Collected সভ্যতার অগ্রগতি - মোস্তাফিজুর রহমান টিটু

dukhopakhidukhopakhi is verified member.

Special Member
Registered
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
407
Messages
5,564
Reaction score
2,005
Points
3,913
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
*****সভ্যতার অগ্রগতি*****

মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু






ফেনী রেলষ্টেশনে গত এক ঘণ্টা যাবত বসে আছি । না কোনো ট্রেন ধরার জন্য বসে নাই । বসে আছি রেলের এক কর্মকর্তার অপেক্ষায় । টিকিটিং সিস্টেমের নতুন টার্মিনাল বসাবার জন্য কিছু ওয়্যারিং করাতে হবে । যদিও আমাদের কাজ কিন্তু করাতে হবে রেলের লোক দিয়েই । আমি ঐসময়ে কুমিল্লা থাকার কারনে অফিস আমাকেই দায়িত্ব দিলো । সকালের ট্রেনে ফেনী এসেছি । এখন প্রায় এগারোটা বাজে । রেল কর্মকর্তা ওমর সাহেব কখন অফিসে আসবে কেউ জানে না । এখন কোনো ট্রেন নাই । বুকিং ক্লার্করা চা-সিগারেট সহযোগে আড্ডায় ব্যস্ত, প্লাটফর্মে একটা মাদী কুকুর তিনটা বাচ্চাসহ শুয়ে আছে, স্টেশনের বাইরে একমাত্র রিক্সার গদীতে বসে রিক্সাওয়ালা মনের সুখে সিগারেট টানছে...চারিদিকে কেমন সুন্দর অলসতা, স্থিরতা । কিন্তু এসব দেখেও মনে স্থিরতার বদলে কেমন বিরক্তি দানা বেঁধে উঠছে...

“কে...কে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে ?” বলতে বলতে একজন ছোট-খাটো মধ্যবয়স্ক মানুষ ষ্টেশনে আসেন ।
-জ্বি, আমি । চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের নাম পরিচয় দেই । আসার কারণটাও বলি ।
“আসো ভিতরে এসে বসো ।“ খেয়াল করি উনি আমাকে তুমি করে বলছেন । আমার সাধারন সমস্যা । দৈহিক গড়নই মূল কারন । মোটা-তাজা হবার জন্য ইউরিয়া সার বাদে বাকী সব কিছু চেষ্টা করেছি । লাভ হয় নাই । চেহারায় একটু ভারিক্কি আনার জন্য মাঝখানে সপ্তাহ দুয়েক গোফ রাখার চেষ্টা করেছিলাম । ফলাফল আরো করুন । লালমাটিয়ার আড়ং এর সামনে দাঁড়িয়ে রিক্সা খুজছি । হঠাৎ এক সুন্দরী মহিলা এসে বললেন ‘এই একটা রিক্সা ধরে দেও না ।‘ এর পরের দিনের ঘটনা আরো করুন । থাক এসব । নিজের অপমানের কথা এত ঢাক-ঢোল বাজিয়ে না বলাই ভালো ।

ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওমর সাহেবের সামনের চেয়ারে বসলাম ।
“তোমার কাজের জন্যতো ইলেক্ট্রিশিয়ান লাগবে । এখন পাবো কিনা কে জানে । এই শহীদ...” বলে একজনকে ডাক দিয়ে ইলেক্ট্রিশিয়ানের খোজে পাঠান ওমর সাহেব । দুজনের জন্য চায়ের কথাও বলেন । চা আসে । ওমর সাহেব আলাপ শুরু করেন । প্রাথমিক বিরক্তিটা দ্রুত কেটে যায় । দিলখোলা মানুষ ওমর সাহেব । রাজশাহী বাড়ী । কথা বলেন বেশ মজা করে ...
“বুঝলা এইখানে পানিশমেন্ট পোস্টিঙে আছি । মনে হয় বছরখানেক থাকতে হবে । সরকারী চাকুরীর এ,বি,সি ভুলে গেছিলাম তাই এই অবস্থা । এ,বি,সি কি জানোতো ?”
-জ্বি না । আমি ছোট করে উত্তর দেই ।
“এ তে হইলো অ্যাভয়েড । কাজ আসলেই চেষ্টা করবা অ্যাভয়েড করতে । বি তে হইলো গিয়া বাইপাস । বাইপাশ মানে কি বুঝছো ?” আমি উত্তর দেবার আগেই ওমর সাহেব আবার বলা শুরু করেন...
“পাস আর বাইপাসের মধ্যে কিন্তু ফারাক আছে । পাস দিলে তোমারে আবার ব্যাক পাস দিতে পারে । তাই কাজ এমনভাবে বাইপাস করবা যাতে তোমার কাছে আর ফিরা না আসে ।“
-সি তে কি ? আমি আবার ছোট করে জিজ্ঞেস করি ।
“কাজ অ্যাভয়েড কিংবা বাইপাস করতে পারো নাই । তাইলে কি করবা জানো । একটা কমিটি কইরা ফালাইবা । সি তে হইলো কমিটি । কাজ খারাপ ভালো যাই হোক তোমাকে যেনো কেউ দায়ী করতে না পারে । দায় সব কমিটির । এই এ,বি,সি থিওরী মেনে অনেকদিন ভালো ছিলাম । ভুতে কিলাইছিলো তাই কিছু কাজ করতে গিয়েছিলাম । ফলাফল পানিশমেন্ট পোস্টিং ।“ এভাবেই কথা চলতে থাকে । আমার বেশ ভালো লাগে । একটু পরেই শহীদ এসে জানায় ইলেক্ট্রিশিয়ান আজ ছুটিতে ।

“তোমাকেতো তাহলে আর একদিন আসতে হবে । ফিরবে কিভাবে ?”
-প্লান ছিলোতো কাজ শেষ করে বিকেলের ট্রেনে ফিরে যাবো । এখনতো আর কিছু করার নাই । দেখি বাসেই ফিরে যাবো ।
“বিকেলের ট্রেনেই ফিরো । চলো বাসায় যাইয়া আড্ডা দেই । এইখানে অল্প কিছুদিন এসেছি । তোমার সাথে আড্ডা দিতে ভালোই লাগবে ।“
-আজ থাক । অন্য আর একদিন যাবো । আমি আপত্তি করার চেষ্টা করি ।
“এত ফর্মালিটি করো কেন মিয়া । তাছাড়া এখান থেকে বাস স্ট্যান্ড গিয়ে বাসে উঠে যতক্ষণে ফিরবে তার আগেই ট্রেনে ফিরতে পারবা ।“

অতএব ওমর ভাইয়ের বাসায় যেতেই হয় । ষ্টেশন থেকে কাছেই বাসা । দরজা যিনি খোলেন তিনি যে ওমর ভাইয়ের স্ত্রী সেটা বোঝাই যায় । ভদ্রমহিলা এককালে অনেক সুন্দরী ছিলেন সেটা বোঝা যায় । এখনও যথেস্ট সুন্দরী...এতটাই যে ওমর ভাইকে তার পাশে বেমানানই লাগে । ওমর ভাই পরিচয় করিয়ে দেন ।
“সানু ভাত দেও তাড়াতাড়ি । “ ওমর ভাই বলেন ।
-ভাই আড্ডা দিতে এসেছি । খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ঝামেলা কেনো । আমি আপত্তি করি ।
‘ছোট ভাই তোমাদের বাসায় দুপুর বেলায় কেউ গেলে কি খেতে বলো না । আর এই মানুষটার সাথে এইসব ফর্মালিটি করে লাভ নাই । কি চিজ জানো নাতো ?’ সানু ভাবী হাসতে হাসতে বলেন ।
“আর তুমি খুব ভালো । আমাকে প্রথম দিনে কি বলেছিলে বলব ছোট ভাইকে ।“ ওমর ভাই পাল্টা উত্তর দেন ।
‘খবরদার । ছেলেটার সাথে আজকেই পরিচয় । কি ভাববে ?’
“ভাবাভাবির ধার আমি কি কোনোদিন ধারছি । শোনো ছোট ভাই । ভালো ফুটবল খেলতাম । মাঝে মাঝেই এখানে সেখানে খ্যাপ খেলতে যেতাম । খ্যাপ খেলা কি জানোতো ?”
-জ্বি জানি ।
“একদিন অন্য এক পাড়ায় খ্যাপ খেলতে গিয়ে দেখি পাশের এক দোতলা বাসার বারান্দায় এক আসমানের পরী দাড়াইয়া খেলা দেখতাছে । কি আর খেলা । একটু পর পর আসমানের পরীর দিকেই খালি চোখ যায় । দুই গোল খাওয়ার পরে একজন আইসা বললো ঠিক মতো না খেললে পা দুটো নিয়া কিন্তু বাসায় যাইতে পারবা না । একটা গোল দিয়েই বারান্দায় চোখ । দেখি পরী আনন্দে হাততালি দিচ্ছে । আমারে আর পায় কে । হ্যাট্রিক করলাম । এক সপ্তাহ ঐ পাড়ায় ঘোরাঘুরি করলাম । কিন্তু আমার অত ধৈর্য নাই । একদিন কলেজে যাবার রাস্তায় ঠিকই মুখোমুখি হলাম । ভালো লাগার কথা বলতেই কি বললো শুনবা ?“
-কি ?
“একটা হরলিক্স এর কৌটা কিনা বাসায় যান । নিয়মিত হরলিক্স খেয়ে বড় হয়ে তারপর দেখা করবেন ।“
‘কি করবো অতটুকু একটা মানুষ । তখন মুখটাও ছিলো বাচ্চা বাচ্চা ।‘ ভাবী হাসতে হাসতে বললেন ।
‘হইসে এখন হাতমুখ ধুয়ে আসো ।‘ ভাবী তাড়া দেন । আমার খুব খুব ভালো লাগে এই স্বল্প পরিচিত যুগলকে । মনেই হয় না মাত্র অল্প কিছুক্ষণ আগে এদের সাথে পরিচয় হয়েছে ।

খেতে বসে আরো মজার মজার কথা বলতে থাকেন ওমর ভাই । মাঝে মাঝে ভাবীও খুনশুটি মুলক কথা-বার্তা বলতে থাকেন ।
-ভাই ভাবীকে কিভাবে রাজী করালেন সেটাতো বললেন না । আমি জিজ্ঞেস করি ।
‘খবরদার । এইসব নিয়া আর আলাপের দরকার নাই ।‘ ভাবী বাধা দেন ।
“পোলাপান মানুষ শুনতে চাইছে । অসুবিধা কি ?“
‘অসুবিধা আছে । শোনো ছোট ভাই । ঘটনা বিশেষ কিছু না, আমিওতো মানুষ, মায়া দয়া আমারোতো আছে ।‘ ভাবী হাসতে হাসতে বলেন ।
“ঠিক আছে তাহলে আমাদের বিয়ের গল্প বলি ।“
-আচ্ছা । বিয়ের গল্পই বলেন । কিভাবে প্রস্তাব পাঠালেন । আমি আবার জিজ্ঞেস করি ।
“তুমি যে এত বোকা এইটা বুঝতে পারি নাই ।“
-কেনো ভাই ?
“আমার খোমা দেইখাও যে মনে করে আমি প্রস্তাব করবো আর সানুর বাবা-মা খুশী মনে আমার সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবে, সে বোকা নাতো কে বোকা ?”
-তাহলে ?
“আরে ভাইগা যাইয়া বিয়ে করেছি । এক বন্ধুদের আমবাগান আছে চাপাইনবাবগঞ্জ । বিয়ে করে বউ নিয়ে গেলাম সেই আমবাগানে । আমবাগানের পাশেই ছোট একটা বাড়ী । আমের মৌসুমে এক-দুইজন লোক থাকে এখানে । তখন শীতকাল । বাড়ীতে কেউ নাই । আমাদের দুজনকে রেখে বন্ধুরা রাজশাহী ফিরে গেলো । কথা হলো দুইদিন পরে আবার আসবে আমাদের বাসা আর সানুদের বাসার খবর নিয়ে । খাবার ভালোই রেখে গেলো । কিন্তু খেয়াল করি নাই যে দুইটা পাতলা কাথা ছাড়া তেমন গরম কোনো গরম কাপড় নাই ঘরে । উত্তরবঙ্গে খুব ঠান্ডা পরে । বিশেষ করে রাতে । মানুষজন বাসর জাগে গল্প করতে করতে । আমরা ঠাণ্ডায় ঠক ঠক করতে করতে রাত জাগলাম । দুইদিন পরে বন্ধুরা এলো আরো দুঃসংবাদ নিয়ে । সানুর বাবা নাকি মহা খেপেছে । থানা-পুলিশ করে একাকার । বন্ধুরা পরামর্শ দিলো বর্ডার পাড়ি দিয়ে ইন্ডিয়া গিয়ে কিছুদিন থাকতে । হাতে দুইহাজার টাকা দিয়ে বর্ডার পার করে দিলো বন্ধুরা । প্রথম তিন-চার দিন ভালোই গেলো । তারপরেই শুরু হলো অর্থকষ্ট । এমনও দিন গেছে সারাদিন শুধু দুইটা লুচি পরাটা আর সবজির তরকা খেয়ে দিন কাটাইছি । একজন আর একজনকে বলতাম ‘দেখেছো ইন্ডিয়ার আলো বাতাসে মনে হয় কিছু আছে । একদম ক্ষুধা লাগে না ।‘ কিযে কষ্ট ...“ মুখে কষ্টের কথা বলছেন অথচ ওমর ভাই সানু ভাবী দুজনের চোখে মুখেই কি অদ্ভুত সুখের ছায়া । ইসসস সবাই যে কেনো এই কষ্ট পায় না ...

সেদিন ফিরে আসলাম । পরেরদিন রেলের ফোনে ওমর ভাই জানালেন ইলেক্ট্রিশিয়ান পরের সপ্তাহে আসবে । আরো অনেকক্ষণ গল্প করলেন । পরের সপ্তাহে গেলাম । ইলেক্ট্রিশিয়ান ফরিদকে নিয়ে ওমর ভাই প্রস্তুত ছিলেন । ফরিদকে কাজ বুঝাইয়া দিলাম । নিজেও কিছু কাজ করলাম । বিকেলে ফেরার আগে ওমর ভাইয়ের বাসায় আধা ঘণ্টা সময় কাটালাম । আগের মতই খুব ভালো লাগলো ।

পরেরদিন আবার গেলাম । কাজ শেষ হয়ে যাবার কথা । কিন্তু সুইচ অন করতেই ইউ,পি,এসের পিছন থেকে ধোয়া বের হলো । ইলেক্ট্রিশিয়ান ফরিদ কোথাও শর্ট সার্কিট করে রেখেছে । ভাগ্য ভালো ইউ,পি,এস এর ফিউজটা জ্বলে যাওয়াতে আর কোনো ক্ষতি হয় নাই । ওমর ভাই ফরিদকে ডাকলেন ।
“এইটা কি কাজ করলা । জানো এখনই লাখ টাকার ক্ষতি হতে পারতো ।“ ওমর ভাই রাগতস্বরে বলেন ।
‘স্যার আমার কোনো দোষ নাই । এইটা আগের ইলেক্ট্রিশিয়ান দেলোয়ারের ভুল । আসেন স্যার দেখাই ।‘ ফরিদ বলে ।
“ভুল হয় মানুষের । আর যে ভুলটা অন্যের ঘাড়ে চাপাইয়া দিতে পারে তাকে কি বলে জানো? অফিসার । তুমিতো বিরাট অফিসার হইয়া গেছো ফরিদ । যাও এই স্যারের সাথে যাইয়া কাজটা শেষ করো ।“ বেশ রাগী গলায় বলেন ওমর ভাই । ফরিদও আর তেমন কথা বাড়ায় না । পুরোনো ওয়্যারিং অনেকখানি আবার নতুন করে শুরু করতে হয় । সেদিন আবার ট্রেন লেট করে দুই ঘণ্টা । তাই ওমর ভাইয়ের বাসায় বেশ কিছুটা সময় কাটে । আলাপের এক পর্যায়ে ভাবী বলেন

‘ওমরের গান শুনেছো ?’
-নাতো ।
“তোমার পকেটে যথেস্ট টাকা পয়সা আছেতো ?” ওমর ভাই পরিহাসসুরে জিজ্ঞাসা করেন ।
-কেনো ? আমি জিজ্ঞেস করি ।
“দুনিয়ায় দুই ধরনের শিল্পী আছে । একদলকে টাকা দিয়ে গান গাওয়াতে হয়, আর একদলকে টাকা দিয়ে গান থামাতে হয় ।“ স্বভাবসুলভ ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলেন ওমর ভাই । কিন্তু যখন হারমোনিয়ামটা নিয়ে গান শুরু করেন আমি স্তব্দ হয়ে যাই । এত সুন্দর গলার গান আমি অনেক অনেক দিন শুনি নাই । দুই তিনটা গানের পরেই আমি বলি ...
-ভাই । আপনার গানের গলা অসাধারন । গানটাকে সিরিয়াসলি নেন ।
“আরে রাখো, তোমার ভাবীর পীড়াপীড়িতে রেডিওতে দুইবার অডিশন দিছিলাম । দুইবারই ফেল । তোমার ভাবীকে মুগ্ধ করার জন্য গান শিখেছিলাম । সে মুগ্ধ হইলেই হবে...”

দুইদিন পরেই আবার যাই । সব ঠিকঠাক থাকলে এখানে আর আসতে হবে না । এবার সব ঠিকই থাকে । খুব তাড়াতাড়িই সব কাজ শেষ হয়ে যায় । ওমর ভাই আগেই বলে রেখেছিলেন আজকে তার বাসায় খেতে হবে । যথারীতি আড্ডা দিতে দিতে খাওয়া চলে ।
‘ছোটভাই আজমির শরীফ যাবো । আমাদের জন্য একটু দোয়া কোরো ।‘ হঠাৎ কথার মাঝখানে সানু ভাবী বলেন ।
‘ষোলো বছর বিয়ে হলো এখনো আমাদের কোনো সন্তান নাই।‘
“তুমি আবার কি শুরু করলা । সন্তান না হলে কি সুখী হওয়া যায় না । “ ওমর ভাই বাধা দেবার চেষ্টা করেন ।
‘সত্যি ছোটভাই, একজন মানুষ জীবনে যা পেতে পারে তা প্রায় সবই আমি পেয়েছি । বিয়ের পরে আত্মীয়-স্বজন বন্ধুরা অনেকে জিজ্ঞেস করেছে -কি দেখে আমি ওমরকে বিয়ে করলাম । এখন আর কেউ করে না । সবাই জানে আমি কি পেয়েছি । কিন্তু এখন যখন ওর আত্মীয়স্বজনরা সন্তানের প্রসঙ্গ তোলে তখন আমার খুব কষ্ট হয় । ওমর অবশ্য কখনোই পাত্তা দেয় না । কিন্তু আমার খুব কষ্ট হয় । এক জীবনে এত ভালোবাসা পেয়েছি ... শুধু একটা সন্তান’ ...কথা শেষ করতে পারেন না সানু ভাবী । গলা ধরে আসে । ওমর ভাই এটা সেটা বলে পরিবেশ স্বাভাবিক করেন ।

কিছুক্ষণ পরে আবার ষ্টেশনে আসি ফিরতি ট্রেন ধরার জন্য । ওমর ভাইও সাথে আসেন । ষ্টেশনে ঢোকার মুখেই মানুষের জটলা দেখি । বয়স্ক এক ভদ্রলোক বেশ উত্তেজিতভাবে এক মহিলার হাত ধরে আছেন । মহিলার পোশাক চুল সব অবিন্যস্ত ।
‘আপনারা যাই বলেন । আমি একে পুলিশে দেবো । এইসব মহিলা আসলে পাগল সেজে বাচ্চা চুরি করে ।‘ ওমর ভাই ভিড়ের মাঝে এগিয়ে যান । ভদ্রলোককে কি বলে বোঝালেন শুনতে পারি না । কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসলে জিজ্ঞেস করি
-কি ঘটনা ওমর ভাই ।
“ঘটনা তেমন জটিল কিছু না । এই পাগলী রাস্তাঘাটে থাকে । কয়েকবছর আগে পাগলী প্রেগন্যান্ট হয়ে যায় । এলাকার মুরুব্বীরা প্রথমবার এবরেশান করে । কিছুদিন পরে পাগলী আবার প্রেগন্যান্ট হয় । বারবার ঝামেলার চাইতে এইবার পাগলীর লাইগেশন করানো হয় । সেই থেকে পাগলী বাচ্চা পোলাপান দেখলেই কোলে নিয়ে দৌড় দেয় । দেখলাইতো আমার বউ বাচ্চা-বাচ্চা করে কি পাগল আর এইখানে এই পাগলী । সবই এই নিষ্ঠুর দুনিয়ার খেলা ।“ উদাসভাবে বলেন ওমর ভাই ।

ট্রেনের জানালায় বসে আমার হঠাৎ একটা ছবির কথা মনে হয় । আমজাদ হোসেনের “কাল সকালে” । মূল গল্পটাই গ্রামের এমন এক পাগলীকে নিয়ে । পাগলী গর্ভবর্তী হলে গ্রামের বিচারে সাব্যস্ত হয় পরেরদিন সকালে পাগলী অনাগত সন্তানের পিতা হিসাবে যার নাম বলবে সেই হবে দোষী । এরপরে রাতের আধারে গ্রামের মাতবর আসে টাকা পয়সা গয়না নিয়ে । এরপর একে একে আসে স্কুল মাস্টার, মসজিদের ইমামসহ আরো গন্যমান্য লোকেরা । সবাই সাথে করে টাকা গয়না নিয়ে আসে । পাগলীকে সবার একই অনুরোধ ‘তুই আমার নামটা বলিস না ।‘

আর যাই হোক স্টেশনের এই পাগলীকে নিয়ে এমন সমস্যা হবার কোনো সম্ভাবনা নাই । মানুষ-সমাজ-সভ্যতা যে এগিয়ে গেছে তাতে আমার কোনোই সন্দেহ থাকে না ...
 
Back
Top