- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 407
- Messages
- 5,564
- Reaction score
- 2,011
- Points
- 3,913
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
কালকুট
(অন্তর্জাল হতে সংগৃহীত)
(অন্তর্জাল হতে সংগৃহীত)
এ জীবনে আমি প্রেমে পড়েছিলাম দুইবার।
একবার বই এর, দ্বিতীয়বার এক নাম না জানা মানুষের।
২০১১ সালের কথা। আমার তখন সবেমাত্র এসএসসি শেষ। তিনমাসের বিশাল ছুটি পেয়েছি। এই তিনমাস ভালোভাবে কাটানোর জন্য অনেক গুলো লেখকের লিস্ট করে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম এক এক করে পড়ব সব। কিন্তু বাধ সাধলো ছোটোমামার পাঠানো পার্সেল। মামা লন্ডনে থাকতো তখন। বছরে দুইবার বিশাল পার্সেল পাঠাতো। সেখানে সবার জন্যই কিছু না কিছু থাকতো।
সেবারে আমার জন্য এলো একটা ল্যাপটপ। আস্ত একটা ল্যাপটপ। ল্যাপটপ তখন খুব রেয়ার। কাজেই ল্যাপটপ হাতে পেয়ে আমি যেন আকাশের চাঁদ পেলাম। একদিকে তিনমাসের ছুটি, আরেকদিকে নতুন ল্যাপটপ-একদম সোনায় সোহাগা যাকে বলে।
২০১১ তেই ফেসবুক আইডি খুললাম, একদম কৌতুহল এর বশে। বাসার কেউই জানেনা। সেসময় ফেসবুক চালানোটা মনে হতো বিশাল অপরাধের কিছু। তার ওপর আমি মেয়ে। তখনের দৃষ্টিভঙ্গি এমন ছিলো যে ভালো মেয়েরা ফেসবুক চালায়? একারণে ফেইক একাউন্ট খুললাম। নাম দিলাম ‘'দীপাবলির সাতকাহন”। সবেমাত্র উপন্যাসটা শেষ করেছি। আমার চোখেমুখে তখন দীপাবলির ঘোর। স্বপ্নে জলপাইগুড়ি ঘুরে বেড়াই, কোলকাতা চষে বেড়াই। আর বাস্তবে ঘাঁটি ফেসবুক। নতুন নেশা হয়ে গেলো এই ফেসবুক।
সাতকাহন মানে কী সেটা তখনো জানতাম না ভালো করে। ভেবেছিলাম সাতকাহন মানে সাতটা কাহিনি। কিন্তু আসল অর্থটা জানালো সেই মানুষটা। যার নাম আমি জানিনা, দেখতে কেমন জানিনা, কোথায় থাকে তাও জানিনা। কিন্তু ওই কাঁচাবয়সে এমনভাবে তার প্রেমে পরে গেলাম যে এ জীবনে আর কাউকে ভালো লাগলোনা!
মানুষটার ফেসবুক একাউন্টের নাম ছিলো ‘কালকূট’। শুধু এতটুকুই। অদ্ভুত লেগেছিলো। একসেপ্ট করতেই তিনি নিজে থেকেই মেসেজ দিলেন। শুরুর দিকের কথাগুলো খুব স্পষ্ট মনে করতে পারিনা এখন। কিন্তু যতটুকু মনে পরে আমার আইডির নাম নাকি ইউনিক লেগেছিলো তার কাছে। এমনটা নাকি সচরাচর দেখা যায়না ফেসবুকে। সেই মানুষটার কাছেই জানলাম সাতকাহন অর্থ সাতটা কাহিনি না। কাহন একটি পরিমাপের একক। কিভাবে গুণভাগ করে বুঝিয়েছিলেন পুরোপুরি মনে নেই। কিন্তু সাতকাহন এর শাব্দিক অর্থ তিনি করে দিলেন- ‘'অপরিমাপযোগ্য’'
এই মানুষটা দুইদিনের মাথায় আমার ঘুম হরণ করে নিলেন।
সারাটা রাত মেসেজে কথা বলতাম আমরা। আমার বয়স তখন ১৬, ফেসবুকে দেয়া ১৮। মানুষটার বয়স ফেসবুকে দেয়া ২১, বাস্তবে কত জানিনা। আমি সদ্য এসএসসি পাশ করা কিশোরী। উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণ। উনার সম্পর্কে শুধু এতটুকুই জানতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ, থার্ড ইয়ার। আর কিচ্ছু না। আমি তার চেহারা দেখিনি। নাম জানিনা।
শুধু জানি একটা শব্দ- কালকূট। পরে উনি বলেছিলেন কালকূট শব্দ অর্থ বিষ। সেই কালকূট আমি পান করেছিলাম ২০১১ সালে। আজও আমার পুরো শরীর কালকূটে নীল হয়ে আছে।
আমাদের প্রেম হওয়ার কথা ছিলোনা। যদিও আমরা রাতজেগে অনেক গল্প করতাম। কিন্তু আমাদের নিজস্ব কোনো অনুভূতি ছিলোনা সেসব গল্পে। আমরা কেউ নিজেদের গল্প করতাম না। সদ্য এসএসসি পাশ করা একটা মেয়েকে উনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন চার্লস বুকোস্কির সাথে, বুদ্ধদেব বসুর সাথে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সাথে, কাফকার সাথে, নেরুদার সাথে, লিওনার্ড কোহেনের সাথে, বব ডিলানের সাথে, রবার্ট ফ্রস্টের সাথে। মন খারাপের সব কবিতার সাথে। আমি ভেবেছিলাম উপন্যাস আমার সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু উনি আমাকে অদৃশ্য আঙুল ছুঁয়ে নিয়ে গেলেন কবিতার রাজ্যে। কি সব মন খারাপ করা কবিতা পড়াতেন!
আমাকে প্রায়ই বলতেন, ‘জানো দীপা, কবিতার সবচেয়ে সুন্দর নাম কবিতা।’
আমি বুঝতাম না ভালো করে। উনি বোঝাতেন, ‘ইংরেজিতে কবিতাকে বলে পোয়েট্রি। উর্দুতে শায়েরি, আরবিতে আশশির, জার্মানে গেদিখট, রাশিয়ানে স্তিখাতাভরেনিয়ে, চায়নিজে শি। কি অদ্ভুত নাম, তাইনা?
তোমার বুকের ভেতর ঝড়, তোমার বুকের ভেতর ধূ ধূ শূন্যতা, তোমার বুক যুদ্ধাহত রক্তাক্ত ময়দান। তুমি এসবের প্রতিফলন ঘটাবে যেখানে, সেটার নাম যদি পোয়েট্রি হয়, গেদিখট হয়, স্তিখাতাভ্রেনিয়ে হয়, তাহলে ভালো লাগবে? কিন্তু বাংলা ভাষায় দেখো, আমরা একে বলি কবিতা। কি সুন্দর, তাইনা?’
তার সাথে আমার কথোপকথন এগোতো, আর আমার মধ্যরাত ভরে উঠতো একশ একটা নক্ষত্রে। উনি আমাকে বলতেন, ‘দীপা জানো, নক্ষত্রেরও মৃত্যু হয়?’
আমি হেসে বলি, ‘ জানিতো। জীবনানন্দ দাশ তো বলেই গেছেন, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়..’
উনি সাথে সাথে প্রতিবাদ করে ওঠেন, ‘উহু, কবিতায় নয় দীপা। সত্যি সত্যি নক্ষত্র মরে যায়। সুপারনোভা মরে গেলে প্রচন্ড বিকিরণ ছড়ায়। পৃথিবী থেকেও দেখা যায় সেটা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সেই আলো পৃথিবীতে আসতে লক্ষ লক্ষ বছর লেগে যায়। কখনো যদি দেখো রাতের আকাশ দিনের মতো উজ্জ্বল হয়ে গেছে, তাহলে বুঝবে লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে কোন একটা নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটেছে। সেদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে আমাকে মনে পরবে তোমার?’
প্রতিরাতে আমাদের গল্প হতো। রাশিয়ান কোনো কবি, কোনো লেখক, কোনো বই, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি সবকিছু নিয়ে কথা বলতাম আমরা।
আমার প্রথম প্রেম ছিল বই। উনার সাথে পরিচয় এর পরে আমার সেই প্রেম আরো শক্ত হলো। কিন্তু এবারে বই এর প্রতি নিখাদ টান থেকে নয়। বরং তার সাথে প্রত্যেকটা কথা আমাকে বই এর দিকে ফিরতে বাধ্য করতো। এত সুন্দর করে গল্প করতে পারতেন উনি!
এই গল্পের মায়া আমাকে তার প্রেমে ফেললো। আমার বয়সটা তখন কাঁচা। কিন্তু আমি জানি যেকোনো বয়সের কেউই তার সাথে একবার কথা বললেই তার প্রেমে পরতে বাধ্য।
আমার দ্বিতীয় প্রেম হলেন সেই মানুষটা। কিন্তু এই মানুষটাও যে আমার প্রেমে পড়ে যাবেন, এমনটা কখনো ভাবিনি আমি। কিন্তু সেটাই হলো। আমরা দুজন তীব্রভাবে দুজনের প্রেমে পড়ে গেলাম।
আমি তার চেহারা দেখিনি। নাম জানিনা। মানুষটা আমাকে ডাকেন দীপা বলে।
তাকে বলতে ইতস্তত করি, যে আমার নাম দীপা না। আমার নাম খুব সেকেলে- চামেলী। পাছে আমার নাম চামেলী জেনে উনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলুক! তবুও একদিন খুব দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার প্রিয় ফুল কোনটা?
তিনি খুব চালাকি করে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার প্রিয় ফুল দীপা’
কেঁপে উঠেছিলাম অজানা এক অনুভূতিতে! জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘'চামেলী ফুল কেমন লাগে আপনার?’'
উনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী ফুল হলো চামেলী। বর্ণহীন, হালকা সুগন্ধ, টুপ করে মাটির বুকে মুখ গুজে পড়ে থাকে। কবিতার যদি চেহারা থাকতো, তাহলে তা দেখতে হতো চামেলী ফুলের মতো।’
শুনে আমার হৃদয় ভরে ওঠে ভালোবাসায়। বলতে ইচ্ছে করে আমিই সেই কবিতা, আমিই সেই চামেলী। আপনি মাটি হয়ে আমার জন্য বুক পেতে থাকবেন?
বলা হয়ে ওঠেনা। বলা হয়ে ওঠেনা যে আমার বয়স আঠারো না। আমি সবে ষোলো পার করেছি। বলা হয়ে ওঠেনা, আমি এসএসসি দিয়ে কলেজে উঠলাম। সময় গড়ায়। দুটো মানুষ কেউ কাউকে না দেখে ভালোবেসে যেতে থাকে। স্বপ্ন দেখতে থাকে। একটা বিকেলের। একটা নদীর।
‘তুমি ময়ুরাক্ষী নদীর নাম শুনেছো?’
আমি হ্যাঁ বলি। উনি বলেন, ‘হিমুর ছিলো ময়ুরাক্ষী নদী, আমার আছে চিত্রা নদী। চিত্রা নদীর পাশে বসে তোমাকে আমি আমার লেখা গান শোনাবো।’
আমি কল্পনায় চিত্রা নদীর ছবি আঁকি।
২০১১ পেরিয়ে ২০১২ আসে। দিনটা এখনো মনে আছে। ফেব্রুয়ারীর ২৯ তারিখ। উনি আমাকে বলেছিলেন পরের ২৯ ফেব্রুয়ারিতে আমাকে নিয়ে চিত্রার পাড়ে যাবেন। উনি পরবেন নীল পাঞ্জাবি, আর আমি সাদা খোলের শাড়ি। আমার হাত ধরে বসে থাকবেন পুরো বিকেল, সন্ধ্যা। তারপর আমরা ফিরব একই বাড়িতে। ছোট্টো একটা রুম হবে আমাদের। একটা বুকশেলফ, একটা রকিং চেয়ার, একটা ওক কাঠের টেবিল, দুটো মাটির চায়ের কাপ, আর একটা বিছানা-আমাদের। তারপর যে কথাটা বলেছিলেন, সেটা শুনে লজ্জায় কান গরম হয়ে গিয়েছিলো আমার।
আমাদের কাল্পনিক সংসার চলছিলো। আমি ততদিনে পূর্ণেন্দু পত্রী পড়তে শিখে গেছি। আমি তাকে ডাকি শুভঙ্কর। আর তিনি আমাকে নন্দিনী। আমি কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে টাইপ করি, ‘তুমি আজকাল বড্ড সিগারেট খাচ্ছো, শুভঙ্কর।’
ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসে, ‘এক্ষুণি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি, কিন্তু তার বদলে?’ আমি লজ্জায় ল্যাপটপ বন্ধ করে রাখি।
আমাদের দেখা করার কথা চলছিলো। আমাদের বাসাটা পুরানা পল্টনে। আর শুভঙ্কর থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। দেখা করার দিনক্ষণ ঠিক করা হচ্ছিলো। আমাদের প্রথম দেখা। স্মরণীয় হতে হবে। আকাশ মেঘলা থাকতে হবে। যেন আমাদের দেখা হওয়া মাত্রই ঝুম বৃষ্টি নামে। বৃষ্টিতে ভিজে দুজন হাঁটবো-বেইলি রোড, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ফুলার রোড। দুজনের চুল থেকে টপটপ করে পানি পরবে। তারপর শুভঙ্কর আমার চুলের পানি ঝেড়ে দিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে আবৃত্তি করবে, ‘'এমনও দিনে তারে বলা যায়.. এমনও ঘনঘোর বরষায়'’
কিন্তু তার কিচ্ছু হলোনা। এক রাতে বাবা আমার ল্যাপটপ আছাড় মেরে ভেঙে ফেললো। ভাঙবে না-ই বা কেন!
ওই বয়সী একটা মেয়ে, পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিনরাত ল্যাপটপের সামনে বসে থাকে, খটাখট করে টাইপ করে, রহস্যময় ভঙ্গিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হাসে, রাতে ঘুমায় না। এসব লক্ষণ বাবা-মা বুঝবে না?
কয়েকদিন পর মোড়ের কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে আমি চেষ্টা করেছিলাম আমার ফেসবুকে লগিন করার। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম যে আমার একাউন্টের পাসওয়ার্ড কী ছিল আমি ভুলে গেছি। মনে করার চেষ্টা করলাম কতভাবে, মনে হলোনা!
এবং আমি বুঝে ফেললাম শুভঙ্করকে হারিয়ে ফেলেছি আমি।
এরপর শুভঙ্করের সাথে আমার সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো। দেড় বছর এর পরিচয়, ছয় মাসের প্রেম। প্রেমের কোনো ইতি টানিনি আমরা। কেউ কারো হৃদয় ভাঙিনি। ঝগড়া করে মান অভিমান করিনি। কিন্তু আমাদের প্রেম থমকে গেলো। যেন একটা রেলগাড়ি ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে মাঝপথে থেমে আছে।
কোনোভাবেই পারিনি শুভঙ্করের সাথে যোগাযোগ করতে। শুধু বারবার মনে হতো শুভঙ্কর জানেনা কেন তার নন্দিনী যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো, সে জানেনা কেন তার দীপাবলির সাতকাহন থেমে আছে। এটা ভেবে কষ্ট আরো বেশি পেতাম। কলেজ ফাঁকি দিয়ে ছুটে যেতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা বিভাগে। কেউ বুঝতো না কেন কলেজড্রেস পড়ুয়া একটা মেয়ে ভার্সিটির বারান্দায় ঘুরঘুর করছে, ক্লাসরুমে উঁকি দিচ্ছে। প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটতাম ফুলার রোডে, ভিসি চত্বরে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। কেউ একটু কৌতুহলী চোখে তাকালে দৌঁড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, আপনি কি জানেন জার্মান ভাষায় কবিতাকে কী বলে?
ভার্সিটির প্রায় অর্ধেক ছাত্রছাত্রী জেনে গেলো নীল সাদা ইউনিফর্ম পরা একটা মেয়ে সবাইকে কবিতার কথা জিজ্ঞেস করছে। তবুও শুভঙ্করকে খুঁজে পাইনি আমি।
এরপর খুব জেদী হলাম পড়াশোনায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হলাম। ভার্সিটিতে এসে প্রথম একটা নিজের ফোন হলো। আসল ফেসবুক একাউন্ট হলো একটা। হাজারবার ‘কালকূট’ লিখে সার্চ করেছি। কিন্তু পাইনি আমার কালকূটকে। যেন এক পাহাড়সম অভিমান বুকে নিয়ে সে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।
ভার্সিটিতে আসার পর কালকূটকে খোঁজার চেষ্টা আবার শুরু করেছিলাম। ওর কথা শুনে মনে হতো ও থিয়েটার করতো, আমি ঢাবির নাট্য সংসদে যোগ দিলাম। ওর যুক্তিতর্কের উপস্থাপনা দেখে আমার মনে হতো ও বিতর্ক করতো। আমি বিতর্ক সংসদে যোগ দিলাম। ওর চিন্তাধারা মনে হতো বামপন্থী। আমি ধীরে ধীরে বাম রাজনীতির সাথেও জড়িয়ে পরলাম। উদ্দেশ্য একটাই। কোনোভাবে যদি ওর কোনো খোঁজ পাই আমি!
বাংলা বিভাগে নিয়মিত যাতায়াত করতাম। যদিও ততদিনে কালকূটের অনার্স মাস্টার্স শেষ হওয়ার কথা! তবুও মনে ক্ষীণ আশা ছিলো, যদি কোনো খোঁজ পাই!
পাইনি খুঁজে।
সাতটা বছর অপেক্ষা করেছি। সাত বছরে আমার কলেজ শেষ, অনার্স শেষ, মাস্টার্সও শেষ। বেসরকারি একটা কলেজে ঢুকেছি লেকচারার হিসেবে। বাড়ি থেকে বিয়ের তোড়জোড় করছে। কিন্তু পাত্র পছন্দ হচ্ছে না আমার। হবে কী করে? শুভঙ্কর যে স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দিয়ে গেছে, ওর ধারেকাছেও তো কাউকে পাইনা। অথবা হয়তো খুঁজিইনি। একের পর এক পাত্র রিজেক্ট করতে থাকলাম। কারণ একটাই- ওদের মধ্যে কেউ জানতো না কবিতার রাশিয়ান প্রতিশব্দ কী, কেউ জানতো না কোন ফুল কবিতার মতো বিষণ্ণ, কেউ জানতো না নক্ষত্রের মৃত্যু হলে কী হয়।
আত্মীয় স্বজন, আমার কলিগরা- অনেকেই এরমধ্যে ভাবা শুরু করেছে বই পড়তে পড়তে আমি পাগল হয়ে গেছি। এরমধ্যেই একদিন এক কলিগের বাসায় দাওয়াত পেলাম। তার মেয়ের জন্মদিন। যেতেই হবে।
যেতাম না। এসব ভীড়, হৈচৈ আমার ভালো লাগেনা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কী মনে করে যেন গেলাম। ভাগ্যিস গেলাম!
জন্মদিনের উৎসব। চারপাশে উজ্জ্বল আলো, অসংখ্য বেলুন, আমরা কয়েকজন কলিগসহ তাদের কিছু কাছের আত্মীয়, আর অনেক বাচ্চাকাচ্চার হৈ হুল্লোড়। কেক কাটা হবে।
সমস্ত লাইট নিভে গেলো। জ্বলে উঠলো অনেকগুলো মোমবাতি। সেই মোমের আলোয় আমি দেখলাম চোখদুটো। আগুনের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ধূসর চোখের মণিতে। কি ছিলো ওই চোখে, কে জানে! আমি চোখ ফেরাতে পারিনি।
চোখাচোখি হয়ে গেলো। সেই চোখদুটোও তাকিয়ে রইলো আমার দিকে একদৃষ্টে। বুকটা ধ্বক করে উঠলো আমার। অনেকদিন পর। আর অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হলো একটা শব্দ- কালকূট!
না, কালকূট এর চেহারা আমি দেখিনি কোনোদিন। ওর চোখ কেমন আমি জানিনা। যে মানুষটির চোখের দিকে আমি সেই সন্ধ্যায় তাকিয়ে ছিলাম, সেই মানুষটার নাম মুনিম।
মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল, বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ, মুখভর্তি দাঁড়ি গোঁফ, আর ঠোঁটের কোণায় একটা হাসি। মানুষটির সাথে আমার কথা হয়নি সেদিন। কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিলো এই মুনিমই আমার কালকূট।
তারও অনেক পরে একদিন আবার বিয়ের প্রস্তাব এলো একটা।
পাত্র আর কেউই নয়- মুনিম নামের মানুষটা।
আমাদের কথা বলতে দেয়া হলো আলাদা করে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘চামেলী, বলো তো, পৃথিবীর সবচেয়ে বিষণ্ণ ফুল কোনটা?’
আমি চমকে উঠে তাকালাম তার দিকে, পূর্ণদৃষ্টিতে। মানুষটা হাসছে। মনে হলো এই হাসি আমার চিরচেনা। হঠাৎ আমার হৃদস্পন থেমে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। চোখ ভর্তি হয়ে গেলো জলে। আমি যন্ত্রের মতো বললাম, ‘'পৃথিবীর সবচেয়ে মন খারাপ করা ফুল হলো চামেলী, বিষণ্ণ কবিতার মতো, একরাশ দুঃখ বুকে নিয়ে যে মাটির বুকে ঝরে পরে’’
এরপর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবিতার রাশিয়ান প্রতিশব্দ কী বলো তো?’
হঠাৎ আমি দেখলাম আমি কাঁদছি। কথা বলতে পারছিনা। মুনিম একটু হেসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। আমি তখন পাগলের মতো বলে যাচ্ছি, ‘আমি আপনাকে অনেক খুঁজেছি, কালকূট। কোথাও খুঁজে পাইনি। আমার ল্যাপটপটা ভেঙে ফেলেছিলো বাবা। আমি আমার আইডির পাসওয়ার্ডও মনে রাখিনি। আমি পারিনি আপনার সাথে যোগাযোগ করতে।’
আরও কতক্ষণ একনাগাড়ে বলে গেলাম সব। কিভাবে কিভাবে খুঁজেছি, কতদিন কোথায় বসে থেকেছি, সবটা। মুনিম আমার হাত ধরে চুপচাপ পুরোটা শুনে গেছে। আমার সব কথা শেষ হলেও চুপ করে থাকলেন তিনি। তারপর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি এসে গেছি তো, এখন সব ঠিক হয়ে যাবে’