Collected বিটি রোডের ধারে - সমরেশ বসু

dukhopakhidukhopakhi is verified member.

Special Member
Registered
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
407
Messages
5,564
Reaction score
2,005
Points
3,913
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
বিটি রোডের ধারে

মূল লেখকঃ সমরেশ বসু






পর্ব - ১
দিন শেষ না হতেই রাত্রি নেমে এল। সারাদিনের ছেড়া ছেড়া মেঘ-ছড়ানো আকাশটার এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো পর্যন্ত কে যেন দিগন্তহীন আলকাতরার ব্রাশ নিয়ে গেল বুলিয়ে। পুর্ব থেকে পশ্চিমে ছুটেছে আলকাতরার ব্রাশটা, এখান থেকে অনেক দূরে, তীব্রগতিতে, দিক হতে দিগন্তে, দেশান্তরে। যেন মেঘের ডালাটা গলে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। ছড়িয়ে পড়ছে আর গলে গলে পড়ছে পৃথিবীতে। কালোয় কালো হয়ে যাচ্ছে আকাশমাটি। কোথাও কোনও সীমারেখা ঠাহর করা যাচ্ছে না।
বাতাস বইছে। পুবে বাতাস। খ্যাপা হাঙরের মতো বাতাসটা কখনও যেন ল্যাজ নাড়ছে ধীরে ধীরে। কখনও তীক্ষ্ণ শিস দিয়ে ঝাপটা মারছে অন্ধকার শুন্যে। গোঁ-গোঁ সোঁ-সোঁ শব্দ উঠছে বাতাসে। থেকে থেকে চুলকাচ্ছে বিদ্যুৎ। যেন আদিগন্ত অন্ধকারকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলতে চাইছে কতগুলি তীক্ষ্ণ তলোয়ার। ব্যুম ব্যুম শব্দে কাঁপছে মাটি। আর তার সঙ্গে ইলশেগুঁড়ির ছাট। রাশি রাশি ছুঁচের মতো বাতাসের ঝাপটায় গায়ে এসে বিঁধছে। হাওয়ার ঝাপটায় এসে বিঁধছে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে। দুর্যোগের অন্ধকার, রাত্রির নয়। ঘড়ির কাঁটায় এখনও নামেনি অন্ধকার, যে ঘড়ি সময়ের চেহারা দেখে না। শুধু চলে আর বাজে। তাই মিউনিসিপালের বিজলি বাতিগুলি জ্বলেনি এখনও।
বাতি জ্বলে উঠছে দোকানে দোকানে। লক্ষ আর প্রদীপ জ্বলে উঠছে ঘরে ঘরে। সেখানে ঘড়ি নেই। মানুষের প্রয়োজনে বাতি জ্বলছে।
ভিড় লেগে গেছে সুদীর্ঘ বি টি রোডের উপর। বি টি রোড। কলকাতা থেকে বারাকপুর, বারাকপুরের চিড়িয়ামোড় থেকে হঠাৎ পুবে মুখ ঘুরিয়ে বি টি রোড জি টি রোড নাম নিয়ে আবার সাঁ সাঁ করে ছুটে গেছে উত্তর দিকে। সেই কাঁচরাপাড়া পর্যন্ত।
এই সুদীর্ঘ রাস্তা জুড়ে ভিড় লেগেছে। কলকারখানার ছুটির ভিড়। সারা বাংলার বৃহত্তম শিল্পকেন্দ্র এই রাস্তা। গঙ্গার তীরে তীরে, রেললাইনের ধারে ধারে অসংখ্য কারখানা ইমারত। তারই ছত্রছায়ায় ছড়ানো আবর্জনা স্তুপের মতো বস্তি। এবড়ো খেবড়ো, বাঁকাচোরা, দোমড়ানো সুদীর্ঘ শিল্পশহর। মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য চিমনি। অন্ধকারে অদৃশ্যচারী ভূতের রক্তচক্ষুর মতো। লাল বাতি জ্বলছে চিমনিগুলোর মাথায়। ধোঁয়া ছাড়ছে অনর্গল। সেই ধোঁয়া বৃষ্টির ছাটে ধুয়ে যেন তরল কাশির মতো ঝরছে কারখানায়, রাস্তায়, বস্তিতে। যেন একটা মাইলের পর মাইল কালো পটের উপরে, কালো ভারী পোস্টারকালারের থ্যাবড়া ব্রাশে ছবি আঁকা হয়েছে।
এই সুদীর্ঘ পথ জুড়ে চলেছে ঘরমুখো মানুষের দল। অন্ধগুহার গায় অবয়বহীন ছায়ার মতো চলেছে সবাই। ভিড় জমে উঠেছে চা-খানাগুলিতে, পান বিড়ির দোকানে, গুঁড়িখানায়। কিন্তু আকাশ দ্রুত তাড়া দিয়েছে সবাইকে ঘরে ফেরার।
সবাই বৃষ্টির ছাটে মাথা নুইয়ে গালাগাল দিচ্ছে আকাশটাকে। আকাশের মা, বোন, বাপ, সবাইকে। রাস্তার দুধারে ছড়িয়ে সাজানো বিপণি সামলাচ্ছে দোকানওয়ালারা, পাততাড়ি গুটোচ্ছে তাড়াতাড়ি। ব্যবসা মাটি ফেরিওয়ালাদের। ফেরার তাড়ায়ও অভ্যাসবশত হেঁকে চলেছে তারা হাঁক পাঁক করে। ছিটকে পড়ছে দা-দিনাই-খুজালির দাওয়াইওয়ালারা। বক্তৃতা বন্ধ করে দিয়েছে ইন্দ্রিয়সালসা ও ঈশ্বরদত্তবটিকা বহনকারী, পথে পথে ফেরা হকিম, বৈদ্য, ডাক্তার আর গুনিনের দল। আর চিবিয়ে চিবিয়ে গাল দিচ্ছে প্রকৃতিকে। আর প্রকৃতি যেন, পাগলের পেছনে লাগা ছেলের দলের মতো হওয়ার ছপটি মারছে, ঝরিয়ে দিচ্ছে গুঁড়ি গুঁড়ি ছাট।
কিন্তু ভিড়টা একেবারে কমল না। এই বি টি রোড় শূন্য হয় না কখনও। যেমন গভীর অরণ্য কখনও শূন্য থাকে না। নিরীহ জীব কীট পতঙ্গ আর হিংস্র শ্বাপদ সেখানে নিয়ত যেমন ঘোরে, এই রাস্তাটা তেমনি। ভিড় কমল না তাদের, যাদের ঘরে ফেরার কোনও তাড়া নেই। যাদের ঘর নেই, সেই সব ভবঘুরে বাউণ্ডুলে যারা এই পথেই ঘুরে ঘুরে জীবন কাটিয়ে দিতে বসেছে। কেউ গেল আচ্ছায়, জুয়ার ঘরে, বেশ্যালয়ে। কেউ কেউ শুধু পথে পথে ঘুরতে লাগল আর শিকারি চিলের মতো দেখতে লাগল এদিক ওদিক। গন্ধ শুঁকে বেড়াতে লাগল বাঘের মতো, একটু পেঁয়াজের, একটু আটার দূলার, নিদেনপক্ষে একটু তালরসের।
অনেকক্ষণ পর ভাঁটা পড়তে থাকে ভিড়ে। দোকানপাটগুলিও ঝাঁপ ফেলতে থাকে অন্যান্য দিনের থেকে অনেক তাড়াতাড়ি।
বি টি রোড থেকে একটা কাঁচা সড়ক চলে গেছে পুবে। গোটা কয়েক ছোট বড় বাঁক নিয়ে, নিউ কর্ড রোড মাড়িয়ে গেছে রেললাইন পর্যন্ত। তারপর হারিয়ে গেছে মাঠে ও দূর দূরান্তের গাঁয়ে।
রাস্তাটা সরু। তার চেয়ে চওড়া, খালের মতো নর্দমা কাঁচা রাস্তার দুপাশে। তাতে জল নেই, আবার একেবারে শুকনোও নয়। পাঁক জমে আছে দইয়ের মতো।
রাস্তাটার নাম নয়া সড়ক করা হয়েছে এই সেদিন। যেন এতদিন পরে একটা ভবিষ্যৎ দেখা দিয়েছে সড়কটার জীবনে। নয়া সড়কই বটে। বস্তির ভিড় এদিকটায় কম, কম অই মানুষের ভিড়। একপাশ ধরে রাকিব ফেলে চওড়া করা হচ্ছে রাস্তাটাকে। মিউনিসিপালের কয়েক রাবিশ ও ময়লার গাড়ি কয় নামিয়ে পড়ে আছে ঋরে ধারে।
রাস্তার পাশে দুচারটে চালাঘর উঠেছে পরস্পর থেকে অনেকটা ফাঁক ও দূরত্ব বজায় রেখে। কেবল নিউ কর্ড রোড ও নয়া সড়কের সঙ্গমে, এক ধারে এক লম্বা বস্তি। বেশ বড় বতি। বৃপ্তিটার ধার ঘেঁষেই, কর্ড রোডের দিকে মুখ ফেরানো একটা হাল আমলের দোতলা বাড়ি। নয়া সড়কের বস্তি থেকে এ বাড়িটার দিকে তাকালে, একটা মস্ত অসামঞ্জস্যের দৃশ্যে হেসে ফেলতে পারে কেউ। যেন একটা ঠাট্টা কিংবা একটি দর্শনীয় বস্তুর মতো সাজানো রয়েছে দুটো জিনিস। বস্তিটাকে ঘর বলে চিনতে না পারলে, মনে হতে পারে, ওটা একটা রাবিশেরই স্তূপ।
কিন্তু কর্ড রোড থেকে দোতলা বাড়িটিকে ভারী সুন্দর দেখায়। যেন ছবির মতো।
মোড়ের এ বস্তিটা কিন্তু নয়া সড়কের থেকেও পুরনো। নয়া সড়ক যখন এক পাশে ধানের খেত আর অন্যদিকে বিস্তৃত মাঠের মাঝে একটা সরু গেয়ো পথ মাত্র ছিল, তখন এই বস্তিটা তৈরি হয়েছিল। এখন নয়া সড়ক শহরের শরিক হয়ে উঠছে। কিন্তু এ বস্তি বাড়িটা মান্ধাতা আমলের মতো তেমনি পড়ে আছে। খোলা হওয়া চালা প্রায় মাটি স্পর্শ করেছে। মাথা হাঁটুতে ঠেকিয়ে বেরুতে হয় এখান থেকে। যেন উপর থেকে সমস্ত বস্তিটা ঝপ করে মাটিতে পড়ে প্রায় গেড়ে বসেছে। অন্ধকারে মনে হয় কালো এবং শেওলা ধরা খোলা সাজানো একটা স্তূপবিশেষ।
একটা লোক পুব দিকের গভীর অন্ধকার কোল থেকে এসে মোড়ে দাঁড়াল। চারদিকের চারটে পথের দিকে সে কয়েকবার দেখল। কিন্তু কোন দিকে যাবে ঠিক না করতে পেরে ভূতের মতো দাঁড়িয়েই রইল অন্ধকারে। থেকে থেকে দু-একটা গলার স্বর ভেসে আসছে ওই খোলর পটা থেকে। সেই কুপটার ধারেই এক জায়গা থেকে ছোট একটা আগুনের শিস দেখা যাচ্ছে। যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঝিলিক দিয়ে উঠছে বিদ্যুতের মতো। কর্ড রোড-মুখো ইমারতের একটা জানালা দিয়ে খানিকটা আলো এসে পড়েছে ভোলার মাথায়।
সমস্ত পথটা অন্ধকার। আলো নেই পথটাতে, কিন্তু কতগুলি পোস্ট খাড়া করা আছে কিনারে কিনারে। যেন শুটকো হাড়গিলে ভূত দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে মাথা উঁচু করে।
থেকে থেকে আচমকা হাওয়ার ঝাপটায় ইলশেগুঁড়ি ছাট আসছে। রাস্তাটা ভিজে উঠেছে। কর্দমাক্ত সড়কটার এক একটা জায়গা বিনা আলোতেই চকচক করছে।
লোকটা নয়া সড়কে এক পা এক পা করে এল, তারপর এগিয়ে গেল খোলার বাড়িটার দিকে। আসতে আসতে প্রায় চালাটার গা ঘেঁষে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ঘর-সংযুক্ত মাটির এবড়ো-খেবড়ো রক। একটা বাতি জ্বলছে সেখানে টিমটিম করে। রকের উপরে কিছু লোক রয়েছে শুয়ে বসে। দু-একজন বয়স্ক মেয়েমানুষও বসে আছে তাদের পাশে শিশুও দেখা যাচ্ছে দু-একটি।
একজন শুধু বসে আছে খাটিয়ায়। তার খালি গা, কালো বর্ণ, শরীরটা মস্ত বড়। মাথা চাঁছা, মস্ত গোঁফ, গভীর কোঁচ নাকের পাশে। সারা গায়ে লোমের ছড়াছড়ি, জুর চুলে প্রায় চোখ ঢেকে গেছে। যেমন কথকঠাকুর রামায়ণ মহাভারত শোনায় লোকজনকে, খাটিয়ার লোকটি তেমনি কথা বলে চলেছে। কথা বলার ভঙ্গিটা তার বড় অদ্ভুত। যেন সব কথাগুলোই সে বিদ্রূপ করে বলছে এবং সবাইকে হাসিয়ে বেশ আনন্দ পাচ্ছে লোকটা। কখনও গোঁফ পাকিয়ে, কখনও ভ্রূ তুলে কিংবা কুঁচকে, হাতের চেটোতে ঘুষি মেরে কিংবা খাটিয়ার বাঁশে তাল ঠুকে, আবার ভীষণ রেগে কথা বলছে। সে হাসছে না। কিন্তু কথাগুলো যারা শুনছে তারা হেসে উঠছে। হাসছেও অবশ্য সসংকোচে, ভয়ে ভয়ে। কেননা হেসে উঠলেই অমনি সে পেটটা ঘোঁচ করে এক ধমকের হাঁকে চুপ করিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। শ্রোতারাও অবশ্য সকলেই একনিষ্ঠ নয়। কেউ কেউ ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেছে। কেউ কেউ হঠাৎ গুনগুন করে উঠছে এবং সেই গুনগুনানি যেমনি নিজের কানে গিয়ে লাগছে থেমে যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। সে গান যদি কোনওক্রমে একবার বক্তার কানে যায়, অমনি সে কথা থামিয়ে গায়কের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।
গায়ক তা বুঝতে পেরেই গান থামায়। কিন্তু বক্তা খুব গভীর অমায়িক গলায় বলে ওঠে, বাঃ বেশ তো গাইছিলি, গলা ছেড়ে ধর না গানটা।
লোকে শুনলে ভাববে বক্তা নিশ্চয়ই গান রসিক, আর শুনতেও চায়। কিন্তু গায়ক আয় কর ললাকেরাই শুধু জানে কেন তার হঠাৎ গানের এত তাগিদ। গায়ক তে বক্তার সেই ভীরু সৃষ্টি ও বাঁকানো গোঁফের দিকে তাকিয়ে কেবলি চোখ পিটপিট করে, মাটিতে নখ দিয়ে দাগ দেয়, গা মাথা চুলকোয় এবং আর বাই তার দিকেই তাকিয়ে থাকে।
তখন খাটিয়ার বক্তা বলে ওঠে, গা না, গা শালা। কী সুখে গাইছিলি গা। সাধ করে বলি যে, তোরা জানোয়ার, অ্যাঁ? একটা কথা হচ্ছে, শুনছে সবাই, অ না ব্যাটা গান ধরে দিলে। না শুনিস তো যা, চলে যা ঘরে, শুয়ে থাক গে।
তারপরে যেন হাসছে এমনি দাঁত বের করে বলে, দ্যাখ দ্যাখ করছে দ্যাখ। বলতে বলতে সে কথান্তরে চলে যায়। বলি, তা হলে শোন এক গাইয়ের কথা বলি।
বলে সে এমনি গল্পে গল্পে গুলজার করতে থাকে। কিন্তু তোরা বোধ করি সে রস গ্রহণে ঠিক সমর্থ নয়, আর নয় তো বলি এ শোনার মধ্যে কোন বাঁধাবাঁধি আছে যে, শুনতেই হবে ভাল লক আর না লাগুক।
তার কথার মধ্যে বারবারই যেটা ফুটে উঠছে, সেটা হল জগতের বটাই যখন মিছে তখন মানুষের এত মাতামাতির কি আছে। নেই। এবং নেই বলেই ওর গল্পের বিষয়বস্তু নাই থাক তার মধ্যে বারবার একজন নায়কই এসে দেখা দিচ্ছে আর মুখ থাবাড়ি দিয়ে সে সবাইকে চুপ করিয়ে দিচ্ছে। তুলনা হিসাবে সে নিজেকে দেখিয়ে বলছে, এই আমি ও সব সইতে পারি নে। সব বুঝে নিয়েছি দুনিয়ার। যা দিয়ে পেট চলবে, সেটি করা, বাকিটা সব বাদ দাও। ল্যাঠা বাড়িয়ে কী দরকার বাবা। সুতরাং গায়কের গল্পের ওই ধরনের একটা পরিণতি দিয়ে গিয়ে তাকে আচমকা থামতে হয়। দেখে হয়তো কেউ বসে থেকেই ঘুমের টানে গড়িয়ে পড়েছে শিশু কেঁদে উঠেছে।
সে অমনি বলে ওঠে, বাঃ, তোর বাচ্চাটা কী সোন্দর কাঁদে। আরও কাঁদিয়ে দে ওকে। যার শিশু, সে বেচারি ভারী ভড়কে গিয়ে তাড়াতাড়ি কান্না থামায়। যে ঝিমিয়ে পড়ে তাকে বলে, আমার খাটিয়াতে শুবি আয়।
ঘুম পালায় অমনি সেখান থেকে।
অথচ লোকগুলির মুখ দেখে মনে হয় না যে তারা এরকম একটা খিটখিটে বা অদ্ভুত মেজাজের লোকের সামনে বসে আছে। বরং যখন কোনও হাসির কথা হচ্ছে তখন বেশ হেসেই উঠছে হে-হে করে। আগন্তুক একটু তাজ্জব হল ব্যাপারটা দেখে। ভারী মজার ব্যাপার তো।
রকের নীচেই একটা ছোট ভোলা উনুনে একজন হাওয়া দিচ্ছিল। তারই সামান্য ফুলকি আগন্তুক দেখতে পেয়েছিল দূর থেকে। উনুনটা ধরে যেতে সেটাকে তুলে নিয়ে উঠবার মুখে লোকটা হঠাৎ আগন্তুককে দেখতে পেল। জিজ্ঞাসা করল, কে হে ওখানে?
আগন্তুক হঠাৎ কোনও জবাব দিতে পারল না।
লোকটা আবার বলল, নীচে দাঁড়িয়ে কেন, রকে উঠে বসোনা।
সকলের দৃষ্টি আগন্তুকের দিকে পড়ল। অচেনা মুখ দেখে সবাই তাকিয়ে রইল তার দিকে।
খাটিয়ার বক্তা মেজাজি গলায় হেঁকে উঠল, কে রে চাঁদু?
চাঁদু উনুন নিয়ে রকে উঠে বলল, চিনি নে, দেখলুম ডাঁইড়ে রয়েছে ওখানে।
কে হে? উঠে এসো এখানে। চড়া গলায় হুকুম করল বক্তা।
আগন্তুক উঠে এল রকে। তার মুখে বিন্দুমাত্র ভয় বা সংকোচের আভাস নেই বরং তার ঠোঁটে মিটমিট করছে একটা চাপা হাসি। বয়সে জোয়ান, একমাথা বড় বড় চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা গোঁফ দাড়ি। মুখের ছাঁদটি লম্বাটে, কোলবসা চোখ দুটোতে সরল আর হাসি-হাসি ভাব মাখা। গায়ে মাত্র একটা গলাবন্ধ হলদে গেঞ্জি, কাপড়টা হাঁটু থেকে একটু উপরে তোলা। একটা চটের থলি লাঠির ডগায় বাঁধা। লোমশ ভুর তলায় প্রায় ঢাকা পড়া বক্তার চোখজোড়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার আগন্তুকের আপাদমস্তক দেখে নিয়ে যথাসম্ভব বক্র ঠোঁটে জিজ্ঞাসা করল, কী হচ্ছিল ওখানে।
যদি লোকটার কথাবার্তা হাবভাব কিছুক্ষণ আগেও আগন্তুক না দেখত শুনত, তা হলে ওই মুখের সামনে দাঁড়িয়ে চট করে কথা বলতে আটকাত। সে বলল, এই শুনছিলাম হুজুর আপনার গালগল্প।
হুজুর আপনার গালগল্প কথাটা শুনে বক্তা ঘাড় বাঁকিয়ে আরও তীব্র চোখে তাকে দেখে নিল। অর্থাৎ লোকটা তাকে পরিহাস করছে কিনা বুঝে নিল সেটা। বলল, তা এদিকে কী মনে করে।
আগন্তুক একটু উসখুস করে জবাব দিল, শহরে যাবার রাস্তাটা খুঁজছিলুম। যা আঁধার পথ। ভেবেছিলুম ইদিক দিয়ে রাস্তা-টাস্তা হতে পারে।
এদিকে হতে পারে? বলতে বলতে বক্তার মুখ আরও বিকৃত হয়ে উঠল। বলল, আর খানিক রাত করে এলেই ভাল হত, বেশ পথ-টথও সব আপনা আপনিই দেখা যেত। যা দুচারটে ঘটি বাটি কাপড়চোপড় চটপট উঠে পড়ত তোমার হাতে। এখনও তো সব জেগে আছে।
অর্থাৎ আগন্তুককে সে চোর ঠাউরেছে। সকলে ফিকফিক করে হেসে উঠল। আগন্তুক দেখল সেই মাটির দেওয়ালের ঘরগুলো থেকে আরও কিছু নতুন মুখ দেখা দিয়েছে। সেও মিটমিট করে হেসে সবাইকে একবার দেখে জবাব দিল, হেঁ হেঁ হুজুর। সবাই তো পেরায় ল্যাংটা এখানে, কার কী চুরি করব?
সেই আলো-আঁধারিতে ভূতের মতো মানুষগুলোর কেউ কেউ হঠাৎ হেসে উঠল সেকথা শুনে। কেউ কেউ একটু অতিরিক্ত কৌতূহলে কাছে এসে দেখল তাকে। কেউ কোমরে হাত দিয়ে, ঘাড় বাঁকিয়ে। দু-একজন অল্পবয়স্কা মেয়ে বউও দেখে নিল তাকে হেসে হেসে, ঠেরে ঠেরে।
একজন বলে উঠল, বেড়ে চালু দেখছি।
কে আর একজন বলে উঠল, ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দে, কাল থেকে ওকে আমার মাদারি খেলায় নিয়ে যাব। বেশ কাজ দেখাতে পারবে। একেবারে ফাস কেলাস।
মাদারি খেলার অর্থ হচ্ছে বাজিকরী খেলা। ধুলো থেকে চিনি করা, কান মুচড়ে ডিম বের করা, আর রুমাল ঝেড়ে উড়িয়ে দেওয়া জোড়া পায়রা। তবে এর চেয়েও বড় কৃতিত্ব হল অদ্ভুত বক্তৃতায় ও ঢঙে এক হাতে ড়ুগড়ুগি ও আর হাতে আড় বাঁশি বাজিয়ে জনতার জমায়েত ও তাদের এক রহস্য উদঘাটনের রুদ্ধশ্বাস অবস্থায় চাকের মৌমাছির মতো জমিয়ে রাখা।
আগন্তুক বলে উঠল তেমনি হেসে, তা দাদা, একটা কাজ কাম পেলে তো বর্তে যাই।
খাটিয়ার বক্তার লোমশ শরীরটা নড়েচড়ে উঠল একটু, তারপর প্রায় হুংকার দিয়ে বলে উঠল, হঁ! কোত্থেকে আসা হচ্ছে?
তা অ-নে-ক দূর?
বক্তা তার গলার স্বরটা অনুকরণ করে বিকৃতমুখে ভেংচি কেটে বলল, কত্ত–দূর? সাতসমুদ্দুরের ধার থেকে?
আগন্তুক বিনীত হেসে জবাব দিল, না ইছামতির পাড়, ইটিন্ডেঘাট থেকে।
বক্তার গোঁফজোড়া আরও খানিক বেঁকে গিয়ে চোখ দুটো প্রায় ঢেকে গেল। কী জন্য এসেছ?
এই কাজকামের ফিকির টিকিরে।
কী কাজ জানা আছে?
ছুতোরের। জাতেও ছুতোর, কাজেও তাই।
কে একজন বলে উঠল, ও জাতের সঙ্গে শালা কারও বনে না। ওদের ঘরেরই ঠিক থাকে না। কথায় বলে,
ছুতোরের তিন মাগ
ভানে কোটে খায় দায়
থাকে থাকে যায় যায়।
সলি কাঠে কাঠে গুঁতোগুঁতি।
আগন্তুক বলল, হেঁ হেঁ কাঠে কাঠে বলেই থাকে থাকে যায় যায়, কিন্তু যায় না। ওই মজা আর কী! তবে অভয় পেলে একটা কথা বলি।
বলো।
বলছিলুম, আমার নিজের মাগ তার ছেলেপুলে নিয়ে অনেকদিন সগগে গেছে। পরের চেয়ে একটু নিজের ঘরের দিকে নজর রাখা ভাল। নইলে–
সকলেই হেসে উঠল তার কথায়। মেয়েরা একটু বেশি হাসল। বক্তা সবাইকে ধমকে উঠে বলল, আর কোনও পেশা আছে?
নেই। তবে ইয়ার দোস্তরা বলতে চারশো বিশ, মানে ফোর টুয়েন্টি। এবারে হাসির শব্দটা আরও জোরে বেজে উঠল।
ফোর টুয়েন্টি হচ্ছে ভারত সরারের একটি আইনের ধারা, প্রতারণার দায়ে তা আরোপ করা হয়। কথাটা কোনও কোনও মহলে, বিশেষ করে কলকারখানা এলাকায় খুব বেশি শোনা যায়। কথায় কথায় বলে, অমুকে ফোর টুয়েন্টি করে দিয়েছে, অর্থাৎ ধোঁকা দিয়েছে।
একজন বলে উঠল, বসো, বসে, পড়ো ভায়া, আজ বর্ষার রাতটা তোমাকে নিয়েই কাটিয়ে দিই।
খাটিয়ার বক্তার ভুড়ি যেন একটু কাঁপল, গোঁফ যেন একটু উঠল। বলল, ফোর টুয়েন্টি কেন বলে?
আগন্তুক বলল, হুজুর, ওই দায়ে মাস তিনেক জেল খেটেছিলুম। এক কাঠের গোলায় কাজ করতুম, সে গোলার মালিক ধরিয়ে দিয়েছিল।
আর কিছু জানা আছে?
রসিক আগন্তুক এবার একটু চুপ থেকে মিটমিট করে হাসতে লাগল। দেখল সকলেই প্রায় তার দিকে হাসিমুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। কেবল খাটিয়ার ওই দানবীয় মূর্তির মুখভাবও যেমন বোঝা যাচ্ছে না তেমনি ধরা যাচ্ছে না তার মনের হদিসটা। তবু আগন্তুকের সে প্রথম থেকেই কেন জানি মনে নিয়েছে, লোকটা শুধু রসিকই নয়, মনটা ও প্রাণটা তার দরাজ। একটু যা হুজুর কতা ভাব, মেজাজ একটু বা চড়াভরা। কিন্তু মানুষটা ভাল।
সে বলল, আর যা জানা আছে সবই অকাজের। হুজুরের তা পছন্দ হবে না।
তবু শুনি?
এই একটু গান-টানের শখ আছে, গল্প-সল্প বলতে পারি।
হুঁ। বলে বক্তা এক মুহূর্ত আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে রইল।
নও বিনা মেঘে বজ্রপলয়, প্রদেশে নানা কাজেতে আবার ত
জিজ্ঞেস করল, নাম?
গোবিন্দচন্দ্র শর্মা।
অন্যান্য লোকেরা গোবিন্দের দিকেই দেখছিল। সকলেরই কেমন একটু ভাল লেগে গিয়েছিল তাকে। চটকল শহরে দৈনিক কত লোকই আসে এবং যায়। দু-দণ্ড বসে কথা বলে যায়। দূরের খবর দিয়ে যায়, নিয়ে যায় এখানকার খবর। সুযোগ পেলে ঢুকে পড়ে কোনও কারখানায়, থেকে যায় ঘরভাড়া নিয়ে। এরকম অনেক লোককে তারা দেখেছে। দেখতে দেখতে সে মানুষ আবার পুরনোও হয়ে গেছে। আবার এসেছে নতুন মানুষ।
কখনও কখনও বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আসে ছাঁটাই। তখন দলে দলে মানুষের মিছিল এখান থেকে চলে যায় অন্যান্য জেলায়, প্রদেশে নানা কাজে। ঠিকে কাজে, কন্ট্রাক্টরের কাজে, কোথাও পুল তৈরি বা রাস্তা গড়তে, দূর গ্রামাঞ্চলে কৃষিমজুর খাটতে।… আবার আসেও।
কিন্তু এরকম লোক তারা দেখতে পায় খুব কম।
একজন বলল, কাজ-টাজের আশা ছেড়ে দেও, কোনও কলে একটা কাকপক্ষীও ঢুকতে পারছে। গেটের মুখে রোজ গাদা ভিড় লেগে থাকে, আর দারোয়ানের খেউড় শুনে, তো খেয়ে সব ফিরে যায়।
গুড়গুড় করে মেঘ ডেকে উঠল আকাশের কোন দূর থেকে। বার কয়েক বিদ্যুৎ চমকে উঠল মেঘের বুক চিরে। সোঁ সোঁ করে মত্ত হাওয়া ঝাপটা দিয়ে গেল খোলার চালায়।
সকলেই চুপচাপ। হাওয়ায় বাতির শিসটা কেঁপে কেঁপে উঠল, মাটির দেওয়ালের গায়ে সকলের ছায়াগুলো কিম্ভুতকিমাকারের মতো উঠল দুলে দুলে।
খাটিয়ার বক্তা বলল, বসো না কেন ঝোলাঝুলি নামিয়ে। এই ঝড় জল মাথায় করে কোথা যাবে এখন?
গোবিন্দ একবার বাইরের অন্ধকার আকাশের দিকে দেখে বলল, আজকের ঝড় তো কালকেও থাকতে পারে। মাথায় করে বেরুনো ছাড়া কি কোনও গতি আছে হুজুর?
তুমি হুজুর বলছ কেন হে? হঠাৎ বক্তা এবার চড়া গলায় জিজ্ঞেস করল।
গোবিন্দ আবার মিটমিট করে হেসে বলল, দেখে শুনে হুজুর হুজুর মনে নিল, তাই বলছি।
মেজাজি গলায় বক্তা বলল, আমি হলুম বাড়িওয়ালা, এ বাড়ির মালিক। হুজুর টুজুর নই, বুঝেছ?
গোবিন্দ তবু বলল, মালিক মানেই তো হুজুর। এত লোকজন যার, কথায় বলে…
বক্তা আবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। লোকটা তাকে ঠাট্টা করছে নাকি? না, সেরকম কিছু ধরা যায় না।
বলল, হ্যাঁ, এখানে আমার হুকুম ছাড়া ছাড়া কারও হুকুম খাটে না। আমার জমি, আমার ঘর, এখানে আইনও আমার।
বলে গোঁফটা বেশ করে পাকিয়ে তুলে বলল, আর দশজন বাড়িওয়ালার মতো আমি ছিচকে নই। আমার কাছে কোনও অন্যায় পাবে না, আবার বেশি তেরিমেরিও চলবে না। ট্যাঁ ফোঁ করলে দূরে করে দিই গলা ধরে। আমি কারও ধার ধারি না। বুঝবে, দিনকতক থাকলেই বুঝতে পারবে।
গোবিন্দ চকিতে একবার বাড়িওয়ালার মুখের দিকে দেখে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, থাকব না যখন তখন আর বোঝাবুঝির কী আছে।
বাড়িওয়ালা ভ্রূ কুঁচকে চুপ করে রইল খানিকক্ষণ। তারপর মুখ তুলে চোখ বুজে বলল, কালো।
কাছেই একটি আধবুড়ো লোক বসেছিল। বলল, বলো।
তুই না কোথা কাজ পাবি বলছিলি?
হ্যাঁ।
কবে থেকে?
পরশু থেকে।
তখন বাড়িওয়ালা বলল গোবিন্দকে, দেখো, তোমার যখন পেছনে কোনও লেন্ডিগেন্ডি নেই, আর তোমার হাড়ে যদি কুলোয়, তবে তুমি আমাদের রান্না করতে পারো।
গোবিন্দ কালো এবং আর সকলের মুখের দিকে একবার দেখল।
এ-সব বস্তিতে ঠিক হোটেল নয়, তবে ওই রকম একটা নিয়ম আছে। যারা পরিবার নিয়ে থাকে তারা সাধারণত নিজেরাই রান্না করে খায়। বাদবাকিরা এক জায়গায় তাদের বন্দোবস্ত করে নেয়। তার মধ্যেও অবশ্য মেয়েপুরুষ সবরকমই আছে। কলে-খাটা মেয়েদের অনেকে রান্নার ঝুঁকিটা নিতে চায় না। যারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কারখানায় কাজ করে তারাও কারও হাঁড়িতে নাম লেখায়।
 
Back
Top