Collected মানব জীবন - ডাঃ লুৎফুর রহমান

dukhopakhidukhopakhi is verified member.

Special Member
Registered
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
407
Messages
5,564
Reaction score
2,011
Points
3,913
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
মানব জীবন

মূল লেখকঃ ডাঃ লুৎফুর রহমান






পর্ব - ১
০১. মানব–চিত্তের তৃপ্তি(১-৫)
মানব-চিত্তের তৃপ্তি অর্থ, প্রাধান্য; ক্ষমতা এবং রাজ্যলাভে নাই। আলেকজাণ্ডার সমস্ত জগৎ জয় করেও শান্তি লাভ করেন নাই। মানুষ অর্থের পেছনে ছুটছে–অপরিমিত অর্থ দাও তাকে, সে আরও চাবে। তার মনে হয় আরও পেলে সুখী হবে। সমস্ত জগৎ তাকে দাও : তবুও সে সুখী হবে না। জাগতিকভাবে যারা অন্ধ, তারাই জীবনে সুখ এইভাবে খোঁজে। দরিদ্র যে, সে আমার জীবন ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে ঈর্ষা করছে, সে আমার অবস্থার দিকে কত উৎসুকনেত্রে তাকিয়ে থাকে কিন্তু আমি নিজে কত অসুখী। পরম সত্যের সন্ধান যারা পায় নাই, মানব-হৃদয়ের ধর্ম কি, তা যারা বুঝতে পারে নাই–তারাই এইভাবে জ্বলে-পুড়ে মরে, এমন কি এই শ্রেণীর লোক যতই মৃত্যুর পথে অগ্রসর হতে থাকে, ততই এদের জীবনের জ্বালা বাড়ে। প্রতিহিংসা-বৃত্তি, বিবাদ, অর্থ-লোভ আরও তীব্রভাবে তাদেরকে মত্ত ও মুগ্ধ করে। তখনও তারা যথার্থ কল্যাণের পথ কী, তা অনুভব করতে পারে না। জীবন ভরে যেমন করে সুখের সন্ধানে এরা ছুটেছে, মৃত্যুর অব্যবহিত পরেও তেমনি তারা সুখের সন্ধান করে–পায় না, এই পথে মানুষ সুখ পাবে না। ক্রোধে তারা চিৎকার করে মানুষকে তারা দংশন করে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের দুখী, আহত-ব্যথিত মন নিজের দেহ এবং পরের অন্তরকে বিষাক্ত করে। বলতে কী, মানুষ জাগতিক কোনো সাধনায় সুখ, আনন্দ এবং তৃপ্তি পাবে না। এই পথ থেকে মানুষকে ফিরতে বলি; সমস্ত মহাপুরুষই এই কথা বলেছেন। মানুষ তার জীবনকে অনুভব করতে পারে নাই; শয়তান মানুষ–চিত্তকে ধর্মের নামে ভ্ৰমান্ধ করেছে। আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার
সত্যের সাধনাই মানব হৃদয়ের চরম ও পরম সাধনা। পরম সত্যকে দিনে দিনে জীবনের প্রতি কাজের ভিতর দিয়ে অনুভব করাই মানুষের শ্রেষ্ঠ সাধনা। কত বিচিত্রভাবে তাকে অনুভব করতে হবে তার ইয়ত্তা নাই। যিনি যতটুকু এই পরম সত্যকে অনুভব করতে পেরেছেন তিনি তত বড় সাধক, সন্ন্যাসী এবং ফকির। জগতে যা কিছু কর, যত কাজেই যোগ দাও, পরিবার প্রতিপালন কর, শিশুর মুখে চুম্বন দাও–মানব-চিত্তের এই একমাত্র গুরুতর সাধনা ও আকাক্ষা এর মধ্যেই প্রচ্ছন্ন রয়েছে। সত্যময় আল্লাহতায়ালাকে হৃদয়ে ধারণ করা, তাতে মিশে যাওয়া, আল্লাহময় হয়ে যাওয়া–সর্বপ্রকারের সত্য, সুন্দর, মধুর ও পূর্ণ হয়ে ওঠা–এই-ই চরম এবাদত।
আত্মার এই সিদ্ধির জন্যই ধর্মের যাবতীয় বিধি-বন্ধনে মত্ত থাকলে এবং তাকেই চরম মনে করলে মানবাত্মা বিনষ্ট হবেই!’হাজার নিয়ম পালন ও রোজা উপাসনায় তাকে উন্নত ও উজ্জ্বল করতে পারবে না। জীবনকে আল্লাহর রঙে রঙিন করে তুলতে হবে, সমস্ত চিন্তা, কথা ও কাজের মধ্য দিয়ে সেই সত্য সুন্দর ও সুমহানের গুণকে প্রকাশ করতে হবে।
.
০২. আল্লাহ্
বহুদিন আগে এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম–’আল্লাহ্ কী? তিনি বললেন, আল্লাহ অনন্ত–তাঁকে কেউ জানে না।’
‘আল্লাহ’র এই ব্যাখ্যা মানুষের পক্ষে বিন্দুমাত্র আশার কথা নহে। ‘আল্লাহ্ অনন্ত’ শুনে আমাদের মন বিন্দুমাত্র বিচলিত ও চঞ্চল হয় না। এই ব্যাখ্যা ব্যাখ্যাই নয়। বস্তুত আরও অনেকে আল্লাহর ব্যাখ্যা অনেক কথায় দিয়ে থাকেন, তাতে আল্লাহর পরিচয় মানুষ একটুও। পায় না-মানুষ বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ে ওঠে।
এই জগৎ, এই অনন্ত সৃষ্টি, অনন্ত জীবনের উৎস যিনি আছেন এবং থাকবেন–যিনি চিরসত্য, যিনি সর্বব্যাপী, যিনি আমাতে আছেন, যিনি আমাকে ভালবাসেন, প্রেম করেন, আমার সঙ্গে খেলা করেন, পথে পথে ঘুরে বেড়ান, আকাশে যার বাঁশি বাজে, হাম্বারবে যার অফুরন্ত প্রেম উছলে উঠে, যিনি মাতৃহারা শিশুর আর্তকণ্ঠে বিশ্বকে মা বলে ডাকেন–আমি। তাঁকে দেখতে চাই, পেতে চাই, হৃদয়ে ধারণ করতে চাই।–ঝড়ের দোলায় তার ভীষণ হাস্য বাজে, বজ্রনিনাদে তার শঙ্কা ধ্বনিত হয়।অনন্ত সৃষ্টি তিনি বুকে ধারণ করে আছেন, তিনি নর-নারীর অঙ্গশ্রীতে লীলায়িত হন, গানের সুরে তিনি ক্রন্দন করেন–সেই অশ্রুর দেবতাকে আমি দেখতে চাই–অনন্ত আকাশে, নিথর রাতে তার ক্রন্দন শুনেছি, মুগ্ধ নির্জন প্রান্তরে তাঁর শোক বাতাসে বয়ে এনেছে, তাকে পাবার জন্যে মানব-চিত্ত ব্যাকুল হয়ে ছুটছে। আমি তাকে পেতে চাই, তাঁকে চুম্বন করতে চাই। মানব-চিত্তের চির-প্রেয়সীর অঞ্চল ধরে অনন্ত সোহাগে আমি বাসরের আনন্দ অনুভব করতে চাই।
‘আল্লাহ’ কী? তাঁর কোনো সিংহাসন নাই, কোনো আসন নাই, রূপ নাই–অন্তরের সঙ্গে তিনি মিশে আছেন। সুন্দর, কল্যাণ এবং সত্যে তিনি আছেন। তোষামোদে তাঁকে পাওয়া যাবে না। তিনি আছেন ত্যাগে, সহিষ্ণুতায় এবং প্রেমে! তিনি রূপমুক্ত প্রেম, কল্যাণ এবং জীবন্ত সত্য। মনুষ্য যখন অন্যায়ভাবে আঘাত পেয়ে আঘাতকারীকে আশীর্বাদ করেছে, তখনই আমি তার রূপ দেখেছি। অসত্য ও অন্যায় দেখে মনুষ্য যখন লজ্জিত ও মর্মাহত হয়েছে, তখনই আমি তার রূপ দেখেছি। মনুষ্য যখন মনুষ্যের জন্য আঁখিজল ফেলেছে, তখনই আমি তাকে দেখেছি। জননী যখন শিশুকে বুকে ধরেছেন, তখনই আমি তাকে দেখেছি। বন্য পশু যখন সন্তানের স্নেহে ব্যাকুল অস্থির হয়ে গর্জে ছুটেছে, তখনই সেই রূপহীনকে আমি চোখের জলে দেখেছি। হে রূপহীন! তুমি ধন্য!–তোমার এত রূপ, কে বলে তোমার রূপ নাই? এতভাবে মনুষ্যকে তুমি ধরা দিচ্ছ–তবুও দেখলাম, তোমার রূপ সমস্ত গগন-পবনে ছড়িয়ে আছে, সমস্ত অবুঝ মনুষ্য বলে–তোমাকে দেখি নাই। প্রাতঃকালে যখন উঠলাম, তখন প্রকৃতিতে তোমার পায়ের নির্মল সুরভি লেগে আছে, সমস্ত দিন ভরে নিজেকে প্রকাশ করলে তবু বলি তোমার রূপহীন।
.
০৩. শয়তান
প্রভু! বীভৎস ঘৃণিত কুৎসিত মুখ আমি দেখতে চাই। আমার হাত তুমি ধর, আমি শয়তানের মুখ দেখবো–খুব ভালো করে তাকে দেখবো। শয়তান কেমন করে আমাকে মুগ্ধ করে, আমার শিরায় শিরায় প্রবেশ করে, আমাকে উদভ্রান্ত করে, আমাকে তোমার স্নেহ-মধুর পূত-নির্মল সহবাস হতে ইঙ্গিতে বিভ্রান্ত করে।
সমস্ত অন্তর দিয়ে তাকে ঘৃণা করতে চাই। তাকে দেখি নাই বললে চলবে না। তার ঘৃণিত, পৈশাচিক মুখ আমায় দেখাও, আমার দেহের অনুপরমাণু ঘৃণায় বিদ্রোহী হয়ে উঠুক, সমস্ত অন্তর দিয়ে আমি শয়তানকে ঘৃণা করতে চাই।
আমি অনেক সাধনা করেছি, অনেক রাত্রি তোমার ধ্যানে কাটিয়েছি আমার সমস্ত শরীর তোমার পরশ-পুলকে অবশ হয়ে উঠেছে; আমাতে আমি নাই–আমার নয়ন দিয়ে তোমার প্রেমের অশ্রু ঝরছে। পৃথিবীর সমস্ত আবিলতা মুক্ত হয়ে তোমার প্রেমে ধন্য হয়েছি; অকস্মাৎ চোখের নিমিষে শয়তান এসে আমার সর্বনাশ করে গেল,–আমাকে এক মুহূর্তে, পাতালের গভীরতম কূপে ফেলে গেল, ক্ষণিকের লোভে মানুষের মাথায় বজ্রাঘাত করলাম, অন্ধকার নিশীথে পশুর নেশায় বারবণিতার সৌন্দর্যশ্রীতে ডুবে মরলাম, গোপনে লোকচক্ষুর অগোচরে কুকার্যে আসক্ত হলাম, মানুষের বৃদ্ধি-অনুভূতির অন্তরালে প্রতারণায় আত্মনিয়োগ করলাম। প্রভু, কে আমায় রক্ষা করবে? মানুষ আমার পাপ দেখে নাই, আমি একাকী দেখেছি, আমাকে শয়তান আমার সর্বনাশ করেছে। প্রভু,মানুষের অগোচরে আমায় দুর্জয় কর; শয়তানের কুৎসিত মুখশ্রী আমায় দেখাও।
পৃথিবীর যত পাপ–পৃথিবীর যত প্রতারণা, নীচাশয়তা, হীনতা, কাপুরুষতা তাই তো শয়তানের মুখ। সাধু সঙ্গ ত্যাগ করে শয়তানের মুখ ভালো করে দেখবার জন্য, পৃথিবীর সমস্ত কাপুরুষতা, সমস্ত মূঢ়তা, গোপন পাপ, নারী ব্যভিচার আজ আমি ভালো করে দেখতে চাই।
একটা দরিদ্র লোক জীবনভর কিছু টাকা উপায় করেছিল। একদিন এক নামাজিকে তার বাড়িতে গিয়ে গভীর রাত্রে পঞ্চাশটি টাকা হাওলাত করে আনতে দেখেছিলাম। নামাজি বিয়ে করতে যাচ্ছিল, খুব বিপদে পড়েই তাকে সেখানে টাকার জন্য যেতে হয়েছিল। পঞ্চাশটি টাকা সে চাওয়া মাত্র পেয়েছিল–কোনো সাক্ষী ছিল না, কোনো লেখা-পড়া দলিলপত্র হয় নাই। এই ঘটনা দেখেছিলেন শুধু আল্লাহ্ আর নামাজির অন্তর মানুষ। তারপর দশ বৎসর অতীত হয়ে গেছে। লোকটি মারা গেছে। তার বিধবা পত্নী নামাজির বাড়িতে হেঁটে হেঁটে হয়রান হয়ে এখন আর হাঁটে না। এই ব্যক্তিকে লোকে মুসলমান বলে, মানুষ তাকে ঘৃণা করে। তাকে অমানুষ বলে ধরবার কোনো পথ নাই। সে পাঁচটি ফরজই আদায় করেছে। কে তাকে কাফের বলবে? কিন্তু আমি দেখেছি তার মুখে শয়তানের বিশ্রী মুখ।
একজন কেরানি তার পত্নীকে খুব ভালোবাসতো। সারাদিন সে পোস্ট অফিসে গাধার খাটুনি খাটতো, আর তার মাঝে তার পত্নীর মুখোনি বুকে জেগে উঠতো। মাতাল যেমন মদ খেয়ে দুর্বল দেহটিকে সবল করে নেয়, সেও তার দুর্বল দেহটাকে পত্নীর মুখোনির কথা মনে করে সবল শক্ত করে নিত। পোস্ট অফিসের ভারী ব্যাগগুলি ধাক্কা মেরে সে দশ হাত দূরে ফেলে দিত।
সে যখন বাসায় ফিরতো বাজার থেকে এক গোছা গলদা চিংড়ি মাছ কিনে শিস দিতে দিতে বাড়ি আসত, পত্নীর হাতে সেগুলি দিয়ে প্রেমে তার মুখের পানে চেয়ে থাকত।
এক ছোঁকরা ঐ বাড়িতে আসত। কেরানি তাকে পুত্রের মতো স্নেহ করতো। তার বয়স আঠার বৎসর হবে। একদিন ছোঁকরার সঙ্গে ঘরখানি খালি করে পত্নীটি চলে এসেছিল–সে এখন পতিতা। রাস্তার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে হাসে। একদিন ঝগড়া করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। হঠাৎ দেখলাম–সেই পতিতার উজ্জ্বল দীপ্ত লোহিত মুখ। সেই মুখে দেখেছিলাম শয়তানের কুৎসিত মুখ-বীভৎস দৃষ্টি। হৃদপিণ্ডে আগুন জ্বলে উঠেছিল, আন্তরিক ঘৃণায় সেই স্থান ত্যাগ করলাম। আমার পাপচিত্ত ক্রুদ্ধ ঘৃণায় জ্বলে উঠেছিল। মহাপাপের মুখ দেখে আমি শিউরে উঠেছিলাম।
শয়তান! আমি তোমার মুখ আরও ভালো করে দেখতে চাই–প্রভুকে যেমন করে দেখছি, তোমাকেও তেমন করে দেখতে চাই–অনন্তভাবে আমি তোমার ঘৃণিত কুৎসিত নগ্ন ছবি দেখতে চাই। আমি সমস্ত প্রাণ দিয়ে তোমাকে ঘৃণা করতে চাই। ভালো করে তোমার মুখ আমায় দেখাও, আমি দুই হাত দিয়ে ভালো করে স্পর্শ করে তোমায় দেখতে চাই।
শমসের এবং হাসান দুই ব্যক্তি কথা বলছিলেন। শমসের বললেন–আপনি মহামানুষ, দেশসেবক, আপনার কাছে আমি চিরঋণী।, হাসান–জনাব, জীবন অনিত্য, কোনো সময় যাই, তার ঠিক নাই, আমার কাছে কৃতজ্ঞ হবার দরকার নাই।
শমসের বললেন–আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ, আপনি মহামানুষ।
অতঃপর হাসান সে স্থান থেকে চলে গেলেন। তার স্থান ত্যাগ করা মাত্র শমসের বললেন–এই ব্যক্তিকে আমি চিনিভারি শয়তান’। শমসেরের মুখে দেখলাম, কাপুরুষ নিন্দাকারী শয়তানের বীভৎস ছবি। শয়তানের হাত থেকে রক্ষা চাই। আমাদের এই সুপবিত্র মুখশ্রীতে শয়তানের মুখ ফুটে না উঠুক।
একটি বন্ধু আর একটি বন্ধুকে ভালোবাসতো। প্রথম বন্ধুটির গৃহে দ্বিতীয় বন্ধুটি প্রায়ই যেত। প্রথম বন্ধু দ্বিতীয় বন্ধুকে বিশ্বাস করতো, ভালোবাসতো। একদিন দেখলাম দ্বিতীয় বন্ধু প্রথম বন্ধুর অনুপস্থিতিতে প্রথম বন্ধুর পত্নীর সঙ্গে অবৈধ প্রেমালাপে মত্ত। শয়তানের মুখ দেখতে বাকি রইল না। শয়তানকে ভালো করেই চোখের সামনে দেখলুম।
একটি যুবক, সে বক্তৃতা করতো, এক সংবাদ-পত্রিকার সম্পাদক সে। এক বুড়ির বাড়িতে সে যেত। বুড়ি তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত–স্নেহ করতো; এতটুকু অবিশ্বাস করতো না। বুড়ি উচ্চ-হৃদয় যুবককে গৃহে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতো। বুড়ির একটি মাত্র অবলম্বন ছিল তার বার বৎসরের প্রিয় সন্তানটি, দেখতে বেহেশতের পরীবালকের মতো। এই যুবক বালকটিকে ভালোবাসতো; বুড়ি প্রাণ ভরে দেখতো তার পিতৃহীন সন্তানকে যুবক ভালোবাসে, স্নেহ করে। প্রাণভরে সে যুবককে আশীর্বাদ করতো। একদিন যুবক এই শিশুর পবিত্র মুখে গোপনে চুম্বন করলো। সুকুমার স্বর্গের শিশুটি যুবকের মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে শিশুকে যুবক পাপের পথে আকর্ষণ করলো। তার সোনার হৃদয়-কুসুমে পাপের হলাহল ঢেলে দিল। বুড়ির নয়ন-পুত্তলির সর্বনাশ হয়ে গেল। বুড়ি তা জানতে পারলে না। তার সাজান বাগানে যুবক আগুন ধরিয়ে দিল। এখন দেখি বুড়ি অন্ধ, রাস্তায় রাস্তায় সে ভিক্ষা করে। তার সোনার যাদুটি মারা গেছে। শিশুটি ধীরে ধীরে পাপের পথে অগ্রসর হতে থাকে, তার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, বিবিধ রোগে সে ভেঙ্গে পড়ে, সে মদ, গাঁজা, ভাঙ্গ খায়, পরে সে জেলে যায়, সেখানেই মরে। সেই সম্পাদক যুবককে কেউ জানে না, তাকে মানুষ নমস্কার করে। নিকটে এলে আসন এগিয়ে দেয়। অনেক টাকা তার। আমি তার মুখ দেখলে ভয় পাই। সম্মুখে সাক্ষাৎ শয়তান দেখে শিউরে উঠি।
এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির গৃহে তার সেয়ানা মেয়েটি থাকতো। মেয়েটির স্বামী বিদেশে থাকে। ভদ্রলোকের বাড়িতে তার এক দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয়ও থাকত। দেখলাম, একদিন সেই আদরের মেয়েটি সেই যুবকটির সঙ্গে গোপনে গোপনে আলাপ করছে। মেয়েটির মা বোনেরা তা জানে, জাতি যাবার ভয়ে কথা বলে না। নির্জন কক্ষে এই দুটি বিশ্বাসঘাতক নর-নারী কথা বলে, এক সঙ্গে খায়।
যুবকটি ভয় করে, অনিচ্ছা প্রকাশ করে; বিবাহিতা অবিশ্বাসিনী যুবতীটি তাকে বলে–কোনো ভয় নাই।
দুই বৎসর পরে দেখলাম, এক জায়গায় এক বাবুর গৃহিণীরূপে এই বালিকাটিকে। বাবু পরম বিশ্বাসে পত্নীর সঙ্গে প্রেমালাপ করছেন, পত্নীও স্বামীর সঙ্গে আনন্দে কথা বলছে।
এই দৃশ্য দেখে শোকে আমার চোখ জলে ভরে উঠলো। শয়তানের এই অভূতপূর্ব কীর্তির ছবি চোখ দিয়ে দেখলাম। অসহ্য দুঃখে ভাবলাম, মানুষের অত্যাচার এবং মূর্খতা-অবিচার আর শয়তানের প্রাণঘাতী কীর্তি!
এক মহাজন এক ব্যক্তিকে বিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। লোকটি একদিন মহাজনের সর্বনাশ করার জন্যে চালাকি করে ঘরে সিঁদ কেটে দুপুর রাতে কাঁদতে আরম্ভ করলো। লোকজন যখন জমা হল, সে কেঁদে বলল, তার সর্বনাশ হয়েছে–চোর তাকে সর্বস্বান্ত করে গেছে, কী করে সে মহাজনকে মুখ দেখাবে?’ প্রাতঃকালে সে মহাজনকে টেলিগ্রাম করল। থানার কর্মচারীর সঙ্গে রাত্রে গোপনে সে দেখা করল। চুরি যে ঠিক হয়েছে এবং সে যে নিঃস্ব হয়ে গেছে, তা প্রমাণ হয়ে গেল। তার মিছে সর্বনাশের কেউ প্রতিবাদ করলো না। করতে কেউ সাহস পেল না।
এই নিমকহারাম বিশ্বাসঘাতক লোকটি সেই টাকা নিয়ে এসে বাটীতে মসজিদ-ঘর তুলো। সেই ঘরে বসে সে বন্দেগী করে। মানুষের মুখে তার প্রশংসা ধরে না; কত মানুষ তার গৌরব করে, কত মৌলবীর মুরুব্বি সে, কত ভদ্রলোকের বন্ধু সে। আমি তার মুখ দেখলেই ভয় পাই, তার মুখে কার বীভৎস মুখ দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠি। ঘৃণায় সে স্থান ত্যাগ করি।
চল্লিশ বৎসর পূর্বে এক ব্যক্তি রেঙ্গুনে গিয়েছিল; সেখানে গিয়ে সে একটি বালিকাকে বিবাহ করেছিল। সেই বালিকাটি এখন যুবতী। যৌবনের রূপ-ঐশ্বর্য দেখে তাকে ভোগ করার লোভ সংবরণ করতে না পেরে, সে প্রতারণা করে তাকে বিয়ে করেছিল। যখন তার পিপাসা মিটে গেল। তখন একদিন আসি’ বলে ঐ যে পালিয়ে এল, আর কোনোদিন সেখানে গেল না। সেই বালিকা যে কত বৎসর ধরে পথের পানে তার প্রিয়তমের আশায় চেয়েছিল, তা কে জানে? এই যুবক একজন ধার্মিক ভদ্রলোক। সমস্ত ধর্ম সাধনাই তার ব্যর্থ হয়েছে। প্রভু আর আমি জেনেছি সে কে!
এক ব্যক্তি মরে গেছে। সে যে বিপুল সম্পত্তি রেখে গেছে তার জন্য তার বংশের মর্যাদা দেশ জোড়া। সে ছিল এক জমিদারের নায়েব। জমিদার বিশ্বাস করে তার সম্পত্তি নায়েবের হাতে দিয়ে আনন্দ করে বেড়াতো। ধীরে ধীরে জমিদারের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রয় করে বিশ্বাসঘাতক নায়েব নিজেই জমিদার হল। তার এখন কত সম্মান, মানুষ তার নামে দোহাই দেয়, কত ইট পাথর তার বাড়িতে। কত বড় বড় প্রতিমা তার ঘরে উঠে। আমি তার বাড়ির সামনে গেলেই হাসি-শয়তানের ভণ্ডামি দেখে জ্বলে উঠি, শয়তান মানুষকে কত রকমেই না প্রতারণা করে। কে তার মুখ মানুষের মুখে দেখতে সাহস পায়?
সৌরভ, সমস্ত পরিচ্ছদ, সমস্ত সৌন্দর্যের সাধ্য নাই শয়তানের কুৎসিত মুখচ্ছবি ঢাকে। যে তা দেখেছে, সেই ভয় পেয়েছে।
 
Back
Top