Collected লোনা জল - মোস্তাফিজুর রহমান টিটু

dukhopakhidukhopakhi is verified member.

Special Member
Registered
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
407
Messages
5,564
Reaction score
2,009
Points
3,913
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
*****লোনা জল*****

মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু





রাস্তার জ্যামের কথা চিন্তা করে বেশ কিছুটা আগেই বাসা থেকে বের হয়েছে শান্তা । অথচ আজ একেবারেই কোনো জ্যাম পরে নাই । পল্লবী থেকে কমলাপুর এসেছে মাত্র পয়ত্রিশ মিনিটে । আজ অবশ্য বেশ কুয়াশা পড়েছে । এতটাই যে গাড়ির হেডলাইট জ্বালাতে হয়েছিলো । শীতও বেশ জাকিয়ে বসেছে । স্টেশনে এসে দেখে ট্রেন ছাড়ারও ঘণ্টাদেড়েক আগে এসে পরেছে । শীতের সকালের রেলষ্টেশন । বড় বড় থামের আড়ালে এখনো কিছু কুণ্ডলী স্থির হয়ে আছে । এরকম একটা মানুষের কুন্ডলির পাশেই একটা বাচ্চা কুকুরও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে । চারিদিকে কিরকম এক আরামদায়ক অলসতা ।

-এই নাও চা । যা ঠান্ডা পরেছে । তুষারের মাফলার, কান্টুপি ঠিকমতো আছেতো ? বলতে বলতে চায়ের কাপটা শান্তার হাতে দেয় সবুজ । চায়ের কাপের উষ্ণতাটুকু হাতের আঙ্গুল, তালু থেকে কেমন সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পরে ...পুকুরে ছোড়া ঢিল-ঢেউ এর মতো । বেশ ভালো লাগে শান্তার ।
-ট্রেন কখন প্লাটফর্মে আসবে ? শান্তা জিজ্ঞেস করে ।
-আরোতো ঘণ্টাখানেক সময় আছে । চা, টা কিন্তু দারুন হয়েছে । আর এক কাপ নিয়ে আসবো ?
-বাবা আমিও চা খাবো ।
-তুইও চা খাবি । চল বেটা সবার জন্য আবার চা নিয়ে আসি । বলে সবুজ ছেলে তুষারকে নিয়ে চা আনতে চলে যায় ।

প্লাটফর্মে ধীরে ধীরে লোকের সমাগম হচ্ছে । একটু আগে দেখা কুণ্ডলীগুলো এখন আর নাই । একটু দুরে এক নবদম্পত্তি দাঁড়িয়ে আছে । যে কেউ দেখেই বলতে পারবে এরা নবদম্পত্তি । মেয়েটা কেমন সংকোচে আলগোছে ছেলেটার হাত ধরে আছে । আর ছেলেটা এক জনমের সুখ চোখে মুখে নিয়ে কি যেন বলছে মেয়েটাকে ... কি বলছে ছেলেটা ...হঠাৎ খুব কৌতুহল হলো শান্তার । কৌতুহল দমন করতেই অন্যদিকে তাকালো শান্তা । বেশ কিছুটা দূরে সবুজ ছেলেকে হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে । এক হাতে ছেলেকে ধরে অন্য হাত মুঠো করে সিগারেটে টান দিয়ে মুখটা আকাশপানে নিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে সুদর্শন সবুজ । সিগারেটের ধোঁয়া আবছায়ায় কুয়াশার ধোঁয়ার সাথে মিশে যাচ্ছে । পুরো দৃশ্যটার মধ্যে একটা অন্যরকম সৌন্দর্য আছে । কয়েকটা মুহূর্ত শান্তাও মুগ্ধ চোখে দৃশ্যটা দেখলো । কিন্তু একটু পরেই বেশ বিরক্ত হলো শান্তা । ছেলের সামনে সিগারেট খেতে হাজারবার নিষেধ করেছে সবুজকে । অথচ...তারপরও ... । তবে এখন এটা নিয়ে কিছু বলবে না বলে ঠিক করে শান্তা । অনেক দিন পরে পুরো পরিবার নিয়ে কক্সবাজার যাচ্ছে । হয়তো এটাই শেষ ...

-আরে শান্তা না ? শান্তাই তো ? হঠাৎ খুব কাছে থেকে এক বেশ সুন্দরী রমণী আগ্রহী চোখে জিজ্ঞেস করে । মাঝারী উচ্চতা, গোলগাল ঝকঝকে মুখে সুখ কিংবা স্বাচ্ছন্দ্যের বাড়তি মেদ কিছুটা প্রহেলিকা সৃষ্টি করলেও চেনা যায় ...সহজেই চেনা যায় ।
-ঝুমা না ? তুই ? এতদিন পরে ? কোথায় যাচ্ছিস ? কোন ট্রেনে ? এক নিঃশ্বাসে অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেলে শান্তা । পরবর্তী কয়েক মিনিট দুই পুরোনো বান্ধবী আবেগে ভেসে যায় । এর মাঝেই জানা হয়ে যায় দুইজনেই কক্সবাজার যাচ্ছে । প্রথমে ট্রেনে পরে মাইক্রোবাসে ।

-তুমি এত জোরে কথা বলছো যে আশেপাশের সবাই হা করে শুনছে । দুই বান্ধবীর কথার মাঝখানেই এক ভদ্রলোক ঝুমাকে বলে । চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা, মাথায় চকচকে টাক, কপালে কিছু স্থায়ী ভাজ ...বয়স একটু বেশীই... ঝুমার স্বামী বোঝা যায় । সাথে তুষারের বয়সী এক মেয়ে ।
- লোকে শুনলে শুনুক । ও কে জানো ? ঝুমা উত্তেজনার সাথেই বলে ।
-বিশেষ কেউ সেটাতো বুঝতেই পারছি । তবে না বললে বুঝবো কিভাবে ? ভদ্রলোকের কথা বলার ভঙ্গীটা বেশ লাগে শান্তার ।
-আরে আমার বান্ধবী শান্তা । ওর কথা তোমাকে অনেকবার বলেছি ।
-ওহ মাই গড । সেই সবুজ-শান্তার শান্তা । আপনাদের কথা কতবার শুনেছি । আমার নাম হানিফ । বুঝতেই পারছেন আপনার সুন্দরী বান্ধবী এই অধমের গলাতেই মালা দিয়েছেন ।
-কিরে ঝুমা, আমার নামে এত কি বদনাম করলি ? তোর কথাও কিন্তু আমরা মাঝে মাঝেই বলি ...
-রেখে গেলাম তোমাকে একা...এখন দেখছি মোটামুটি একটা হাট বসিয়ে ফেলেছো । শান্তার কথার মাঝখানেই ফোমের কাপে চা হাতে নিয়ে এসে বলে সবুজ ।
-কেমন আছেন সবুজ ভাই ? বেশী সুখে থাকলে নাকি মানুষ পুরোনো সব কথা ভুলে যায় । দেখেনতো চিনতে পারেন কিনা ?
-তুমি হলে ঝুমা । খুব ভালোভাবেই মনে আছে । এখন চা টা হাতে ধরো । আমি আরো কয়েক কাপ নিয়ে আসছি ।
-না সবুজ ভাই আপনাকে যেতে হবে না । আমরা বড় দুই ফ্লাস্ক শুধু চাই এনেছি । এই চায়ের ফ্লাস্কটা একটু বের করো না । চা আর দুই পরিবারের মাঝে প্রাথমিক আলাপ শেষ হতে না হতেই প্লাটফর্মে ট্রেন এসে থামে ।

-দেখুন আমরা পুরো একটা এসি কামড়া রিজার্ভ করে যাচ্ছি । আপনারা একসাথে গেলে আমাদের খুব ভালো লাগবে । আমি টিটির সাথে কথা বলে ঠিক করে ফেলছি । খুব আন্তরিকতার সাথে বলেন হানিফ সাহেব ।
-তুমিও না । এর মাঝে আবার বলার কি আছে । শান্তা চাইলেই কি আর আমি ওকে ছাড়বো । তুমি টিটির সাথে কথা বলে এসো । ঝুমা এমনভাবে বলে যে এর উপরে কোনো কথাই থাকতে পারে না ।
-তুষার অবশ্যই আমাদের সাথে যাবে । খুব মিষ্টি করে ঝুমার মেয়ে টুম্পা বলে । এতটুকু সময়ের মাঝেই দুই শিশুর মাঝে চমৎকার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ...শুধু শিশুরাই এমন পারে । অতএব সবাই একসাথেই এক কামড়াতে ওঠে ।

একটু পরেই ট্রেন ছাড়ে । দুই বান্ধবী আরাম করে পা তুলে পাশাপাশি বসে । দুই পুরুষও মুখোমুখি বসে ।

-ভাই আপনাদের গল্প এত শুনেছি বিয়ের পর থেকে, সত্যি খুব ভালো লাগছে । ভীষণ আন্তরিকভাবে কথা শুরু করে হানিফ ।
-কি এত গল্প শুনলেন ? সবুজ জিজ্ঞেস করে ।
-আপনাদের প্রেমের গল্প । ঝুমা প্রতিবার আপনাদের প্রেমের গল্প শেষে চকচকে চোখে বলবে ‘ইশশ আমার যদি এরকম একটা প্রেম হতো’ । এই কথা শুনতে শুনতে আমিও আজকাল ভাবি ‘আহারে আমারো যদি এই জীবনে এরকম একটা প্রেম হতো ‘।
- তোমার হবে প্রেম । তুমি ব্যবসা ছাড়া আর কিছু বোঝো । সবুজ ভাইকে দেখো । ঝুমা কপট কটাক্ষ করে ।
-তুই না একটু বেশী বেশী । শান্তাও কপট রাগ দেখায় ।
-শোন একটুও বেশী বেশী না । সবুজ শান্তার প্রেমের কথা জানে না এমন কেউ লালমনিরহাটে তখন ছিলো নাকি ।
-ভাই আমার একটা কথা জানার অনেক কৌতুহল । এই যে সারা শহরে মাইকিং করে আপনি সবাইকে বিয়ের দাওয়াত দিলেন আবার বললেন সবাইকে নিজের খাবার নিয়ে আসতে সাথে পঞ্চাশ টাকা । গিফট হিসাবে । এরকম অদ্ভুত আইডিয়া আপনি কিভাবে পেলেন । হানিফ সাহেব বলেন ।
-এইসব কথাও আপনি জানেন । সবুজ হাসতে হাসতে উত্তর দেয় ।
-আপনাদের প্রায় সব কথাই আমার মুখস্ত । বলেন না ।
-ধুর ভাই কি বলবো । আমাদের উত্তরবঙ্গের লোকদের নাকি আয়োডিনের অভাব আছে । ধরে নেন আয়োডিনের অভাবেই আমাদের বুদ্ধি কম । আর তাই এমন কাজ করেছি ।
-ভাই এড়াইয়া যাইয়েন না । প্লিজ বলেন ।
-কি বলবো । ওর বড় বড় তিনটা ভাই ছিলো । এলাকায় খুব প্রভাবশালী । বিয়ের আগেই একবার পিটাইয়া আমার হাত ভাঙ্গছে । পরে পালিয়ে যখন বিয়ে করলাম তখন তারা প্রকাশ্যেই আমাকে মেরে ফেলার কথা বলতে লাগলো । যে বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম সেও দেখি ভয় পেয়ে গেছে আমাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বাসা থেকে চলে যেতে বললো । আমার তখন দিশেহারা অবস্থা । পকেটে একটা ৫০০ টাঁকার নোট নিয়ে সকালে বের হলাম । তখনই মনে হলো যদি মরেই যাই অন্তত সারা শহরের মানুষ জানুক যে আমি বিয়ে করেছি । সেই জন্যই এই কাজ । মাইকিং অবশ্য বেশীক্ষণ করতে পারি নাই । অল্পক্ষণ পরেই ওর এক ভাইকে দেখে দৌড়ে পালাই । অনেক অনেকদিন পরে গল্পটা বলতে বেশ ভালো লাগলো সবুজের । শান্তার দিকে তাকিয়ে দেখে সেও আগ্রহ নিয়ে শুনছে । হায় অথচ মাত্র দশটা বছর...কতকিছু বদলে যায় ।
-ঐ আধা ঘন্টার মাইকিং সারা শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে দিলো । ঝুমা বলা শুরু করে ।
-পরেরদিন সকাল থেকেই একদল তরুন তরুনী লেগে গেলো প্যান্ডেল সাজাতে । আর একদল বাজার সদাই করতে । সব করা হলো চাদা তুলে । আমার এক ভাইও ছিলো ঐ দলে । বাবা বাসা থেকে বের হতে আমিও যোগ দিলাম । প্রায় চার হাজার লোক হয়েছিলো । অধিকাংশই তরুন তরুণী । কিন্তু শান্তা কিংবা সবুজ ভাইয়ের কোনো খবর নাই । সবাই বলাবলি করছে সবুজ ভাই এলে একটা খুনাখুনি হয়ে যাবেই । কি যে উত্তেজনা । তিনটার দিকে সবুজ ভাই আর শান্তা আসলো । সবুজ ভাইয়ের পরনে একটা ময়লা ঘিয়ে রঙয়ের পাঞ্জাবী আর শান্তা একটা কলা পাতা রঙয়ের শাড়ী পরে । কিন্তু এই সাধারন পোশাকেই কি যে সুন্দর লাগছিলো দুজনকে ।
-দেখেছেন গল্পটা বলতে গিয়ে কেমন চোখ চকচক করছে ঝুমার । ভাই আপনাদের এই গল্প আমার এই জন্যই মুখস্ত । হাসতে হাসতে বলে হানিফ সাহেব । এর মাঝেই শান্তার ফোন আসে । রুম থেকে বের হয়ে কথা বলে আসে শান্তা । কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এসে বলে...
-তোর কথাতো তেমন কিছু জানি না ঝুমা । আমার বিয়ের তিন বছর পরে শুনেছিলাম বিশাল এক বড়লোকের সাথে তোর বিয়ে হচ্ছে । কিন্তু আমরা তখন ঢাকায় চলে এসেছি । সবুজের অফিসের তখন অনেক কাজ আমিও মাত্র চাকুরী শুরু করেছি । তাই যেতে পারি নাই । হানিফ ভাই আপনাকে একটা কথা বলি ঝুমা কিন্তু আমাদের বান্ধবীদের মধ্যে সবচাইতে সুন্দরী ছিলো ।

-জানি জানি । সেকথাও আড়ে ঠারে আমাকে অনেকবার বলা হয়েছে । আমি একটু দেরীতেই বিয়ে করি তার উপর আবার এমন সুন্দরী । কিযে ভয়ে ছিলাম না ।
-ঢং করো না । দেরী করে বিয়ে করতে কে বলেছিলো ?
-কেউ বলে নাই তবে ঐযে একটা কৌতুক আছে না - চাকরি ও স্ত্রীর মাঝে বেশ মিল আছে-এক নম্বর মিল- একবার নিলে ছেড়ে দেওয়া কঠিন। দুই নম্বর মিল একটি থাকা অবস্থায় দ্বিতীয়টা নেওয়া কঠিন আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মিল হলো এটা ছাড়া সবই ভালো লাগে । তাই প্রথমে চাকুরী ছাড়লাম । তারপর ব্যবসা করে গুছাতে গিয়ে একটু সময় লাগলো আর কি ? আর আমিতো জানতামই তুমি অপেক্ষা করে আছো । হানিফ সাহেবের রসবোধ বেশ ভালো লাগে শান্তা এবং সবুজের ।
-রাখো তোমার ঢং করা কথা । শোন না শুনেছি বর এর বয়স বেশী, মাথায় চুল কম । আমিতো প্রথমে একেবারেই রাজী না । আমার দিলু খালার কথা মনে আছে তোর ।
-হ্যা গার্লস স্কুলের টিচার ছিলেন যিনি । তুইতো ওনাকে খুব পছন্দ করতি ।
-সেই দিলু খালাকে কি তুকতাক করছিলো আল্লাহই জানে । আমার কাছে দিলু খালা এমন প্রশংসা করা শুরু করলো আমি গলে গেলাম । বিয়ের রাতেই দেখি ভীষণ নাক ডাকে । তিনদিন পরে কক্সবাজার গেলাম বেড়াতে । পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো । আকাশে থালার মত চাঁদ । বাথরুমে ফ্রেস হতে ঢুকে ভাবি আজ সারারাত গল্প করা যাবে । অথচ বাথ্রুম থেকে বের হয়েই দেখি জনাব নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন । সে কি ঘুম তুই চিন্তাও করতে পারবি না । চিমটি কাটি ধাক্কা দেই । লাভের মাঝে লাভ হয় শুধু নাক ডাকার আওয়াজটা একটু কমে । ঘণ্টাখানেক চেষ্টা করার পরে এত খারাপ লাগা শুরু হলো । সারারাত কেঁদেছি । সেই থেকে শাস্তি হিসাবে প্রতিবছর কক্সবাজার নিয়ে আসি ।
-ভাই শান্তিমতো ঘুমানোও যে একটা অপরাধ হতে পারে বিয়ে না করলে জানাই হতো না । দুইজনের কপট ঝগড়ার মাঝে সুখটা চাপা থাকে না । ক্ষণে ক্ষণেই প্রকাশ পায় ।

-চা খেয়ে আর পোষাচ্ছে না । চলেন বুফে কার থেকে কফি খেয়ে আসি । হানিফ কিছুক্ষণ পরে বলে ।
-তুমি খাবা মানে আমাদের সবার জন্য নিয়ে আসবা ।
-ঠিক আছে মহারানী । বলে হানিফ আর সবুজ বের হয়ে যায় রুম থেকে ।

-তোকে তোর সংসারটা দেখে খুব ভালো লাগছেরে ঝুমা । শান্তা বলে ।
-হ্যারে । বেশ ভালোই আছি । প্রথমে কি যে ভয় পেয়েছিলাম । বয়স বেশী, অল্প কয়েকদিনেই বুঝলাম রুচিরও অনেক ফারাক । জানতাম অনেক এডজাস্ট করতে হবে । কিন্তু পারবো কিনা ভয়ে ছিলাম । কয়েকদিন যেতেই দেখলাম মানুষটা আসলে খুব ভালো । কেয়ারিং, দারুন রসবোধ খুজে খুজে এরকম অনেক ভালো গুনও পেয়ে গেলাম । তোর মতো কপালতো হয় নাই যে সব কিছু আগে থেকেই চেনা জানা । ঝুমার শেষ কথাটা শুনে নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে শান্তার । হায় চেনা মানুষই কত অচেনা হয়ে যায় ।


-আপনাদের দেখে বেশ ভালো লাগছে হানিফ ভাই । বুফে কারে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে সবুজ ।
-ভাই বইলেন না । প্রথমে কিযে ভয়ে ছিলাম । এমনিতেই আমার বয়স বেশী । বউ মহাসুন্দরী । প্রথম কয়েকদিনেই টের পেলাম মেজাজও খান্দানী । জানতাম অনেক এডজাস্ট করতে হবে ...কিন্তু কতটা সেটা জানতাম না । কয়েকদিন পরেই অবশ্য বুঝতে পারলাম মনটা আসলে খুব নরম আর খুব মায়াবতী । আপনার মত কপাল নাতো ভাই যে সব আগে থেকেই চেনা জানা । হানিফ ভাইয়ের শেষ কথাটা শুনে নিজের অজান্তেই একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে সবুজের ।

-আপনারা আমার গিন্নীকে একটু বুঝান বিয়ের পরের প্রেমও প্রেম। খাঁটি প্রেম । কফি নিয়ে ফিরেই আবার শুরু করেন হানিফ সাহেব ।
-তুমি বলতে চাও সবুজ ভাই শান্তার প্রেম খাঁটি না ।
-ছি ছি এইটা আমি কখন কইলাম । আমি কইলাম আমার প্রেম খাঁটি । ধরো তোমার সাথে বিয়ের আগে প্রেম করলে মাসে-সপ্তাহে একদিন কিছু সময়ের জন্য দেখা করতাম । চেষ্টা করতাম যতটা সম্ভব তোমাকে ইমপ্রেস করতে । নিজের অজান্তেই করতাম । তুমিও একই কাজ করতে । সবাই করে । তারপর বিয়ের পরে যখন দেখতা রাত আটটার সময় নাক ডাইকা ঘুমাই তখন বলতা ‘আরে এই লোকরে তো আমি ভালোবাসি নাই ‘ ব্যস কেচালের শুরু ...
-হইছে অনেক প্রেম বিশারদ হইছো প্রেম না কইরাই । ঝুমা মাঝখানে থামাইয়া দিলেও শান্তা আর সবুজের কোথায় যেনো দাগ কেটে যায় হানিফ সাহেবের হাল্কাভাবে বলা কথাগুলো ।

এরপরেও জোর আড্ডা চলতে থাকে । এভাবেই প্রথমে চট্টগ্রাম এবং আরো পরে কক্সবাজার পৌছানো হয় । দুই পরিবারের হোটেল ভিন্ন বলে কক্সবাজারে এসে যার যার হোটেলে ওঠে । হোটেলের রুমে ঢুকে মোবাইল অন করে শান্তা দেখে খালেদ চারবার কল করেছে । ঘুমন্ত তুষারকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে শান্তা খালেদকে ফোন করে । সবুজের সামনেই । সবুজও ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে যায় ...নিশ্চয় রুনিকে ফোন করবে ।
-এইতো মাত্র পৌছালাম । খালেদ ফোন ধরতেই বলে শান্তা ।
-ফোন বন্ধ ছিলো নাকি । কয়েকবার চেষ্টা করলাম ।
-ফোন বন্ধ ছিলো না রিংগার অফ ছিলো ।
-তোমরাতো চারদিন পরে ফিরছো । মনে আছেতো ?
-হ্যা । সব মনে আছে । এখন রাখি ।

ছেলে তুষারকে আর ওঠানো সম্ভব না বলে দুজনে রুমেই খাবার খেয়ে নিলো । আততায়ী নিঃশব্দতার মাঝে । দুজনের মনের মাঝেই অনেক কিছু হয়ে যাচ্ছে । দুজনে খুব স্বাভাবিকভাবে বেড়াতে আসলেও মনে মনে জানে এটাই শেষ কয়েকদিনের একত্র জীবনযাপন । বিছানার দুই প্রান্তে যোজন যোজন দুরত্বে শুয়েও ঘুম আসে না শান্তা আর সবুজের ।

তাহলে কি আসলেই এডজাস্টের কোনো চেষ্টা ছিলো না নিজেদের মধ্যে ? শান্তাকে কেনো সবসময় নিষ্ঠূর নির্দয় মনে হতো । সবুজ নিজে কি খুব আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে ? খালেদ কিংবা রুনি যে আসলে কোনো ব্যাপার না সেটা সবুজ ঠিকই বুঝতে পারে ।

সবুজের খারাপ দিকগুলোই কেনো বেশী চোখে পরতো ? প্রেম-বিয়ের যুদ্ধে কি সবুজ ক্লান্ত হয়ে গেছিলো আর সেজন্যই কি নিঃস্পৃহতা । ওর নিজের মধ্যেও কি কোনো শিথিলতা ছিলো... এসব ভাবতে ভাবতেই সকাল হয়ে যায় ...নির্ঘুম ।

-বাবা কখন সমুদ্র দেখতে যাবো ? ঘুম থেকে উঠেই তুষার জিজ্ঞেস করে ।
-এখনই যাবো বাবা । শান্তা চলো । সমুদ্র দেখে ফিরেই নাস্তা করবো । শুনে ভালো লাগে না শান্তার । অনিয়ম খুব অপছন্দ শান্তার । বিশেষ করে তুষারের ব্যাপারে । কিন্তু কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায় শান্তা ।
-চলো । ছোট করে উত্তর দেয় শান্তা ।

নিজের মাফলারে শক্ত করে তুষারের চোখ বেধে সমুদ্রের কাছে যায় তিনজন । সবুজের এই অতি নাটকীয়তা সবসময়ই ছিলো । মনে আছে প্রথম যখন কক্সবাজারে আসে তখনো সবুজ নিজের আর শান্তার চোখ বেধে এক ভদ্রলোককে অনুরোধ করে অন্ধের মত হেটে হেটে সমুদ্রের পারে এসেছিলো । হয়তো বিয়ের মাইকিংটাও ওরকমই অতি নাটকীয়তারই প্রকাশ । আচ্ছা তখন এত ভালো লাগতো কেনো ? খুব ধীরে ধীরে তুষারের চোখ খুলে দেয় সবুজ । গভীর আগ্রহ নিয়ে শান্তাও দেখে । বিস্ময় আর আনন্দ মিলে মিশে একাকার ছোট তুষারের চোখে । সাত বছর আগে ঠিক একই চোখে সবুজও প্রথম সমুদ্র দেখেছিলো । ছোট ছোট ভীরু পায়ে তুষার এগিয়ে যায় সমুদ্রের দিকে ...হায় এওতো একেবারে সবুজের মত । সবুজ সাথে সাথে যায় । শান্তা স্তব্দ হয়ে দেখতে থাকে । সবুজের কোলে বসেই তুষার প্রথম সমুদ্রের পানি ছোয় । অল্প কিছুক্ষণ পরেই বড় একটা ঢেউ সবুজ-তুষারের মাথার উপর ভেঙ্গে পরে । এক মুহূর্তের জন্য দুজনকে দেখা যায় না । কেমন তীব্র আতংকে ছেয়ে যায় শান্তার মন । একটু পরেই দুজনেই ফিরে আসে । কাছে এসে থু থু করতে থাকে তুষার ।
-থুথু ফেলো না বাবা। পানি দিয়ে কুলি করো । বলে শান্তা সাথে করে নিয়ে আসা পানির বোতলটা দেয় তুষারের হাতে ।
-মা সমুদ্রের পানি এত লবন কেনো ?
-জানি না বাবা ।
-এত পানিতে এত লবন কে মেশালো মা ? প্রশ্নটা শুনে সবুজ-শান্তা একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে । সাত বছর আগে এখানেই ঠিক এই প্রশ্নটাই সবুজকে করেছিলো শান্তা । ঠিক একইভাবে । দুজনেরই মোবাইল বাজতে থাকে । কেউ ধরার আগ্রহ দেখায় না ।

অবোধ বালক এখনও খেয়াল করে নাই চোখের জলের স্বাদও লোনা । চোখের জলেই বা কে লবন মেশালো ?
 
Back
Top