Collected অন্ধ ও বধির - মোস্তাফিজুর রহমান টিটু

dukhopakhidukhopakhi is verified member.

Special Member
Registered
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
407
Messages
5,564
Reaction score
2,009
Points
3,913
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
*****অন্ধ ও বধির*****

মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু






‘তোর নাম আসলেই বিল্টু ।‘
-জ্বি স্যার ।
‘বিল্টু আবার কারো নাম হয় নাকি ?‘
-আমগো মতো মাইনসের হয় স্যার । ব্যাক দিন একই কথা জিগান । এহন আমারে ধইরা একটু উঠেন ।
‘কেনো আজকে কি রবিবার নাকি ?’
-জ্বে না আইজকা শুক্রবার । আপনার দোস্ত মতিন সাহেব আইবো । আর কথা কইয়েন না । আমারে কাম করবার দেন ।

সিরাজ সাহেব চুপ করেন । বিল্টু সিরাজ সাহেবকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে কাজ করতে থাকে । কি কাজ করে সেটা অবশ্য দেখতে পারে না সিরাজ সাহেব । তিন বছর আগে ব্রেইন স্ট্রোক করে সিরাজ সাহেবের । দুই মাস যমে-মানুষে টানাটানির পর হাসপাতাল থেকে বাসায় আসেন একটা মাংসের দলা হিসাবে । চোখে দেখতে পারেন না , কানে শুনতে পারেন না, কথা বলতে পারেন না, বাম হাতের কব্জি শুধু একটু নাড়াতে পারেন...তবে কেমন যেনো সব অনুভব করতে পারতেন । ঐ সময়েই আমেরিকা থেকে বড় ছেলে সবুজ আর লন্ডন থেকে মেয়ে মিতু আসে । অসুস্থ হবার প্রথম দিকে মেয়ে আর ছেলে নাকি এসেছিলো । অল্প কয়েকদিন থেকে আবার চলে গিয়েছিলো । এসবই পরে শুনেছেন সিরাজ সাহেব ।

বড় ছেলে, ছোট ছেলে আর মেয়ে মিলে আবার শুরু করলো চিকিৎসা । সকাল বিকাল ডাক্তার আর ফিজিওথেরাপিস্ট আসা যাওয়া শুরু করলো । প্রথমদিকে ভালো উন্নতিও হচ্ছিলো । এক মাস পরেই কথা বলা শুরু করলেন । বা হাতে আর বা পায়েও সাড়া ফিরে এলো । বাদিকে জোরও পেলেন খানিকটা । তিনমাস পরে খুব আবছাভাবে শোনাও শুরু করলেন । তবে চোখের কোনো উন্নতি হলো না । আর মাস ছয়েক পরে থেকে উন্নতিও থেমে গেলো । মিতু লন্ডন থেকে হিয়ারিং এইড পাঠালো । ঐটা পরলে মোটামুটি কথা শুনতে পারেন । কিন্তু খুলে ফেললে যা শোনেন তার কোনো মানে বের করতে পারেন না ।

-স্যার কোন পাঞ্জাবীটা পড়বেন ? যদিও কোনো মানে নাই তারপরও প্রতিবার বিল্টু জিজ্ঞেস করে । সিরাজ সাহেবের বেশ ভালো লাগে । ছেলেটা প্রতিদিন সকালে এক ঘণ্টা আর সন্ধ্যার পরে এক ঘণ্টার জন্য আসে । সিরাজ সাহেবের কাজ করার জন্য ।
‘আকাশী রং এরটা পরা ।‘ বিল্টু যত্ন করে পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দেয় । এর মাঝেই রুমে নতুন গন্ধ টের পান সিরাজ সাহেব । অসুখের পর থেকেই এটা হয়েছে । অন্য কিছু না শুধু মানুষের শরীরের গন্ধ টের পান সিরাজ সাহেব । এখন যে মিষ্টি গন্ধটা পাচ্ছেন সেটা ছোট বৌ শিলার । প্রতিদিন একবার না একবার এই রুমে আসবেই শিলা । কোনো কোনোদিন চার পাঁচবারও আসে । ছোট ছেলে সেলিম অবশ্য প্রতিদিন আসে না । তবে যেদিন আসে সেদিন কমপক্ষে একঘণ্টা থাকে রুমে ।
‘কেমন আছো বৌমা । অহনা কোথায় ? ‘
-জ্বি বাবা ভালো । আজ শুক্রবার না, অহনা ঘুমাচ্ছে বাবা । আজও আপনি আকাশী রং এর পাঞ্জাবী পরেছেন বাবা । এটা কি আপনার খুব পছন্দের ।
‘আমিতো আর রং দেখতে পারি না বৌমা । তবে এটা পরলে আরাম লাগে ।‘
-ঠিক আছে বাবা । আপনাকে একটু আতর দিয়ে দেই । মতিন চাচা এসে বসে আছেন । বলে শিলা খুব যত্ন করে আতর লাগিয়ে দেয় ।

-তোমাকে দেখলে খুব হিংসা হয় সিরাজ । কানের বেশ কাছে মুখ নিয়ে বলে মতিন সাহেব । দুজনে একসাথে চাকুরী করেছেন অনেকদিন । ডেপুটি সেক্রেটারি হিসাবে দুজনের অবসরও প্রায় একসাথেই । দুজনেই বিপত্নীক । সিরাজ সাহেবের স্ত্রী মারা গেছেন ছয় বছর আগে, আর মতিন সাহেবের চার বছর আগে । প্রতি শুক্রবার নিয়ম করে মতিন সাহেব আসেন সিরাজ সাহেবের বাসায় ।
-আমার মত মানুষ দেখেও হিংসা হয় ?
-হয় । কেনো হয় সেটা চোখে দেখতে পারলে ঠিকই বুঝতে পারতে । বেশী কিছু না তোমার আর আমার পাঞ্জাবীটা দেখেই । বাহ আবার আতরও দিয়েছো দেখছি ।
-হ্যা, ছোট বৌ দিয়ে দিলো । বলে একটু সলজ্জ হাসেন সিরাজ সাহেব । রোগ শরীরের অনেক কিছু কেড়ে নিলেও হাসিটা সেই আগের মতই আছে সিরাজের মনে মনে ভাবেন মতিন সাহেব ।
-সবই কি কপাল সিরাজ ? নাকি কর্মফলও আছে ? চাকুরীকালীন সময়ে খারাপ কাজতো কম করি নাই । তুমিও করছো তবে অনেক অল্প । নরম সরম মানুষ বলে দুই দুইবার ডিসি পোষ্ট পাইয়াও যাও নাই । আর আমি চার জেলায় ডিসি হিসাবে চাকুরী করলাম সাত বছর । মনে আছে ?
-খুব মনে আছে । জানোইতো আজকাল সব মনে পরে । চোখে দেখি না । কানের এই যন্ত্রটাও পরি শুধু শুক্রবার আর রবিবার । অথচ সারাটা দিন কত কিছু দেখি কত কিছু শুনি । আগের দিনের । তুমি কিন্তু দারুণ তেজী অফিসার ছিলা ।
-তা ছিলাম । যা বলতাম যা করতাম সরাসরি বলতাম-করতাম । পিরোজপুরে আমার নামই ছিলো সোজা ডিসি । ওহহো গতসপ্তাহে বিনোদিনী স্কুলের হেডমাস্টারের সাথে দেখা হয়েছে । সেও দেখি বুড়ো হয়ে গেছে ।
-কে ?
-আরে তোমাকেতো এর কথা কয়েকবার বলেছি । একবার দেখেছোও ।
-ওহ বুঝেছি । যে স্কুলে গেলেই মনে হতো বিদেশের স্কুল... এতটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । পরে টের পাইছো আসলে স্কুলের অবস্থা খুবই খারাপ । শুধু তুমি যেদিন যাইতা তার আগে সব ছাত্র-ছাত্রীর ইউনিফর্ম, স্কুলের দেয়াল, বারান্দা ঝকঝক তকতকে করে রাখা হোতো ।
-হ্যা লোকটা কতবড় ধান্ধাবাজ, কিচ্ছু টের পাই নাই । কোনোরকম ঘুষ না নিয়াই স্কুলের নামে দুইবার বেশ কিছু টাকা ছাড় করিয়েছি । যেটা বেশীরভাগ এই হেডমাস্টার আর স্কুল কমিটির সভাপতি খেয়ে ফেলেছে । তাকেই দেখলাম । এখনো সেই অমায়িক ব্যবহার । বুড়ো হলেও স্বভাব আগের মতোই আছে । এতটকু বলার পরেই ছোট বউ শিলা আসে । পিছনে ট্রে হাতে করে কাজের লোক ।

-চাচা কেমন আছেন ? মিষ্টি করে হেসে বলে শিলা ।
-আমাদের আর থাকা । বাতিল মাল, ভাঙ্গা বাসন কোসন । আগের দিনে কটকটিওয়ালা ছিলো বইলা তাও কিছু দাম ছিলো । এখনতো তাও নাই । শোনো তোমারে আমার চাকুরী জীবনের একটা গল্প বলি । একবার হইলো কি এক এস পিরে সবাইর সামনেই দিলাম এক চড় ...বলে লম্বা একটা গল্প বলে ফেলেন । এই এক সমস্যা হয়েছে মতিন সাহেবের । আজকাল অনেক কথা বলে ফেলেন । বলতে খুব ভালো লাগে । সমস্যা হয়েছে আজকাল কেউ তার কথা শুনতে চায় না । শুধু এই বাসাটাই ব্যাতিক্রম । সিরাজতো শোনেই । এই যে কি সুন্দর হাসি হাসি মুখ করে শিলাও শুনছে । তাইতো মাঝে মাঝে মনে হয় শুধু শুক্রবার কেনো অন্যদিনওতো আসা যায় । নিজের বাসা থেকে বেশী দূরওতো না । একটু লজ্জা লজ্জা লাগে বলে আসতে পারছেন না ।
-আপনারা বাঘের মত ছিলেন । কি সাহস ? চাচা এই চায়ের কাপটা বাবার । বাবার বিস্কুটও কিন্তু আলাদা । এই যে এখানে । আমার ভিতরে একটু কাজ আছে । আপনারা গল্প করুন । বলে শিলা উঠে পরে । কি সুন্দর ব্যবহার ! অচল শ্বশুরের জন্য কি যত্ন ! আহা !
-আমি ভুলটা কোন জায়গায় করলাম সিরাজ ? ছোট একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করেন মতিন সাহেব ।
-কেনো এই কথা কেনো ? সিরাজ সাহেব জিজ্ঞেস করেন ।
-তোমার ছেলে মেয়ের চাইতেতো আমি আমার ছেলে মেয়ের জন্য বেশী পয়সা খরচ করছি । সব চাইতে ভালো স্কুল কলেজে পড়াইছি । সারা বছর ধইরা টিউটর দিছি । এখন ছেলেরা কেউ আমার কোনো খোজ রাখে না । বউ নাতি নাতনিরাতো অনেক দূরের । আর তুমি ? কি যত্নে আছো ।
-আসলেও জানো এই জীবনটাও অসহ্য খারাপ লাগছে না । কেমন জানি ভালোই লাগছে । বাদ দেওতো । তুমি এখন আছো কোন ছেলের সাথে ।
-ছোট ছেলে ।
-ছোট ছেলের সাথেই মনে হয় বেশী থাকো ?
-হ্যা । কারণ ঐ বাসাতেই সামান্য একটু দাম এখনো আছে ? কারণ কি জানো ?
-কি ?
-কারণ ঐ বাসাতে আড়াই বছর বয়সী এক শিশু আছে । বৌমা শপিং, বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিতে বাইরে যেতে পারে নিশ্চিন্ত মনে । কাজের মেয়ের চাইতেও দাদাতো অনেক বেশী নির্ভরযোগ্য তাই না ?
-এসব কথা বাদ দেওতো ?
-বাদতো আমিও দিতে চাই । কিন্তু তোমার এখানে আসলে আরো বেশী মনে পরে । আসলে জানো কি সব হচ্ছে ভাবীর অবদান । ভাবীকেতো দেখেছি কি সুন্দর সব কিছু ম্যানেজ করেছেন ।
-দেশের কি অবস্থা ? কথা ঘোরাবার জন্য সিরাজ সাহেব জিজ্ঞেস করেন ।
-দেশের অবস্থার কথা পরে বলি । ভুলে যাবার আগে আসল কথাটা বলি । তোমাকে এক আধ্যাত্মিক সাধকের কথা বলেছিলাম না । এই সোমবার তার সাথে দেখা হবে । তোমার কথা তাকে আগেই বলেছি । দেখি কিছু দেয় কিনা । এইবার বলি দেশের কথা ...

-কেমন আছো বাবা ? রবিবার দুপুর একটায় নিয়মমতো মেয়ে মিতু স্কাইপ করে । লন্ডনে এখন ছুটির দিনের সকাল ।
-ভালো আছিরে মা । তোরা সবাই কেমন আছিস । টিয়া, টগর কেমন আছে । জামাই কেমন আছে ?
-সবাই ভালো আছে বাবা । তুমি খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করতে পারোতো ?
-পারি মা । তোরা আসবিনা ?
-আসবো বাবা । এই জুনেই আসবো । শিলা বাবার দাড়িতো মনে হয় বেশ বড় হয়ে গেছে । নাপিত আসে না । প্রশ্নটা পাশে দাঁড়ানো ছোট বৌকে করা ।
-আজকেই আসবে আপা ।
-শোনো তোমার একাউণ্টে চারশ পাউন্ড পাঠাইছি । বাবার যখন যা লাগে খরচ কইরো । সেলিমতো অনেক ব্যস্ত থাকে তাই তোমার একাউন্টেই পাঠাই ।
-ঠিক আছে আপা । বড়ো ভাইও আমার একাউন্টেই পাঠায় ।
-শোনো তোমার সাথে আমার আরো কথা আছে । বাবা আবার আগামী সপ্তাহে কথা বলবো । বলে বিদায় নেয় মিতু । ঘণ্টাদুয়েক পরে সবুজ ফোন করবে আমেরিকা থেকে । রবিবার দিনটা বেশ সুখকর ব্যস্ততায় কাটে সিরাজ সাহেবের । অথচ ছেলেমেয়ে নিয়ে কি সমস্যাই না গেছে ।

ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন সময়েই হঠাৎ একদিন মিতু ঘর ছেড়ে পালালো । খোজ নিয়ে জানা গেলো পাড়ার এক বখাটে ছেলের সাথে ভেগেছে মিতু । তিনদিন পর খোজ পাওয়া গেলো । মিতুর মামারা নিয়েও আসলেন মিতুকে । সেই থেকে বছর দেড়েক মিতু রাজশাহীর মামা বাড়িতেই থাকলো । মামা বাড়িতেই মিতুর বিয়ে হয় । ডাক্তার ছেলের সাথে । সব কিছু ম্যানেজ করেছে স্ত্রী যোবেদা । ইন্টারমিডিয়েটের পরে বড় ছেলে সবুজও প্রায় উচ্ছন্নে যাচ্ছিলো । তাকে আমেরিকা পাঠাবার বুদ্ধিও যোবেদার । মতিন ঠিকই বলেছে । যোবেদা না থাকলে কি হোতো ভাবা যায় না ...মনে মনে আরো একবার প্রয়াত স্ত্রীর উপর কৃতজ্ঞতাবোধ করেন সিরাজ সাহেব ।


আসসালাতূ খাইরুম মিনান নাওম
আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম
আহ কতকাল পরে ফজরের আজান শুনছি । চোখ বন্ধ করেই মনে মনে ভাবেন সিরাজ সাহেব । কানের যন্ত্রটা মনে হয় কাল রাতে খোলা হয় নাই । পরক্ষনেই মনে হয় এটাতো সম্ভব না । কানে যন্ত্র নিয়ে তিনি কখনোই ঘুমাতে পারেন না । আসলে শুক্র ও রবিবার অল্প সময়ের জন্যই তিনি কানে যন্ত্র পরেন । তাহলে কি...? ইয়াল্লা, ইয়া মাবুদ ...। অথচ পরশুদিন মতিন যখন গাছগাছড়াগুলো দিলো তখন তিনি একেবারেই বিশ্বাস করেন নাই । বন্ধু দুংখ পেতে পারে বলে মুখ ফুটে অবশ্য কিছু বলেন নাই । গতকাল সকালে বিল্টুর হাতে গাছগাছড়াগুলো দিয়ে যখন বলেছেন এগুলো এক গ্লাস পানিতে ভিজিয়ে দে তখনো তেমন কিছু মনে করেন নাই । এর আগেও এরকম অনেক কিছু খেয়েছেন ...কোনো কাজ হয় নাই ...হওয়ার কথাও না । অথচ...চোখটাও কি খুলবো নাকি ...ইয়াল্লা, ইয়া মাবুদ ...

বড় এক মাকড়শা নিশ্চল ঝুলে আছে । এই কুৎসিত দৃশ্যটাই প্রথম দেখলেন সিরাজ সাহেব । সকালের আলো আগন্তকের মত সবে কিছুটা ঘরে ঢুকেছে । তার আলোতে সিলিঙয়ের কোনায় কোনায় আরো গোটা দশেক মাকড়শা দেখতে পেলেন সিরাজ সাহেব । ডানদিকের হাত পা নাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন একটু । তারপরও ... আশ্চর্য এরকমও হয় । আবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন সিরাজ সাহেব । একটু হয়তো ঘুমিয়েও পরেছিলেন । অতিরিক্ত উত্তেজনার ফলে হয়তো ।

এরপরের বার যখন চোখ খুললেন তখন আলো আধারী একদম কেটে গেছে । প্রথমেই নিজের শরীরের দিকে চোখ যায় । গেঞ্জিটায় হলুদ, লাল আর ছাই রং মাখামাখি হয়ে আছে, কতদিন আগে ধোয়া হয়েছে কে জানে । মাথাটা সামান্য ঘুরিয়ে পাশের টেবিলের দিকে তাকালেন । একটা প্লেটে এক টুকরা রুটি । রূটিটার উপরে একটা তেলাপোকা বসে আছে । পাশেই পিরিচে একটা ডিম । সেখানেও দুইটা তেলাপোকা । সকালে কাজের লোক হয়তো রেখে গেছে । একটু দূরে ময়লা ফেলার ঝুড়িটা উপচে পরছে ময়লা । অল্প সময় পরেই বিল্টু এলো । ছেলেটার চেহারা আগে কখনো দেখা হয় নাই সিরাজ সাহেবের । আজই প্রথম দেখলেন । গোলগাল মুখ, কালো হলেও একটা লাবন্য আছে মুখে । ‘জানিস বিল্টু...’ কি মনে হতেই চুপ করে যান সিরাজ সাহেব । খবরটা প্রথমে বিল্টুকে দেয়া ঠিক হবে না । বিল্টু বেড প্যান আর বিছানার আশে পাশে পরিষ্কার করতে থাকে । একটু পরেই বিল্টু পাউরুটি আর ডিমটা নিয়ে আসে প্রতিদিনের মত । কিন্তু প্রতিদিনের মত খেতে পারেন না সিরাজ সাহেব । কেনো পারেন না সেটাও বলতে পারে না । ‘আপনেতো এমন করেন না । শরীর ঠিক আছেতো ?’ বিল্টু জিজ্ঞেস করে । শরীর আমার ঠিকই আছে । উত্তর দেন সিরাজ সাহেব । ‘আইচ্ছা আমি তাইলে এখন যাই । আজকেতো রবিবার । দুপুরেতো আবার আসতে হবে ।‘ বলে বিদায় নেয় বিল্টু । একটু পরেই নাকে মিষ্টি গন্ধ এসে লাগে । চোখ না খুলেও বুঝতে পারেন ছোট বৌ শিলা এসেছে । মনটা খুশী হয়ে যায় সিরাজ সাহেবের । ভাবেন খবরটা শিলাকেই প্রথম দেই । চোখ মেলে দেখেন ফোন হাতে মিলা দূরের একটা সোফায় বসে আছে । সেই একইরকম মিষ্টি চেহারা ছোট বৌমার ।
-আচ্ছা দিনে যে এরকম দশ-বারো বার ফোন করো এটা কি ঠিক ? সেলিম বাসায় আছে । তাও কপাল ভালো শ্বশুরের এই রুমটা আছে । শ্বশুর চোখেও দেখে না কানেও শুনে না তাই বারবার এই রুমে আসলেও সমস্যা হয় না । শিলার কথা শুনে অবাক হয়ে যায় সিরাজ সাহেব ।
-শোনো শ্বশুর সাহেবের জন্য আমার ভাসুর আর ননাস যে টাকা পাঠান সেখান থেকে ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকা ব্যয় করা কোনো ব্যাপার না । তুমি চিন্তা কইরো না । আরে বাবা কালকেতো আসছিই ..বেশী দুস্টামি করবা না কিন্তু ... ফোন শেষ করেই শিলা সোজা রুম থেকে বের হয়ে যায় । সিরাজ সাহেবের দিকে একবার তাকায় না পর্যন্ত ।

আর একটু পরেই ছোট ছেলে সেলিম ঢোকে রুমে । বাহ ছেলের স্বাস্থ্যতো বেশ ভালো হয়েছে । একটা ল্যাপটপ নিয়ে একটু আগে যেখানে শিলা বসেছিলো সেখানেই বসে সেলিম ।
-বাবার এই রুমটা বেশ নিরাপদ । তোমাকেতো হলুদ ড্রেসটায় দারুণ লাগছে ...আরো কয়েকটা কিনে দিতে হবে ...সেলিমও বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে । রুম থেকে যাওয়ার সময় অবশ্য সেলিম বাবার দিকে একবার তাকিয়ে ‘বাবা কেমন আছো?’ বলে । তবে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে না ।

দুপুরে বিল্টু এসেই সিরাজ সাহেবের মুখের চর্চা করে । মুখ ধুয়ে, ক্রিম দিয়ে পরিপাটি করে ফেলে । শেষ হবার পরে নিত্যকার মতো জিজ্ঞেস করে ‘চাচা কোন পাঞ্জাবীটা পড়বেন ।‘ আজকে আর উত্তর দিতে ইচ্ছা করে না সিরাজ সাহেবের । চকচকে ইস্ত্রি করা ঘিয়ে রঙয়ের এক পাঞ্জাবী পড়ায় বিল্টু । নিজেকে কেমন যেনো বিনোদিনী স্কুলের ছাত্রের মত মনে হয় সিরাজ সাহেবের...চকচকে ইউনিফর্ম পরা ...একটু পরেই মেয়ে আর ছেলে দেখবে তাই । একটু পরেই হাসি হাসি মুখ করে শিলা আসবে । সেলিম মনে হয় আজকে বাসায় আছে ...সেও হয়তো আসবে ।

কিন্তু সিরাজ সাহেব অধীর আগ্রহে পরের শুক্রবারের জন্য অপেক্ষা করেন । মতিনকে বলতে হবে পীর বাবার কাছ থেকে অন্ধ আর বধির হবার ওষুধ নিয়ে আসতে । এই অল্প কয়েক ঘণ্টাতেই বুঝে গেছেন এই বয়সে আর এই পোড়া সময়ে এর চাইতে আশীর্বাদ আর কিছু হতে পারে না !!!
 
Back
Top