও আমার কোনো বন্ধু হয় নি। নেত্রকোনার অজ পাঁড়াগায়ে আমার জন্ম। আর সব বন্ধুদের তুলনায় ঢিলেঢালা প্যান্ট, কায়দা করে চুল আঁচড়াতে পারি না। একটানা বেশিক্ষণ কথা বললে খাস নেত্রকোনার টান এসে যায়। নিজের পোশাক-ভাষা নিয়ে সবসময় জড়তায় ভুগি।
একদিন থার্মোডায়ানামিক্সের ক্লাস চলছিল।খুব মনোযোগ সহকারে ম্যামের লেকচার শুনছিলাম। হঠাৎ পিছনের বেঞ্চে বসা একটা মেয়ে গপ করে আমার মাথার একগোছা চুল ধরে বললো,
- 'এইরে, তোমার মাথায় উকুন।'
টান মেরে উকুনটা বের করে বেঞ্চে মারলো।
লজ্জায় ইচ্ছা করছিল মাটির সাথে মিশে যাই। পিছন দিকে তাকাতে পারছিলাম না৷ নির্ঘাত মেয়েগুলি খুব হাসছে। সারাক্লাস আর কিছু মাথায় ঢুকছিল না।কোনোমতে ক্লাস শেষে ম্যামের সাথেই বের হয়ে এলাম।ছোট্ট কোনো ঘটনা নিয়ে ক্লাসের সহপাঠীদের হাসাহাসি করতে দেখেছি। একটা ছেলের মাথায় উকুন পাওয়া এতো বিরাট কোনো ঘটনা। সেদিন আর ক্লাস করলাম না। শুক্র-শনি দুইদিন হলিডে।
.
রোববার দুরুদুরু বুকে পিছনের বেঞ্চে বসে আছি।স্যার ক্লাসে আসলে বেঁচে যাই। ঠিক এমন সময় ফর্সামতন একটা মেয়ে আমার সাথে এসে বসলো।কোঁকড়া চুল ঝুটির মত করে বসা৷নড়েচড়ে বসলাম।ছেলেমেয়ে একসাথে বসে না এমন নয় কিন্তু আমার সাথে মেয়ে তো দূরে থাক কোনো ছেলেই বসতে চায় না।
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো,
- 'তোমার কাছে আমি একটা থ্যাংকস পাওনা।'
- 'কেন?'
- 'সেদিন যে তোমার মাথার উকুন মেরে দিলাম। কাছে আসো তো, আরো উকুন আছে কি না দেখি।'
- 'না, না। লাগবে না।'
লাফ দিয়ে বেঞ্চের শেষ মাথায় গিয়ে বসলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আজই বাড়ি গিয়ে চুল কেটে ফেলবো।
ক্লাস শুরু হতে মেয়েটা আমার কাছ ঘেষে এল।
ফিসফিস করে বললো,
- 'পড়াশুনা করতে আমার ভালো লাগে না।রসায়ন তো বমি পায়।'
- 'তাহলে পড়াশোনা করো কেন?'
- 'কি করবো! নয়ত বাবা বিয়ে দিয়ে দিবে।আমার বড়বোনের দুইবোনের খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গেছে।বড়টার বিয়ে হয়ে গেছে একটা গোবদা চেহারার ব্যবসায়ীর সাথে। টাক মাথা।সেই মাথায় জিলাপীর প্যাঁচ।কিভাবে ব্যবসা বাড়ানো যায় সেই ধান্দা৷দু'দিন পর পর আমার জন্যে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে। বদ শালা!'
হা করে মেয়েটার কথা গিলছিলাম। একটা মেয়ে তার নিজের দুলাভাইকে শালা বলে গালি দিতে পারে বলে জানতাম না।
- 'তোমার নাম কি?'
- 'রুমী।'
- 'বাহ! জাহানারা ইমামের ছেলের নাম ছিল রুমী।শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। তুমি ‘একাত্তরের দিনগুলি’ পড়েছ?'
- 'না।'
- 'কি বলছো! তুমি এত ভালো বই পড়ো নি!'
- 'আসলে আমার বই পড়ার অভ্যাস আছে কিন্তু গ্রামের লাইব্রেরিতে তত বই ছিল না।'
- 'ওহ!' মেয়েটা বিজ্ঞের মত মাথা নাড়লো।
- 'তোমার কাছে ২০০ টাকা হবে?'
- 'কেন?'
ভয় পাচ্ছিলাম ধার চাইবে নাতো। বাবা যে টাকা পাঠায় খুব টানাটানি করে মাস শেষ করি। মুদি দোকানদার বাবার কাছ থেকে এরচেয়ে বেশি চাইতেও লজ্জা হয়।
- 'কি হলো? কতো আছে?'
- '১০০ টাকা আছে।'
- 'ঠিক আছে। আজ ক্লাস শেষ হলেই আমরা নীলক্ষেত যাবো।'
ভেবেছিলাম কোনো উছিলা ধরে মেয়েটার হাত থেকে নিস্তার যাবো।তা না। মেয়েটা টানতে টানতে নীলক্ষেতে নিয়ে চলে এলো।ফুটপাতের বৃদ্ধ দোকানদার ওকে দেখে সবগুলো দাঁত করে হাসলো।
- 'ঋতু, মামনি। কতদিন পর আসলা।'
- 'পকেটে টাকা ছিলো না মা।'
- 'সাথে এটা কে?'
- 'আপনার নতুন কাস্টমার।'
ঋতু আধময়লা পুরানো একটা বই নাকে নিয়ে ঘ্রাণ শুঁকল।বড় বড় চোখ করে ওকে দেখছি।
- 'জানো তো, বই যত পুরানো হয় বোঝা যায় পাঠকের কাছে তার মূল্য ঠিক ততোখানি হয়।'
সেদিন ডজন খানেক বই কিনে বাড়ি ফিরলাম।পুরানো বই, নাম মাত্র মূল্যে দাম। অর্ধেকটা ঋতু দিয়েছে অর্ধেকটা আমি৷
মেয়েটা চলে যাবার পর লক্ষ্য করলাম মানিব্যাগ শূন্য, হাতে গোটা কয়েক বই কিন্তু হৃদয় জুড়ে প্রশান্তি রেখে গেছে।
'
'
'
'
'
- 'কি ভাবছেন?'
ভদ্রলোকের প্রশ্নে বর্তমানে ফিরে এলাম।
- 'কিছু না। আপনি চা, কফি কি খাবেন বলুন।'
- 'ভাই,আমি আপনার কাছে সময় কাটাতে আসি নি। আপনি সত্যিই বলছেন ঋতু আপনার কাছে আসে নি!'
- 'জ্বী না৷ আপনার মত বিত্তবানকে ছেড়ে আমার মত বাউন্ডুলের কাছে আসার কথাও না। মেয়েরা সুখ খুঁজে নিতে জানে।'
মিলন সাহেব মানে ঋতুর হাজবেন্ড হাসলেন।
- 'মেয়েদের মন কখন কি চায় তারা নিজেও জানে না৷ বইমেলা ঘুরে ও আপনার প্রকাশিত বইয়ের কয়েক কপি কিনে।পরিচিতজনদের বই গিফ্ট করে গল্প করে, আপনি ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।'
- 'এতে অন্যায় কিছু দেখছি না৷ যখন আমার বই বের হত না লোকে আমাকে চিনত না তখনও ঋতু আমার লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তো।পড়ে মন্তব্য করতো।মেয়েটা বই পড়তে ভালোবাসে।'
- 'বই পড়া! যত্তসব ঢং। কোনো বিয়ে-বার্থডে পার্টি কোথাও যেতে চায় না।আমার আত্মীয়-স্বজন কারো সাথে মিশতে পারে না।আনকালচার একটা।'
অন্য কেউ ঋতুর নামে এমন মন্তব্য করলে কড়া ভাষায়
জবাব দিতাম।কিন্তু মিলন সাহেব ঋতুর হাজবেন্ড।স্রষ্টা ঋতুর প্রতি আমার সমস্ত অধিকার কেঁড়ে নিয়েছেন।
- 'সেটা আপনাদের পারিবারিক ব্যাপার আপনারা সলভ করবেন।'
- 'জ্বী৷ সেই চেষ্টাই করছিলাম।মাঝখান থেকে ঋতু উধাও।
আজ উঠি৷ এটা আমার কার্ড। ঋতুর কোনো খোঁজ পেলে আমাকে জানাবেন।'
মিলন সাহেব দরজা পর্যন্ত চলে গিয়ে আবার ফিরে এলেন,
- 'কিছু মনে করবেন না, আপনার বাসাটা ঘুরে দেখতে পারি?'