- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 407
- Messages
- 5,564
- Reaction score
- 2,005
- Points
- 3,913
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
মেস লাইফ
(অন্তর্জাল হতে সংগৃহীত)
(অন্তর্জাল হতে সংগৃহীত)
ঢাকা শহরে পা দিয়েছিলাম একটা সস্তা ব্যাগ, বাবার দেওয়া পাঁচ হাজার টাকা আর অস্পষ্ট এক স্বপ্ন নিয়ে—বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো, কিছু একটা হবো। নাম আমার জহির। তখন আমার বয়স উনিশ।
রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে চারপাশের চেনা-অচেনা মুখ, প্যাঁচানো গলি, ধোঁয়া-ধুলো-চিৎকার—সবকিছু যেন আমার মাথায় ভিড় করছিল। পেছনে বরিশালের সেই শান্ত বিকেলগুলো, খালের ধারে বসে পড়া, আর সামনে এক বিশাল অজানা শহর।
মামার চেনাজানা এক ছেলের মাধ্যমে জায়গা হলো ঢাকার শান্তিবাগের একটা মেসে—তিনতলা একটা পুরনো বাড়ি, তার দ্বিতীয় তলায় ছয় নম্বর রুম। চাবি হাতে দিয়ে কেয়ারটেকার বলেছিল, “এই রুমে আরও পাঁচজন থাকে, টানাপোড়েন চলে, মানিয়ে নিতে পারলে থাকেন।”
রুমে ঢুকেই হোঁচট খেলাম। দরজার পাশে একটা জোড়া হাওয়াই চপ্পল, পাশে রাখা ভাঙা বালতি, ছেঁড়া পর্দা জানালায় ঝুলছে, বাতাসে ঘাম আর রান্না হয়ে যাওয়া তেলের গন্ধ।
ভেতরে একজন বালিশে হেলান দিয়ে বসে হেডফোনে গান শুনছিল, চোখে ছিল চশমা, কাঁধে গামছা। সে আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
“নতুন? নাম কী ভাই?”
“জহির… বরিশাল থেকে এসেছি।”
“ও, আমি মিতুল। খুলনা থেকে। আসেন, খাট খালি আছে ওখানে।”
তার ঠোঁটে ছিল একটা অবচেতন হাসি, আর আচরণে এমন একটা স্বাভাবিকতা, যেন আমি অনেকদিনের পরিচিত।
আস্তে আস্তে বাকিরাও ফিরলো। কেউ বাজার থেকে, কেউ ক্লাস শেষে, কেউ ঘুম ভেঙে উঠলো বিকেলে। আলাদা আলাদা চেহারা, কিন্তু একটা অদ্ভুত মিল—সবাই এখানে নিজের মতো, কিন্তু একসাথে।
রাতে বসে ভাত খেলাম। ডালটা পানির মতো, ভাজিটা জ্বলে গেছে, কিন্তু সেই ভাঙা টেবিলে সবাই একসঙ্গে বসে হেসে হেসে খাওয়ার মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত স্বস্তি।
কেউ বলল, “আজ তোর রান্না ভালো হইছে, মানে গতকালের চাইতে একটু কম বিষাক্ত।”
আরেকজন হেসে বলল, “তোরে তো খাইয়া এখনও মরি নাই, এখন বলিস বিষ?”
রাতে শুয়ে ছিলাম জানালার পাশে। জানালার বাইরে ঢাকা শহর তখনও জেগে, গাড়ির হর্ণ, মানুষের হাঁটাহাঁটি, পেছনের গলিতে কারা যেন গল্প করছিল। আমি চোখ বন্ধ করে ভাবছিলাম—এই কি তবে শুরু? এই চার দেয়ালের মধ্যে আমার নতুন জীবন?
মেসের খাটে শুয়ে, অচেনা পাঁচজনের নিঃশ্বাসে এক ধরনের সুর শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমি একা নই—এক অজানা যুদ্ধের সৈনিকদের সাথে, ছয় নম্বর ঘরে, একটা নতুন গল্পের শুরুতে।
........
রুমমেটরা
ছয় নম্বর রুম। নামটা শুনলেই অনেকে ভুরু কুঁচকে বলে, “ওই রুমে না কি ভুত থাকে?”
আমরা বলি, “ভূত না, ব্যাচেলর।”
এক রুমে ছয়জন। খাট তিনটা, তাতে বাঁশ দিয়ে আলাদা করা 'দুই তলা সিস্টেম'। একজনের পাখার হাওয়া মানেই অন্যজনের গরমে দমবন্ধ অবস্থা। তবে তার মধ্যেই গড়ে উঠেছে এক অদ্ভুত সম্পর্ক—বন্ধুত্ব, সহনশীলতা, আর নীরব বোঝাপড়া।
১. কাদের ভাই
সবার সিনিয়র। প্রায় বারো বছর ধরে এই মেসেই আছেন। একসময় বুয়েটে পড়তেন, পড়া শেষ করেননি—“দার্শনিক” হয়ে গেছেন। চা খেতে খেতে হঠাৎ বলে ওঠেন,
“জানো, মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে নিজেরই অলসতা।”
তার পরেই হাই তুলে ঘুমিয়ে পড়েন।
বইয়ের তাক ভরা পুরনো নোট, খবরের কাগজ আর কাগজে মোড়া শুকনো মাছ।
২. রফিক
দিন শুরু হয় তার “আল্লাহু আকবার” দিয়ে, তারপর “গরম পানি আছে?”
ধর্মভীরু হলেও কথার মধ্যে ব্যঙ্গ মিশিয়ে কথা বলেন।
বাজার করার দায়িত্বে থাকেন, তবে বেশি দাম দিয়ে কিছু কিনলে বলেন, “ইনশাআল্লাহ, পরের বার ঠকব না।”
নামাজের সময় সবাইকে ডাকেন, আর ডাল বেশি পাতলা হলে “সাবধান করতেছি” বলেও হুমকি দেন।
৩. মিতুল
আমার প্রথম পরিচিত মুখ। খুলনা থেকে এসেছে। পড়াশোনায় মাঝারি, প্রেমে প্রবল।
ফোনে প্রেমিকার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ভুল করে কাদের ভাইকে একবার “বেবি” বলে ফেলেছিল। সেই গল্প এখনও চায়ের দোকানে চলে।
পথে বসে গান গায়, লেখালিখিও করে, কখনও কখনও গভীর রাতে জানালায় দাঁড়িয়ে বলে,
“জহির, জানিস, ভালোবাসা আসলে একটা লোন—সুদ অনেক।”
৪. জুয়েল
ফাইন আর্টস পড়ে, মাথায় সবসময় একটা পাগলামি থাকে। দেয়ালে দেয়ালে আঁকে—কখনও মাছের মাথায় মানুষের চোখ, কখনও ল্যাম্পপোস্টের ওপর শুয়ে থাকা বাঘ।
সে বলে, “বাস্তবতা বোরিং, কল্পনা কর।”
জুয়েল হঠাৎ হঠাৎ গান গায়, আবার রান্নার ডিউটি থাকলে বলেন, “আজকে আমি শুধুই শিল্পী, রাঁধুনি না।”
৫. নীলয়
নীরব, স্থির, গভীর। সে ঢাকা মেডিকেলে পড়ে, মুখে কম কথা, চোখে বোঝা যায় অনেক কিছু দেখে।
রুমে কেউ অসুস্থ হলে সবার আগে এগিয়ে আসে।
একবার আমি জ্বরে কাঁপছিলাম, নীলয় এসে বলেছিল,
“চিন্তা করিস না, আমি আছি।”
তখন বুঝেছিলাম, একেকজন মানুষ কতটা নিঃশব্দে আপন হয়ে যেতে পারে।
৬. আমি—জহির
আমি শুধু দেখতাম, শিখতাম, অনুভব করতাম।
এই পাঁচজন—যারা একে অপরের পছন্দ-অপছন্দ জানে, কিন্তু কেউ কখনও “তুই কেমন আছিস?” জিজ্ঞেস করে না—তাদের মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে এক নতুন পরিবার খুঁজে পাচ্ছিলাম।
মেসে কোনো নিয়ম নেই। রাত তিনটায় কেউ খিচুড়ি রান্না করে, দুপুর তিনটায় কেউ ঘুম থেকে ওঠে। তবে একটা অদৃশ্য নিয়ম আছে—একটা খাট কম হলেও সবাই মিলে ঘুমায়, একটা ডিম থাকলেও সবাই ভাগ করে খায়।
এই ছিল আমার পাঁচ রুমমেট, আর এই ছিল ছয় নম্বর রুমের প্রথম চেনাজানা।
..........
নিয়মিত অনিয়ম
মেসের সবচেয়ে বড় নিয়ম ছিল—কোনো নিয়ম নেই।
রান্না হবে না? ঠিক আছে, সবাই হোটেল থেকে খেয়ে নেবে। বাজারে ডিম নেই? কেউ একজন রোল খেয়ে চলে আসবে।
কিন্তু বাসনটা কে মাজবে?
এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল।
প্রতিদিন সকালে টেবিলের কোণে বাসন জমত। ধোঁয়া ওঠা গরম চালভাজা যেমন নেই, তেমনি বাসন মাজারও কোনো আগ্রহ নেই।
জুয়েল বলত, “বাসনগুলোও শিল্পকর্ম। এদের একটু সময় দাও।”
রফিক তর্ক করত, “শিল্প নয়, ভাইজান, এগুলো পঁচা গন্ধ।”
আর কাদের ভাই ঘোষণা দিতেন, “বাসন যত বড় হবে, দায়িত্ব তত ছোট হওয়া উচিত।”
আমরা একটা “রোটা” বানিয়েছিলাম—কে কবে রান্না করবে, কে বাজার করবে, আর কে বাসন মাজবে।
রোস্টার প্রথম তিনদিন ভালো চললো। তারপর কাগজটা জানালার পাশে উড়তে উড়তে হারিয়ে গেল।
মেসের রান্না নিয়ে বলতে গেলে একটা ইতিহাস লেখা যায়। মিতুল একদিন ভাত রান্না করতে গিয়ে পানি বেশি দিয়ে ফেলেছিল। সবাই বলল,
“এটা কি ভাত, নাকি খিচুড়ির আগের স্টেজ?”
কেউ কেউ সেই ভাতে কলা মেখে খেয়ে নিয়েছিল, কেউ রুটি কিনে আনলো।
রাতগুলো ছিল সবচেয়ে জমজমাট। খাবার পর টেবিলটা এক এক করে চায়ের দোকানে চলে যেত।
নিচতলার দোকানে ছয়টা চেয়ার থাকত, আমরা সাতজন বসতাম—একজন সবসময় আধা গায়ে দাঁড়িয়ে থাকত।
চায়ের কাপের ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে গল্প চলত—রাজনীতি, সিনেমা, পাশের রুমের মেয়েদের হঠাৎ হাসি, প্রেমের ব্যর্থতা, বিসিএস-এর স্বপ্ন।
ঝগড়া হতো, প্রচুর হতো।
একদিন আমি রফিকের মগ ভুল করে ব্যবহার করেছিলাম। সে সেই ঘটনা তুলেছিল তিনদিন পর, রান্নার সময়, এক ফোঁটা তেল হাতে নিয়ে বলে,
“এই তেলটা যেমন তোর হৃদয়ে জায়গা করে নিচ্ছে, ঠিক তেমনই আমার মগে তোর ঠোঁট!”
তবে সবচেয়ে বড় ঘটনা হয়েছিল সেদিন, যেদিন রান্নার পালায় ছিল জুয়েল। সে ঘোষণা করলো,
“আজ আমি আর্টিস্ট, শেফ না।”
সবাই হেসে বললো, “তাহলে খাবে কে?”
সে বলেছিল, “তোমরা খাবে না, অনুভব করবে।”
সেইদিন সবাই হোটেল থেকে খেয়ে এসেছিল।
কিন্তু এই অনিয়মের মাঝেই ছিল সবচেয়ে বেশি আনন্দ।
নিয়ম না থাকায় আমাদের ইচ্ছেমতো হাসা, গলা ফাটিয়ে গান গাওয়া, পরীক্ষার আগের রাতে চোখের নিচে কালো দাগ, আর একটামাত্র ডিম ছয়ভাগে ভাগ করার নির্মল আনন্দ।
জীবনের সবচেয়ে এলোমেলো দিনগুলো যেন এক নিয়মমাফিক শান্তি নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল আমাদের ছয় নম্বর রুমে।
.........
প্রেম ও প্যাঁচ
মেসে প্রেম আসে না—এমনটা কেউ বিশ্বাস করত না।
প্রেম ছিল চারদিকে, শুধু প্রেমিকা ছিল না আশেপাশে।
ফলে মেসে প্রেম মানে ছিল ফোনের ভেতরের প্রেম, স্ট্যাটাসে ভেসে থাকা ভালোবাসা, কিংবা ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা।
মিতুল ছিল আমাদের প্রেমবিষয়ক বিভাগের প্রধান।
প্রায় প্রতিদিনই নতুন নাম, নতুন কথা, নতুন গল্প।
একবার তার ফোনে মেয়ের নাম “মনিরুল” নামে সেভ করা ছিল। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম ছেলের বন্ধু। পরে দেখা গেল, সে-ই তার "জানু"।
মিতুলের প্রেমিকারা শুধু ফোনে থাকত, কিন্তু তাদের কান্না, অভিযোগ, আর রাগে ভরা মেসের বাতাস ভারী হয়ে উঠত প্রায়শই।
একদিন গম্ভীর মুখে সে বলল,
“ভালোবাসা মানে sacrifice।”
কাদের ভাই পেছন থেকে বলে উঠলেন,
“ভালোবাসা মানে বেহুদা ফোন বিল।”
আমি নিজে তখন চুপচাপ। প্রেমে পড়েছি, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারি না।
ক্লাসে দেখা, করিডোরে হঠাৎ চোখাচোখি, ফেসবুকে “seen” হয়ে থাকা মেসেজ—এসব নিয়েই আমার প্রেম।
জুয়েল এই দলে ছিল না। সে বলত,
“আমি মানুষে বিশ্বাস করি না, মেয়েতে করব কীভাবে?”
তবে তার ডায়েরির এক পৃষ্ঠায় আমি একদিন পড়ে ফেলেছিলাম—
“সে আসলে সাদা জামা পরলে সাদা আর ছায়ায় থাকলে ধূসর হয়ে যায়।”
আমি জানতাম, এ ‘সে’ কে।
রফিক প্রেমের কথা উঠলেই বলত,
“ভাইজান, প্রেম করলে শেষতক বিয়ে করতেই হবে। বিয়ে করতে হলে রোজগার লাগবে। কাজের কথা বলেন।”
তবু সন্ধ্যার পর সবাই নিজেদের মতো একেক কোণায় বসে ফোন ঘাঁটত।
মিতুল হেডফোনে গলা নিচু করে কথা বলত,
“তুই না থাকলে আমি কিছুই না রে…”
কেউ কেউ তখন হঠাৎ করে দার্শনিক হয়ে যেত।
কাদের ভাই বলতেন,
“ভালোবাসা হল শরতের বাতাস—থাকে, কিন্তু ধরা যায় না।”
প্রেম আসলে ছিল আমাদের নিঃশ্বাসে।
কেউ সেটা প্রকাশ করত, কেউ চাপা দিত, কেউ উপহাস করত, কেউ বোঝার চেষ্টা করত।
তবে একটা জিনিস ছিল—যখন কারো প্রেমে সমস্যা হতো, মেসে রান্না হতো খিচুড়ি, হতো বিশেষ চা, আর শুরু হতো গভীর রাতের গল্প।
ছয় নম্বর রুমে তখন প্রেম মানে ছিল—একটা ফোন, একটা গান, আর কিছু অনামা দীর্ঘশ্বাস