- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 363
- Messages
- 4,918
- Reaction score
- 1,275
- Points
- 3,863
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
মীরার গ্রামের বাড়ি
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ
পর্ব - ১
নৌকায় উঠার মুখে ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটল, শেফার চোখ থেকে চশমা খুলে পানিতে পড়ে গেল। শেফার মাইয়োপিয়া, চশমা ছাড়া প্রায় কিছুই দেখে না। সে একবার ভাবল, ‘মা আমার চশমা’ বলে বিকট চিৎকার দিয়ে সবার পিলে চমকে দেবে। সে তা করল না, যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে নৌকায় উঠে এল।
চশমা পানিতে পড়ে যাবার ব্যাপারটা এখন কাউকে না-জানানোই ভালো। বাবা হুট করে রেগে যাবেন। সবার সামনে বকা শুরু করবেন। দেলোয়ার ভাইকে এই ঠাণ্ডার মধ্যে পানিতে নামতে হবে। কী দরকার? জায়গাটা শেফা চিনে রেখেছে। একসময় চুপিচুপি এসে পানি থেকে তুলে নিলেই হবে। চশমাটা যেখানে পড়েছে সেখানে হাঁটু পানিও হবে না। আর যদি হয় অসুবিধা হবে না। শেফা সাঁতার জানে। এই বছরই মাদার’স ক্লাব থেকে সাঁতার শিখেছে।
শেফা খুব সাবধানে পা ফেলে এগুচ্ছে। বেশি হাঁটাহাটি করা যাবে না। শেষে কোনোকিছুতে পা বেধে হুড়মুড় করে পানিতে পড়ে যাবে। চশমা ছাড়া সব কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। বাবাকে দেখাচ্ছে খড়ের গাদার মতো। হলুদ কোটটা পরায় এমন লাগছে। খড়ের গাদার মাথায় লাল রঙ-করা হাঁড়ি বসানো। লাল হাঁড়িটা হচ্ছে বাবার মাথার লাল ক্যাপ।
শেফা তার বড় বোন মীরার পাশে ধপাস করে বসে পড়ল। এক বসায় নৌকা প্রায় কাত হয়ে গেল। মীরা তার দিকে তাকাল সরু চোখে। মীরার মাথায় নীল স্কার্ফ। শীতের জন্যে কান ঢেকে স্কার্ফ পরেছে। স্কার্ফের জন্যেই বোধ হয় তাকে দেখাচ্ছে বিদেশিনী মেয়েদের মতো। যেন ইউরোপের কোনো মেয়ে বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছে। বাংলাদেশের নোংরা থেকে নিজেকে আলাদা রাখার জন্যে শরীর শক্ত করে এক কোনায় বসে আছে। মীরার হাতে একটা বই। শেফা বাজি রেখে বলতে পারে যে নৌকা ছাড়ামাত্র মীরা আপা বই পড়তে শুরু করবে এবং অবশ্যই অবশ্যই বাবার কাছে বকা খাবে। বাবার কাছ থেকে বকা না-খেয়ে আজ পর্যন্ত তারা কোনো বেড়ানো শেষ করেনি। বেশির ভাগ সময় সে বকা খায়। আজ নিশ্চিতভাবে মীরা আপার টার্ম।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন
শেফা খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল, আপা তোর হাতে কী বই?
মীরা জবাব দিল না।
শেফা আবারো বলল, বইটার নাম কী?
মীরা বিরক্ত গলায় বলল, সবসময় ঝামেলা করিস কেন? বইয়ের নাম দিয়ে করবি কী? তুই কি কখনো বই পড়িস? আর শোন্ গায়ের উপর এসে বসছিস কেন? নৌকায় কি আর জায়গা নেই যে আমার কোলে এসে বসতে হবে?
শেফা সরে বসল।
মীরা বলল, তুই অন্য কোথাও গিয়ে বস তো। তোকে অসহ্য লাগছে।
‘কেন অসহ্য লাগছে?’
‘জানি না কেন লাগছে, প্লিজ তুই আমার পাশে বসবি না।’
শেফা উঠে দাঁড়াল। নৌকার অন্য মাথায় যাওয়া যায়। অনেকটা জায়গা হাঁটতে হবে। নৌকার ভেতরটা কেমন খোপ খোপ। নিশ্চয়ই ধাক্কা টাক্কা খাবে। শেফার বুক সামান্য ধুকধুক করছে। তার চোখে চশমা নেই বাবা ধরে ফেলবে নাতো? ধরতে না-পারার সম্ভাবনাই বেশি। বাবা হয়তো তার মুখের দিকে ভালো করে তাকাবেই না। শেফার ধারণা কেউ তার মুখের দিকে ভালো করে তাকায় না। একবার তার নাকের ডগায় ফোঁড়ার মতো হল। নাক ফুলে হাতির শুঁড়ের মতো হয়ে গেল, তাও বাসার কেউ ধরতে পারল না। শুধু স্কুলের অঙ্ক মিস বলল, শেফা তোর নাকে কী হয়েছে? মানুষের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়, তোর দেখি নাক ফুলে পেপে গাছ হয়ে গেছে।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন
শেফার বাবা সুপ্রিম কোর্টের জাজ আজহার সাহেব মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আনন্দিত গলায় বললেন, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমার কাছে চলে আয়। বাবার পাশে বসতে শেফার মোটেই ইচ্ছা করছে না। বাবার পাশে বসা মানেই জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শোনা। বেড়াতে এসেও জ্ঞানীকথা শোনার কোনো মানে হয় না। কোনো উপায় নেই। শেফার মনে হচ্ছে তার জন্মই হয়েছে জ্ঞানীকথা শোনার জন্যে।
শেফা বাবার পাশে বসল। মেয়ের পিঠে হাত রেখে খুশি-খুশি গলায় বললেন, কিরে শেফা একসাইটিং লাগছে না? এ রিয়েল জার্নি বাই কান্ট্রি বোট। আগে রচনা লিখেছিস মুখস্থ করে। এখন লিখতে পারবি অভিজ্ঞতা থেকে।
শেফার মোটেই একসাইটিং লাগছে না। বাবাকে খুশি করার জন্যে বলল, দারুণ লাগছে বাবা।
আজহার সাহেব হাসিমুখে বললেন, তোরা তো গ্রামে আসতেই চাস না। বলতে গেলে তোদের জোর করে ধরে নিয়ে এসেছি। এখন মনে হচ্ছেনা, না এলে বোকামি হত?
‘হুঁ মনে হচ্ছে। না এলে খুব বোকামি হত।’
‘গ্রামের এই সৌন্দর্যের কোনো তুলনা আছে? কোনো তুলনা নেই। ফার ফ্রম দি মেডিং ক্রাউড। কীরকম ফ্রেশ বাতাস দেখেছিস? ওজন ভর্তি বাতাস। ঢাকায় এ-রকম বাতাস কোথায় পাবি? ঢাকার বাতাস মানেই কাৰ্বন—মনক্সাইড। ফুসফুসের দফারফা। জখম হওয়া ফুসফুস ঠিক করার জন্যে আমাদের মাঝে মাঝে গ্রামে আসা দরকার।’
‘ঠিক বলেছ বাবা।’
ঠিক এই মুহূর্তে তার চশমাটার জন্যে শেফার খুব আফসোস হচ্ছে। এখন একটা মজার দৃশ্য হচ্ছে। চশমা না-থাকার কারণে শেফা দৃশ্যটা ভাসা-ভাসা দেখতে পাচ্ছে। ভালোমতো দেখতে পারলে খুব মজা হত। তার মা মনোয়ারা নৌকায় উঠছেন। তাঁকে সাহায্য করছেন দেলোয়ার ভাই। মনে হচ্ছে সার্কাসের কোনো খেলা হচ্ছে। দড়ির উপর হাঁটার রোমাঞ্চকর খেলা। নদীর পার থেকে নৌকার গলুই পর্যন্ত দুটা বাঁশ ফেলা আছে, বাঁশে পা দিয়ে নৌকায় উঠতে হয়। দেলোয়ার ভাই দুহাতে মার ডান হাতটা ধরে টানছেন। মনে হচ্ছে বালির বস্তা টেনে আনছেন। আর মা এমনভাবে দুলছেন যে মনে হচ্ছে তাঁর খুব ইচ্ছা নদীতে পড়ে যাওয়া। দেলোয়ার ভাই থাকতে মা একা-একা নদীতে পড়ে যাবে তা হবে না। দেলোয়ার ভাইও অতি অবশ্যই মা’র সঙ্গে নদীতে ঝাঁপ দেবে। তাতে মজা ভালোই হবে। শুধু শেফার চশমা যেখানে পরেছে, দুজন মিলে সেখানে না-পড়লেই হল।
মনোয়ারা বেগম নৌকায় উঠে তৃপ্তির হাসি হাসছেন। তিনি আজ শাড়ি পরেননি। মীরার একটা কামিজ পরেছেন। টকটকে লাল রঙের কামিজটা আঁট হয়ে গায়ে বসে গেছে। শুরুতে তাঁর একটু লজ্জা-লজ্জা লাগছিল এখন আর লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। শাড়ি পরে নৌকায় উঠানামা খুব ঝামেলা। তিনি বড় মেয়ের কাছে এসে দাঁড়ালেন, আদুরে গলায় বললেন, ‘বুঝলি মীরা, আরেকটু হলে পড়েই যেতাম। দেলোয়ার গাধাটা দেখছে আমার ব্যালান্সে সমস্যা হচ্ছে তার পরেও হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিচ্ছে। মানুষ এমন গাধাও হয়।
মীরা কিছু বলল না। মনোয়ারা মেয়ের পাশে বসতে বসতে বললেন, চা খাবি? ফ্লাস্কে চা নিয়ে এসেছি।
মীরা বলল, না।
‘জিজ্ঞেস কর তো তোর বাবা খাবে কি না।’
মীরা বিরক্তমুখে বলল, তুমি জিজ্ঞেস কর। আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে কেন?
‘তুই জিজ্ঞেস করলে অসুবিধা কী?’
‘আমি শুধু শুধু জিজ্ঞেস করব কেন? এমনতো না তোমার ল্যারেনজাইটিস হয়েছে, কথা বলা ডাক্তারের নিষেধ।’
মনোয়ারা বিস্মিত হয়ে বললেন, রেগে যাচ্ছিস কেন?
মীরা বলল, মা তুমি দয়া করে আমার পাশে বসবে না। তুমি বোধহয় জানো না যে তোমার গা থেকে কাদামাটি টাইপ একটা গন্ধ আসে, আমার মাথা ধরে যায়।
মনোয়ারা আহত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মীরা বলল, ঠিক আছে বসে পড়েছ যখন বোস। শুধু সারাক্ষণ ‘চা খাবি? কলা খাবি? সন্দেশ খাবি?’ এইসব করতে পারবে না। আমি কিছুই খাব না। সকাল থেকে আমার বমি আসছে। আমি যে-কোনো মুহূর্তে বমি করব। এইজন্যেই আমার পাশে বসতে নিষেধ করছি।
‘শরীর খারাপ?’
মীরা শীতল গলায় বলল, শরীর ঠিক আছে। মা শোনো, ‘শরীর খারাপ নাকি, জ্বর নাকি, কাশি হচ্ছে নাকি?’ এইসবও জিজ্ঞেস করতে পারবে না।
মনোয়ারা দুঃখিত গলায় বললেন, আচ্ছা যা তুই একা-একা বস। আমি চলে যাচ্ছি।
মুখে বললেও তিনি চলে গেলেন না। কোথাও বেড়াতে গেলে বড়মেয়ের সঙ্গে থাকতে তাঁর খুব ভালো লাগে। দুজনে মিলে গুটুর গুটুর করে কথা বলেন। মেজাজ ভালো থাকলে মীরা চমৎকার গল্প করে। আজ বোধহয় মেয়েটার মেজাজ ভালো নেই। মনোয়ারা ধরে নিলেন নৌকা ছাড়লেই মীরার মেজাজ ভালো হবে।
আজহার সাহেব বললেন, সবাই ঠিকঠাক বসেছ তো। ছাতা নেয়া হয়েছে? নদীর উপর রোদ বেশি লাগে। পানিতে রোদটা রিফ্লেক্ট করে এইজন্যে বেশি লাগে। দেলোয়ার কোথায়? দেলোয়ার?
দেলোয়ার ভীত গলায় প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, চাচাজি আমি এইখানে।
দেলোয়ার আজহার সাহেবের গ্রামের বাড়ির কেয়ার টেকার। সে তার শহরবাসী হাইকোর্টের জাজ সাহেব চাচাকে যমের মতো ভয় পায়। তার প্রধান চেষ্টা আজহার সাহেবের চোখের আড়ালে থাকা। সেটা মোটেই সম্ভব হয় না। আজহার সাহেব প্রতি পাঁচ মিনিটে একবার দেলোয়ারকে খুঁজেন। অকারণেই খুঁজেন।
‘দেলোয়ার।’
‘জ্বি চাচাজি।’
‘ছাতা নিয়েছ?’
দেলোয়ারের মুখ শুকিয়ে গেল। ছাতার কথা তার একবারও মনে হয়নি।
‘কী ব্যাপার ছাতা নাওনি?’
‘জ্বি না। একদৌড় দিয়া নিয়া আসি? যাব আর আসব।’
আজহার সাহেব রাগী-রাগী গলায় বললেন, ছাতার কথা মনে করা উচিত ছিল। যাই হোক নৌকা ছাড়তে বল। ভবিষ্যতে এই জাতীয় ভুল করবে না।
মনোয়ারা বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, অদ্ভুত সুন্দর লাগছে তাই না। ছায়া ছায়া ভাব। তুই চা খাবি?
‘না।’
‘কচুরীপানার ফুল কত সুন্দর দেখেছিস। ফুলের মধ্যে ময়ুরের পাখার মতো ডিজাইন।’
মীরা কিছু না বলে বই খুলল। মা’র আহ্লাদী তার অসহ্য লাগছে। মীরার ধারণা কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মা খুকি-খুকি ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠবে, ওমা কী সুন্দর একটা বক। মীরা দেখ দেখ বক দেখ। তোর বাবাকে বল্ বকটার একটা ছবি তুলতে। বাবাও সঙ্গে সঙ্গে বকের ছবি তোলার প্রস্তুতি নেবেন। তখন দেখা যাবে সব এসেছে ক্যামেরা আসে নি। বাবা শুরু করবেন তার বিখ্যাত চিৎকার, ক্যামেরা কেন কেনা হয়েছে? শো-কেসে সাজিয়ে রাখার জন্যে? প্রয়োজনের সময় যে জিনিসটা পাওয়া যাবে না তার দরকার কী? ফেলে দিলেই হয়। বাড়িতে পৌছে প্রথম যে কাজটি করবে তা হল ক্যামেরা পুকুরে ফেলবে।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুনঅনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন
নৌকা চলতে শুরু করেছে। নদীর নাম সোহাগী। বেশ বড় নদী তবে শীতকাল বলে পানি কম। আজহারউদ্দিনের চোখেমুখে তৃপ্তির ভঙ্গি। যা দেখছেন তাতেই মুগ্ধ হচ্ছেন। তাঁর হাতে ফোকাস ফ্রি ক্যামেরা। কিছুক্ষণ পরপরই তিনি ক্যামেরা চোখের সামনে ধরছেন তবে ছবি তুলছেন না।
শেফা খুবই অস্বস্তি বোধ করছে কারণ তার বাথরুম পেয়েছে। এই কথাটা কাউকে বলা যাবে না। বাবা শোনামাত্র চেঁচিয়ে বলবেন, ঘর থেকে বেরুবার সময় বাথরুম করে বের হতে পারনি? ক্লাস টেনে উঠেছ, তুমিতো আর বাচ্চা মেয়ে না। এখন এই নদীর মধ্যে বাথরুম করবে কীভাবে। যতসব ন্যুইসেন্স।
শেফা খুবই চিন্তিত বোধ করছে। একবার বাথরুম পেয়ে গেলে খুব সমস্যা। মাথার মধ্যে শুধু বাথরুম ঘুরতে থাকে আর কিচ্ছু ভালো লাগে না। নদীর পাড়ে সুন্দর একটা মাটির ঘর দেখা গেল। ঘর থেকে একটা মেয়ে বের হয়ে অবাক হয়ে নৌকা দেখছে। শেফার মনে হল মেয়েটা কত সুখী। সে নৌকায় নেই। ঘরে আছে। বাথরুম পেলেই বাথরুম করতে পারবে। শেফা বলল, বাবা আমরা নৌকায় কতক্ষণ থাকব?
আজহার সাহেব বললেন, অনেকক্ষণ থাকবরে মা। সাধ মিটিয়ে নৌকা ভ্রমণ। তোর ভালো লাগছে না?
শেফা শুকনো গলায় বলল, ভালো লাগছে।
‘তোরা শহরবাসী হয়ে গাছপালা ভুলে গেছিস। বল্ দেখি ঐটা কী গাছ?’
‘জানি না বাবা।’
‘মীরা তুই বলতে পারবি?’
‘না।’
‘মনোয়ারা তুমি পারবে? ‘
‘শ্যাওরা গাছ।’
‘রাইট— এটাই হল বিখ্যাত শ্যাওরা গাছ।’
শেফা বলল, বিখ্যাত কেন?
আজহার সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, বিখ্যাত কারণ গ্রামের মানুষদের ধারণা শ্যাওরা গাছে ভূত থাকে। এই গাছগুলি লোকালয়ে হয়ও না। জংলামতো জায়গা ছাড়া শ্যাওরা গাছ হয় না। গাছের পাতাগুলিও খুব ঘন। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া। চাঁদের আলো যখন পড়ে তখন পাতার কারণে মনে হয় ভূত-প্রেত বসে আছে।
শেফা উঠে দাঁড়াল। বাবার জ্ঞানীকথা শুরু হয়ে গেছে। তার অসহ্য লাগছে। বাথরুমের দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে জ্ঞানীকথা শুনতে ভালো লাগে না। অনেকক্ষণ নৌকায় থাকতে হবে শুনে তার বাথরুম আরো বেশি লাগছে। কিছু একটা করা দরকার। চুপিচুপি মাকে বলা যায় না। না, মাকে বললে হবে না। বলতে হবে আপাকে। আপা একটা ব্যবস্থা করবেই।
আজহারউদ্দিন বললেন, ‘শেফা যাচ্ছিস কোথায়?’
‘মা-র কাছে যাচ্ছি বাবা।’
‘মা-র কাছে যেতে হবে না। চুপ করে বস তো। চলন্ত নৌকায় হাঁটাহাঁটি করবি না। ব্যালেন্স হারিয়ে পানিতে পড়ে যাবি।’
শেফা বসে পড়ল। আজহারউদ্দিন ডাকলেন, মীরা 1
মীরা চমকে তাকাল। বাবা ডাকছেন। ডাকার ভঙ্গি ভালো না। খুবই গম্ভীর স্বর। নিশ্চয়ই বাবা কোনো কারণে রেগেছেন। এখন রাগের প্রকাশটা হবে। খুব বিশ্রীভাবে হবে বলাই বাহুল্য।
‘কী পড়ছিস?’
‘বই।’
‘বই যে পড়ছিস সেতো দেখতেই পাচ্ছি। গল্পের বই?’অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন
‘না, জোকস-এর একটা বই।’
‘এত ঝামেলা করে নৌকা নিয়ে বের হয়েছি কি জোকস-এর বই পড়ার জন্যে?’
‘সরি।’
‘আমি সকাল থেকে লক্ষ্য করছি তুই মুখ ভোঁতা করে বসে আছিস। কারণটা কী?
মীরা কিছু বলার আগেই মনোয়ারা শঙ্কিত গলায় বললেন, ওর শরীর ভালো না। জ্বর।
‘জ্বরটর কিছু না, ও ইচ্ছা করে এ-রকম করছে। আমি গত দুদিন ধরে ওকে লক্ষ্য করছি। এ-রকম একটা ভাব করছে যেন নির্বাসনে এসেছে। হোয়াই? বেড়াতে যেতে হলে নেপালে যেতে হবে? সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে? নিজের দেশে বেড়ানো যায় না? মীরা, তুই অন্যদিকে তাকিয়ে আছিস কেন? তাকা আমার দিকে।’
মীরা বাবার দিকে তাকাল।
‘জোকস-এর বইটা নদীতে ফেলে দে। ফেল বললাম। দ্যাটস এন অর্ডার।’অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন
মীরা বইটা নদীতে ফেলে দিল। বই টুপ করে ডুবল না। ভেসে রইল। দেলোয়ার দুঃখিত চোখে বইটার দিকে তাকিয়ে আছে। আজহারউদ্দিন গম্ভীর গলায় ডাকলেন, দেলোয়ার।
দেলোয়ার ভীত গলায় বলল, জ্বি চাচাজী।
‘নৌকা ঘুরাতে বল্। আমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। বাড়িতে ফিরে যাই। মেয়েরা জোকের বই পড়ুক।’
দেলোয়ারকে কিছু বলতে হল না। মাঝি নৌকা ঘুরিয়ে ফেলল। শেফা খুব খুশি। সব খারাপ জিনিসেরই একটা ভালো দিক আছে। বাবা আপার ওপর রাগ করল বলেই তারা এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারছে, নয়তো দুপুর পর্যন্ত বাথরুম চেপে নদীতে নদীতে ঘুরতে হত। শেফা মনে মনে বলল, আপা থ্যাংকস। আপার জন্যে শেফার বেশ মন খারাপ লাগছে। এতগুলি মানুষের সামনে বেচারি বকা খেল।
মনোয়ারা পরিস্থিতি সামলাবার জন্যে আজহার সাহেবের দিকে তাকিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ততার সঙ্গে বললেন, এই তুমি চা খাবে? ফ্লাস্কে করে চা এনেছিলাম।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন
আজহার সাহেব বললেন, না।
মনোয়ারা মীরার দিকে তাকিয়ে বললেন, চা খাবি? খেয়ে দেখ ঠাণ্ডার মধ্যে চা খেতে ভালো লাগবে। কাপে ঢেলে দেই?
মীরা বলল, মা তুমি একটু সরে বসো তো, আমি বমি করব।
বলতে বলতেই সে হড় হড় করে বমি করল। মনোয়ারা মেয়েকে ধরতে এগিয়ে এলেন। মীরা বলল, মা প্লিজ কাছে এসো না।
শেফার এখন বাবার জন্যে খারাপ লাগছে। সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে আপাকে বমি করতে দেখে বাবার মন খারাপ হয়েছে। অকারণে অসুস্থ মেয়েকে এতগুলি মানুষের সামনে বকা দেয়া হল। শেফার ধারণা বাবার খুব ইচ্ছা করছে বড় মেয়ের কাছে যেতে। চক্ষুলজ্জার জন্যে পারছেন না। শেফা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, আহা চক্ষুলজ্জার মতো অতি সামান্য কারণে মানুষ কত ভালো কাজ করতে পারে না। সে নিজেও পারে না। একবার স্কুল ছুটির পর শেফা গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিল। শাহবাগের মোড়ে সিগন্যালে গাড়ি থামল। বুড়ো এক ভিক্ষুক তার জানালার সামনে মাথা নিচু করে খুবই মিষ্টি গলায় বলল, সুন্দর আফা, একটা টেকা দিবেন? চা খামু। তার কথা বলার ধরন, তার হাসি, শেফার এত ভালো লাগল, কিন্তু চক্ষুলজ্জার জন্যে টাকাটা বের করতে পারল না। উল্টা কঠিন গলায় বলল, যাও মাফ কর। ‘মাফ কর’ বললে যে-কোনো ভিখিরি রাগ করে। এই বুড়ো রাগ না করে ঠিক আগের মতো মিষ্টি করে হাসল। তারপরই চলে গেল অন্য গাড়ির কাছে। শেফার খুবই ইচ্ছা করছিল ভিখিরিটাকে ডাক দিয়ে আনে। ড্রাইভার চাচাকে প্রায় বলেই ফেলছিল, ওকে ডাক দিন তো। চক্ষুলজ্জার জন্যে বলা হল না। এই বুড়ার কথা শেফার মাঝে মাঝেই মনে হয়।