Collected নৈশপ্রহরী

dukhopakhidukhopakhi is verified member.

Special Member
Registered
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
407
Messages
5,564
Reaction score
2,011
Points
3,913
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
নৈশপ্রহরী

(অন্তর্জাল হতে সংগৃহীত)






পর্ব - ১
শীতের গভীর রাত!
শহরের ব্যস্ততা অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। একমাত্র জেগে আছে স্ট্রিটল্যাম্পের কুয়াশায় ঢেকে থাকা আলো.. বেওয়ারিশ কুকুরের মাঝেমধ্যে ডেকে ওঠা, আর মোড়ের শেষ দোকানটা—যেটা ‘মুকুলের টি-স্টল’ নামে পরিচিত।

এই রাত্রির একাকী প্রহরী হলেন রহিম চাচা। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়, গায়ে মোটা চাদর জড়ানো, হাতে একটা পুরনো কাঠের লাঠি, আর কোমরে ঝোলানো বাঁশি। তিনি এই শহরের নৈশ প্রহরী—চুপিচুপি রাতের অলিগলি ঘুরে বেড়ান, মাঝে মাঝে বাঁশির শব্দে জানান দেন, “আমি আছি।”
প্রতিদিন রাত দশটার পর শুরু হয় তার দায়িত্ব। হাঁটতে হাঁটতে তিনি জানেন কোন বাড়ির পেছনের দরজাটা একটু খোলা থাকে, কোথায় বাসার ছাদে কেউ চুরি করে রুটির টুকরো শুকায়, কোন রাস্তায় রাতে কুত্তারা দল বেঁধে ঘোরে। শহরের সবাই তাকে চেনে, কিন্তু কেউ তাকে গভীরভাবে চেনেনি।
আজও তিনি হাঁটছেন। হালকা কুয়াশার মধ্যে পা টিপে টিপে রাস্তায় লাঠির ঠকঠক আওয়াজ তুলে চলেছেন। হঠাৎ মুকুলের টি-স্টলের সামনে থেমে যান।

দোকান প্রায় বন্ধ, তবুও জানালা খুলে মুকুল বলল,
“চাচা, এক কাপ গরম চা দেব?”
রহিম চাচা হেসে বললেন, “দে বাবা, আজ শীতটা একটু বেশিই।”
“চাচা, আজকে দুধ একটু কম,” বলে চা এগিয়ে দিল মুকুল।
— “ঠিক আছে বাবা, গরম থাকলেই চলে,” রহিম চাচা শান্ত কণ্ঠে বললেন।
চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে। পাশে একটা ভাসমান কুকুর এসে বসেছে, যেন এই দুজনের সাথী।

চারদিক কুয়াশায় ঢাকা। দূরে একটা হেঁটে যাওয়া রিকশার চাকা ঘষ ঘষ করে শব্দ করছে। হঠাৎ একটা বিড়াল ডাস্টবিনের ঢাকনায় লাফ দিয়ে ওঠে—শব্দে মুকুল চমকে উঠে বলে,
— “চাচা, আপনি না থাকলে এই শহর ভয়েই মরে যেত।”

রহিম চাচা হেসে বলেন,
— “ভয়টাকেই একটু সঙ্গ দিলে সে শান্ত হয়ে যায়।”
এই শহর তাঁর কাছে অচেনা নয়। প্রত্যেক মোড়, প্রতিটা ভাঙা সিঁড়ি, রাত তিনটায় জেগে থাকা টিনের চালের শব্দ—সব তার চেনা। কখনো এই শহর তাকে কিছু দেয়নি, তবু সে প্রতিদিন এর পাহারা দেয়।
চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন। বাঁশির একটা ধ্বনি ছেড়ে দিলেন শূন্যে। তারপর ধীর পায়ে হাঁটতে লাগলেন পশ্চিম গলির দিকে। দূরে মসজিদের মিনার দেখা যায় কুয়াশার মধ্যে।
এই শহরের কেউ জানে না—এই নৈশ প্রহরীর সজাগ চোখের নিচেই প্রতিরাতে ঘুমায় কত নির্ভার মানুষ।
.......

....মুকুলের বয়স তেইশ। ছোটখাটো গড়ন, সবসময় মাথায় টুপি পরে, আর মুখে একরকম কৌতূহলী হাসি লেগেই থাকে। শহরের এই পুরনো মোড়ের এক পাশে তার ছোট্ট চায়ের দোকান—চারটা বেঞ্চ, একটা চুলা, আর একটা বেতের ঝুড়িতে বিস্কুট, চানাচুর। রাতের শহরে কিছু মানুষ যেমন অন্ধকারে হারিয়ে যায়, কিছু মানুষ ঠিক জ্বলে ওঠে। মুকুল তেমনই একজন।

রহিম চাচার সাথে তার সম্পর্কটা অদ্ভুত। রক্তের সম্পর্ক নয়, তবু কতটা যেন আত্মার।
প্রতিদিন রাতের নির্দিষ্ট একটা সময়ে রহিম চাচা আসেন, চা খান, কয়েকটা কথা বলেন, তারপর বেরিয়ে যান। এই অল্প কথার মাঝেই গড়ে ওঠে এক অভিভাবকত্ব।

সেই রাতে, চা শেষ করার পর রহিম চাচা দাঁড়িয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। দোকানের পেছনের গলিটা লক্ষ্য করছিলেন। মুকুল জিজ্ঞেস করল,
— “চাচা, আজ এতক্ষণ তাকিয়ে আছেন ওদিকে?”
— “ওই গলিটায় আজকাল রাতের বেলা কিসের যেন শব্দ পাই… জানি না ঠিক কি।”
মুকুল একটু ভয় পেল। বলল,
— “চাচা, আপনি একা যাচ্ছেন? আমি আসি?”
রহিম চাচা মাথা নেড়ে বললেন,
— “না, তুমি দোকান গুটাও। শহর জেগে থাকে আমার মতো লোকদের জন্য।”

চাচা চলে যাওয়ার পর মুকুল কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল—দুই দিন আগে এক রিকশাওয়ালা বলেছিল, পেছনের গলিতে এক ছেলে নাকি রাত করে বসে থাকে, কখনো কাঁদে, কখনো খায়। কেমন অদ্ভুত ছেলেটা!
মুকুল জানে, রহিম চাচা কোনো কথা এমনি এমনি বলেন না। তাঁর চোখ অনেক কিছু দেখে—যা সাধারণ মানুষ দেখতে পায় না।
তবে সে আর কিছু না ভেবে দোকান গুটিয়ে ঘরে চলে গেল।
আর সেই রাতেই, গলির মাথায় প্রথমবার রহিম চাচা দেখে ফেললেন ছায়াময় এক ছেলেকে—কে সে, কোথা থেকে এসেছে, তা তখনও জানা হয়নি।
......

রহিম চাচা আজকের রহিম চাচা হয়ে ওঠেননি হঠাৎ করে। কেউ জন্ম থেকেই নৈশ প্রহরী হয় না—জীবনের হাত ধরে আসতে হয় অন্ধকার, বিসর্জন আর দীর্ঘ নিঃসঙ্গতার দিকে।

দশ বছর আগের কথা। তখন তার পরিচয় ছিল “রহিম সাহেব”—রেলওয়ের জুনিয়র ক্লার্ক। সকালবেলার ট্রেন চলার শব্দে ঘুম ভাঙত, আর সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলে ছোট মেয়ে রুমানা দৌড়ে এসে বলত,
— “আব্বু, আজ আমি স্কুলে গানে প্রথম হয়েছি!”
স্ত্রী সেলিনা ছিলেন শান্ত, নম্র, সংসারী। তিনজনের ছোট সংসার ছিল ছোট্ট এক খুপরি ঘরে, কিন্তু ভালোবাসার কমতি ছিল না।
রহিম তখনো বাঁশি বাজাতেন, তবে সেটা মেয়ের আবদারে—“আব্বু, আবার বাজাও না... আমি শুনতে চাই!”
একটা দুর্ঘটনা বদলে দেয় সবকিছু।

একদিন রেলের অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে প্ল্যাটফর্মে পা পিছলে ট্রেন লাইনে পড়ে যান রহিম। ভাগ্যক্রমে প্রাণ বাঁচে, কিন্তু ডান পায়ের হাঁটু ভেঙে যায়। দীর্ঘ চিকিৎসা, আর অফিসে ছুটির শেষে জানানো হয়—চাকরি রাখা যাবে না।
তারপর শুরু হয় এক কঠিন সময়।

ঘরে খাবার নেই, মেয়ের স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। সেলিনা নিজের গয়নাগাটি বিক্রি করেন, শেষে অসুস্থ হয়ে পড়েন। একদিন রাতে, রহিম বাজার থেকে ফিরলে দেখে সেলিনা আর নেই—চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। পাশে বসে ছিল ছোট রুমানা, স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে।
মেয়েটাকে পাঠাতে হয় মায়ের মামাবাড়িতে। সেখানে অন্তত দুটো বেলা খেতে পাবে।
তারপর শহরের ভেতর একা হয়ে যান রহিম।

কিছুদিন মসজিদে রাত্রি কাটান। একদিন এক পুরনো দারোয়ান তাঁকে বলেন—“রহিম ভাই, আপনি চাইলে একটা কাজ আছে। রাতে পাহারা দিতে হবে। মাইনে কম, কিন্তু থাকার জায়গা আছে।”
রহিম বলেননি কিছু। শুধু মাথা নেড়ে রাজি হন।

আর সেই থেকেই শুরু—এক নতুন জীবনের। প্রতিটি রাত্রির সাথে একাত্ম হয়ে ওঠা। নিজের কথা ভুলে গিয়ে শুধু শহরকে পাহারা দেওয়া। আর মাঝে মাঝে, চুপিচুপি মেয়ের পুরনো ছবি দেখে ফেলে রাখা চোখের জল মুছে নেওয়া।
এই যে রহিম চাচার বাঁশির আওয়াজ—এটা শুধু পাহারার নয়, নিজের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা।
 
Back
Top