Collected শুভ্র - হুমায়ূন আহমেদ

dukhopakhidukhopakhi is verified member.

Special Member
Registered
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
407
Messages
5,564
Reaction score
2,011
Points
3,913
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
শুভ্র

মূল লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ






পর্ব - ১


শুভ্রর একটা বিশ্ৰী সমস্যা হয়েছে।
রোজ ঠিক রাত তিনটায় অবধারিতভাবে তার ঘুম ভেঙে যায়। কাঁটায় কাটায় তিনটায়। পাঁচ মিনিট আগেও না, পরেও না। মনে হচ্ছে কোনো অদ্ভুত উপায়ে তাঁর শরীরের ভেতর একটা এলার্ম ক্লক ঢুকে গেছে। এলার্ম ক্লিকটা রাত তিনটা বাজার মিনিট তিনেক আগে বেজে ওঠে। রাত তিনটায় শুভ্ৰ ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর এলার্ম ক্লিক থামে।
গভীর রাতে অনেকেরই ঘুম ভাঙে। তাদের ঘুম ভাঙার সঙ্গে শুভ্রর ঘুম ভাঙার কোনো মিল নেই। তারা পানি খেয়ে, বাথরুম করে আবার বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। শুভ্ৰ পারে না। তার ঘুম আসতে আসতে ছটা। তিনটা থেকে ছটা এই তিন ঘণ্টা সময় কাটানো খুব কষ্টের। আগে পড়াশোনা ছিল, হাত-মুখ ধুয়ে বই নিয়ে বসলে সময় কেটে যেত। এখন পরীক্ষা শেষ। থিসিসের উপর ভাইভাও হয়ে গেছে। তিন ঘণ্টা জেগে থেকে সে করবে। কী? তিন ঘণ্টা তো কম সময় না। দশ হাজার অ্যািটশ সেকেন্ড। এই সময়ে আলো ১,৮৬,০০০ × ১০,৮০০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করবে। পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর ৪৫ ডিগ্রি ঘুরে যাবে। পৃথিবীতে অনেক কীটপতঙ্গ আছে যাদের আয়ু তিনঘণ্টারও কম। তিন ঘণ্টা তুচ্ছ করার ব্যাপার না। শুভ্ৰ তুচ্ছ করতে পারছে না। করতে পারলে ভাল হত।
শুভ্ৰ সময় কাটানোর মোটামুটি একটা রুটিন করে ফেলেছে। পনেরো মিনিট-— বাথরুম, দাঁত ব্ৰাশ করা, হাত-মুখ ধোয়া, পানি খাওয়া। পনেরো মিনিট— গান এবং চা পান। চা-টা সে নিজেই বানায়। ইলেকট্রিক হিটারে পানি গরম করে, বড় একটা মাগে দুটো টি ব্যাগ দিয়ে মগ ভর্তি চা বানিয়ে গান শুনতে বসে। হিন্দি গান। গভীর রাতে হিন্দি গান ছাড়া অন্য কোনো গান কেন জানি শুনতে।ভাল লাগে না। খুব লো ভল্যুমে সিডি প্লেয়ারে গান বাজে। গানের ভল্যুম একটু বাড়লেই শুভ্রর বাবা মোতাহার সাহেবের পাতলা ঘুম ভেঙে যাবে। তিনি মহাব্যস্ত হয়ে শুভ্ৰর ঘরে উপস্থিত হবেন এবং আতংকিত গলায় বলবেন, কী হয়েছে। বাবা? ঘুম আসছে না? বলিস কী? ঘুম আসবে না কেন?
যেন শুভ্রর ঘুম না হওয়াটা ভয়ংকর একটা ঘটনা। পৃথিবীর আহ্নিক গতি বন্ধ হয়ে যাবার মত বড় ঘটনা। গান পর্ব শেষ হবার পরের এক ঘণ্টা পড়াশোনা। ইন্টারেস্টিং কোনো বই; যেমন–Life in Space, Magic of Number, Birth of God। এখন সে পড়ছে ব্রেইলী পদ্ধতির উপর একটা বই। অন্ধরা হাতের আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কীভাবে পড়ে খুব সুন্দর করে উদাহরণ দিয়ে বইটাতে ব্যাখ্যা করা। এই বইটা শুভ্র খুব আনন্দের সঙ্গে পড়ছে এবং ব্ৰেইলী পদ্ধতিতে পড়া প্রায় শিখে ফেলেছে। একটা উঁচু ফোঁট মানে A, দুটো ফোঁটা একটি উপরে একটি নিচে B, দুটো ফোঁটা পাশাপাশি C, কোণাকুণি দুটো ফোঁট মানে E। সমস্যা হল A এর জন্য যে চিহ্ন, ফুলস্টপের জন্যে একই চিহ্ন। ব্ৰেইলী পদ্ধতি শুভ্র খুব আগ্রহ করে শিখছে কারণ তার চোখ ভয়ংকর খারাপ। চশমা ছাড়া সে কিছুই দেখে না। চশমা। চোখে শুভ্রকে প্রথম যে দেখে সেও একটা ধাক্কার মত খায়। শুভ্রর চোখের দিকে যেই তাকাবে তার কাছে মনে হবে কাচের সমুদ্রে দুটো চোখ ভাসছে। শুধু যে ভাসছে তা না, ঢেউ এর মত খানিকটা উঠা-নমাও করছে। শুভ্রর ধারণা— কোনো এক ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে সে কিছুই দেখবে না। ব্ৰেইলী পদ্ধতির পড়া এখন কাজে না লাগিলেও তখন কাজে লাগবে।
পড়াশোনার পর্ব শেষ করার পরের অংশ হল বারান্দা। বারান্দায় সে এক ঘণ্টা থাকবে। এই এক ঘণ্টায় সকাল হতে শুরু করবে। সকাল দেখাটা মন্দ না। অন্ধকার থেকে আলোয় আসার পর্বটা এত সুন্দরভাবে হয় যে শুভ্ৰ প্ৰতিবারই মুগ্ধ হয়। সবচে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, একটা সকালের সঙ্গে আরেকটা সকালের কোনোই মিল নেই। প্রতিটি সকালেই আলাদা।
সকাল হওয়া দেখে শুভ্ৰ আবারো বাথরুমে যায়। হাত, মুখ ধোয়। আবারো দাঁত ব্ৰাশ করে। তারপর পাতলা চাঁদর গায়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ঘুম আসতে তখন আর দেরি হয় না।
আজ শুভ্রর ঘুম ভাঙল তিনটার অনেক আগে। সে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হতভম্ব। রাত বাজছে বারোটা দশ। সে ঘুমুতে গেছে। দশটা চল্লিশে। অর্থাৎ সে মাত্র দেড় ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। এর মধ্যেই ঘুম ভেঙে গেল। কারণটা কী? শরীরের ভেতরের এলার্ম ক্লাকে কি কোনো গণ্ডগোল হয়েছে? যিনি এলার্ম ক্লাকে চাবি দেন সেই তিনি চাবি দিতে ভুলে গেছেন? শুভ্ৰ বিছানা থেকে নামল আর তখনি শুনল খুব স্পষ্ট গলায় কে যেন ক্রমাগত বলছে
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
গলার স্বরটা অনেকটাই তার বাবার মতো; একটু শুধু চিকন। শব্দটা আসছে। তার ঘরের বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে। বাবা কি দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছেন? তার পুত্ৰ ভাত খেয়েছে কি-না জানতে চাচ্ছেন? তা কী করে হয়! শুভ্ৰ বিস্মিত গলায় বলল, কে?
দরজার ওপাশের শব্দ সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল। ভৌতিক কিছু? না-কি হঠাৎ ঘুম ভাঙার কারণে শুভ্ৰীয় মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে, হেলুসিনেশন হচ্ছে। শব্দের হেলুসিনেশন। শরীরে হঠাৎ করে অক্সিজেনের অভাব হলে হেলুসিনেশন হয়। দরজা জানালা বন্ধ করে শোয়ায় কি অক্সিজেনের ঘাটতি হল? তা হবার কথা না। শুভ্র বাথরুমে ঢুকল। চোখে-মুখে পানি দিয়ে বাথরুম থেকে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে আবারো সেই ব্যাকুল জিজ্ঞাসা—
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ মা বলে আতংকিত শব্দ করল। সঙ্গে সঙ্গে দরজায় ধাক্কা দিয়ে শুভ্ৰর মা জাহানারা বললেন, ও খোকন আমি এখানে, ভয় পেয়েছিস? দরজা খোল। শুভ্র হড়বড় করে বলল, মা, কে যেন কথা বলছে। জাহানারা বললেন, দরজাটা খোল খোকন। আমি ভয় ভাঙ্গিয়ে দিচ্ছি।
শুভ্র দরজা খুলছে না। বিড়বিড় করছে। অস্পষ্টভাবে সে মাকে ডাকছে। তার পা কাঁপছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে। জাহানারা ব্যাকুল গলায় বললেন, ও খোকন ভয়ের কিছু নেই। এটা একটা ময়না পাখি। তোর বাবা এনেছে। দরজা খোল বোকা।
দরজা খুলে শুভ্ৰ বের হয়ে মাকে দেখল। খাচা হাতে তিনিই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলে প্ৰচণ্ড ভয় পেয়েছে এই জন্যে তিনি খুবই বিব্রত। জাহানারা বললেন, এত ভয় পেয়েছিস কেনরে বোকা? ইশ মুখ টুখ শুকিয়ে কী হয়েছে! এই দেখি ময়না। কথা বলা ময়না। ময়না কথা বলছিল।
শুভ্ৰ ময়নার দিকে তাকালো। ময়না যন্ত্রের মত বলল–
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
জাহানারা ছেলের হাত ধরলেন। এবং কপালের উত্তাপ পরীক্ষা করলেন। ভয়ে ছেলের জ্বর এসে যায়নিতো? জ্বর দেখার কাজটা তিনি সব সময় করেন। জ্বর থাকলেও করেন, না থাকলেও করেন। অনেক দিনের অভ্যাস থেকে এরকম হয়েছে। ছোটবেলায় শুভ্রর হঠাৎ করে জ্বর আসত। ছেলে দিব্যি নিজের মনে হাসছে খেলছে- কপালে হাত দিলেই দেখা যেত আকাশ-পাতাল জ্বর।
জাহানারা কোমল গলায় বললেন, খুব ভয় পেয়েছিলি?
শুভ্ৰ হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। বাড়াবাড়ি রকমের ভয় পাওয়ায় তার একটু লজার মত লাগছে।
জাহানারা বললেন, তুই কি ভেবেছিলি ভূত?
কিছু ভাবি নি। তবে ভয় পেয়েছি।
তোর বাবা তিন মাস আগে ময়নাটা কিনেছে। অফিসে রেখে কথা শিখিয়েছে। আমাকে বলেছে ঠিক যেন বারোটা এক মিনিটে পাখিটা নিয়ে তোর দরজার সামনে দাঁড়াই। আমি তাই করলাম। তুই এত ভয় পাবি বুঝতে পারি নি।
শুভ্র ময়নার খাঁচার সামনে বসে পড়েছে। পাখিটা অবিকল তার বাবার গলায় কথা বলছে। কী বিস্ময়কর ঘটনা! জীবন্ত ভয়েস রেকর্ডার।
খোকন।
উঁ।
ময়না পছন্দ হয়েছে?
পছন্দ হয় নি। খাঁচায় বন্দি পাখি দেখতে খারাপ লাগে, তবে খুব অদ্ভুত লাগছে- মা, ময়না পাখি কি যা শুনে তাই বলতে পারে?
হ্যাঁ পারে। তুই মজার মজার কথা শিখাবি– ও সুন্দর করে বলবে।
আমি শুধু Talking bird-এর কথা শুনেছি, এই প্রথম ওদেরকে কথা বলতে শুনলাম। ব্যাপারটা যে এত ইন্টারেস্টিং হবে জানতাম না। বাবার গলাটাতো খুব সুন্দর নকল করেছে।
তুই খুশি হয়েছিস শুভ্ৰ?
শুভ্ৰ অবাক হয়ে বলল, খুশি হব কেন?
তোর একটা শখের জিনিস তোর বাবা তোকে প্রেজেন্ট করল। এই জন্যে।
হ্যাঁ খুশি হয়েছি।
জাহানারা ছেলের দিকে তাকিয়ে রহস্যপূর্ণ গলায় বললেন, খোকন বলত ঠিক বারোটা এক মিনিটে তোর ঘরের দরজার সামনে কেন দাঁড়িয়েছিলাম? দেখি তুই বলতে পারিস কি-না।
শুভ্র কারণটা জানে। আজ তার জন্মদিন। জন্মদিনে মা রাত কারোটায়। এই ধরনের ছেলেমানুষী করেন। বাবারও তাতে সায় থাকে। শুভ্ৰ মার দিকে তাকাল। জাহানারায় চোখ চকচক করছে। শুভ্ৰ জানে মা জন্মদিনের খবরটা দিয়ে তাকে চমকে দিতে চাচ্ছেন। মাকে এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। জাহানারা আবার বললেন, কীরে জিনিস, কেন রাত বারোটা এক মিনিট তোর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম?
জানি না।
আরে বোকারাম আজ তোর জন্মদিন। আচ্ছা তুই সব সময় নিজের জন্মদিন ভুলে যাস কেন? গতবারও ভুলে গেলি। তোর সব কিছু মনে থাকে। আর জন্মদিন মনে থাকে না? অন্যদিন রাত এগারোটার সময় ঘুমুতে যাস আজ ঘুমুতে গেলি সাড়ে দশটায়।
জাহানারা ছেলের পাশে বসলেন। তাঁর একটু মন খারাপ, কারণ শুভ্ৰ তার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না— শুভ্রর যাবতীয় কৌতূহল ময়নাটার দিকে। শুভ্র বলল, ময়নাটা আর কোনো কথা জানে না?
আমি তো একটা কথাই বারবার শুনছি।
কী অদ্ভুত ব্যাপার তাই না? একটা পাখি অবিকল মানুষের গলায় কথা বলছে।
শুভ্ৰর কথার মাঝখানে পাখি বলল—
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ ভাত খাইছ?
শুভ্ৰ বিক্ষিত গলায় বলল, শুভ্রর মত যুক্তাক্ষর কত স্পষ্ট করে বলছে দেখছ মা? কোনোরকম সমস্যা হচ্ছে না। একজন আমেরিকান বা বিলেতী সাহেব দু তিন বছর চেষ্টা চরিত্র করার পরও শুভ্র বলতে পারবে না। বলবে সুবরু।
জাহানারা বললেন, তোর পাখি সাহেবদের চেয়েও সুন্দর করে শুভ্র বলছে ঠিকই, কিন্তু খাইছ শুনতে বিশ্ৰী লাগছে না? তোর বাবা ইচ্ছা করলেই খাইছ না শিখিয়ে খেয়েছো শেখাতে পারত। তোর বাবার গ্রাম্যতা দূর হল না। ময়না যখন কথা বলে তখন মনে হয়। কাজের বুয়া কথা বলছে। সুন্দর কিছু শিখাবে— তা না।
শুভ্র বলল, ভাত খাইছাঁ শুনতে আমার কাছে খারাপ লাগছে না। মিথ্যা করে হলেও মনে হচ্ছে পাখিটা আমার ব্যাপারে কনসার্ন। আমি ভাত খেয়েছি। কিনা তা জানতে চায়।
তোর বাবাকে থ্যাংকস দিবি না?
বাবা কি জেগে আছেন?
হ্যাঁ জেগে আছে। তোকে হ্যাপী বাৰ্থ ডে বলার জন্যে জেগে আছে। তার শরীরটা অবশ্যি খারাপ। জ্বর এসেছে। ঘুমিয়ে পড়লে ভাল করত।
বাবাকে ঘুমিয়ে পড়তে বল মা। আমি সকালে থ্যাংকস দেব।
তোর জন্যে জেগে বসে আছে- তুই সকালে থ্যাংকস দিবি এটা কেমন কথা? অসুস্থ একজন মানুষ। অপেক্ষা করে আছে। আর আমি নিজেও তো তোর জন্যে কাওনের চালের পায়েস বানিয়েছি। আয় সবাই মিলে পায়েস খাব। তুই আমাদের পা ছুঁয়ে কদম্বুসি করে দোয়া নিবি না?
তুমি যাও। আমি আসছি। তবে পায়েস খাব না। আর কদমবুসিও করতে পারব না। লজ্জা লাগে।
শুভ্ৰ গভীর আগ্রহের সঙ্গে পাখির দিকে তাকিয়ে আছে। পাখিটার কী সুন্দর, চকচকে কালো গা। যেন গা থেকে কালো আলো বের হচ্ছে। শুভ্র নিজের মনেই হাসল— ফালো আলো আবার কী? আলো কখনো কালো হয় না। পাখিটাকে মজার কিছু শেখাতে হবে। অদ্ভুত কিছু। যেন পাখির কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে যায়। এক লাইন গান শেখালে কেমন হয়?
বধূ কোন আলো লাগল চোখে।
যে পাখি শুভ্ৰ ভাত খাইছ বলতে পারে সে নিশ্চয় বিধু কোন আলো লাগল চোখেও বলতে পারবে। কিংবা আরেকটা জিনিস শেখানো যায়— খিলখিল হাসি। পাখিটা একটু পর পর খিলখিল করে হেসে উঠবে। শুভ্রর পরিচিত মানুষদের মধ্যে সবচে সুন্দর করে হাসে মীরা। একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে মীরার হাসি রেকর্ড করে নিয়ে এলে হয়। রেকর্ড করা হাসি বার বার পাখিকে শুনানো হবে। মীরাকে আগে বলা যাবে না কেন তার হাঁসি রেকর্ড করা হচ্ছে। একদিন তার হাঁসি তাকে ফেরত দিয়ে চমকে দেয়া যাবে।
শুভ্ৰর বাবা মোতাহার সাহেবের শরীর কদিন ধরে ভাল যাচ্ছে না। তাঁর ডায়াবেটিস আছে। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এসিডিটি। মানুষের শরীরে কোনো রোগ একা বাস করতে পারে না। কিছুদিনের মধ্যেই সে তার সঙ্গি জুটিয়ে ফেলে। যার ডায়াবেটিস আছে তাকে ধরে এজমায়।
মোতাহার সাহেব নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করেন। সকালে নিয়ম করে এক ঘণ্টা হাঁটেন। দুপুরে চায়ের কাপে এক কাপ ভাতের বেশি। কখনো খান না। তারপরেও রক্তে সুগারের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ডাক্তার ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে বলছে। ইনজেকশনের ব্যাপারে মোতাহার সাহেবের সীমাহীন ভীতি আছে। রোজ ইনজেকশন নিতে হবে- এই ভয়েই তিনি কাতর হয়ে আছেন।
আজ তাঁর জ্বর এসেছে। তেমন কিছু না, নাইনটি নাইন পয়েন্ট ফাইভ। পঞ্চাশ বছর বয়সে এই জুরাই মানুষকে কাহিল করে দেয়। সন্ধ্যার দিকে মনে হচ্ছিল তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বুক ভার, নিঃশ্বাসে কষ্ট। সেই যন্ত্রণা এখন নেই। শুধু মাথা ভার ভার হয়ে আছে এবং চোখ জ্বালা করছে।
তিনি খাটে চাঁদর গায়ে শুয়ে আছেন। ঘর ঠাণ্ডা, এসি চলছে। খাটের পাশে টেবিল ল্যাম্প জুলছে। আলো চোখে লাগে বলে টেবিল ল্যাম্পের ওপর একটা টাওয়েল দেয়া আছে। টাওয়েলের রঙ সবুজ বলেই ঘৱে কেমন সবুজ সবুজ আলো। তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন, জাহানারা ঘরে ঢোকার পরেও চোখ না মেলেই বললেন, শুভ্ৰ খুশি হয়েছে?
জাহানারা বললেন, খুশি মানে। বাচ্চাদের মত খুশি। খাচার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। এখনই তোমাকে থ্যাংকস দিতে আসবে।
থ্যাংকসের কী আছে? জন্মদিনের সামান্য উপহার।
জাহানারা অবাক হয়ে বললেন, সামান্য উপহার? তুমি কলমাকান্দা থেকে পাখি আনিয়েছ। অফিসে তিন মাস রেখে কথা শিখিয়েছ। এটা সামান্য হল? বাংলাদেশের কটা বাবা এরকম করে?
শুভ্ৰর বয়স কত হল?
তেইশ। আচ্ছা শোন, আমি শুভ্রর বিয়ে দিতে চাই।
মাত্র তেইশ বছর বয়স, এখনই কীসের বিয়ে?
তুমি নিজে কিন্তু তেইশ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলে?
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। আমি শুভ্ৰকে এখনই বিয়ে দেব। ওর জন্যে শক্ত টাইপের একটা মেয়ে দরকার। শুভ্র হচ্ছে লতানো গাছ, ওরা দরকার শক্ত খুঁটি। তা ঠিক। জাহানারা একটু পান দাও তো, পান খাই।
পান পরে খাও। শুভ্ৰ আসুক, আমরা আগে এক সঙ্গে পায়েস খাব। তোমার জন্যে আলাদা করে স্যাকারিন দিয়ে পায়েস বানিয়েছি।
স্যাকারিন মিষ্টিটা আমার শরীরে সহ্য হয় না। খেলেই বমি বমি ভাব হয়।
তুমি যখন আগে থেকে জািন যে স্যাকারিন দেয়া হয়েছে তখনই বমি বমি ভাব হয়। না জানলে হয় না। যে দুদিন তোমাকে না জানিয়ে চিনির চা বলে স্যাকারিনের চা খাইয়েছি। তুমি কিছু বুঝতে পার নি।
মোতাহার সাহেব শোয়া থেকে উঠে বসলেন। এতক্ষণ চোখ বন্ধ করেই কথা বলছিলেন, এখন চোখ মেললেন। ঘরে আলো নেই ধললেই হয়। সবুজ তোয়ালে সব আলো চুষে নিয়েছে, তারপরও চোখ জ্বালা করছে। তিনি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কই শুভ্ৰতো আসছে না?
পাখি নিয়ে এখনো বোধহয় খেলছে! ছেলেটা কী যে মজা পেয়েছে। একেবারে বাচ্চাদের স্বভাব। ডেকে নিয়ে আসি?
না থাক ডাকতে হবে না। আসুক নিজের মত করে। তুমি কি সত্যি শুভ্রর বিয়ে দিতে চাও?
জাহানারা আগ্রহের সঙ্গে বললেন, অবশ্যই চাই। এ বাড়িতে একটা বউ আমার জন্যেও দরকার। তুমি থাক তোমার ব্যবসা নিয়ে, শুভ্র থাকে তার পড়াশোনা নিয়ে, আমার কে আছে বল? আমি থাকব কী নিয়ে? শুভ্রর বৌ থাকলে আমি যখন-তখন তার সঙ্গে গল্প করতে পারব। তাকে নিয়ে টুকটাক শপিং-এ যেতে পারব।
তা ঠিক।
আমি বউমাকে হাতে ধরে রান্নাও শেখাব। তারপর দুজনে মিলে রান্না করব। একটা আইটেম সে করল, একটা আইটেম করলাম। আমি। তোমরা খেয়ে বলবে কোনটা কে বেঁধেছে। কোনটা ফার্স্ট, কোনটা সেকেন্ড।
শুভ্ৰ কি বিয়ে করতে রাজি হবে?
কেন রাজি হবে না! তুমি বললেই রাজি হবে। আজই বল। আজ একটা শুভ দিন। এক সপ্তাহের মধ্যে আমি ছেলের বিয়ে দিয়ে দেব।
মোতাহার সাহেব প্রশ্ৰয়ের হাসি হাসলেন। জাহানারা বললেন, তুমি হাসবে না। আমি কিন্তু সিরিয়াস। ঘোমটাপরা লাজুক একটা মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভাবতেই কেমন লাগে।
আজকালকার মেয়েরা কি আর ঘোমটা দিয়ে ঘুরবে? লজ্জার ঘোমটা না, ফ্যাশানের ঘোমটা।
আমার ছেলের বউ ঘুরবে।
দরজায় টোকা পড়ছে। খোলা দরজা, শুভ্ৰ ইচ্ছা করলেই ঢুকতে পারে, তা সে করবে না। দরজায় টোকা দেবে। বাবার ঘরে ঢোকার আগে কোনো ছেলে কি টোকা দেয়?
শুভ্রর গলা শোনা গেল, বাবা আসব? মোতাহার সাহেব বললেন, আয়।
শুভ্র ঘরে ঢুকেই বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল।
মোতাহার সাহেব মুগ্ধ হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। কী সুন্দর গায়ের রঙ! মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল। পাতলা ঠোঁট লালচে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে খুব হালকা করে লিপষ্টিক দেয়া। মোতাহার সাহেব এবং জাহানারা দুজনেরই গায়ের রং ময়লা। তাদের বংশে কারোর কোঁকড়ানো চুল নেই। ছেলে এত সব সুন্দর সুন্দর জিনিস কোথেকে পেল? জাহানারা প্রায়ই বলেন, ছেলে না হয়ে যদি মেয়ে হত কত ভাল হত। আমি কত সুন্দর একটা মেয়ে পেতাম। তেমন সুন্দরী মেয়েতো আজকাল দেখাই যায় না। শুভ্ৰ যদি মেয়ে হত আমি তার নাম রাখতাম জুই। বিছানায় যখন শুয়ে থাকে তখন মনে হয় কেউ এক খলুই জুই ফুল ঢেলে রেখেছে। ছেলে হবার জন্য কঠিন একটা নাম রাখতে হল। উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁত ভেঙে যায়। শুভ্র! নামটা উচ্চারণ করার পর শেষ হয় না। মুখের ভেতর র র র করে কিছুক্ষণ বাজে।
 
Back
Top