- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 407
- Messages
- 5,564
- Reaction score
- 2,009
- Points
- 3,913
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
মুঘল হারেম
(অন্তর্জাল হতে সংগৃহীত)
(অন্তর্জাল হতে সংগৃহীত)
হারেম শব্দটি আরবি শব্দ "হারিম" থেকে এসেছে, যার অর্থ "নিষিদ্ধ স্থান" বা "পবিত্র স্থান"।
এটি নারীদের বসবাসের জন্য একটি সংরক্ষিত এলাকা ছিল।
রাজপ্রাসাদের সেই আলাদা অংশে শাসকের মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা, নারী কর্মচারী, উপপত্নী প্রমুখ বাস করতেন তা হারেম, হারিম বা হেরেম নামে অভিহিত হতো। বহিরাগতদের হারেমে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
পৃথিবীর সকল যুদ্ধবাজ সম্রাটদের বিরুদ্ধে যেসব অপবাদ শোনা যায় তার ভেতরে উল্লেখযোগ্য হলো যুদ্ধে জয়লাভ করার পর বিভিন্ন প্রদেশ কিংবা অঞ্চল থেকে নানান ধর্ম ও বর্ণের মেয়ে এনে নিজেদের হারেমে রাখা। মুঘল হারেমেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। কখনো কখনো হারেমে মেয়েদের সংখ্যা ৭-৮ হাজার ছাড়িয়ে যেত।
এছাড়া সম্রাটদের চোখে কোন সুন্দরী তরুণী বা যুবতী দেখা পড়লে, সম্রাট দের পছন্দ হলেই তাদেরকে হেরেমে নিয়ে আসা হতো।
বাদশাহ আকবরের হারেমেই প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি বেগম ও সেবিকা ছিল!
হারেম নিয়ে মজার তথ্যেরও অভাব নেই। সম্রাজ্ঞী, রাজকন্যা কিংবা সম্রাটের রক্ষিতারা সকলে নাকি প্রায় একভাবেই সাজগোজ করত। বেণী করে আটকে রাখা চুল, ঝলমলে পোশাক আর মণিমুক্তার অলংকারে চারপাশ আলোকিত করে রাখত তারা। সকলের বুড়ো আঙ্গুলে ছোট্ট আয়না বসানো আংটিও পরা থাকত যার মধ্য দিয়ে তারা নাকি নিজেদের প্রতিবিম্বের দিকে দিনভর চেয়ে থাকত!
সম্রাট আকবরের আমলেই মুঘল হারেম সঠিক চেহারা পেলেও বাবরের আমল থেকেই হারেমের অস্তিত্বের কথা জানা যায়।
মোঘল হোক বা তুর্কি, হারেম মানেই যৌনতা ও বৈভব
মুঘল হারেম মহিলামহলে কেবল বাদশাহ ছাড়া আরও কারও প্রবেশাধিকার ছিল না।
সেখানে কেবল রাজমহিষীরাই থাকতেন তা নয়। উপপত্নী ও দাসীরাও থাকতেন।
অবশ্যই ‘পজিশন’ অনুযায়ী, থাকার ব্যবস্থা ছিল আলাদা রকমের।
আবুল ফজলের লেখায় পাওয়া যায়, আকবর নাকি পাঁচ হাজারেরও বেশি মহিলাকে তাঁর হারেমে রেখেছিলেন।
তাঁদের মধ্যে কয়েকশো মহিলার সঙ্গে তাঁর শরীরী সম্পর্ক ছিল।
বাকিরা ছিলেন হারেমের ব্যবস্থাপনায়। কিন্তু তাঁদেরও হারেমের কড়া নিয়ম মেনে চলতে হত। সেখানে কারও কোনও ছাড় ছিল না।
তখনকার সময়ে রাজার অনেক পত্নী আর উপপত্নী থাকতো। নিজেদের দাস-দাসী আর পত্নীদের সম্রাট নিজের ইচ্ছেনুযায়ী ব্যবহার করবেন সেটাও অবাক করার মতো ব্যাপার ছিল না। হারেমে তাই সর্বাধিক গুরুত্ব পেত আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা।
অন্তঃপুরের একাংশে থাকতো বাদ্যযন্ত্র এবং হাতি, ঘোড়া ও রথের সাজসজ্জা। এগুলোর বিশেষ প্রয়োজন পড়তো পুরনারীদের ভ্রমণের সময়ে। সম্রাটের বিনোদনের জন্য হারেমে প্রায় সব ধরনের সুযোগ সুবিধা রাখা হতো। তাই সম্রাটের আত্মীয়-পরিজনের পাশাপাশি থাকত সঙ্গীতশিল্পী আর নৃত্যশিল্পীরাও। মাঝে মাঝেই বসত নৃত্যগীতের আসর।
হারেম সংস্কৃতির প্রথম দিকে প্রাসাদের অভ্যন্তরেই আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা থাকতো।
পরবর্তীতে নারীদের জন্য আলাদা ভবন নির্মাণের রীতি শুরু হয়। মুঘল আমলেই হারেম পূর্ণাঙ্গ রাজকীয় পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকাশ লাভ করে।
শাহী পরিবারের নারীদের আবাসস্থলগুলো ‘মহল’ নামে পরিচিত ছিল। এছাড়াও জেনানা, মহল-সারা, হারেম-সারা, হারেম-গাঁ, রানীবাস ইত্যাদি নামেও হেরেমকে আখ্যায়িত করা হতো।
রাজপ্রাসাদের এক বিশাল অংশ জুড়ে ছিল মহল এলাকা।
বাগান আর ফোয়ারার দিকে মুখ করে থাকা অগুনতি কামরায় হাজার দুয়েক নারীর বাস আর তাদের প্রত্যেকের জন্যই আলাদা মহল। এছাড়া আর তিনটি প্রাসাদে সম্রাটের উপপত্নীগণ বাস করতেন। এগুলোকে বলা হতো, লেথেবার ( রবিবার), মঙ্গল (মঙ্গলবার) এবং জেনিসার (শনিবার) মহল। এই নির্ধারিত দিনগুলোতে সম্রাট নির্দিষ্ট প্রাসাদে যেতেন।
একটি হারেম বা অন্তঃপুরে অনেক কক্ষের ব্যবস্থা থাকতো। আলাদা রন্ধনশালা, আলাদা প্রহরী, আলাদা গোসলখানাসহ কোনো কিছুর অভাব ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি কক্ষের মধ্যে থাকতো আরো একাধিক কক্ষ, এক কক্ষের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করা যেতো একাধিক কক্ষের প্রবেশমুখে। হারেমের চারদিক প্রহরী ও প্রাচীর বেষ্টিত থাকতো। এতোসব কক্ষ ও আয়োজনের মূল দরজা কিন্তু থাকতো কেবলমাত্র একটিই।
মুঘল হারেমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর ছিল। বহিরাগতের জন্য মুঘল হারেমে প্রবেশ করা রীতিমতো দুঃসাধ্য ছিল। সূর্যাস্তের সময় হারেমের দরজা বন্ধ করে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হতো।
খোজা (eunuch) প্রহরীরা হারেমের ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকত। এসকল খোজাকে ‘নাজির’ নামে অভিহিত করা হত। প্রত্যেক রাজকুমারীর একজন করে নাজির থাকত যার ওপর তিনি গভীর আস্থা স্থাপন করতেন। বেগমদের কারো কোনো সামগ্রীর প্রয়োজন হলে তারা হারেমের কোষাধ্যাক্ষের কাছে আবেদন করত। হারেমে ব্যবহারের জন্য আলাদা রকমের মুদ্রা ছিল যা বাইরে পাওয়া যেত না।
কেমন ছিল হারেমের জীবন?
এখানে ঢোকা মানেই বাইরের জগতের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া। এমনকী সম্রাটের মৃত্যুর পরেও সেখান থেকে মুক্তি ছিল না।
তাঁদের নিয়ে যাওয়া হত হারেমের অপেক্ষাকৃত স্বাধীন অঞ্চলে, যার নাম ছিল সুহাগপুরা। আকবরের আমলে তৈরি হওয়া হারেমে ঐতিহ্য পরবর্তী সময়ে রক্ষা করেছিলেন জাহাঙ্গির, শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবও।
তবে জাহাঙ্গিরকে ঘিরেই মুঘল হারেমের সবথেকে বেশি গুঞ্জন শোনা যায়। ওলন্দাজ ব্যবসায়ী ফ্রান্সিসকো পেলসের্ট জাহাঙ্গিরের আমলে ভারতে এসেছিলেন। তাঁর লিখিত বিবরণ থেকে জানা যায়, মাত্র ২৫ বছর বয়সেই ২০ জন স্ত্রী ছিলেন জাহাঙ্গিরের। দাসী ছিলেন তিনশোরও বেশি।
পরে যত বয়স বেড়েছে ততই সংখ্যায় গুণিতক হারে বাড়তে থেকেছেন তাঁরা। শিল্পরসিক জাহাঙ্গিরের আমলে হারেমের ভিতরে মহলগুলি যেমন ঐশ্বর্যে ঝলমল করত, তেমনই হারেমের বন্দিনীদের পরনেও থাকত ভারী পোশাক, ঝলমলে গয়নাগাটি। তাঁদের শরীরে ভুরভুর করত সুগন্ধীর সুঘ্রাণ।
বলা হয়, সেই বন্দিনীদের জীবনের মোক্ষই ছিল যেনতেনপ্রকারণে সম্রাটকে খুশি করা। জাঁহাপনার পছন্দের খাবার কিংবা মিষ্টান্ন প্রস্তুত করে তাঁরা তা পেশ করতেন। প্রত্যেকেই নিজেদের এমনভাবে নিবেদন করতেন যাতে বাদশাহের মন জিতে নেওয়া যায়। তাঁর সঙ্গেই যেন শরীরী খেলায় মেতে ওঠেন বাদশাহ।
জাহাঙ্গির
জাহাঙ্গিরই (Jahangir) একমাত্র মুঘল সম্রাট, যিনি মদ ও আফিমে ডুবে থাকতেন। অন্য নেশাও ছিল তাঁর। কোনও কোনও বর্ণনায় মেলে, তিনি নাকি সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে মেয়েদের মাঝে গিয়ে বসতেন।
যদি স্ত্রীর কোনও দাসীর দিকে তাঁর নজর পড়ে যেত, তাহলে তাঁকেই হতে হত সম্রাটের সেরাতের শয্যাসঙ্গিনী।
সেই দাসীও চেষ্টা করতেন বাদশাহের মন জিতে নিতে। একবার জাহাঙ্গিরের নজরে পড়ে যাওয়া মানে হারেমে তাঁর প্রতিপত্তিও যেত বেড়ে। আবার জাহাঙ্গিরের মনে না ধরলে অচিরেই তিনি নির্বাসিত হতেন বিস্মৃতির অন্ধকারে। বাদশাহ আর ফিরেও দেখতেন না সেদিকে। সেজীবনের মতো যৌনতা তাঁর অধরাই থেকে যেত। কেননা খোদ সম্রাট ছাড়া আর কারও সঙ্গে যৌনতায় জারি ছিল কড়া নিষেধাজ্ঞা। মৃত্যু ও অসুস্থতার কোনও স্থান ছিল না হারেমে। সেখানে কেবলই ফুর্তি আর জৌলুস। তাই কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেই তাঁকে ঠেলে দেওয়া হত বিমারখানায়।
সেখানে কারও সঙ্গে দেখা করার অনুমতিটুকুও ছিল না। যৌন অতৃপ্তিতে ভোগা হারেমের অনেক বাসিন্দার চিকিৎসকদের কাছে নিজেদের সমর্পণ করার কথাও জানা যায়।
তবে সেখানেও সহজে প্রবেশাধিকার মিলত না পুরুষদের। মেয়ে ‘জারাহ’ বা শল্য চিকিৎসকের ডাক পড়ত সর্বাগ্রে।
তবে রোগীদের অবস্থা যখন জারাহদের আয়ত্তের বাইরে চলে যেত, তখন বাধ্য হয়েই পুরুষ হাকিমদের বা চিকিৎকদের ডেকে পাঠাতে হতো বেগমখানায়। তাদের হারেমে নিয়ে যাওয়ার
ঝক্কিও কম ছিল না।
বেগমের জন্য নির্ধারিত খোজার কঠিন পাহারায় আপাদমস্তক কাশ্মীরি শালে মুড়ে অন্ধের মত তাকে ভেতরে নেয়া হতো। কেউ তার চেহারা দেখত না, তিনিও কাউকে দেখতে পেতেন না। ভেতরে প্রবেশের পরেও শাহী নিয়ম অনুযায়ী, বাতচিত করা যেত না সরাসরি বেগমের সাথে।
বেগমের খাস বাঁদির মুখে তার বিবরণ শুনে সেই মত ইলাজ অর্থাৎ ওষুধের ব্যবস্থা করা হতো। হারেমের এক প্রান্তে, বিশেষ করে পেছন দিকে, থাকতো ধাত্রীবিদ্যা ও বিভিন্ন ব্যধিতে ব্যবহৃত ওষুধ-পথ্যের ভাঁড়ার। হারেমের নারীকুলের জন্য আলাদা চিকিৎসালয় স্থাপন করাটা গণ্য হতো অত্যাবশ্যক হিসেবে।
সব মিলিয়ে হারেম আসলে বৈভবের ঝলকানির আড়ালে চিরদুঃখিনী অন্তঃপুরবাসিনীদের গোপন কান্নার জন্মস্থানও। আগ্রা ফোর্ট থেকে ফতেপুর সিক্রি, ইতিহাসও আজও বয়ে চলেছে সেযুগের কত অনাম্নী মহিলার যন্ত্রণার নীরব জলছবি।
মুঘল হারেম এবং খোজা
হারেমের ‘নপুংসক’ পুরুষ পাহারাদাররা।
সশস্ত্র এই পাহারাদের প্রধানকে বলা হত হারেম সারা। হারেমের ভিতরের ব্যবস্থাপনা ও সব কিছুই তাঁর নজরে থাকত। পাহারা দেওয়ার পাশাপাশি বার্তাবাহক থেকে অন্তঃপুরবাসিনীদের মন ভোলানো, তাঁদের সেবা সবই করতেন এই খোজারা।
কেন তাঁদের ‘পুরুষত্ব’ নষ্ট করে দেওয়া হত? এর উত্তর সকলেরই জানা। যাতে তাঁরা হারেমের কোনও মহিলাকে ভোগ না করতে পারেন।
হারেম নিয়ে একটি অসামান্য বই ‘ডটার্স অফ দ্য সান: এমপ্রেসেস, কুইনস অ্যান্ড বেগমস অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার’। লেখিকা ইরা মুখোটি। তিনি লিখেছেন, বাবর ও হুমায়ুনের আমলে হারেমের চেহারা এতটাও গোপনীয় ছিল না। কারণ সেসময় হারেমের মহিলাদের অধিকাংশই চাগতাই তুর্কিষ এই মহিলারা কেবল ঘর সামলাতেন না। যুদ্ধনীতি থেকে রাজনীতিতেও ছিলেন চৌকস। আকবরের আমল থেকেই হারেমকে ঘিরে গোপনীয়তার কুয়াশা গড়ে উঠতে থাকে। আর সেই কুয়াশাকে ঘিরে পাক খেতে থাকে অদম্য কৌতূহল। আগেই বলেছি, যে কৌতূহল আজও একই ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। কয়েকশো বছরেও তার নিবৃত্তি হয়নি।
বাংলার স্বাধীন নওয়াবগণও মুঘল ঐতিহ্য অনুসারে হারেম প্রথা প্রবর্তন করেন। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীতে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পরও হারেম ব্যবস্থা অপরিবর্তিত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মকর্তা ও ইংরেজ বণিকগণ নওয়াবদের মতো হারেম রীতি অনুসরণ করে। তবে তাদের হারেমে আর্মেনীয়, পর্তুগিজ, বাঙালি, এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নারীদের সমাবেশ ঘটত।
আধুনিক সভ্যতা অতীতের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। আর তাই ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে সম্রাট বা বাদশাহদের কীর্তিকলাপ এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। রাজ্য নিঃশেষ হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে মণিমুক্তায় জড়ানো হারেমের অপরূপ নারীরা। অথচ মুঘল হারেমের অন্তরালে কী লুকিয়ে ছিল সে নিয়ে আগ্রহ মানুষের আজও মেটেনি।