- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 407
- Messages
- 5,564
- Reaction score
- 2,011
- Points
- 3,913
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
হলুদ বসন্ত
মূল লেখকঃ বুদ্ধদেব গুহ
মূল লেখকঃ বুদ্ধদেব গুহ
পর্ব - ১
ফোনটা বাজছিল।
অন্য প্রান্তে ফোনটা কুরর্–কুর্ কুরর্—কুর্ করে কোনও মেঘলা দুপুরের কামাতুরা কবুতরের কথার মতো বাজছিল। শুনতে পাচ্ছিলাম। এখন রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। টেলিফোনটা ওদের বাড়ির সিঁড়িব কাছে আছে। এখন বাড়িতে কে কে থাকতে পারে? সুজয় নিশ্চয়ই আড্ডা মারতে বেরিয়েছে। কদিন বাদে দোল। পাড়ায় দোল-পূর্ণিমার ফাংশন হবে। তাই নিয়ে পাড়ার রুস্তমরা ব্যস্ত। ফাংশন না কচু। ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে রেলিশ করে কিছু মেয়ে দেখা। রুস্তমদের রং ফিকে হয় না। বুকের নোম পেকে গেলেও না। বেশ আছে ওরা। টেরিলিন-টেরিকটে মোড়া বৃদ্ধ বালখিল্যের দল। নয়নার মা নিশ্চয়ই ঠাকুরঘরে চুপ করে বসে আছেন। এমন ভাব, যেন পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনা-দুর্ঘটনা সব ওই ঠাকুরঘরের কন্ট্রোলরুম থেকেই রেডিয়ো কন্ট্রোলে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
ফোনটা বাজছেই—বাজছেই–বাজছেই।
নয়না এখন কী করছে? বোধহয় ঘুমুচ্ছে। সারাদিন পরিশ্রম তত কম নয়। নয়নার কথা ভাবলে আশ্চর্য লাগে। ওর সমবয়সি মেয়েদের পটভূমিতে ও বর্ষার জল-পাওয়া মৌরলা মাছের মতো লাফায়, অথচ ও আমার কাছে এলে শীতের সংকোশ নদীর ঘরেয়া মাছের মতো ধীরা হয়ে থাকে। আস্তে মাথা দোলায়, আলতো করে চোখ তুলে চায়, মুখে যত না বলে, চোখ দিয়ে তার চেয়ে বেশি কথা বলে। ওকে বুঝতে পারি না–ওকে একটুও বুঝতে পারি না। অথচ ওকে কী করে বোঝাই যে ওর এক চিলতে হাসি, ওর এক ঝিলিক চোখ চাওয়া–এইসব সামান্য সামান্য দান আমার সমস্ত সকাল, আমার সমস্ত দিন কী অসামান্য মহিমায় মহিমামণ্ডিত করে তোলে। গত পাঁচ বছর ধরে কখনও এ কথাটা ওকে বোঝাতে পারিনি কিংবা ও বুঝলেও, না বোঝার ভান করে থেকেছে।
হ্যালো।–ওপার থেকে নয়নার মা’র গলা শোনা গেল। গম্ভীর, ঠান্ডা, নিরুৎসাহব্যঞ্জক গলা। অথচ ভদ্রমহিলা আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। বন্ধুর মা তো বটেই। আমি ফোন করলেই শুধোন, ওঁদের বাড়ি কেন যাই না–কাকিমার আর্থারাইটিস কেমন আছে? মিনুর বাচ্চাটা (২ নং) ভাল আছে কি না ইত্যাদি, ইত্যাদি। অথচ তবু, আমার ইচ্ছে করে না ওঁর সঙ্গে কথা বলতে। বোধহয় মনে পাপ আছে বলে। আচ্ছা, ভালবাসা কি পাপ? জানি না। বোধহয় অন্যায়ভাবে, জোর করে ভালবাসাটা পাপ। নইলে এমন ভীরুতা, চোর চোর ভাব, অন্যায় বোধ আসে কেন?আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার
আবার শুনলাম, হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো!
কোনও উত্তর দিলাম না। কেন দেব? আমি তো ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইনি। অফিস থেকে ফিরে, পায়জামা-পাঞ্জাবি চাপিয়ে আরাম করে সোফাটায় আসনপিড়ি হয়ে বসে পাখাটাকে আস্তে খুলে দিয়ে আমি নয়নার সঙ্গে কথা বলব বলেই ফোন ডায়াল করেছিলাম। আমি তো অন্য কাউকে চাইনি। আমি তো অন্য কাউকে চাই না।
ভাবলাম, রিসিভার নামিয়ে রেখে দিই। কিন্তু হঠাৎ দেহাভ্যন্তরীণ কোনও যান্ত্রিক গোলযোগে অনিচ্ছায় মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, হ্যালো। আমি ঋজু।
কী ব্যাপার? লজ্জায় মরে গেলাম। ইস। তবে কি ওঁর কাছেও ধরা পড়ে গেলাম? বললাম, কোনও ব্যাপার নেই। মানে, নয়না আছে? গতকাল আপনাদের ওখানে গিয়েছিলাম–বসবার ঘরে আমার দেরাজের চাবিটা বোধহয় ফেলে এসেছি। পাচ্ছি না।
মাসিমা আবার শুধোলেন, তোমার গাড়ির চাবি ফেলে গেছ?
আমি বললাম, না। দেরাজের চাবি। (গাড়ির চাবি ফেলে এলে আর গাড়ি চালিয়ে বাড়ি এলাম কী করে? যাচ্ছেতাই। কানে আজকাল কম শুনছেন।)
কোথায় ফেলেছ মনে আছে বাবা?
আমি বললাম, নয়নাকে একবার জিজ্ঞেস করুন না? কাল ও কাছে ছিল, গল্প করছিল।
দাঁড়াও। ফোনটা ধরো একটু।
শুনতে পেলাম, সিঁড়ির তলায় দাঁড়িয়ে মাসিমা নয়নাকে ডাকলেন। গমগম করে উঠল। যেমন গমগমে গলায় আমার মাথার মধ্যে নয়নার নাম শুনি আমি কোনও অসহ্য একলা গরম দুপুরে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি যাওয়ার আওয়াজ শুনলাম। রিসিভারের জালে ডাবল হর্নটা ঝমঝমিয়ে বেজে উঠল। একটু পরে নয়না এসে ফোন ধরল।
কী হল? হলটা কী?
আমার চাবি।
আপনার চাবি?
হ্যাঁ! আমার চাবিটা, দেরাজের চাবিটা: তোমাদের বাড়ি কাল ফেলে এসেছি। পাচ্ছেন না?
না।
জ্বালালেন। দাঁড়ান দেখি।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, সব তো দেখলাম, সোফার কোনা, মেঝে; এমনকী রাস্তায় যেখানে আপনার গাড়ি ছিল সেখানে অবধি। যদি গাড়িতে উঠবার সময় পড়ে গিয়ে থাকে, তাই ভেবে। কিন্তু নেই। পেলাম না।
নেই?
না। বললাম তো পেলাম না।
পাবে না।
মানে?
মানে আমার চাবি আমার সামনেই আছে। হারায়নি। বলেই টুং টুং করে চাবিটা রিসিভারের সঙ্গে বাজালাম।
ইস। কী খারাপ আপনি–ভারী অসভ্য। কেন অমন করলেন?
তোমার মা কেন ফোন ধরলেন?
মা কি যম?
আমার যম। আমার ভীষণ ভয় করে তোমার মাকে।
আমার মা’র মতো লোকই হয় না।
তারপর একটু খুশি খুশি গলায় বলল, তারপর? আপনার কী খবর বলুন?
আমি বললাম, আমার আবার কী খবর? তোমার সঙ্গে একলা কথা বলতে একলা দেখা করতে ইচ্ছে করে। ভাল লাগে। তাই অফিস থেকে ফিরে তোমাকে ফোন করলাম। তুমি বিরক্ত হলে?
না, আপনার ফোন এলে আমার ভাল লাগে।
আমার চিঠি পেয়েছ? পরশু পোস্ট করেছিলাম।
হুঁ।
কেমন লাগল?
ভাল।
শুধু ভাল?
ভীষণ ভাল।
একটারও জবাব দাও না কেন?
মানে, সময় হয়ে ওঠে না, তা ছাড়া আপনার মতো ভাল চিঠি লিখতে পারি না। ‘কেমন আছেন? ভাল আছি। কলেজের প্রিন্সিপাল আজ এই বললেন এই রকম চিঠি লেখার তো কোনও মানে হয় না। যেদিন আপনার মতো করে লিখতে পারব, সেদিন লিখব।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম।
কী হল? কিছু বলুন।
তুমি আমাকে ভালবাসো না কেন?
বাসি না?
না।
খুব.বাসি। (বলে একটা নিশ্বাস ফেলল।)
আমি অনুক্ষণ, অনুক্ষণ তোমার কথা ভাবি, তোমার কথা ভাবি, আর তুমি আমাকে একটুও ভালবাসো না।
তারপর আবার চুপ। কোনও কথা নেই। হঠাৎ নয়না বলল, ভালবাসলে কী করতে হয়?
কী জবাব দেব জানি না। ইচ্ছে হল বলি, চুমু খেতে হয়, আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টির মতো বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়–অনিমেষ আশ্লেষে অন্যের মধ্যে আপ্লুত হতে হয়। কিন্তু ওসব কথা বলা যায় না। একবার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলে আর ফেরানো যায় না। ঝড় একবার উঠলে নদীতে কত বড় বড় ঢেউ উঠবে তা আমি জানি না–সে ঢেউয়ে হাল ধরতে পারব কি না তাও জানি না। তবু খুব ইচ্ছে করল, বলি–যে কথা সব সময় বলতে চাই–ঘুমুবার সময় বলতে চাই, ঘুম ভেঙে বলতে চাই–কাজের ফাঁকে ফাঁকে বলতে চাই–সেই কথা বলবার জন্যে আমায় আমন্ত্রণ জানাল নয়না; অথচ আমি কিছুই বলতে পারলাম না। ভালবাসলে কী করতে হয় এই সরল সোজা প্রশ্নের উত্তরে বললাম, জানি না।
নয়না সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমিও জানি না।
একটুক্ষণ চুপচাপ।
আমি বললাম, তুমি কী শাড়ি পরে আছ?
বাজে; বাড়ির শাড়ি।
তবু, বলো না!
হলুদের মধ্যে কালো কাজের একটি কটকি শাড়ি।
আর জামা?
উঃ, জ্বালালেন আপনি। হলুদ জামা।
দাঁড়াও, মনে মনে আমার চোখের আয়নায় দাঁড় করিয়ে তোমায় দেখে নিই। বাঃ, ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তো। হুবহু একটি হলুদবসন্ত পাখি।
নামটা পছন্দ, কিন্তু আমি তো সুন্দর না।
তুমি সুন্দর না?
সবাই বলে।
সবাইর তো চোখ নেই। তোমার সৌন্দর্য সকলের জন্যে নয়।
থাক, বানিয়ে বানিয়ে বলতে হবে না। বাজে কথা রাখুন। টেনিস খেলতে গিয়ে পায়ে যে চোট লেগেছিল, এখন কেমন আছে?
কাল থেকে ভাল।
তবু, পুরোপুরি সারেনি তো?
না। এখনও একটু ব্যথা আছে।
কয়েকদিন না খেললে কী হয়? খেলোয়াড় যা, সে তো আমি জানি। যান তো অনেক সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে দেখতে। তাই না?
সব মেয়েকে আমার দেখতে ইচ্ছে করে না। তার চেয়ে ঘোড়ফরাস দেখতে আমি বেশি ভালবাসি।
উপমাটাও ভদ্রজনোচিত দিতে পারেন না? আপনি সত্যিই একটি জংলি হয়ে যাচ্ছেন।
আমি তো জংলিই।
বাঃ। খুব বাহাদুরির কথা, না? বাহাদুরি নয়। আমি যা, আমি তাই। তোমাদের সংজ্ঞায় সভ্য হতে চাই, সবসময় চেষ্টা করি; পারি না, সত্যি সত্যি পারি না।
চেষ্টা করুন, চেষ্টা করতে থাকুন। কঠিন কাজ কি কেউ একবারে পারে? ওঃ শুনুন মনে পড়েছে। আপনার সেই লেখাটা আমার বান্ধবী সুমিতার খুব ভাল লেগেছে। আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছে।
জানোই তো আমি যার-তার সঙ্গে আলাপ করি না। কিন্তু লেখাটা তোমার কেমন লেগেছে বলোনি তো একবারও?
আমার? আমার মত দিয়ে কী হবে?
তুমি জানো না কী হবে?
না। জানি না।
তুমি নিজে একটি জংলি। পৃথিবীসুদ্ধ লোক হাই ফাঁই অ্যামপ্লিফায়ারে চিৎকার করে আমাকে ভাল বললেও আমার যতটুকু না আনন্দ হবে, তুমি একা যদি আমায় ভাল বলো—আন্তরিকভাবে–তাতে আমার অনেক বেশি আনন্দ হবে।
তাই হবে বুঝি?
জানো নয়না, ছোটবেলা থেকে জনারণ্যের মুখ চেয়ে বড় হইনি–আজও মাত্র একজন দু’জনের দাক্ষিণ্যে বেঁচে আছি–যা কিছু করার করছি–তাই তাদের মধ্যে কেউ যদি ফাঁকি দেয়, তখন অন্ধের মতো দিশেহারা হয়ে পড়ি পথ দেখতে পাই না। কী করব বুঝতে পারি না। বুঝলে?
বুঝলাম, কিন্তু আমি কোনও অন্ধের যষ্টি হতে রাজি নই।
তা আমার মতো করে আর কে জানে?
কিছুক্ষণ চুপ।
কী করছিলে? ঘুমুচ্ছিলে?
না স্যার। আপনার মতো সবসময় ঘুমুই না। সোমবার পরীক্ষা। পড়ছিলাম।
কী পরীক্ষা?
উইকলি পরীক্ষা।
তা হলে তো এতক্ষণ কথা বলে অনেক সময় নষ্ট করলাম।
না। এতটুকুতে আর কী ক্ষতি হবে?
বললাম, তবু যাও পড়ো গিয়ে লক্ষ্মী, সোনা মেয়ে।
নয়না বলল, আচ্ছা। ও এমনভাবে ফোন ছাড়ার আগে আচ্ছা বলে, মনে হয় সুন্দর সুগন্ধি কোনও ভালবাসার চিঠিতে সিলমোহর দিল। চুমু খাওয়ার মতো মিষ্টি করে বলল, আ–চ্ছা!আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহারআপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার
তুমি ছাড়ো ফোন।
না। আপনি আগে ছাড়ুন।
ফোন ছেড়ে দিলাম।
এই মুহূর্তে আমার এত ভাল লাগছে যে কী বলব! আমার কী যে ভাল লাগে; কী যে ভাল লাগে। নয়নার সঙ্গে এই যে একটু কথা বললাম, এর দাম জানি না। কেন এমন হয় তাও জানি না। কীই বা জানি? কতটুকু বা জানি? শুধু জানি যে শোবার সময় যখন ফুরফুর করে বসন্তের বাতাস মাধবীলতাটায় দোল দিয়ে আমার নেটের মশারিতে ঢেউ তুলে উত্তরের জানালা দিয়ে পথে বেরোবে তখন আমি রাজার মতো, মহারাজের মতো, বিড়লার সমান বড়লোকের মতো আরামে, আবেশে, নয়নার উজ্জ্বল চোখ দুটি ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ব। সেই আনন্দের বদলে আমি আর কিছুই চাই না। কিছুতেই তো বিনিময় করতে পারি না।
.
০২.
এই একটা দিন। রবিবার। সারা সপ্তাহ এর মুখ চেয়ে থাকা। সপ্তাহে ছ’দিন সকাল আটটা থেকে রাত সাতটা করি। ভাল লাগে না। মাঝে মাঝে গা জ্বালা করে। কিন্তু ওই যে পুরুষালি জেদ। ক’জন তোক আর শুধু পয়সার জন্যে খাটে? খাটে লোকে জেদের জন্যে। আমি পারি, ভাল করে পারি, এইটে প্রমাণ করার জন্যে। বিজিতেনবাবু একদিন বলেছিলেন; তখন আমি ছেলেমানুষ; সবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে কারখানায় ঢুকেছি। বলেছিলেন, প্রফেশনাল ফার্মে গুডউইল নিজের নিজের তৈরি করে নিতে হয়–বাপ কাকার নামে চলে না। মামা বড় ইঞ্জিনিয়ার বলে লোকে আপসে ভাগনেকে বড় ইঞ্জিনিয়ার বলবে না। মানে, কটাক্ষ করে এমনভাবে কথাটা বলেছিলেন যে, মনে লেগেছিল। ভেবেছিলাম মামা বেচে খাব এই বা কেমন কথা? যে নিজের পরিচয়ে পরিচিত নয়, নিজের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত নয়, সে আবার পুরুষ কীসের? ব্যস। ওই জেদেই গেল। মাথার চুল পাতলা হল, চোখের কোনায় কালি জমল, চেয়ারে বসে বসে তলপেটে চর্বির আস্তরণ পড়তে লাগল। বিনিময়ে, বুকের কোনায় হয়তো কিছু আত্মবিশ্বাস জন্মাল।
সত্যি বলতে কী, এরকম সাফল্যে আত্মপ্রসাদ হয়তো আছে, কিন্তু আনন্দ নেই। বর্তমানটাকে পদদলিত করে নিজেকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করলাম বটে–কিন্তু কখনও কখনও–কাজের ফাঁকে ফাঁকে–টেলিফোনের রিসিভার কানে ধরে–কোনও কালোয়ারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ দূর দিগন্তে মনে মনে ছুটির ছবি দেখি কানে নিচু-গ্রামে ছুটির বাজনা বাজতে শুনি, তখনই মনটা কেঁদে ওঠে। ইচ্ছে করে গ্যাড়গিল এন্ড ঘোষ কোম্পানির মুখে লাথি মেরে, কাচের জানালা ভেঙে কোনও পাখি হয়ে উড়ে চলে যাই। কোনও সমুদ্র কিনারে। অনেকদিন আগে-যাওয়া গোপালপুরে। যেখানে আসন্ন সন্ধ্যার করুণ সুগন্ধি স্লানিমায়, সুনীল আকাশের পটভূমিতে শ্বেতা ফেনার বুদবুদ মেখে কেবলমাত্র নিজের আনন্দেই নিজে উড়ে বেড়াই। যেখানে আমার কোনও কর্তব্য নেই, আমার উপর কারও দাবি নেই। ইচ্ছে করে, নিজের মনের ইজেল বালুবেলায় সাজিয়ে অবসরের প্যাস্টেল কালারে, খুশির তুলিতে ছবির পর ছবি আঁকি।
রবিবারের Gun-club-এ একটা মেলা মেলা আবহাওয়া আছে। সারি দিয়ে সকলে বন্দুক দেখে নিচ্ছে। প্রথমে স্কিট-শুটিং, পরে ট্র্যাপ-শুটিং হবে। শুটিং-পজিশনে দাঁড়িয়ে উড়ন্ত ডিশকে গুঁড়িয়ে দেবার একটা আনন্দ আছে। মনে মনে অবচেতনে আমি যা পছন্দ করি না, আমি যা ঘেন্না করি, আমি যা সইতে পারি না–সেই সবকিছুকে আকাশ থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলোর সঙ্গে পড়তে দেখি। ভারী আনন্দ লাগে।
সুগত হাই-হাউসের নীচে দাঁড়িয়ে ওর পাখিকে ডাকল। শট-গানটা ডান থাইয়ের উপরে বসিয়ে শক্ত করে ধরে ডাকল–পুল। অমনি হাই-হাউস থেকে মাটির ডিস্ক বেরিয়ে গেল মেশিনে– সাঁই করে। যাচ্ছে, যাচ্ছে, যাচ্ছে–মুহূর্তের মধ্যে দূরে চলে যাচ্ছে–দুম। আকাশে গুঁড়ো হয়ে গেল। নীল আকাশের পটভূমিতে একমুঠো কালো ধুলোর মেঘ ফুটে উঠে বৃষ্টি হয়ে নীচে পড়ল।
এবার লো-হাউসের পাখি আসবে। সুগত রেডি হয়ে বলল, পুল–নিচু দিয়ে এবার সামনে থেকে উড়ে এল, কাদার ডিস্ক–এল এল; এল–একেবারে সামনে দুম্। আবার গুঁড়িয়ে গেল।
এবার ডাবল। একসঙ্গে হাই এবং লো–দু’দিক থেকে দুটি পাখি উড়ে এল–দূরে-যাওয়া পাখিকে আগে মেরে, কাছে-আসা পাখিকে পরে মারতে হবে, তাই নিয়ম। দুম্ দুম্–আবার দুটি। পাখিরা গুঁড়ো হয়ে পড়ল।
বন্দুকের ইজেক্টরটা মাঝে মাঝে জ্যাম হয়ে যাচ্ছিল–ব্রিচটা খুলে দেখছি–এমন সময় যতি এসে ফিসফিস করে কানের কাছে বলল, ঋজুদা গাড়িটা দেখেছ? প্যাভিলিয়নের পাশে চেয়ে দেখো।
চেয়ে দেখলাম–একখানা গাড়ির মতো গাড়ি বটে–একটা চাপা রঙা জাগুয়ার স্পোর্টসকার প্যাভিলিয়নের পাশে দাঁড় করানো। ভাল করে দেখার আগেই সুগত ডাকল, এই ঋজু, কী হল? এসো।
আমি বললাম, আমার বন্দুকের ইজেক্টর খারাপ হয়ে গেছে।
ও ধমকে বলল, ঝামেলা কোরো না–এসো।
সুগতর অভিযোগ আছে যে কোনওদিনই আমি সিরিয়াসলি অনুশীলন করলাম না। কেন জানি না–প্রতিযোগিতায় আমি নামতে চাই না কারও সঙ্গে কোনও ব্যাপারেই। যে প্রতিযোগিতা পেটের জন্যে করতে হয়–তার কথা স্বতন্ত্র। সে প্রতিযোগিতায় না নেমে উপায় নেই। কিন্তু তা ছাড়া অন্য প্রতিযোগিতায় নামার শখ আমার নেই। এক প্রতিযোগিতাতেই আমি হাঁপিয়ে গেছি; ফুরিয়ে গেছি। বরং জীবনের অনেকানেক ক্ষেত্রে অনবধানে ঢুকে পড়ে রংরুটের মতো যেটুকু মজা লুটে নিতে পারি, সেটাই দৈনন্দিন প্রতিযোগিতার গ্লানি ঢেকে রাখার জন্যে প্রয়োজন আমার। আমি পারি না। প্রতিযোগিতাতে হেরে যাবার জন্যেই আমি জন্মেছিলাম।
তবু সুগত আমায় ভালবাসে; তাই বলে। ক’জনই বা ভালবাসে? এত বড় পৃথিবীতে ক’জনই বা কাকে কাছ থেকে চেনে, জানে, বোঝে? সেই মুষ্টিমেয়দের মধ্যে সুগত অন্যতম; আমার জঙ্গলের বন্ধু।
কোনওরকমে একটা ‘ডিটেল’ ছুঁড়ে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম গাড়িটার পাশে। যতি আগেই গেছে। রঞ্জনও গুটি গুটি এল। গাড়ি একখানা।
এয়ার কন্ডিশনড তো বটেই–যেমন চেহারা তেমন গড়ন। টায়ারগুলো ইয়া মোটা, মোটা এক জোড়া সাইলেন্সর চকচক করছে–দরজাটা খুলে যেখানে খুশি ছেড়ে দিলে সেখানেই আটকে থাকে। ধরে থাকতে হয় না। রঞ্জন গাড়িটার গায়ে ঠোঁট লাগিয়ে চুঃ শব্দ করে একটা চুমু খেল। যতির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করতে লাগল। গাড়িটার পেছনের কাচের এক কোণে এমব্যস করে নাম লেখা রয়েছে “লাভ ইন দ্য আফটারনুন”।
গাড়ির মালিককে আমরা চিনি। বেঁটেখাটো গর্বিত চেহারা। পাঞ্জাবি ভদ্রলোক। মিস্টার সিধু। অনেক ব্যাবসা-ট্যাবসা আছে। যতি ডাকত, বিধুমুখী। ভদ্রলোকের এরকম আরও গোটা পাঁচ-সাত গাড়ি আছে। এক একদিন এক একটা নিয়ে আসেন। আমরা আমাদের ঝরঝরে অ্যামবাসাডারে, এবং যতি, যতির আড়াই-পাক-ফলস্টিয়ারিংওয়ালা জিপে বসে, আড়চোখে গাড়িগুলোকে রোজ দেখি–আর ক্ষোভে হিংসায় পাটকাঠির মতো দাউদাউ করে জ্বলি। এক একটি গাড়ির দাম সোয়ালাখ; দেড় লাখ। স্টেট ট্রেডিং কর্পোরেশন থেকে কেনেন ভদ্রলোক।
হঠাৎ রঞ্জন বলল, যতি, তুই চিনে খেতে খুব ভালবাসিস, না?
এই প্রশ্নে যতি চমকে বলল, কেন? এর মানে কী হল?
রঞ্জন একটু ভেবে বলল, তোর জিপ যদি তুই ওই গাড়ির ঘাড়ে তুলে দিতে পারিস কখনও, তো তোকে তিন দিন চিনে খাওয়াব।
যতির চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। চিনে খাবার লোভে নয়, এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝেছে ও–আমিও বুঝেছি।
বললাম, আমিও তিন দিন চিনে খাওয়াব।
যতির চোখ দুটো আবার উজ্জ্বল হল। দপদপ করতে লাগল। বলল, গাড়িটার বাম্পার দেখেছ–কেমন নিচু–জিপকে একবার ঘাড়ে চড়াতে পারলে পেছনের কাঁচ এবং এয়ারকন্ডিশনার-টনার ভেঙে একেবারে সিটের উপর পৌঁছে যাব।
এই অবধি বলেই হঠাৎ মুষড়ে পড়ে বলল, কিন্তু তা হবার নয়–। এ গাড়ির যা স্পিড, এ তো ক্যাঙারুর মতো দৌড়োবে–এ গাড়িকে পেছন দিয়ে গিয়ে ধরা, জিপ গাড়ির কর্ম নয়–তবে সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুতে সামনাসামনি যদি কোনওদিন পাই তো “জয়, বজরঙ্গবলীকা জয়” বলে একেবারে মুখোমুখি লড়িয়ে দেব।
তারপর যো হোগা, সো হোগা।
আমি বললাম, সামনাসামনি মারলে তো সামনের সিটের লোকও মরে যেতে পারে।
যতি বলল, তা তো পারেই। তুমি বেশ কথা বলছ বটে। ছ’দিন চিনে খাব–আর তার বদলে এক-দু’জন লোক মরবে না? আমাদের জীবনের দাম কি এতই বেশি নাকি?
রঞ্জন ওকে নিরস্ত করার জন্যে বলল, দ্যাখ যতি, বেশি বাড়াবাড়ি করতে যাস না–সবটাতে তোর জ্ঞান দেওয়া স্বভাব হয়ে গেছে।