- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 407
- Messages
- 5,564
- Reaction score
- 2,005
- Points
- 3,913
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
*****নিরোর বাঁশী*****
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
নিজের হাতে রান্না করা খাবার খেলে আমার কেমন জানি একটা ভাব হয় । জ্ঞানগম্যি একটু বেশী হলে এই ভাবকে অনায়াসে দার্শনিক ভাব বলে চালিয়ে দিতে পারতাম । কিন্তু জ্ঞান নিতান্তই কম, অতএব এটাকে মুকুলের রোগ বলা ছাড়া আমার কোনো গত্যন্তর নাই । মুকুল আমার বন্ধুর নাম । দুনিয়ার ৫ সমুদ্র আর ২৭ নদীর পানি খেয়ে সে এখন আমেরিকার ওকলাহোমা সিটিতে থিতু হয়েছে ।
রোগটা বলার আগে মুকুলের সাথে শেষবার যখন দেখা হলো সেই গল্পটা বলি । ২০১৩ সালে সপরিবারে লম্বা আমেরিকা ভ্রমণের সময় আমার কথা ছিলো ওকলাহোমায় যাওয়ার । হিউস্টন থেকে প্রথমে যাবো ডালাসে মামাতো ভাইয়ের বাসায় ওখান থেকে মুকুলের বাসায় । কিন্তু ডালাস রওনা হবার আগের দিন থেকে ভীষণ অসুস্থ হয়ে গেলাম । অসুস্থতা বলতে খাবার মুখ থেকে টয়লেটে যেতে দশ মিনিটের বেশী সময় লাগে না, যাকে বলে একেবারেই ডাইরেক্ট লাইন । রাত নাগাদ এমন অবস্থা যে টয়লেটেই পারলে বিছানা করে থাকি । সকালে ছেলে মেয়ে মুখ করুণ করে বলল, বাবা বাদ দেও যাওয়ার দরকার নাই । ছেলে মেয়ের করুণ মুখ সব বাবাদের জন্যই বাড়তি শক্তির টনিক । বললাম, বাদ যাবে কেনো তাড়াতাড়ি তৈরী হও একটু পরেই রওনা হবো । বউ এসে বললো, এই শরীরে এতদূর ড্রাইভ করবে বাদ দেও না । আমি চোখ মুখ শক্ত করে বললাম, আমি যাবো আর খবরদার আমাকে পানিও খেতে বলবে না । ঘন্টা দেড়েক পরেই রেন্ট এ কারের গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম । এমনিতেই শরীর ভীষণ খারাপ আবার আমেরিকান সব কিছুই তো উল্টা । দুনিয়ার সব লোক গাড়ির ডান দিকে বসে ড্রাইভ করে আমেরিকানরা করে বাম দিকে বসে । প্রথম কয়েক মিনিট একটু অসুবিধাই হলো । সিগনাল দিতে গেলে সামনের ওয়াইপার নড়াচড়া করে । একটু ধাতস্থ হতেই হাইওয়েতে উঠে গেলাম । পথের মাঝে দুইবার থামতে হলো, টয়লেটের জন্য । শেষবারের বিরতির পর আমার চোখ মুখের অবস্থা দেখে বউ খাবার এগিয়ে দিতেই খেকিয়ে উঠলাম, বলেছি না পানিও খেতে বলবে না ।
প্রায় পাঁচ ঘন্টা ড্রাইভ করে ডালাস পৌছালাম । পৌছাবার একটু পরেই মুকুলের ফোন । ফোন ধরেই কোনো ভনিতা না করেই সোজা বললাম, আমি ওকলাহোমা যাচ্ছি না তোর সাথে এবার আর দেখা হবে না । মুকুল থতমতো খেয়ে বললো, কি হইছে ?
কি হইছে এতো ভ্যাজর ভ্যাজর করে তোকে বুঝাইতে পারবো না । আমাকে এখনই টয়লেটে ঢুকতে হবে । তুই মনার সাথে কথা বল ।
মুকুলের সাথে মনার কি কথা হয়েছে সেটা আমি আর জিজ্ঞেস করি নাই, করার মতো অবস্থা আমার ছিলো না । মরার মতো বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম । সানু ভাই আর সুমী ভাবী যত্নের চূড়ান্ত করলেন । এই যত্ন আর বিশ্রামের ফলে রাত ভোর হতে হতেই শরীরটাও একটু একটু করে সতেজ হতে লাগলো । সামান্য নাস্তা করে চায়ের কাপ হাতে নিতেই দরজায় টোকা । দরজা খুলতেই মুকুল বাম কান থেকে ডান কান পর্যন্ত দন্তসারি বিকসিত করে বললো, বেটা দেখা না কইরা যাবি কিভাবে ? পিছনে দেখি উর্মি ভাবী আর মুকুলের দুই ছেলে মেয়ে । ছোট করে বলি মুকুল সেদিন কি করেছে । সময়টা আমেরিকার শীতকাল, ঐ অঞ্চলে শীতের প্রাদুর্ভাব খুব বেশী না হলেও একেবারে কম না । বিশেষ করে রাতের বেলায় । রাস্তায় তুষার না পড়লেও জায়গায় জায়গায় পাতলা বরফে আচ্ছাদিত থাকে । ঐসব জায়গাগুলো রাতের ড্রাইভিং এর জন্য বেশ বিপদজনক । ঐ রাস্তায় চলার জন্য গাড়ির বিশেষ ধরনের চাকা লাগে । মুকুল সেই চাকা গাড়িতে লাগিয়ে সমস্ত পরিবার নিয়ে রাতেই রওনা হয়ে গেছে । এরকম বন্ধু যখন সামনের দরজা দিয়ে চলে আসে অসুখ তখন চোরের মতো পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায় ।
এবার রোগটা বলি ।
সামনেই পরীক্ষা । সারা বছর ভুলে থাকতে পারলেও এই কদিন আমরা যে ছাত্র সেটা ভুলে থাকতে পারি না । ফটোকপি, নোট সব যোগাড় শেষে অবশেষে পড়া শুরু করি । থারমোডায়নামিক্স এর কঠিন তত্ত্ব আজাদ আমাদের সবাইকে বুঝাইতাছে এমন সময় মুকুল কপালে চিন্তার কয়েকটা স্পীড বাম্প তুলে বলবে,
আচ্ছা বলতো পিজি হাসপাতাল শাহবাগে কেনো ?
এতটাই গুরুত্ব দিয়ে প্রশ্নটা করবে যেনো এর উত্তরের উপর ওর জীবনের অনেক কিছু নির্ভর করছে ।
মুকুলকে নিয়ে আরো অনেক অনেক স্মৃতি আছে, এত লিখতে গেলে হাত ব্যথা করবে । ছোট করে আর একটা বলি । মুকুল ওর শরীরে জীবানুর গতিবিধি টের পায় । মুকুলকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি আর ও শুয়ে শুয়ে খোদাবক্স মৃধার মতো ধারাভাষ্য দিচ্ছে, জীবানুটা এই মাত্র কোমরে চলে আসছে, এখন ডান হাতে…এখন বাম হাতে…
আজ নিজের হাতের রান্না খেয়ে হঠাৎ মুকুলের মতোই আমার মনে প্রশ্ন আসলো, রোম পুড়ে যাবার সময় নিরো বাঁশী বাজাচ্ছিলো কেনো ?
আগুন নেভাবার চেষ্টা না হয় নাই করলো, অন্য কিছুও তো করতে পারতো, বাঁশী বাজাচ্ছিলো কেনো ? কপাল ভালো এই প্রশ্ন নিয়ে আমাকে কোনো বেরহম বন্ধুর কাছে যেতে হয় নাই । প্রশ্ন করলাম সত্যিকারের সবজান্তা মিঃ গুগলকে । ভাবের রাজত্বে ছিলাম বলেই সরাসরি প্রশ্ন করি নাই । সেই জন্যই কিনা জানি না প্রথম লিঙ্কটাই আসলো রোমান সম্রাট মারকাস অরিলিয়াসের নাম । এই লোক সম্রাট হয়েও “Meditations” নামে একটা বই লিখে গেছে । কিন্তু সেই বইয়ের কিছু অংশ পড়ে আমার মাথায় আবার নতুন প্রশ্ন আসলো । প্রশ্নটা পড়ে বলি আগে কিছু অংশ কোট করছি ।
“The happiness of your life depends upon the quality of your thoughts.”
“Everything we hear is an opinion, not a fact. Everything we see is a perspective, not the truth.”
“If you are distressed by anything external, the pain is not due to the thing itself, but to your estimate of it; and this you have the power to revoke at any moment.”
“I have often wondered how it is that every man loves himself more than all the rest of men, but yet sets less value on his own opinion of himself than on the opinion of others.”
এরকম আরও গোটা বিশেক অনায়াসেই লেখা যায় । আপনাদের অনেকেরই জ্ঞানপিপাসা জেগে উঠেছে আমি জানি । কিন্তু আমার মনে ভিন্ন প্রশ্ন । রাজাদের কি আসলেই কোনো কাজ থাকে না ? থাকলে এরকম অবিনশ্বর সত্যি কথা মাথায় আসে কিভাবে ?
এসব ভাবতে ভাবতেই একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলাম । ঝিমুনির মধ্যেই এক মহামানবের দেখা পেলাম । আশে পাশের চেলা চামুন্ডার সংখ্যা এবং চেহারা দেখে নিশ্চিত হলাম উনি আমাদের নেতা । ভাবলাম নিরোর প্রশ্নটা ওনাকেই করি ।
স্যার একটা প্রশ্ন ছিলো ।
বলেন কি প্রশ্ন ?
স্যার ঢাকা শহর যদি পুড়ে যেতে থাকে আপনি কি করবেন ?
আপনি কে ? এই দ্যাখতো সাথে নিশ্চয় মোবাইল ফোনে সব রেকর্ড করতাছে ।
নেতার আদেশে তিন চেলা আমাকে আপাদমস্তক পরীক্ষা করা শেষে বললো স্যার কিছু নাইক্কা ।
দেখে শুনে তো আপনাকে ভদ্রলোকই মনে হয় । এরকম উদ্ভট প্রশ্ন করেন কেন ?
নাহ স্যার প্রশ্নটা করেছি নিরোর জন্য ।
নিরো সে আবার কে ?
স্যার নিরো রোমান সম্রাট, রোম পুড়ে যাবার সময় সে বাঁশী বাজাচ্ছিলো ।
ধুর তাই বলেন । এইসব নেতা আমাদের দেশে ভাত পাবে না ।
আমি মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম , তারপরও স্যার ধরেন এরকম একটা ক্রাইসিস হয়েই গেলো ।
আপনি তো মহা ত্যাদর । দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে, ফায়ার ব্রিগেড আছে তাদের অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে, হেলিকপ্টার আছে , এসব ক্রাইসিস কাটিয়ে ওঠা এখন ওয়ান, টুয়ের ব্যাপার ।
ধরেন স্যার এইসব কোনোকিছুই কাজ করলো না । ফায়ার সারভিস এর গাড়ি গিয়ে দেখলো কোথাও পানি নাই । হেলিকপ্টার উড়তে পারলো না পেট্রলের অভাবে ।
দেখেন আপনার এইখানে বেড়াতে আসছি বলে এইসব উদ্ভট প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি । তাছাড়া সবাই আমাকে মিস্টার নাইস বলে । শোনেন ঢাকা শহরে আমার লাখ বিশেক খাস লোক আছে । ধরেন আপনার কথা মতো হেলিকপ্টার, দমকল সব ফেইল মারলো । আমার খাস লোকদের প্রত্যেকের প্যান্টের ভিতরে একটা করে নিজস্ব দমকল আছে । আমি হুকুম দিলে সেই দমকল দিয়াই যেকোনো আগুন নিভিয়ে ফেলা সম্ভব ।
মাথায় একটা ঠোক্কর খেতেই ঝিমুনিটা চলে গেলো । কিন্তু মাথায় নতুন করে আবার একটা প্রশ্ন আসলো, এই জন্যই কি দেশের যে কোনো ক্রাইসিসে মুত্র উৎসব শুরু হয়ে যায় ? ইস্যু আসলেই হিসু ।