- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 407
- Messages
- 5,564
- Reaction score
- 2,011
- Points
- 3,913
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
রিয়া
মূল লেখকঃ বুদ্ধদেব গুহ
মূল লেখকঃ বুদ্ধদেব গুহ
পর্ব - ১
বেলা পড়ে এসেছিল। পথের দু-পাশের গাছের ছায়াগুলি দীর্ঘতর হয়ে আসছে। শীতের কমলালেবু-রঙা রোদ হলদেটে দেখাচ্ছে এই শেষবেলাতে। শীত এখনও জাঁকিয়ে পড়েনি। এবারে শীত পড়তে দেরি হচ্ছে। পুজো শেষ হয়ে গেছে। কালীপুজোর কিছুদিন বাকি।
রিয়া আর সংজ্ঞা সাইকেলে চড়ে ফিরছিল পান্ডে স্যার-এর বাড়ি থেকে টিউশন নিয়ে। চড়াই-উতরাই-এ ভরা জঙ্গুলে পথ বেয়ে গামারিয়ার বুকের কোরক থেকে। দোকান-টোকান বি ডি ও-র অফিস সব ওইদিকেই।
সাইকেলের ঘণ্টা বাজছিল ক্রিং ক্রিং। রিয়ার পরনে সালোয়ার কামিজ। সংজ্ঞা একটি ডুরে শাড়ি পরেছে তাঁতের। গায়ে শাড়ির প্যাস্টেল রঙে রং মিলানো চাদর। সাইকেলে চলেছে। পথের দু-পাশে বড়ো বড়ো গাছ। অন্যান্য বাড়ির কম্পাউণ্ড; গেট। ছায়া রোদ্দুর; রোদ্দুর। ছায়া। লাল ধুলো উড়ছে। দু-পাশে ল্যানটানার গন্ধ উঠছে। উগ্র কটু গন্ধ, যা ছায়াচ্ছন্নতাকে এক ধরনের রহস্যময়তা ধার দেয়।
রিয়া বলল, কী রে? চাটুজ্যেদের বাড়িতে এবারে কারা এল?
কে জানে! প্রতিবছরই তো আসে, কোনো না কোনো চেঞ্জারের দল। সেবার সেই শ্যামবাজারের মিত্তিররা এসেছিল। মনে আছে? কী যেন নাম ছিল বকা ছেলেটার? আর ঘঘাষেদের বাড়ির সবিতা?
রিয়া–সবিতার কথা আর বলিস না। ক্যাবলি একটা! আজকালকার দিনে অমন মূর্খামি কেউ করে?
সংজ্ঞা–এবারে ও-বাংলোতে কারা এল? আজই আসবার সময় ওদের কম্পাউণ্ডে যেন গাড়ি দেখলাম! চাটুজ্যেসাহেবরা নিজেরা কখনো আসেন না। প্রতিবছরই তো ভাড়া দেন বাড়ি।
রিয়া হেসে বলল, ড্যাঞ্চি বাবুদেরই এসেছেন কেউ। ড্যাম চিপ বলা চ্যাঞ্জারবাবুরা।
সংজ্ঞা-এখন আর কেউ ড্যাম-চিপ বলে না। শহরে আর গ্রামে জিনিসপত্রে দামের তো বিশেষ তফাত নেই আজকাল।
রিয়া–আনাজের আছে। মানে, তরি-তরকারির।
সংজ্ঞা–আর পাঁঠার মাংসরও।
রিয়া–আসল তো জল আর হাওয়া। বিনি পয়সায় এমন জল-হাওয়া কোথায় পাবে? কলকাতার মানুষেরা তো এখন একটু নিশ্বাস নেবার মতো টাটকা বাতাসও পায় না। তোর আবার সেই কলকাতায় গিয়েই পড়বার ইচ্ছে হল। বলিহারি!
সংজ্ঞা–ইচ্ছা থাকলেই যেন সব হয়! দেখি।
সামনেই চাটুজ্যেদের বাড়ি। সেখান থেকে একটি ছোটো গাড়ি বেরুল। মারুতি।
সংজ্ঞা–গাড়ি! গাড়ি বাঁ-দিকে চাপ রিয়া। দেখিস।
রিয়া—হুঁ।
ক্রিং ক্রিং করে বেল বাজিয়ে সাবধান করে দিল গেট থেকে বেরিয়েই খুব জোরে-আসা গাড়িটাকে ওরা। উঁচু-নীচু পথ। যেখানে চড়াই, সাইকেল নিয়ে চড়তে হাঁফ ধরে যায়, ঠিক সেইখানেই গাড়ি! মুখে বিরক্তিসূচক শব্দ করে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল রিয়া। সংজ্ঞা তখনও নামেনি। রিয়া বলল, নেমে পড় নেমে পড়। আপদ বিদেয় হোক আগে।
গাড়িটা কিন্তু এসে ওদের কাছেই থেমে গেল। সপ্রতিভ চেহারার, বুদ্ধিমান, দীর্ঘাঙ্গ অনিরুদ্ধ, গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে নেমে বলল, এক্সকিউজ মি! দরিয়াগঞ্জের বাজারটা কোন দিকে হবে বলতে পারেন?
তারপরই, হিন্দিতে বলল, এরা বাংলা নাও বুঝতে পারে মনে করে, কিতনা দূর পড়েগি হিয়াসে? দরিয়াগঞ্জকি বাজার?
দুজনের মধ্যে রিয়াই দুষ্টুমিতে দড়। দুজনের মধ্যে বেশি সপ্রতিভও।
রিয়া বলল, বাজার সে-ই জাগে যিতনিই দূর, ই জাগে সে বাজার স্রিফ উতনাহি দূর!
দরিয়াগঞ্জ তো শুনেছি দিল্লিতে। এখানে তো কোনো দরিয়াগঞ্জ নেই।
সংজ্ঞা বলল।
অনিরুদ্ধ– নেই?
রিয়া–না!
অনিরুদ্ধ-তবে যে বলল মালি!
সংজ্ঞা-ভুল বলেছে। এখানে ধারিয়াগঞ্জ আছে। কিন্তু বাজার বলতে আপনারা যা বোঝেন তা তো সেখানে নেই। এখানে হাট বসে রবিবারে রবিবারে। আর এখান থেকে তিন মাইল দূর তারিয়াতেও বসে। বুধবারে।
তাই?
কী কিনতে বেরিয়েছেন?
মুরগি আর দুধ।
রিয়া বলল, ডান হাত তুলে দেখিয়ে, সোজা গিয়ে ডানদিকে মোড় নেবেন। দেখবেন, একটা মস্ত পিপ্পল গাছের তলাতে একটি খাপরার চালের ঘর। ওইখানে মৈনুদ্দিন থাকে। ওর কাছে মুরগি-মোরগা সব পাবেন। আণ্ডা-বাচ্চাও।
অনেক ধন্যবাদ। মেনি থ্যাংকস। অনিরুদ্ধ বলল। তারপরই বলল, আপনারা বাঙালি?
রিয়া– কী মনে হচ্ছে? কাবুলি?
না। তাহলে বাঙালিই। বাঃ।
রিয়া– আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু বাঃ কেন?
ওই। এমনিই বললাম। অনিরুদ্ধ বোকার মতো বলল।
তারপর আবার বলল, আপনাদের বাড়ি কোথায়? মানে, থাকেন কোন দিকে?
আপনাকে জানি না, শুনি না, বাড়ির হদিশ দিতে যাব কোন দুঃখে?
সংজ্ঞা বলল কেটে কেটে।
অনিরুদ্ধ অপ্রতিভ হয়ে বলল, ওঃ সরি! থাক। তাহলে দেবেন না।
সোজা গিয়ে ডানদিকে। সংজ্ঞা বলল।
এবং সোজা গিয়ে বাঁ-দিকে। মানে আমাদের বাড়ি। রিয়া বলল।
কতদূর গিয়ে?
সংজ্ঞা–বেশিদূর নয়। ওদের বাড়ির নাম হ্যাপি ন্যুক। আর আমাদের বাড়ির নাম…
কী?
রিয়া বলল, ওর উচ্চারণ করতে লজ্জা করে। ওদের বাড়ির নাম ভালোবাসা।
লজ্জা পাবার কী আছে? কলকাতাতে আমাদের পাড়াতেই একটা বাড়ি আছে। ওই একই নাম। তা ছাড়া, ভালোবাসা তো লজ্জার নয়।
রিয়া–তা জানি না। এখন আমাদের যেতে হবে। একটু পরই সন্ধেও হয়ে যাবে। টর্চও আনিনি। তার ওপর একটা পাগলা শেয়াল বেরিয়েছে আবার দিনকয় হল। প্যাডেলে-রাখা পায়ের কাফ-মাসলে যদি খ্যাঁক করে দেয় দাঁত বসিয়ে? তাহলেই চিত্তির।
অনিরুদ্ধ রিয়ার কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে উঠল।
সংজ্ঞা–আরও দেরি করলে মৈনুদ্দিনকে কিন্তু আপনি নাও পেতে পারেন। তাড়াতাড়ি যাওয়াই ভালো। নয়তো মহুয়া খেতে ভাটিখানায় চলে যাবে হয়ত একটু পর।
রিয়া-রোজই মোরগা না হলে বুঝি চলে না আপনাদের? এত প্রোটিনের কী দরকার? চেহারাটি তো দুর্বল নয় মোটেই।
দুর্বলতা ভেতরের জিনিস। বাইরের নয়। অনিরুদ্ধ বলল।
তাই? সংজ্ঞা বলল, বলেই, রিয়ার দিকে চাইল।
অনিরুদ্ধ শুধলো, আর দুধ? দুধ কোথায় পাব?
রিয়া বলল, সঙ্গে শিশু আছে বুঝি?
অনিরুদ্ধ হেসে বলল, শিশু নেই। কিন্তু আমাদের বাড়ির সকলেই দুবেলা দুধ খান। দাদু দিদা, বাবা-মা, আমি এবং আমার এক কাকা, ভজুকা।
রিয়া বলল, চারপেয়ে জানোয়ারেরাও কিন্তু একটা বয়েসে পৌঁছোবার পর দুধ ছেড়ে দেয়। মানুষদের বৃদ্ধ বয়েস পর্যন্ত গোরুর দুধের জন্য এমন হ্যাংলামো আপনাকে অবাক করে না?
অনিরুদ্ধ প্রথমে চুপ করে থাকল একটুক্ষণ কী বলবে ভেবে না পেয়ে। পরমুহূর্তেই বলল, কথাটা ভেবে দেখার। কিন্তু দুধ কোথায় পাব তা কি বলতে পারেন?
রিয়া–এই সময়ে কোথাওই পাবেন না। তা ছাড়া আপনাদের মাদার-ডেয়ারি ফাদার ডেয়ারির মতো তো দুধের দোকান নেই এখানে, কতখানি লাগবে?
এই আড়াই কে জি মতো।
সংজ্ঞা–আমি বাড়ি গিয়েই পাঠিয়ে দেব আপনাদের বাড়ি। আমাদের বাড়িতে দুটি গোরু আছে। মুলতানি গোর।
কত দাম দিতে হবে, আপনাদের লোককে বলে দেবেন কিন্তু।
রিয়া ফোড়ন কেটে বলল, ও তো গয়লানি নয়! দুধের ব্যাবসা তো করে না।
তাহলেও।
তাহলে কিছু নেই। এখন আমরা পালাই। পরে দেখা হবে।
সংজ্ঞা কিছু বলার আগেই রিয়া বলল।
ওদের চলে যাওয়া দেখল অনিরুদ্ধ দাঁড়িয়ে। সাইকেল দুটো চড়াইয়ে ঠেলে ঠেলে তুলল ওরা দুজনে। চড়াইটা উঠেই পেছনে ফিরে তাকাল দু-বন্ধু। হাত তুলল অনিরুদ্ধর দিকে। বলল, চলি।
অনিরুদ্ধ বলল, বাই!
বলেই, গাড়িতে উঠে মরা আলোয় গাড়ি স্টার্ট করে এগোল।
গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ মরে যেতেই ওরাও যার যার সাইকেলে উঠে পড়ল।
রিয়া–তুই না সুন্দর ছেলে দেখলেই তুতলে যাস। কেন বল তো?
কতদিন থাকবে এখানে তার ঠিক নেই। জানা নেই, শোনা নেই, একেবারে গয়লানি রাধা হয়ে গেলি! দুধের বিনি-পয়সার কনট্রাক্ট নেবার কী দরকার ছিল তোর? শহরের লোকেরা যত বড়োলোক, ততই কঞ্জুস। কিপটেমি না করলে কি টাকা জমে? না হয় কিছু খরচই হত!
দুধ কে খায় অত! আমাদের বাড়িতে দুধ নষ্ট হয়। সুরজের মা তো ঘি করেই রাখে। বেশি ঘি জমে গেলে গোমেজগঞ্জে বিক্রিও করে আসে কখনো কখনো। তুই তো আর খাস না।
রিয়া-না ভাই। আমি গতজন্মে কুকুর ছিলাম। ঘি খেলেই আমার চুল পড়তে থাকে।
একটু চুপ করে থেকে বলল, অচেনা ইয়াং একটা ছেলেকে দুধ পাঠাবার কথা বললে মাসিমা রাগ করবেন না?
রাগ করার তো কথা নয়। তা ছাড়া, এখন তো করার আর কিছুই নেই। কথা তো দিয়েই ফেলেছি। দেখি, এখন সুরজকে বাড়িতে পাই কি না! আমি চলোম রে!
বলেই, বাঁ-দিকে হ্যাঁণ্ডেল ঘোরাল সংজ্ঞা, ওদের ভালোবাসা বাড়ির গেটে।
গেটের ওপরের থোকা থোকা লাল ও হলুদ বুগেনভিলিয়ার ওপরে দিনের শেষ আলো পড়ে বিধুর দেখাচ্ছিল। রিয়ার ছটফটে মনটাও হঠাৎ কেমন শান্ত, বিধুর হয়ে গেল যেন। এমন শান্তি অথবা অশান্তি মনের মধ্যে কখনো বোধ করেনি রিয়া আগে। সমুদ্রের ঢেউ যখন পাকিয়ে পাকিয়ে সবচেয়ে উঁচু হয়ে ওঠে, ভেঙে পড়বার ঠিক আগের মুহূর্তে; যখন সি-গাল ডাকে, উড়তে উড়তে সেই ঢেউয়ের ওপরে, কী যে বলে সেই ডাক, তা তো বোঝা যায় না; শুধু বোঝা যায় যে, এর পরেই ঢেউ ভাঙবে, সেই ঢেউ ভাঙার আগের মুহূর্তের নিস্তব্ধতার মতোই নিস্তব্ধতা ওর বুকের মধ্যে বাসা বাধল।
দূরে চলে যেতে যেতে সংজ্ঞা চেঁচিয়ে বলল, পরশু পান্ডে স্যারের কোচিং-ক্লাসে যাবার সময় তোকে ডেকে নিয়ে যাব রিয়া। সাড়ে তিনটেতে। ব্যাডমিন্টন খেললে তুইও ডেকে নিস আমাকে।
রিয়া কোনো জবাব দিল না। দিতে পারল না।
কিছু একটা ঘটে গেছে রিয়ার ভেতরে। সেটা যে কী, তা ও নিজেই জানে না।
.
০২.
সুরজ বাড়িতেই ছিল। মাকে বলে সংজ্ঞা সুরজের হাতে দুধ পাঠিয়ে দিল। বলল, সুরজদাদা, চ্যাটার্জিসাহেবের বাংলোতে যাঁরা এসেছেন তাঁদের দিয়ে এসো। ওঁদের বলা আছে।
লাঠি আর লণ্ঠন নিয়ে একটু আগেই চলে গেছে সুরজ। নীহার একটু রাগ যে করেননি তা নয়! বলেছিলেন, এখন বড়ো হয়েছ, অমন অচেনা বড়োলোকের ছেলের সঙ্গে গায়ে-পড়ে কথা বলার দরকার কী ছিল? চেঞ্জারেরা দু-দিনের জন্যে আসে, দু-দিন পরে চলে যায়। তাদের সব মাখামাখি, ভালো ব্যবহার রেলগাড়ির কামরায় আলাপ হওয়া সহযাত্রীদের ভাব ভালোবাসার মতোই মিলিয়ে যায় ডিসট্যান্ট সিগন্যালের কাছে ট্রেনের পেছনের লাল আলো মিলিয়ে যাবার সঙ্গেই সঙ্গেই। গত বছরের আগের বছর ঘোষেদের মেয়ে সবিতাকে কী বিপদে ফেলেই না চলে গেল সেই শ্যামবাজারের মিত্তির বাড়ির লক্কা ছেলেটা? মনে নেই? তোমাদের আমি আর কী বলব? সেই ছোঁড়াও তো এসে উঠেছিল চ্যাটার্জিসাহেবের বাংলোতেই। তা ছাড়া তোমার বাবার এরকম অবস্থা। অন্য কোনো পুরুষ আত্মীয়ও নেই একজনও যিনি দাঁড়াতে পারেন আমাদের পাশে এসে। তা ছাড়া আমাদের আর্থিক অবস্থাও তো রিয়াদের মতো নয়। অনেকই ভেবেচিন্তে চলতে হয়, চলা উচিত আমাদের। আমার বড়ো ভয় করে রে তোকে নিয়ে সাগু। কবে যে বড়ো হবি তুই, চেহারাতে আর বয়েসেই শুধু বড়ো হচ্ছিস তুই, বুদ্ধিশুদ্ধি কিছুই হল না তোর।
এইসময় সংজ্ঞার ছোটোবোন প্রজ্ঞা হড়বড়িয়ে এসে বলল, দিদি ভাইফোঁটার পর স্কুল খুলে যাবে। আমার অঙ্কগুলো তুমি কিন্তু দেখিয়ে দিলে না এখনও।
সংজ্ঞা ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, এতদিন ঘুমুচ্ছিলে কেন? আমি নিজেকে দেখব, না তোমাকে?
সংজ্ঞা ওরকম বিরক্তির গলায় কখনোই কথা বলে না প্রজ্ঞার সঙ্গে।
নীহার চমকে তাকালেন বড়োমেয়ের মুখের দিকে। প্রজ্ঞাও তাকাল অবাক হয়ে।
সংজ্ঞা বাথরুমে চলে গেল। চোখে-মুখে খুব করে জলের ঝাঁপটা দিল। ওর দু-কানের পেছন ঝমঝম করছে। গরম হয়ে লাল হয়ে গেছে কান। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখেমুখে জল দিতে দিতে চোখদুটি জলে ভরে গেল। রিয়াকে খুব ঈর্ষা হল, রাগও হল তার প্রিয় সখীর ওপরে খুবই। ও যদি রিয়ার মতো সপ্রতিভা হত! অমন মুখেচোখে কথা যদি বলতে পারত! চমৎকার কথা বলে রিয়া।
রাত সাতটা হবে। বাইরে অন্ধকার ঘোর হয়েছে। বাইরে ঝিঁঝির ডাক। সংজ্ঞা পড়ছিল। একই ঘরে ছোটোবোন প্রজ্ঞাও খাটে শুয়ে শুয়ে পড়ছিল।
প্রজ্ঞা বলল, তোর কী হয়েছে রে দিদি?
কী আবার হবে? পাকামি না করে নিজের পড়া করো। কাল সকালে তোমার অঙ্ক নিয়ে বসব।
ঠিক আছে। বলল, অভিমানী গলায়।
প্রজ্ঞা এরকম করেই কথা বলে। অনেক সময়েই পুরো শব্দ উচারণ করে না।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, চ্যাটার্জিসাহেবের বাংলোতে কে এসেছে রে দিদি? তুই যে ভালোবেসে দুধ পাঠালি!
তা দিয়ে তোর কী দরকার? বেশি ডেঁপো হয়েছিস না? প্রতিবছরই তো কত লোক আসে। আবার চলেও যায়। তা দিয়ে তোরও যেমন দরকার নেই, অন্য কারও নেই। আমার তো নেই-ই!
প্রজ্ঞা বলল, তোমার আছে। বললে তো হবে না।
প্রজ্ঞা দিদির ওপর রেগে গেলে, তুমি করে বলে।
মানে? সংজ্ঞা বলল, বিরক্তি ও রাগের গলায়।
মানে-টানে জানি না। তবে তোর আছে।
প্রজ্ঞার দিকে ঘুরে বসে সংজ্ঞা লাল মুখে বলল, তোকে বলতেই হবে কেন তুই.। ঠিক তখুনি বাইরে একটি গাড়ির শব্দ হল এবং গাড়ির হেডলাইটের আলোয় বাড়ির বাগানের সব ফুল ঝলমলিয়ে উঠল যেন। গাড়ির এঞ্জিন বন্ধ করার শব্দ হল। এবং দরজা খোলার।
কৌতূহলী প্রজ্ঞা ততক্ষণে গিয়ে জানালার পর্দার আড়াল দিয়ে আগন্তুকদের দেখতে আরম্ভ করেছে। সংজ্ঞা নিজের চেয়ারেই বসেছিল। এক চাপা উত্তেজনায় ওর মুখ উদ্ভাসিত হয়েছিল।
প্রজ্ঞা রিলে করছিল; একটা বড়ো গাড়ি। সাদা। একটা দাড়িঅলা বুড়ো। হাতে লাঠি। একজন চওড়া লাল পাড় শাড়ি পরা বুড়ি। মাথা-ভরতি সাদা চুল। সিঁথিতে দগদগে লাল সিঁদুর। সুরজদাদা। আর একজন ছেলেও।
পরক্ষণেই সংজ্ঞার দিকে ঘুরে বসে বলল, এই দিদি! সত্যিই দারুণ দেখতে রে দিদি! এর সঙ্গেই তোর দেখা হয়েছিল বুঝি? এর জন্যেই দুধ পাঠালি? বেশ করেছিস। অনেকদিন পর একটা ভালো কাজ করলি।
ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বোনকে ইশারা করে সংজ্ঞা বলল, চুপ কর।
নীহার তখন বসবার ঘরে বসে প্রজ্ঞার জন্যে সোয়েটার বুনছিলেন। গাড়ির শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে আপ্যায়ন করে ওঁদের বললেন, আসুন! আসুন! আপনারা?
অনিরুদ্ধ নীহারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, আপনারা দুধ পাঠিয়েছেন, তাও মুলতানি গোরুর দুধ; আপনাদের এই লোক সুরজ তো পয়সাও নিল না। তাই দাদু-দিদা বললেন, এমন ভদ্রলোক এ যুগে প্রবাসে আছেন তাঁদের সঙ্গে একবার আলাপ করে আসতেই হয়। আমি কিন্তু ওঁকে বলেছিলাম।
ওঁকে মানে?
নাম তো জানি না। মানে অনিরুদ্ধ বলল।
ও! আমার বড়োমেয়ে সংজ্ঞা। তা এইটুকু তো প্রতিবেশীর জন্যে প্রতিবেশী করেই থাকে। এ আর বেশি করা কী! আপনারা দু-দিনের জন্যে এসেছেন। আমাদের যা দেশ, আপনাদের তাই বিদেশ।
বৃদ্ধ যোগেনবাবু বললেন, না। না, মা। তা বললে তো হয় না। এইটুকু নয়; এইটুকু নয়। তা মা দুধ কি রোজই পাঠাবে। না একদিনই পাঠালে শুধু?
না, না। একদিন কেন? রোজই পাঠাব।
দুধের চেহারা দেখেই তো আমরা অজ্ঞান! এখনও মুখে দিইনি। কলকাতার লোকের পেটে সইলে হয়। আর রোজ খেতে পাব তা শুনেই তো আমি আহ্লাদে আটখানা। কিন্তু দাম না নিলে রোজ নিই কী করে মা?
যোগেনবাবু বললেন।
নীহারের মুখের ভাব কঠোর হয়ে এল। ওঁর বসবার ঘরের বর্তমান দৈন্য কাউকেই বুঝতে সময় দেয় না যে, একদিন ওঁদের অবস্থা ভালো ছিল। আজ নেই। যাঁদের চোখ আছে তাঁদের চোখ খোলা-গ্যারেজে ভাঙা মিলিসেন্টে ফিয়াট গাড়িটাও এড়াবে না।
যোগেনবাবুর স্ত্রী, নীপবালা একমুহূর্ত নীহারের চোখে চেয়েই স্বামীকে বললেন, অন্য কথা বলো।
স্বামীকে একথা বলেই, নীপবালা নীহারকে দু-হাত ধরে বললেন, আমার স্বামীকে মার্জনা করবেন ভাই। ওই ওঁর দোষ। কোথায় যে কী বলতে হয়, একেবারেই জানেন না।
বৃদ্ধ যোগেনবাবু বললেন, তা ঠিক! তা ঠিক! আমার এই দোষ! সত্যিই বড়ো মারাত্মক দোষ মা!
নীহার নীপবালাকে বললেন, আমাকে আপনি করে বলবেন না। বয়সে আমি অনেকই ছোটো।
যোগেনবাবু বললেন, তা হতে পারো মা! কিন্তু জ্ঞানে-বুদ্ধিতে হয়তো নও। তোমাকে তুমি করে বলাতে কি তুমি রাগ করেছ মা আমার ওপর?
নীহার বললেন, কী যে বলেন!
নীপবালা বললেন, তা কই? মেয়েকে ডাকো। যার দৌলতে এই বিদেশ-বিভুইতে এসে দুধের সরবরাহ পাকা হয়ে গেল তাকে তো একবার ধন্যবাদ দেওয়াটা দরকার।
নীহার বললেন, আমার দুই মেয়ে।
তাই বুঝি? তা কোনজনের সঙ্গে আমাদের অনির দেখা হয়েছিল।
বড়জনের সঙ্গে।
ডাকো মা, দুজনকেই ডাকো। আর দু-একটা দিন যাক। ভালো করে গুছিয়ে বসি, তারপর সকলে মিলে আসতে হবে কিন্তু আমাদের ওখানে। দু-দিনের মধ্যেই সব গুছিয়ে নিতে পারব আশা করি।
নীহার মেয়েদের ডাকলেন। প্রজ্ঞা গজগজ করছিল। ধাত! এইরকম পোশাকে কেউ বাইরের লোকের সামনে বেরোয়? তোর জন্যেই তো। দুধ বিলি করছে!
মেয়েরা এল। সাগু যোগেনবাবুকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যেতে বৃদ্ধ সাগুর দুটি হাত ধরে ফেললেন. বললেন, একদ্দম না। কখখনো না। তুমি কি জানো না মা যে, এদেশে একশৃঙ্গ গণ্ডার আর প্রণম্য মানুষের সংখ্যা বড়োই কমে গেছে?
বলে, নিজেই নিজের রসিকতায় হো হো করে হেসে উঠলেন।
নীপবালা বললেন, বাঃ ভারি লক্ষ্মী মেয়ে দুটি তোমার।
প্রজ্ঞার নীচের দুধের দুটি দাঁত পড়ে মাড়ি দেখা যাচ্ছিল। এই বয়েসটা সব মেয়ের পক্ষেই এম্বুরাসিং। ওকে ডাকলেন বলে, মায়ের ওপর খুবই রাগ হচ্ছিল প্রজ্ঞার।
অনিরুদ্ধ বলল, কখন হঁদুরে নিয়ে গেল তোমার দাঁত? চলো তো দেখি, তাকে খুঁজে বের করে এক্ষুনি মারব আমি। আমার সঙ্গে বন্দুক আছে। জানো?
প্রজ্ঞা রাগ ভুলে গিয়ে বলল, তাহলে পাগলা শিয়ালটাকে মারতে পারবেন?
নিশ্চয়ই পারব। কিন্তু তোমার নাম কী তা তো বললে না?
প্রজ্ঞা বলল, পাগু।
নীপবালা শুধোলেন, আর তোমার দিদির নাম?
সাগু।
অনিরুদ্ধ–সাগু? সাগু।
সাগু লজ্জায় এবং পাগুর ওপরে রাগে জ্বলে উঠল কিন্তু ওদের সামনে কিছুই বলতে পারল না।
নীপবালা বললেন, এই দোষ আমার নাতির! এত পেছনে লাগতে পারে না মানুষের! চেনা-অচেনা, আপন-পর কোনো খেয়ালই নেই।
যোগেনবাবু বললেন, আহা! পর হতে যাবে কেন? পাগু-সাগু কি আমাদের পর? ও কি কথা!
নীহার হেসে বললেন, সাগুর ভালো নাম সংজ্ঞা আর পাগুর প্রজ্ঞা।
অনিরুদ্ধ বলল, বা; ভারি সুন্দর নাম তো।
যোগেনবাবু বললেন, তা ওদের বাবা কোথায়? তাঁর সঙ্গে তো আলাপ হল না।
নীহার মুখ নীচু করে রইলেন।
সংজ্ঞা বলল, বাবার হঠাৎ-ই একটু মাথার গোলমাল মতো হয়। তাই সাইকিয়াট্রিস্টদের কথা মতো তাঁকে রাঁচির কাঁকে রোডের হাসপাতালে রাখা হয়েছে।
কতদিন মা? দুঃখের গলায় নীপবালা বললেন।
বছরখানেক হতে চলল।
বড়ো করুণ শোনাল নীহারের গলা।
একটা কথা বলব মা? ওকে হয়তো হাসপাতালে না পাঠালেও পারতে। আমার কী মনে হয় জানো? আজকালকার দিনে কমবেশি মাথার গোলমাল শতকরা নব্বই ভাগ মানুষেরই আছে। সুস্থ আছি আর আমরা ক-জন? হাসপাতালে তো উন্মাদেরাও থাকে।
যোগেনবাবু বললেন।
নীপবালা ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, আর কারও থাকুক আর না থাকুক তোমার যে মাথার গোলমাল নিশ্চয়ই বিলক্ষণই আছে তা এঁরা সকলেই এতক্ষণে বুঝে গেছেন।
অনিরুদ্ধ এই অপ্রিয় প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্যে বলল, না! দাদু-দিদা তোমরা যে সব বিষয়ে নিয়েই ঠাট্টা করো এটা কিন্তু ঠিক নয়। ব্যাপারটা অত্যন্ত সেনসিটিভ।
নীহার তাড়াতাড়ি বললেন, না, না। তাতে কী হয়েছে বাবা।
আই অ্যাম সরি। অফুলি সরি মা। যদিও আমার বক্তব্য ছিল অন্য। কিন্তু আমার দাদুভাই ঠিকই বলেছে। বুড়ো হয়েছি তোআমার বুদ্ধিশুদ্ধি সত্যিই লোপ পেয়েছে। কোনোভাবে তোমাদের আহত করে থাকলে আমাকে নিজগুণে মার্জনা কোনো।
যোগেনবাবু অপরাধীর গলায় বললেন।
নীহার–না, না, কী যে বলেন।
অনিরুদ্ধ–প্রায়ই দেখতে যান কি আপনারা ওঁকে? রাঁচিতে?
সংজ্ঞা–না। প্রায়ই কী করে হবে? যাতায়াতেরও অনেকই অসুবিধা। শেষবার গেছিলাম বোধ হয় ঠিক মাস তিনেক আগে। না মা? এই তারিখেই। তবে, চিঠিপত্রে হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। রাঁচিতে আমার এক জ্যাঠতুতো দাদা থাকেন, হেভি এঞ্জিনিয়ারিং-এ কাজ করেন, তিনিও গিয়ে দেখা করেন মাঝে মাঝে।
অনিরুদ্ধ বলল, বলেন কী! তিন মাস! তার মানে বিজয়ার পরেও যেতে পারেননি?
নীহার মাথা নীচু করে বললেন, না বাবা। আমি গেলে মেয়েদের একা থাকতে হয়। এ তো কলকাতা বম্বে নয়। মেয়েদেরও তো একা পাঠানো যায় না এত ঝক্কি করে।
অনিরুদ্ধ বলল, চলুন! আমরা পরশুদিনই যাই। দাদুকেও সঙ্গে নেব। ভোরে রওয়ানা হব আর সন্ধের আগে আগেই ফিরে আসব।
যাবেন তো? ভজুকাকে আপনাদের বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে রেখে যেতে পারি।
সংজ্ঞা মুখ তুলে বলল, ভজুকা কে?
ভজুকা আমার এক কাকা। বাবার মাসতুতো ভাই। ব্যাচেলর। খুব মজার লোক। ভজুকাকে প্রত্যেকেরই পছন্দ হবে।
যোগেনবাবু বললেন, কী হল মা, যাবে তো?
নীহার একটু ভেবে বললেন, দেখি বাবা।
নীপবালা বললেন, এতে ভাবাভাবির কিছু তো নেই মা। তোমরা যদি আগামীকালও যেতে চাও তো স্বচ্ছন্দে যেতে পারো। দাদুর আর তার দাদুভাই-এর তো এখানে আমাদের সাহায্য করার কিছু নেই। আমার ছেলে আর বউমা থাকলেই যথেষ্ট। দাদুকেও না নিয়ে গেলে চলে। ভজুই যেতে পারে অনির সঙ্গে।
আপনাকে জানাব মাসিমা। ভেবে নিয়ে একটু।
তাই ভালো। আমাদের চেনো না শোনো না পর্যন্ত! এমন হুট করে আলাপ আর এক কথাতেই অল্পবয়েসি মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে দূরে কোথাও যাওয়াটা একটু ভাবার ব্যাপারই তো বটে। আমি হলেও ভাবতাম। তোমরা ভেবেই বোলো। কিন্তু একথাও বলব যে, তিন মাস যদি স্বামীর সঙ্গে এবং মেয়েদেরও তাদের বাবার সঙ্গে না দেখা হয়ে থাকে তবে আর দেরি না করাই ভালো।
নীপবালা বললেন।
বৃদ্ধ সৌম্য যোগেনবাবু সাদা দাড়ি নেড়ে বললেন, মা জননী! আমরা তোক কিন্তু আদৌ খারাপ নই। আমি সারাজীবন অধ্যাপনা করেছি। অনেকই ছেলে আমার হাতে যে খারাপ হয়ে গেছে একথা অস্বীকার করতে পারি না, তবে ভালোও হয়েছে অনেকে। তারাই তো আমার গর্ব। কিন্তু আমার দাদুভাই, যে তোমাদের সঙ্গে করে রাঁচি নিয়ে যাবে তার মতো ছেলেই হয় না মা। আমার নিজের নাতি বলে বলছি না বড়ো মুখ করে।
নীহার বললেন, আমি কি ও বেচারিকে একবারও খারাপ বলেছি। ছিঃছি:! এ আপনি কী বলছেন! এসব ওর পক্ষে ভারি লজ্জার কথা। দেখুন তো বেচারি লজ্জায় কেমন লাল হয়ে গেছে।
নীপবালা বললেন, সারাজীবনই তো নিজের ঢাক নিজে পেটালে। এখন কি নাতির ঢাক বাজানোর বায়না নিয়েছ?
যোগেনবাবু হেসে ফেললেন। বললেন তা কী করি! বোসবংশের একমাত্র প্রদীপ।
অনিরুদ্ধ মুখ নীচু করে বলল, সত্যি! দাদু তুমি না!
অপ্রতিভ অনিরুদ্ধর অস্বস্তি সংজ্ঞা এবং প্রজ্ঞা খুব উপভোগ করল।