Collected ঢাকা টু হুলারহাট - মোস্তাফিজুর রহমান টিটু

dukhopakhidukhopakhi is verified member.

Special Member
Registered
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
407
Messages
5,564
Reaction score
2,005
Points
3,913
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
*****ঢাকা টু হুলারহাট*****

মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু






বড় বিশৃঙ্খল জীবনযাপন করি তখন । লন্ডনের এক সফটওয়্যার কোম্পানির ঢাকা শাখায় চাকুরী করি । লন্ডনের সাথে সময় মিলাতে দুপুর ১টার সময় অফিসে যাই ফিরি রাত দশটার পরে । নাস্তা সকাল এগারোটায়, অফিসে লাঞ্চ বিকাল তিনটায় আর রাতের খাবার খেতে খেতে প্রায়ই বারোটা বাজে । পেশাটার প্রতি একটা দরদ সব সময়ই ছিলো তার উপর লন্ডন অফিস কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে ডিরেক্টর হিসাবে প্রমোশন দিলো । একটা সম্পুর্ন প্রডাক্ট তৈরী করবার দায়িত্ব আগে থেকেই ছিলো । এর সাথে যুক্ত হলো অফিস চালাবার দায়িত্ব । নিজেকে কেমন গুরুত্বপুর্ন মনে হয় (হায় এজগতে কেউই যে তেমন গুরুত্বপুর্ন না সেই শিক্ষা তখনও ভালোভাবে হয় নাই...) । মাঝে দুইবার লন্ডন গিয়ে দেখলাম প্রডাক্টটার ভবিষ্যৎ সত্যি বেশ ভালো । উৎসাহ আরো বাড়ে । সবার আগে অফিসে যাই ফিরি সবার শেষে । সে এক নেশাগ্রস্থ সময় ।

এমন সময়ই হঠাৎ আমার জন্ম সনদপত্রের দরকার পড়লো । কোনো কিছু না দেখেই অফিসের ড্রাইভারকে দিয়ে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে একটা সনদপত্র নিয়েও আসলাম । কিন্তু পাসপোর্ট খুলে দেখি জন্মস্থান লিখেছি পিরোজপুর । মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো । জীবনের দশমিক এক শতাংশ সময় পিরোজপুর না থেকেও নিজেকে বরিশাইল্লা বলি । বলতে ভালো লাগে ...সেটা ঠিক আছে । কিন্তু এখন এই ঝামেলা অসহ্য মনে হয় । আর তাছাড়া আমার সত্যিকার জন্মস্থান আসলে পিরোজপুর না । খুলনার ফুলতলা । তাও কেনো যে পাসপোর্টে জন্মস্থান পিরোজপুর লিখলাম আল্লাহই জানে । পিরোজপুরের সেহাংগল গ্রামে চাচাতো ভাই হুমায়ুনকে ফোন করি । দুইদিন পরে হুমায়ুন জানালো আমাকে এক দিনের জন্য হলেও যেতে হবে । সশরীরে না গেলে নাকি সরকারী অফিসার কাগজটা দেবেন না ।

ঐ সময়ে অফিসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আবার লন্ডনে । তাই আমার অফিসে থাকা অপরিহার্য । অন্তত এইরকম একটা ভুল ধারনাই ছিলো । পরিকল্পনা করলাম শুক্রবার সন্ধ্যায় লঞ্চে গিয়ে শনিবার কাজ করে আবার রবিবারেই ঢাকা ফেরত আসবো । শনি-রবি অফিস ছুটি । তাই কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না । চাচাতো ভাই হুমায়ুনও পরিকল্পনামতো ঢাকা আসলো ।

অফিসে আরো একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন । শুক্রবার একটু আগেই অফিসে যাই । দুইজনের ইন্টারভিউ নিয়ে দুপুর দুইটা-আড়াইটা নাগাদ অফিস থেকে বের হয়ে সদরঘাট চলে যাবো । এই ছিলো পরিকল্পনা । প্রথমজনের ইন্টারভিউ নিলাম । প্রার্থীর দুই বছরের অভিজ্ঞতা আছে । কিন্তু আমরা যা চাচ্ছি অভিজ্ঞতা তার সাথে মেলে না । তাও চাইতেও বড় কারন তার অভিজ্ঞতা আসলে তাকে কিছু বাজে অভ্যাসে অভ্যস্ত করে ফেলেছে । দ্বিতীয় জন আসলো আধা ঘণ্টা দেরী করে । সদ্য পাশ করা ঝকঝকে তরুন প্রকৌশলী । কোনো কমার্শিয়াল অভিজ্ঞতা নাই । কিন্তু ছাত্রকালীন সময়ে কিছু কাজ করেছে এবং সেগুলো দেখে বেশ ভালো লাগলো । আরো কিছু কথাবার্তা বলে ভালো লাগাটা বাড়লো । আমি চাকুরীর প্রস্তাব দিলাম । তার চোখে মুখে খুশির ছায়া দেখলাম । কিন্তু একটু পরেই যখন বেতনের পরিমান বললাম দ্রুত মেঘ ঘনিয়ে এলো সেই মুখেই ।
“আমি যে তিনটা টিউশনি করি তা থেকেইতো এর চাইতে বেশী আয় করি ।“ আধার মুখে বলে যুবক ।
-এটাতো শুরু । আর টিউশনিতো আর আপনার পেশা হবে না, তাই না ? আমি মৃদু হেসে উত্তর দেই ।
“তাও আমার বন্ধুরা গ্রামীন/একটেলে এর চাইতে অনেক বেশী টাকায় চাকুরী করছে ।“
-দেখুন শুধু টাকাই কোনো পেশার মূল কারন হতে পারে না । আপনার মেধা নিয়ে আপনি এর চাইতে কম পরিশ্রমেও হয়তো কাচকি মাছের আড়ৎদারী করলে ভালো করবেন । কিন্তু আপনিতো আর তা করবেন না । আমি বোঝাবার সুরেই বলি ।
“আপনি কেনো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন ?” হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করে যুবক ।
-মানে ?
“না আপনি কেনো ইতিহাস, ভুগোল কিংবা রাস্ট্রবিজ্ঞান পড়েন নাই ?” উত্তরে কি বলবো আমি বুঝতে পারি না ।
“সরল উত্তর হলো আপনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন কারন ঐটা পড়লে একটা ভালো চাকুরী পাওয়া যায় । আর ভালো চাকুরী মানেই বেশী টাকা । তাই না ? জানেনতো ‘অর্থই সকল অনর্থের মূল’ ভাবসম্প্রসারনটা পকেটে অনেক টাকা থাকলেই সব চাইতে ভালো লেখা যায় । ” আমি বেশ অবাক হয়ে যাই । একযুগ আগে আমিও টেবিলের ঐ প্রান্তে ঠিক ওভাবেই বসে ছিলাম । কিন্তু এই কথাগুলো বলার মত সাহস কিংবা ব্যক্তিত্ব আমার ছিলো না । উত্তরে তাই আমার অনেক কিছু বলার থাকলেও বলি না । বরং আমার বাজেটের বাইরে আরো একটা প্রস্তাব দেই । জানি এর জন্য আমি বিপদেও পড়তে পারি ।
“আপনাকে ধন্যবাদ । গ্রামে বাবার জমি বিক্রির টাকায় আমি পড়াশুনা করেছি । আমাকে অনেক টাকা আয় করতেই হবে । ভেবেছিলাম আপনাদের বিদেশী কোম্পানী ...কিন্তু এখন দেখছি সময় নষ্ট ।“ বলে চলে যায় যুবক । মুখের মধ্যে কেমন তেতোভাব নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আতকে উঠি । ঘড়ির ঘণ্টার কাটা অনেক আগেই তিনটা অতিক্রম করেছে । তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হই । চাচাতো ভাই হুমায়ুনকে নিয়ে সদরঘাট রওনা হই ।

কোলাহলপূর্ণ সদরঘাট । সব লঞ্চই মনে হয় ছেড়ে গেছে ভেবে দুশ্চিন্তায় ছিলাম । পৌছে দেখি ঢাকা টু হুলারহাট লাইনের চার পাঁচটা লঞ্চ তখনও ঘাটে ভেড়ানো । জলকপোত নামটা পরিচিত লাগায় ঐদিকে যাই ।
“মেবাই ঐটার কেবিনে খালি উড়াশ (ছারপোকা) । চলো পারাবতে যাই ।“ চাচাতো ভাই হুমায়ুন বলে । অতএব হুমায়ুন এর কথামতো পারাবতে উঠি । কেবিন ঠিক করার কাজ হুমায়ুনই করে ।

সব কিছু ঠিক হবার পরে কেবিনে ব্যাগটা রেখে বাইরে এসে দাড়াই । সাথে সাথে এক দমকা শৈশব এসে হুমড়ি খেয়ে পরে । লঞ্চের গায়ে লাগানো কয়েকটা নৌকা, মাল উঠাচ্ছে । প্লাটফরমে হকারদের চিৎকার । ডেকে চাদর বিছিয়ে কিছু যাত্রী বসে আছে, এক একটা চাদরের সীমানাই এক একটা পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা । আগামী দশ বারো ঘণ্টার জন্য । বালিস, হাত পাখা আর ছয় বাটির টিফিন ক্যারিয়ারটা রেখে সবাই একটু হাত পা ছড়িয়ে বসেছে । ছেলেবেলায় ঠিক এভাবেই তিন চারবার গ্রামে গিয়েছি বাবা মার সাথে । তারপর কিভাবে যেনো ঢাকায় ঢাকা পরে গেলাম । আসলে জানি কিভাবে...সাত ভাইবোনের বড় সংসার । একজনের এস,এসসি পরীক্ষা শেষ হয়তো আর একজনের এইচ,এস,সি পরীক্ষা শুরু হয় । সবাই মিলে গ্রামে যাওয়া আর হয় না । এভাবেই গ্রামের সাথে সুতাটা আলগোছে আগলা হয়ে যায় ।

একটু পরেই বুড়িগঙ্গার কালো পানি ভেদ করে লঞ্চ ছাড়ে । পনের বিশ মিনিট পরে সভ্যতা-উন্নতির কটু গন্ধটাও পিছনে ফেলে আসি । হালকা ঝিরি ঝিরি বাতাসে দাঁড়িয়ে দুরের এক গ্রামের কিছু গাঢ় সবুজ গাছের আড়ালে সূর্যটাকে হারিয়ে যেতে দেখলাম । একটু ঠাণ্ডা লাগাতে কেবিনে ঢুকে পরি । হুমায়ুনের সাথে টুকটাক আলাপ করি ।
-কালকে কিন্তু কাজটা হতেই হবে ।
“তুমি চিন্তা হইরো না । মোরা হুইপের লোক (আমাদের এলাকার সাংসদ তখন সংসদের হুইপ)।“ বলে আশ্বস্ত করে হুমায়ুন । এমন সময় বাইরে হৈ হট্টগোল শুনতে পাই । কেবিনের দরজা খুলে আমি হুমায়ুন দুজনেই বের হয়ে আসি ।
“এক কাপ চায়ের কথা বললে আধা ঘণ্টা লাগে । এই হইলো ভি আই পি কেবিনের সার্ভিস । ডাক তোর মাস্টাররে । “ গলায় মোটা চেইন, হাতে দামী ঘড়ি এক ভদ্রলোক বাজখাই গলায় চিৎকার করছেন । ভদ্রলোক মনে হয় আমার ডান পাশের কেবিনের যাত্রী ।
‘এদের সাথে কথা বইলা কি লাভ । তুমি আব্বারে একটা ফোন দেও । দেখবা লঞ্চের সারেং লঞ্চ চালানো বাদ দিয়া তোমার পা টিপতে আইছে ।“ পিছন থেকে এক রমণী হাত নেড়ে নেড়ে কথাগুলো বললো । লঞ্চের এই জন্ডিস আলোতে দশ ফুট দুরের চেহারাটা খুব ভালোভাবে দেখতে না পেলেও মহিলার বাবা যে কেউকেটা সেটা শরীরভর্তি গয়না দেখেই বোঝা যায় ।
“শোন তোগো এই লঞ্চের মত দশটা লঞ্চ আমি দিনে রাইতে কেনতে পারি । বেডা মানুষ চিনস না ।“ আমাদের মত আরো দুই চারজন শ্রোতা দর্শক পেয়ে হম্বি-তম্বি বাড়ে । যার উপর হম্বি-তম্বি চালানো হচ্ছে সেই বেয়ারা চুপচাপ এককোনে দাড়িয়ে আছে । এমন সময় আমার বাম দিকের কেবিনের দরজা খুলে গেলো । দরজার ওপাশ থেকে একজন জ্যোতির্ময় বৃদ্ধের আবির্ভাব হলো । ইচ্ছে করেই ‘আবির্ভাব’ শব্দটা লিখলাম । কারন এটাই ওনার সাথে যায় । গমের মত গায়ের রং, মাথার চকচকে টাক থেকে এই জন্ডিস আলোও প্রতিফলিত হচ্ছে । ধবধবে সাদা পায়জামা,পাঞ্জাবী চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মাঝারী উচ্চতা বয়সের ভারে একটুও নুয়ে যায় নাই ।
“কি হয়েছে ?” মনে হলো গভীর কোনো কুয়ার তল থেকে কেউ কথা বললো ।
‘স্যারের চা দিতে দেরী হইছে ।‘ এতক্ষণ পরে কথা বললো বেয়ারা ।
“যাত্রীদের সেবার দিকে খেয়াল রাখবা না । এখন থেকে আর দেরী করো না ।“ সামান্য দুইটা বাক্যের আড়ালে ভদ্রলোকের প্রবল ব্যক্তিত্ব সবাইকেই শান্ত করে । দ্রুত সবাই চলে যায় । আমি আবার কেবিনে ঢুকতে যাবো এমন সময় বামের কেবিন থেকে এক রূপসী তরুণী বের হয়ে আসে । কয়েক পা হেটে গিয়ে তরুণী রেলিঙে দাঁড়ায় । কেমন যেনো একটু এলোমেলো হাটার ভঙ্গি । আমি কেবিনে না ঢুকে দরজাতেই দাঁড়িয়ে থাকি । এক মিনিট পরেই বৃদ্ধের গলা শোনা যায় । “রেবা ভিতরে আসো” । সাথে সাথেই তরুণী ঘুরে আবার একটু এলোমেলো পায়ে কেবিনের দিকে আসতে থাকে । দরজায় দাঁড়ানো আমাকে দেখে একটু হাসেও । কিন্তু হাসিটা যেন কেমন লাগে ।

কেবিনে ঢুকে হুমায়ুনের সাথে গ্রাম, আত্মীয়-স্বজন আর গ্রামের রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতে থাকি । একটু পরেই বেয়ারা আসে রাতের খাবারের অর্ডার নিতে ।
‘ভাতের সাথে সালুন কি নিবেন ?‘
আমি হুমায়ুনকে দেখিয়ে বলি ঐ অর্ডার দিবে ।
“আর কোনো ঝামেলা হইছে ?” আমি জিজ্ঞেস করি বেয়ারাকে ।
‘না স্যার । চৌহিদারের পুত আছেলে । কেমনে কেমনে গারমেন্ট হইরা এহন কোটি কোটি টাহার মালিক । মানুরে মানু মনে হরে না । বিয়া হরছে আবার আর এক নেতার মাইয়ারে । সেরের উপর সোয়া সের…‘
“তাহলে এদেরকে তুমি চেনো ?”
‘অ্যা কন কি? চিনমু না ক্যা । মোগো বাড়ির তিন গ্রাম পরেইতো হেগো বাড়ি ।‘
“আর ঐ বুড়া ওনাকেও চেনো ?”
‘না স্যার হেরে চিনি না । তয় লঞ্চে এইরহম যাত্রী উঠে । দেখপেন হারা রাত দরজা খুলবো না । দরবেশ এর মত চেহারার খাচ্চর শয়তান । হারা রাত ফুর্তি হরবো হালার বুইড়া ।‘

অর্ডার নিয়ে বিদায় হয় বেয়ারা । ব্যাগ থেকে একটা বই খুলে পড়ার চেষ্টা করি । অল্প আলোয় পড়ার কারনে অল্প সময়েই মাথা ধরে যায় । বই বন্ধ করতেই খাবার আসে । খাবার খাই । ইলিশ মাছটা খুব ভালো ছিলো । হুমায়ুন আবার একটু অসুস্থ । তাই ওকে ঘুমিয়ে পড়তে বলি । আমিও ঘুমাবার চেষ্টা করি । ঘন্টাখানেক চেষ্টার পরে হাল ছেড়ে দেই । কেবিন থেকে বের হয়ে আসি । হাটতে হাটতে ডেকে আসি । এখানেও অধিকাংশ যাত্রী কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে । এক কিনারে কয়েকজন তাস খেলছে । পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই । টুয়েন্টি নাইন খেলছে চারজন । পাঁচ মিনিট খেলা দেখে চলে আসবো এমন সময় একজন বললো
“মেবাই একটু হাতটা ধরেন । মোর এট্টু টয়লেটে যাইতে হবে ।“ লঞ্চে অপরিচিত লোকজনদের সাথে বেশী মেলামেশা ঠিক না । অনেক আজব কাহিনী শুনছি । কিন্তু তেমন চিন্তা হয় না । বসে যাই খেলতে ।
‘আমনে খালি কলটা ঠিকমতো দিয়েন । বাকীটা আমি দেহুম ।‘ আমার পার্টনার বলে ।
-হয় আপনার পার্টনার হইলো ম্যারাদোনা । আর একজন বলে ।
“আরে রাখ রাখ ম্যারাদোনা । ঐ গল্পটা হুনছোসতো ।
কাক্কু বউ লইয়া ঘোরতে বাইর হইছে । রাস্তায় এক আন্ধা ফহির কাক্কুর বউরে দেইখ্যা কইলে ‘ও সুন্দরী বুবু দুইটা টাহা দিয়া জান ‘ । কাক্কু হের বউয়ের দিগে চাইয়া কইলে ‘দেও বউ দুইডা টাহা দিয়াই দেও ...বেডা হাচ্ছইও অন্ধ‘।“ সবাই হেসে উঠে ।
‘বেডা তোর এতবড় সাহস মোরে নিয়া টিটকারি মারস ।‘ যাকে ম্যারাদোনা বলা হচ্ছে সে কপট রাগের সাথে বলে ।
“মেবাই সাহসের দেখছো কি সাহস ছেলে মোগো প্রাইভেট মাস্টেরের । মোর বাফের কাছ থেইক্কা টাহা নিয়া মোরেই কেউন্নাইয়া থুইয়া যাইতে ।“ এভাবেই হাসি আনন্দের সাথে আধাঘন্টা খেলে কেবিনে ফিরি । আবার ঘুমাবার চেষ্টা করি । ঘুম আসে না । মাঝে আরো একবার কেবিন থেকে বের হই । লঞ্চ তখন চাঁদপুর ঘাটে ভেড়ানো ।

এরপরে ঘণ্টা দুয়েকের একটা ঘুম হয় । বিছানায় শুয়েই ঘড়িতে দেখলাম রাত চারটা বাজে । পাশের বিছানায় হুমায়ুন নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছে । কেবিনের দরজা খুলে বাইরে আসতেই দেখি পাশের কেবিনের সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটা চেয়ারে বসে আছেন । আমি রেলিঙয়ের কাছে গিয়ে দাড়াতেই ...
“কোথায় যাবা ?” সেই জলদগম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন ভদ্রলোক । আমি ছোট করে উত্তর দেই । বেয়ারার কথা মনে করে এই লোকের সাথে বেশী কথা বলতে ইচ্ছা করে না । কিন্তু ভদ্রলোক আমি কি করি, কোথায় থাকি এরকম আরো দুই চারটা প্রশ্ন করেন । আমি এক দুই কথায় উত্তর দেই । নিতান্তই সৌজন্যবশত । কোনো পাল্টা প্রশ্ন করি না ।

“আমিও তোমার বাবার মত চাকুরীর প্রয়োজনে গ্রাম ছাড়ি প্রায় ৫০ বছর আগে । সেভাবে আর ফেরা হয় নাই । এখন নাতনি নিয়ে গ্রামে যাচ্ছি জমি-জমা সংক্রান্ত ব্যাপারে ।“
-নাতনি বুঝি আপনার খুব আদরের ? আমি কৌতুহলীস্বরে জিজ্ঞেস করি ।
“নাতি নাতনি আমার আরো আছে । তবে আমার এই নাতনির আমি ছাড়া কেউ নাই ।“ থমথমে গলায় বলেন বৃদ্ধ ।
-কেনো বাবা মা ?
“আছে আবার নাইও । আমার বড় ছেলে নিজের পছন্দমতো বিয়ে করে । আমি আপত্তি করি নাই কারন আপত্তি করলেও লাভ হোতো না । বছর দুয়েক পরেই আমার এই নাতনির জন্ম হয় । বছর দুই তিন ভালোই ছিলো । তারপর বোঝা যায় ওর মানসিক বৃদ্ধি খুব খুব মন্থর । কিছুদিনের মধ্যেই এই নিয়ে শুরু হয় সাংসারিক ঝামেলা । ওরা স্বীকার করে না কিন্তু ওদের বিচ্ছেদের মূল কারণই ছিলো আমার এই নাতনি ।“
-তারপর?
“তারপর আর কি । নাতনিকে আমিই নিয়ে আসলাম । ছেলে এখন আর এক বিয়ে করে আমেরিকায় । বউও অস্ট্রেলিয়ায় আর এক সংসারে ব্যস্ত । বছরে এক দুইবার ফোন করে মেয়ের খবর নেয় । ব্যস ঐ পর্যন্তই । গল্পে নাটকে সিনেমায় বাবা-মার ভালোবাসা নিয়ে কত গল্প পড়েছি দেখেছি । কিন্তু নিজ জীবনেই রেবার মত হতভাগ্য সন্তানও দেখতে হলো । ফুলের মত মেয়েটা । আমার শুধু চিন্তা হয় আমি যখন থাকবো না তখন রেবার কি হবে ?“

এতটুকু বলেই হঠাৎ চুপ করে যান বৃদ্ধ । একজন সদ্য পরিচিত লোককে এতকিছু বলায় হয়তো একটু বিব্রতও বোধ করেন । বেয়ারা দুইকাপ চা দিয়ে যায় । পুব আকাশে নদীর গর্ভ থেকে লাল কুসুমের আভা দেখা যায় । চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আমরা দুইজন তা দেখতে থাকি ।
 
Back
Top