- Joined
- Dec 28, 2024
- Threads
- 164
- Messages
- 3,897
- Reaction score
- 1,700
- Points
- 2,213
- Age
- 46
- Location
- Dhaka
- Gender
- Male
সময়ের সিঁড়ি
(উৎসঃ শব্দের আঁচড়ে গাঁথা স্বকীয় ভাবনার মৌলিক নির্ভেজাল নির্যাস, আমার নিজের লেখা)
(উৎসঃ শব্দের আঁচড়ে গাঁথা স্বকীয় ভাবনার মৌলিক নির্ভেজাল নির্যাস, আমার নিজের লেখা)
ময়মনসিংহের একটা পুরনো বাজারের কোণে, যেখানে লোকজন সাধারণত যায় না, সেখানে একটা ছোট্ট দোকান ছিল। দোকানের নাম: "কালের খেলাঘর"। বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো, এটা কোনো পুরনো বইয়ের দোকান, কিন্তু ভেতরে ঢুকলে চোখ ধাঁধিয়ে যেত। দেওয়ালে অদ্ভুত ঘড়ি, তাকের উপর কাচের বোতলে রঙিন ধোঁয়া, আর মাঝখানে একটা পুরনো কাঠের সিঁড়ি, যার শেষ কোথায় তা বোঝা যেত না।
আয়ান, একজন কলেজ ছাত্র, যে সবসময় কৌতূহলী আর একটু বেশিই দুঃসাহসী, এক বৃষ্টির দুপুরে এই দোকানে ঢুকে পড়ল। তার হাতে একটা পুরনো ডায়েরি ছিল, যেটা সে তার বাবার লাইব্রেরি থেকে পেয়েছিল। ডায়েরিতে লেখা ছিল: "সময়ের সিঁড়ি খুঁজে পেলে, তুমি অতীত বদলাতে পারবে। কিন্তু সাবধান, প্রতিটি পদক্ষেপের দাম আছে।"
দোকানের মালিক, একজন বৃদ্ধ, যার চোখ দুটো যেন তারার মতো ঝকঝক করত, আয়ানকে দেখে হাসলেন। "তুমি এসেছ, তাই না? সিঁড়িটা তোমাকে ডাকছে।" আয়ান হেসে বলল, "এটা কি কোনো ম্যাজিক শো? আমি তো শুধু ডায়েরির কথা জানতে এসেছি!" বৃদ্ধ বললেন, "সময়ের সিঁড়ি কোনো খেলা নয়। এটা তোমাকে অতীতে নিয়ে যাবে, কিন্তু তুমি যা বদলাবে, তার ফল ভবিষ্যতে এসে ধরা দেবে। তুমি কি প্রস্তুত?"
আয়ানের মনে একটা অদ্ভুত টান অনুভব হল। তার বাবা পাঁচ বছর আগে একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, আর সেই দুর্ঘটনার কথা ভাবলেই আয়ানের মনে অপরাধবোধ জাগত। সে যদি সেদিন বাবার সঙ্গে না ঝগড়া করত, তাহলে কি বাবা বেঁচে থাকতেন? এই সিঁড়ি কি তাকে সেই ভুল শোধরানোর সুযোগ দেবে?
আয়ান তার বন্ধু রিমিকে সঙ্গে নিল। রিমি, যে সবকিছুতেই হাসি খুঁজে পায়, দোকানে ঢুকে বলল, "এটা কি হ্যারি পটারের সেট নাকি? এই ঘড়িগুলো কেন যেন আমার দিকে তাকাচ্ছে!" বৃদ্ধ তাদের সিঁড়ির সামনে নিয়ে গেলেন। সিঁড়িটা দেখে আয়ানের গা ছমছম করে উঠল। প্রতিটি ধাপে একটা অদ্ভুত চিহ্ন খোদাই করা ছিল, আর উপর থেকে একটা মৃদু আলো নেমে আসছিল।
বৃদ্ধ বললেন, "প্রতিটি ধাপ তোমাকে এক বছর পিছনে নিয়ে যাবে। তুমি যত ধাপ নামবে, তত অতীতে চলে যাবে। কিন্তু মনে রাখ, তুমি যদি অতীতে কিছু বদলাও, ভবিষ্যৎও বদলে যাবে। আর ফিরে আসার জন্য তোমাকে একটা জিনিস ছাড়তে হবে।" রিমি হেসে বলল, "কী ছাড়তে হবে? আমার মোবাইল? আমি কিন্তু ইনস্টা ছাড়া বাঁচব না!" বৃদ্ধ গম্ভীরভাবে বললেন, "সময় নিজেই ঠিক করে নেয় তুমি কী ছাড়বে।"
আয়ান সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখল। হঠাৎ তার চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল, আর যখন আলো ফিরল, সে দেখল সে তার পুরনো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। তারিখ ছিল পাঁচ বছর আগের, ঠিক সেই দিন, যেদিন তার বাবার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল। রিমি পাশে দাঁড়িয়ে বলল, "আয়ান, এটা কি সত্যি? আমরা কি টাইম ট্রাভেল করলাম? আমার তো মনে হচ্ছে আমি কোনো সায়েন্স ফিকশন মুভিতে!"
আয়ান তার বাবাকে দেখল, যিনি ঠিক আগের মতো জীবন্ত। তার বাবা তাকে দেখে হাসলেন, "আয়ান, তুই এত তাড়াতাড়ি ফিরলি?" আয়ানের গলা বুজে এল। সে জানত, এই দিনে তার বাবা একটা মিটিংয়ে যাবেন, আর পথে একটা ট্রাকের সঙ্গে দুর্ঘটনায় মারা যাবেন। আয়ান ভাবল, যদি সে বাবাকে আটকাতে পারে, তাহলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে?
কিন্তু সমস্যা হল, তার বাবা তার কথা বিশ্বাস করলেন না। আয়ান যখন বলল, "বাবা, তুমি আজ বাইরে যেয়ো না, দুর্ঘটনা হবে," তার বাবা হেসে বললেন, "তুই কি সিনেমা দেখে এসেছিস?" রিমি পরামর্শ দিল, "তুই ওনার গাড়ির চাকা পাংচার করে দে! তাহলে তো যেতেই পারবেন না!" আয়ান হাসল, কিন্তু তার মন বলছিল, এত সহজ হলে তো বৃদ্ধ সতর্ক করতেন না।
আয়ান শেষমেশ তার বাবার সঙ্গে গাড়িতে উঠল, ভাবল, সে নিজে গিয়ে দুর্ঘটনা আটকাবে। কিন্তু রাস্তায় যখন সেই ট্রাকটা দেখল, তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। সে চিৎকার করে বলল, "বাবা, গাড়ি থামাও!" তার বাবা তৎক্ষণাৎ গাড়ি সাইডে নিলেন, আর ট্রাকটা তাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। আয়ানের বুক ধুকপুক করছিল। সে কি সত্যিই বাবাকে বাঁচাল?
যখন তারা বাড়ি ফিরল, আয়ান দেখল, সবকিছু বদলে গেছে। তার মা, যিনি বাবার মৃত্যুর পর ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন, এখন হাসিখুশি। তার বোন, যে স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল, এখন কলেজে পড়ছে। কিন্তু একটা জিনিস আয়ানের চোখে পড়ল, রিমি আর তার পাশে নেই। সে চারপাশে খুঁজল, কিন্তু রিমির কোনো চিহ্ন নেই। তার মা বললেন, "রিমি? ও তো কখনো আমাদের বাড়িতে আসেনি।"
আয়ানের মাথা ঘুরে গেল। সে কি এমন কিছু বদলে ফেলেছে যে রিমির অস্তিত্বই মুছে গেছে? সে দৌড়ে সেই দোকানে ফিরল। বৃদ্ধ তাকে দেখে বললেন, "তুমি বদলেছ, তাই না? এবার দাম দেওয়ার পালা।" আয়ান চিৎকার করে বলল, "আমার বন্ধু কোথায়? আমি তাকে ফিরিয়ে আনতে চাই!" বৃদ্ধ বললেন, "সময়ের সিঁড়ি আবার উঠতে হবে। কিন্তু এবার তুমি আরো বড় কিছু ছাড়তে হবে।"
আয়ান সিঁড়িতে উঠল। এবার প্রতিটি ধাপে তার স্মৃতি মুছে যাচ্ছিল। সে তার বাবার হাসি ভুলে গেল, তার মায়ের কান্না ভুলে গেল। কিন্তু রিমির কথা মনে রাখল। শেষ ধাপে পৌঁছে সে দেখল, রিমি তার সামনে দাঁড়িয়ে। রিমি হেসে বলল, "তুই সত্যি পাগল! আমার জন্য এত কিছু করলি?" কিন্তু আয়ানের চোখে জল। সে বলল, "আমি সব ভুলে গেছি, রিমি। আমি জানি না আমি কে।"
রিমি আয়ানকে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনল। বৃদ্ধ বললেন, "সময় কাউকে ক্ষমা করে না। তুমি তোমার বন্ধুকে ফিরিয়ে এনেছ, কিন্তু নিজেকে হারিয়েছ। তবে একটা উপায় আছে।" বৃদ্ধ তাকে একটা ছোট্ট কাচের বোতল দিলেন, যার মধ্যে একটা আলো জ্বলছিল। "এটা তোমার স্মৃতি। তুমি এটা ফিরিয়ে নিতে পারো, কিন্তু তাহলে তোমার বাবা আবার হারিয়ে যাবে।"
আয়ানের মন দ্বিধায় পড়ে গেল। সে কি তার বাবাকে বাঁচাবে, নাকি নিজের স্মৃতি ফিরিয়ে নেবে? রিমি বলল, "আয়ান, তুই যা ঠিক মনে করিস, তাই কর। কিন্তু আমি তোর সঙ্গে আছি, এমনকি যদি তুই আমাকে ভুলেও যাস।" আয়ান হাসল। সে বোতলটা বৃদ্ধের হাতে ফিরিয়ে দিল। "আমি নতুন করে শুরু করব। আমার বাবা বেঁচে থাকুক।"
দোকান থেকে বেরিয়ে আয়ান আর রিমি বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে লাগল। রিমি বলল, "তুই জানিস, এই টাইম ট্রাভেলের পর আমার ইনস্টায় কত লাইক পড়বে?" আয়ান হেসে বলল, "তুই না সত্যি অদ্ভুত!"
আয়ান বুঝল, অতীত বদলানো সম্ভব, কিন্তু তার দাম সবসময় ভারী।
এই গল্প শুধু সময় ভ্রমণের রোমাঞ্চ নয়, এটা আমাদের জীবনের পছন্দ আর ত্যাগের গল্প। আমরা সবাই কি কখনো অতীতের কোনো ভুল শোধরাতে চেয়েছি? কিন্তু প্রশ্ন হল, আমরা কতটা ছাড়তে প্রস্তুত?