Collected মিথ্যার মত সত্য সত্যের মত মিথ্যা - মোস্তাফিজুর রহমান টিটু

dukhopakhidukhopakhi is verified member.

Special Member
Registered
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
407
Messages
5,564
Reaction score
2,009
Points
3,913
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
*****মিথ্যার মত সত্য সত্যের মত মিথ্যা*****

মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু





‘আমিতো এখনো দোকানে ঢুকি নাই । আরো আধা ঘণ্টা পরে ফোন দেও ।‘ নতুন ছেলেটা শাজাহান কি অবলীলায় মিথ্যা বলে, ফোনে । গলার স্বরে এতটুকু হেরফের নাই । অনেকের মতে মোবাইল ফোনের দৌলতে মানুষ আরো বেশী মিথ্যুক হয়েছে । কাওরান বাজারে সবজি কিনতে কিনতে অনায়াসে পাওনাদারকে বলা যায় ‘ভাই কাজে একটু রাজশাহী আছি । দুইদিন পরে ঢাকা ফিরেই আপনাকে ফোন দিবো । আপনার জন্য কি কিছু আম নিয়ে আসবো ?’ মোবারক সাহেব নিজেই অবশ্য এরকম মিথ্যা মাঝে মাঝেই বলেন । হোলসেলার ফোন দিলেই বলেন ‘আমিতো ভাই দোকানে নাই । পরে আইসেন । আসার আগে ফোন দিয়েন ।‘

এরকম টুকটাক মিথ্যা আজকাল ঘটমান বর্তমান জীবনেরই অংশ । সবাই বলে । তবে মোবারক সাহেব অবাক হন শাজাহানের অকারন মিথ্যা বহর দেখে । এইতো গতকাল দুপুরে খাবারের সময় মার্কেটের ফুড কর্নারে শাজাহানকে ফোনে কথা বলতে আর খাবার খেতে দেখেন । ‘বেচা বিক্রি কিছু হইছে নি’ যোহরের নামাজ শেষে অন্য আর একটা কাজ সেরে দোকানে ফিরে জিজ্ঞেস করেন মোবারক সাহেব । ‘কিছুই হয় নাই স্যার । আমিতো সারাক্ষণ দোকানেই ছিলাম ।‘ সাথে সাথেই জবাব দেয় শাজাহান । দোকানে আরো দুইজন ছিলো । ঝুলন্ত প্রশ্নটার জবাব যে কেউই দিতে পারতো । কিন্তু শাজাহানই উত্তর দিলো এবং উত্তরটা আধা-সত্য এবং আধা-মিথ্যা । তার চাইতেও বেশী খারাপ মিথ্যাটা অপ্রয়োজনীয় । বয়স্ক ইদ্রিস মিয়া সব সময় দুপুরে দোকানে থাকে । বাকি দুইজন এদিক সেদিক বসে খাবার খায় । সবাই এটা জানে ।

অবাক ব্যাপার হলো সবাই শাজাহানের মিথ্যাগুলো সহজভাবেই নেয় । এই যেমন এখন কেউ কিছুই বললো না । মোবারক সাহেবের মনে পরে চার মাস আগে এমনই এক ঝিম ধরা দুপুরে প্রথম শাজাহান আসে দোকানে । ব্যবসার অবস্থা তখন খুব খারাপ । আগের তিনদিনে বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫৭০০ টাকার । রোজার ঈদ পার হয়ে গেছে দুই মাস । খালি ক্যাশ বাক্স সামনে নিয়ে ভাবছেন দোকানটা বিক্রি করে ফাস্ট ফুড কিংবা রেস্টুরেন্টের ব্যবসা শুরু করবেন কিনা । কিন্তু ঠিক সাহসও করতে পারছেন না । ‘তন্দ্রা শাড়ী হাউসের’ আসল মালিক তন্দ্রা, মোবারক সাহেবের স্ত্রী । শ্বশুরের সূত্রে আরো দুইটা দোকানের মালিক হয়েছিলেন মোবারক সাহেব । কিভাবে কিভাবে যেনো সেদুটো এখন হাতছাড়া । ভিতরে-বাহিরে ভীষণ প্রগল্ভ বউ প্রায়ই বলে ‘তোমার যে মুরোদের অভাব সেটা আমার চাইতে বেশী জানে কে ?‘ এই কথার উত্তর দেবার মতো মুরোদ আসলেও মোবারক সাহেবের নাই ...থাকে না ।

তাই ব্যবসা বদলের চিন্তা মনের মধ্যেই ঘুরপাক খায় । কথায় কিংবা কাজে প্রকাশের সাহস হয় না । এরই মাঝে শাজাহান আসে চাকুরির জন্য । নিজের আয়-রোজগারের অবস্থাই শোচনীয় । এরকম অবস্থায় নতুন লোক রাখার প্রশ্নই আসে না । কিন্তু যিনি শাজাহানকে পাঠাইছেন তাকে অবজ্ঞা করার মত অবস্থাও মোবারক সাহেবের নাই । অঢেল টাকা আর ক্ষমতার মালিক কিছু মানব ইশ্বরওতো আমাদের জীবনকে কিছুটা ছুয়েই থাকে । প্রবল বাস্প ওঠা হাড়ির মত । নির্বিগ্নে যেতে দাও, কোনো সমস্যা নাই । কিন্তু পথে ঢাকনির বাধা হয়ে দাঁড়াও ফুসে ফুলে জগত তছনছ করার চেষ্টা করবে ।

-পড়াশুনা করেছো ? সুদর্শন শাজাহানকে জিজ্ঞেস করেন মোবারক সাহেব ।
-জ্বি স্যার । আই এ পাশ করেছি । ভরাট মার্জিত গলায় উত্তর দেয় শাজাহান । এই ছেলে শাড়ির দোকানে কেনো কাজ করবে । এরতো সিনেমায় নিদেন পক্ষে টিভিতে অভিনয় করা উচিৎ । মনে মনে ভাবেন মোবারক সাহেব ।
-শাড়ীর দোকানে আগে কাজ করেছো ?
-জ্বি স্যার করেছি ।
-তাহলে আর কি । ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ । বেতন কি দিতে পারবো বলতে পারি না । তবে চৌধুরী সাহেব যখন পাঠাইছেন তখন কাজ শুরু করে দিতে পারো ।

সেই শুরু । অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বেচা কেনা ভালো হওয়া শুরু হলো । এখনতো মাশাল্লা বেশ ভালো । শাজাহানের দৌলতেই । মিথ্যাই বলে ...এইতো ...এ আর এমন কি ।


দুই তরুণী কাস্টমারকে রং ঢং করে শাড়ী দেখাচ্ছে শাজাহান । বোঝাই যাচ্ছে এরা আসলে শাড়ী কিনবে না । দোকানে এধরনের কাস্টমারের সংখ্যাও আজকাল বেড়ে যাচ্ছে । ‘এইটা পাড় এইটা জমিন আর কুঁচির পাশে এই কাজগুলো দেখা যাবে...’ বলে শাজাহান একরকম শাড়ীটা পরেই দেখায় । দারুন সুদর্শন এক তরুন শরীরে শাড়ী জড়িয়ে ক্রেতার মনোরঞ্জনের চেষ্টা করছে, ক্যাশ বাক্সের দুরত্বে বসে দৃশ্যটা কেমন যেনো । তাই চোখ সরিয়ে নেন মোবারক সাহেব । আজকাল এত এত দোকানে মহিলা কর্মী কাজ করে অথচ শাড়ীর দোকানে মহিলা বিক্রেতা নাই বললেই চলে। ব্যাপারটা অদ্ভুত না ।

-জ্বি না ভাবী আজকেতো আমি দোকানে নাই । মাল আনতে বের হইছি । আজাইরা ক্রেতা রেখে শাজাহানকে ফোনে কথা বলতে দেখেন মোবারক সাহেব । ‘কবে আসতে পারবো পরে জানাবো ভাবী ।‘ বলে ফোন রাখে শাজাহান । দিনের মাঝে এরকম দশ পনেরোটা ফোন আসে শাজাহানের । এসবও একদম পছন্দ করেন না মোবারক সাহেব । কিন্তু অন্য অনেক ব্যাপারের মত এব্যাপারেও শাজাহানকে কিছু বলেন নাই মোবারক সাহেব ।

মালিকের বউ ফোন করা শুরু করেছে । এই খেলার এইটা নিতান্তই শুরু । শাজাহান বুঝতে পারে এখানেও তাহলে বেশীদিন চাকরি করা হবে না । তবে মালিকটা কেমন যেনো চিমসানো । এইটাই আশার কথা । সবকিছু ম্যানেজ করে কিছুদিন টিকেও যেতে পারে । এসব ভাবতে ভাবতেই সুবেশী দুই নারীপুরুষকে দোকানে ঢুকতে দেখে শাজাহান ।

-আসেন স্যার । আসেন ম্যাডাম । কি শাড়ী দেখাবো ।
-ভালো ভালো কিছু শাড়ী দেখান । কোটের বোতাম ঠিক করতে করতে ভদ্রলোক বলেন ।
-কয়েকটা কাঞ্জিভরম দেখাই । একদম লেটেস্ট বাজারে আসছে । অন্য কোনো দোকানেই পাবেন না এখন । ম্যাডামকে দারুন মানাবে । শেষ কথাটা শুনে মহিলা বেশ খুশী হন । এর পরের আধাঘণ্টা একজন নিখুত যাদুকরের মত ক্রেতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে শাজাহান ।
-এসেছিলামতো মাত্র দুইটা শাড়ী কিনতে । চারটা শাড়ী কেনা কি ঠিক হবে ? মহিলার গলার স্বরে অনুমোদনের আকাংখা প্রবল ।
-ম্যাডাম । কোনটা বাদ দিবেন । এই গাদোয়াল কিংবা এই ইক্কাট কাতানটা এত সুন্দর । আর এগুলিতো স্যারই পছন্দ করলেন । স্যারের কিন্তু পছন্দ আছে । ভরাট গলায় কিন্তু স্বরে অনেকখানি মধু মিশিয়ে বলে শাজাহান ।
-দাম একটু কম নিয়েন । ভদ্রলোক আসলেই প্রভাবিত হয়েছেন দেখে ভিতরে ভিতরে খুশী হয় শাজাহান ।
-স্যার আমাদের চাইতে কম দামে এই শাড়ী কোথাও পাবেন না । কিছুটা গাম্ভীর্য নিয়েই বলে শাজাহান ।
-মাত্র অল্প কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে যাবো এত শাড়ী কি কেনা ঠিক হবে ? নিজেকে পরিষ্কার করতে আরো একবার বলেন ভদ্রমহিলা ।
-আরে তুমি এত ভাবছো কেনো । তিনদিনে সবগুলি শাড়ীই পরতে পারবে । দেখি সব মিলিয়ে কত হলো বলেন ।

অনেকদিনের পরিকল্পনার পরে এরকম একটা ট্যুরে যাচ্ছে ওরা । বাসা, অফিস কতদিক ম্যানেজ করতে হয়েছে । সাদীরতো এত ঝামেলা নাই । আর ওর টাকারওতো কোনো অভাব নাই । আর শাড়ীগুলো আসলেও সুন্দর । মনে মনে ভাবে ভদ্রমহিলা ।

অতপর সাতান্ন হাজার টাকা বিল দিয়ে সত্যিকারের সুখ নিয়েই মিথ্যা স্বামী-স্ত্রী দোকান থেকে বের হয়ে আসেন । দোকানের মাঝেও নেমে আসে সত্যিকারের সুখ । বয়স্ক ইদ্রিস আর এক কর্মচারী সেলিম খুশী এমাসেও পুরো বেতন পাবার সুস্পষ্ট নিশানায় । মোবারক সাহেব সুখী নগদ লাভে । চল্লিশ হাজার টাকার শাড়ী কি অনায়াসেই সাতান্ন হাজারে বিক্রি হলো । আগে ভাবতেন পন্য ভালো হলে মানুষ কিনবেই । শাজাহান এসে এতদিনের সব জানা ভুল করে দিচ্ছে মোবারক সাহেবের ।

সেদিনই পকেটে বেতনের পুরো টাকা নিয়ে দোকান থেকে বের হয় শাজাহান । রাতের আকাশে তখন থালার মত এক চাঁদ । কালো ধোঁয়া কিংবা ধোঁয়ার মতই মেঘ চাঁদের মিথ্যা আলোকে যতটা কমিয়েছে তার চেয়ে বেশী অলংকৃত করেছে । হনহন করে হাটা ধরে শাজাহান । মিরপুর রোডে উঠে তারপর মোহাম্মদপুরের বাস ধরবে । প্রতিদিনের মত । সিগনালের কাছে এসে রাস্তা পার হবার জন্য দাঁড়ায় শাজাহান । সিগনালে গাড়ীর গতি কমার সাথেই রাস্তায় পা রাখে । কয়েক কদম হাটার পরেই সামনের বৃদ্ধ মানুষটা দুম করে রাস্তায় পরে যায় । একেবারে শাজাহানের পায়ের উপরেই । বাধ্য হয়েই শাজাহানকে থামতে হয় । রাস্তার উপর থেকে বৃদ্ধকে টেনে তোলে শাজাহান । সফেদ পাঞ্জাবীর সাথে মিল রেখে একমাথা সাদা চুল, প্রশস্ত কপালের নীচে চোখ জোড়া এত রাতেও কালো চশমায় ঢাকা । সব মিলিয়ে বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা বৃদ্ধের । রাস্তায় পরে থাকা হাতের লাঠিটা উঠিয়ে শাজাহান জিজ্ঞেস করে...

-ঠিক আছেনতো চাচা মিয়া ।
-হ্যা বাবা । ঠিক আছি । বললেও বৃদ্ধ এলোমেলোভাবে পা ফেলেন রাস্তায় । শাজাহান হাত ধরে বৃদ্ধকে রাস্তা পাড় করে নিয়ে আসে...আসতেই হয় ।
-চাচা বসেন একটু ।
-নারে বাবা আমি ঠিক আছি । বলেই আবার টলে ওঠে বৃদ্ধ ।
-চলেন চাচা এক কাপ চা খাই । বলে একরকম জোর করেই বৃদ্ধকে রাস্তার পাশের দোকানে নিয়ে আসে শাজাহান ।
-কয়টা বাজে বাবা । দোকানের সরু বেঞ্চিতে বসে জিজ্ঞাসা করে বৃদ্ধ ।
-রাত সাড়ে দশটা ।
-অনেক রাত । চোখে ছানি পড়ছে । ঠিকমতো দেখি না । ভাবছিলাম রাত তেমন হয় নাই ।
-আপনি থাকেন কই ।
-এইতো কাছেই । একটা মেসে । তোমার মত ভালোমানুষ এখনো দুনিয়ায় আছে দেইখা কইলজাটা জুড়াইয়া গেলো বাবা । চায়ের ওম স্বাদ মাত্র জিহ্বায় অনুভব করেছে শাজাহান । কিন্তু কইলজার মধ্যেও যেনো ওম স্বাদটা ছড়াইয়া গেলো । কতদিন পর এভাবে কেউ ভালোমানুষ কইলো...
-পরিবার নাই চাচা । এই বয়সে মেসে থাকেন যে ।
-তুমি ভালো মানুষ । কিন্তু তাও এসব কথা আমি বলতে পারবো না । চা টা খেয়েই আমি চলে যাবো ।
-বলেনই না চাচা । নিজের ছেলে মনে কইরাই বলেন না হয় ।
-খুব বেশী কিছু বলার নাই বাবা । ছোট ছেলে হওয়ার সময় স্ত্রী মারা যায় । অনেকে বলার পরেও আর বিয়ে করি নাই । সৎভাবে থেকে দুই ছেলে মানুষ করার চেষ্টা করেছি । আচ্ছা সবাইতো মানুষ হিসাবেই জন্মায় তাহলে মানুষ করার কথা বলি কেনো ?
-উত্তর জানি না চাচা ।
-যাহোক তারা কতটুকু মানুষ হইছে জানি না । তবে তারা বৃদ্ধ বাবার খবর রাখে না । আমিও খুব বেশী রাখি না ।
-চলেন কিভাবে ?
-পেনশনের টাকায় কোনোমতে চলে যায় । অসুখ বিসুখ হইলেই যা সমস্যা । যেমন এই ছানি কাটার টাকা যোগাড় হইতাছে না ।
-চাচা আজকে বেতন পাইছি । আপনার ছানি কাটার টাকাটা আমিই দিতে চাই । নিরাবেগী গলায় বলে শাজাহান । শুনে শাজাহানের হাত ধরে বৃদ্ধ । কেমন ঠান্ডা শীতল হাত ।
-বাবাজি অনেক অনেক খুশী হইছি । কিন্তু এই টাকা আমি নিতে পারবো না । বলে একরকম উঠে দাঁড়ায় বৃদ্ধ ।
-বসেন বসেন চাচা । আর এক কাপ চা খাইতে খাইতে আপনাকে একটা গল্প কই । এরপরে টাকা নিলে নিবেন না নিলে না নিবেন । দিগদারির কিছু নাই ।

আমার আব্বার নাম ছিলো ফয়জুর রহমান । মসজিদের মুয়াজ্জিন আছিলো । সব সময় সত্য কথা কইতো । এমনকি খুব খারাপ সত্য হলেও কইতো । গ্রামের সবাই ডাকতো ঠ্যাডা মৌল্ভী । এই নামে ডাকলেও আসলে গ্রামের সবাই তাকে ভয় পাইতো । শ্রদ্ধাও করতো । বাবা কেমন ছিলো বুঝাবার জন্য একটা ঘটনার কথা বলি । আমি মাদ্রাসায় পড়তাম । হাইস্কুলে ওঠার পরে বাবা আমাকে স্কুলে ভর্তি করাইয়া দিলেন । বাজার করে ফিরতে একদিন এলাকার চেয়ারম্যানের লগে দেখা । আমি আব্বার হাত ধইরা আছি । ‘পোলাডারে মাদ্রাসা ছাড়ানডা কি ঠিক হইলো মৌল্ভী । হাফেজ বানাইতা । আখেরাতে পোলা হাত ধইরা বেহেস্তে নিয়া যাইতো । ‘ শুনে আব্বা উত্তর দেন – ‘আমি কি নাপাক কাম করি নিহি যে পোলার পুণ্যি নিয়া বেহেস্তে যাইতে হইবো । এইসব চিন্তা আফনের মত মানুষরা করবো ।‘ শুনে চেয়ারম্যানের মুখ চুন হইয়া যায় । গজগজ করতে করতে সে চলে চায় । চিন্তা কইরা দেখেন এগারটা গ্রাম এর মাতব্বর মুখের উপর এইরকম কথা ।

গ্রামের বিচার আচারে আব্বার কথাই ছিলো শেষ কথা । আব্বার একটা পোষা টিয়া ছিলো । সে শুধু একটা একটা কথাই বলতো -মৌল্ভী বাড়িত নাই । আব্বা বাসায় থাকলেও বলতো । আব্বার ছেলে হিসাবে আমার ভীষণ গর্ব ছিলো । শুধু নিজের গ্রাম না আশে পাশে কোথাও গেলেও আব্বার নামটা বলার সময় কেমন যেনো বুকটা অদ্ভুত বাতাসে ফুলে উঠতো । লোকজনও নামটা শুনে সমীহ করতো । আপনে কি বুঝতে পারছেন আব্বাকে আমি কি পরিমান ভালোবাসতাম ?

প্রশ্নটা করে একটু থামে শাজাহান । চায়ের দোকানের সামান্য দূরে একটুকরা উচ্ছিষ্ট খাবার নিয়ে তখন দুই কুকুর প্রবল বচসায় লিপ্ত । নিজের ব্যবসা ঠিক রাখতে চায়ের দোকানদারকেই লাঠি নিয়ে কুকুর তাড়াতে হয় ।

বলো বাবা বলো । কন্ঠে প্রবল আগ্রহ নিয়ে শাজাহানকে জিজ্ঞেস করেন বৃদ্ধ ।

আব্বার সবকিছুই আমি নকল করতাম । হাটা, বসা, কথা বলা । আব্বা চিৎ হয়ে বাম হাত কপালের উপর দিয়ে ঘুমাতেন । আমি এখনো সেভাবে ঘুমাই । শাজাহান আবার বলা শুরু করে ।

বাড়িতে আমি আব্বা আর এক ফুপি থাকতাম । ফুপির অনেক বয়স হইয়া গেলেও সেই রান্না বান্না করতো । খুব ছোটবেলায় মা মারা গেলে আব্বা আর বিয়ে করেন নাই । এইটা নিয়েও লোকজন অন্যরকম শ্রদ্ধা করতো আব্বাকে ।

তারপর আইলো সেইদিন । এইটে পড়ি তখন । নিম্নচাপ হইছিলো । সকালের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি স্কুল ছুটি হইতে হইতে ঝুম বৃষ্টি । খন্দকার বাড়ির আলফাজ সেদিন স্কুলে যায় নাই । অনেকটা পথ তাই একাই ছাতা মাথায় হাটতে হয় । কাদা মাটির রাস্তায় কেউ নাই । কচু পাতায় নাকি পানি ধরে না । অথচ রাস্তার পাশের কচু পাতাও মাটিতে গড়াগড়ি । বাড়ির উঠানে আসতেই মিথ্যুক টিয়া চিল্লায় মৌলভী বাড়িত নাই । বারান্দায় উঠে চাল থেকে পড়া বৃষ্টির পানিতেই পায়ের কাদা ধুই । বাইরের ঘরটা পাড় হতেই আব্বার ঘর থেকে আজব শব্দ পাই । তাড়াতাড়ি ঘরে যাই । আব্বা আড়াআড়ি বিছানায় পরে আছে । সাদা কালো রোমে ভর্তি বুকটা হাপরের মত ওঠা নামা করতাছে । সাথে গলায় শব্দ । ‘কি হইছে কি হইছে আব্বা কইয়া’ কাছে যাইতেই আব্বা খপ কইরা আমার হাতটা ধরেন । আমি জোরে ফুপুরে ডাকি । বৃষ্টির মাতম ছেদা কইরা সেই ডাক পাকের ঘরে পৌছায় কিনা জানি না । ঘর ঘর শব্দে আব্বা কথা বলার চেষ্টা করেন । একটু মনোযোগ দিলেই শুনতে পারি ।

‘বাজান জীবনে আমি জাইনা শুইনা অন্যায় করি নাই । তর লগেও করতাম পারুম না । বাজান আমি আসলে তোর বাপ না । আমারে তুই মাফ কইরা দিস ।‘ ঠোটের কোনায় আরো মনে হয় দুই চারটা শব্দ বলেন আমি ঠিক শুনতে পাই না । ফুপু ততক্ষণে ঘরে আসছেন । আমাদের দুইজনের চোখের সামনেই আব্বার শরীরটা নিথর হইয়া যায় ।

এর পরে বেশ কিছুক্ষণ শাজাহান কোনো কথা বলে না । বৃদ্ধও চুপচাপ বসে থাকেন । শাজাহান নিঃশব্দে চায়ের টাকা দেয় ।

আব্বার শেষ কথাগুলো কাউরেই কই নাই । মাঝে মাঝে মনে হয় যা শুনছি ভুল শুনছি । কিন্তু বাবা ফুপুর সাথে আমার চেহারায় কোনো মিলই ছিলো না । ‘মৌলভির পুন্যিতেই এত সুন্দর ছেইলা হইছে ।‘ ছেলেবেলায় এই কথাটা অনেকবার শুনছি । আমার জীবন সেই থেকেই কেমন আউলাইয়া গেলো । সত্য মিথ্যার ফারাক বুঝি না মাঝে মাঝে । এতকাল পরে আজ আপনাকে দেইখা আব্বার কথা খুব মনে পড়তাছে । এখন এই যে আমি আপনার ছানি কাটার টাকা দিলাম আপনে এইটারে মিথ্যা মনে করলেইতো হয় । আমার জীবনের মতই মিথ্যা । বলেই টাকার প্যাকেটটা বৃদ্ধের হাতে দিয়ে শাজাহান আবার হনহন করে হাটতে থাকে ।

শিরদাড়া সটান করে দাঁড়িয়ে নকল বৃদ্ধ সেই হাটা অপলক দেখতে থাকেন । এরকম আরো অনেক মিথ্যা অভিনয় হয়তো আবারো এখানে কিংবা অন্য কোথাও করবেন । তবে কালো চশমা এবং ছানি বিহীন নকল বৃদ্ধের চোখের জল্টুকু ভীষণ সত্যি বলেই মনে হয় .. মানুষের জীবনের মতই সত্যি ।
 
Back
Top