- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 171
- Messages
- 1,930
- Reaction score
- 350
- Points
- 1,633
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
রিদম জিরো: এক নির্মম দায়িত্বহীনতার পরীক্ষা
মূল লেখকঃ পঞ্চানন মণ্ডল
(লেখাটি অন্তর্জাল হতে সংগৃহীত)
১৯৭৪ সালের এক সন্ধ্যায় ইতালির নেপলস শহরের একটি গ্যালারিতে একাকী দাঁড়িয়ে ছিলেন এক মহিলা পারফরমেন্স আর্টিস্ট। সম্পূর্ণ নীরব, নিষ্ক্রিয়, অভিব্যক্তিহীন এক জড়বস্তুর মতো। তিনি একটি কাগজে লিখে রেখেছিলেন —"আমি এখন একটি বস্তু, আপনারা যা খুশি করতে পারেন। আপনাদের হাতেই সব।"মূল লেখকঃ পঞ্চানন মণ্ডল
(লেখাটি অন্তর্জাল হতে সংগৃহীত)

সেই মহিলার নাম মারিনা আব্রামোভিচ (Marina Abramović)—পারফরমেন্স আর্টের ইতিহাসে এক অনন্য নাম। আর এই পরীক্ষা, যার নাম "Rhythm 0", তা শিল্পের পরিধি ছাড়িয়ে গিয়ে মানব মনস্তত্ত্বের এক গভীর অন্ধকার গলিপথ উন্মোচন করেছিল।
পরীক্ষা না অন্য কিছু !
এটা ছিল ছয় ঘণ্টার একটি পারফরমেন্স। মারিনার সামনে রাখা ছিল ৭২টি বস্তু—কিছু নিতান্তই সাধারণ জিনিস ফুল, পালক, কলম, রুটি আর কিছু বিপজ্জনক জিনিস যেমন কাচ, ছুরি, চেইন, কাঁচি, এমনকি একটি লোডেড পিস্তল।
মারিনা পুরো সময় ছিলেন একদম নিষ্ক্রিয়, নির্লিপ্ত, একটি "মানব বস্তু"। নিজেকে দর্শকদের হাতে সঁপে দিয়েছিলেন। শুধু বার্তা লেখা ছিল —“যা খুশি করুন, দায় তাঁর নয়”।
শুরুতে সবকিছু ঠিকমতো চলছিল —কেউ ভালোবেসে ফুল দিল, কেউ ছবি তুলল, কেউ একটু আদর করল। মারিনা নির্লিপ্ত রইল। কিন্তু সময় যত এগোতে লাগলো ধীরে ধীরে দর্শকদের সাহস বাড়তে লাগলো। কেউ আঁচড়ে দিল। একজন তো ব্লেড দিয়ে কেটে রক্ত বার করল। কেউ জামাকাপড় টেনে ছিঁড়ে দিল। আরেকজন ঠোঁটে জোর করে চুমু খেল। কারো কারো চোখে দেখা গেল চরম হিংস্রতা, লোলুপতা। এরপর ঘটতে যাচ্ছিল এক চরম অঘটন! একজন পিস্তলটা তুলে নিয়ে গুলি চালাতে উদ্যত হয়েছিল—শেষমেশ অন্য কেউ বাধা না দিলে কী হতো, তা বলাই বাহুল্য।
দর্শকরা যখন অমানবিকতার মুখোশ পরে
এই পারফরমেন্সে আব্রামোভিচ নিজেকে রক্ষার সব অধিকার ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, এখানে শরীর নয়—মানব চেতনাই পরীক্ষা হচ্ছে। মারিনা কারোর কোনো ক্ষতি করেনি। মারিনাকে এই দর্শকরা চেনে না। অথচ তারা বিনা কারণে মারিনার শ্লীলতাহানি থেকে খুন পর্যন্ত করতে গিয়েছিল!
কিন্তু কেন?
এই পরীক্ষা থেকে উঠে এল কিছু ভয়াবহ সত্য—
- দায়িত্বহীনতা মানুষকে কতটা হিংস্র করে তোলে।
- ক্ষমতার সুযোগ পেলে একজন সাধারণ মানুষও নির্যাতক হয়ে উঠতে পারে।
- আমরা শিল্প বা বাস্তবের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে যখন কাউকে অসহায় দেখি, তখন কিছু মানুষ সেই অসহায়তাকে ভোগের বস্তু হিসেবে দেখে।
এই পরীক্ষা কি সমাজের আয়না?
Rhythm 0 ছিল এক প্রতিবাদ—মানবীয় সহানুভূতির অভাবের বিরুদ্ধে, কর্তৃত্বের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে।
এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—"যদি সমাজ কাউকে একা ফেলে দেয়, যদি কারো নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা না থাকে বা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রক্ষাকবচ না থাকে, তাহলে মানুষের মনে পাশবিকতা জেগে ওঠে।"
আব্রামোভিচ নিজেই লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে:
"If you leave it up to the audience, they can kill you."
এই বাক্য আজও আমাদের চিন্তাচেতনায়, মনোবিজ্ঞানে ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোড়ন তোলে।
পরিশেষে
Rhythm 0 ‘শুধু শিল্প’ ছিল না। এটা ছিল মানব মনের এক গভীর, অস্বস্তিকর আয়না—যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পারি, মানুষ কতটা নৃশংস হতে পারে, যদি কেউ বাধা না দেয়।
এই পারফরমেন্স আমাদের বাধ্য করে প্রশ্ন করতে—
"আমরা কি সত্যিই সভ্য?"
"নৈতিকতার ভিত যদি নড়ে যায়, তাহলে আমরা কি পাশবিক হয়ে যাই?"
মারিনা আব্রামোভিচ আমাদের এসব প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিয়ে চলে গেছেন নিঃশব্দে। আর রেখে গেছেন এক অমোচনীয় প্রতিচ্ছবি—যেখানে মানুষ আর অমানুষের তফাৎটা আর খুব একটা স্পষ্ট নয়।
তথ্যসূত্র:
১। Marina Abramović – Walk Through Walls: A Memoir, 2016
২।BBC Culture – “Marina Abramović: How far would you go for art?”, 2019
৩। Documentary: Marina Abramović: The Artist Is Present (2012)