Collected লীলাবতী - হুমায়ূন আহমেদ

dukhopakhidukhopakhi is verified member.

Special Member
Registered
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
407
Messages
5,564
Reaction score
2,011
Points
3,913
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
লীলাবতী

মূল লেখকঃ হুমায়ুন আহমেদ






পর্ব - ১
পূর্বকথা
আমার শৈশবের একটি অংশ কেটেছে মোহনগঞ্জে, আমার নানার বাড়িতে। ছায়াময় একটি বাড়ি, পেছনে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতর সারদেয়াল–পূর্বপুরুষদের কবরস্থান। সব কিছুই রহস্যময়। সন্ধ্যাবেলায় সারদেয়ালে ছায়ামূৰ্তিরা হাঁটাহাঁটি করে। গভীর রাতে বাড়ির ছাদে ভূতে ঢিল মারে। কেউ তেমন পাত্তা দেয় না। অশরীরী কিছু যন্ত্রণা তো করবেই। এদেরকে গুরুত্ব দেয়া ঠিক না। মূলবাড়ি থেকে অনেক দূরে বিশাল এক তেঁতুলগাছের পাশে টাট্টিখানা। সন্ধ্যার পর যারা টাট্টিখানায় যায় তারা না-কি প্রায়ই তেঁতুলগাছে পা বুলিয়ে পেততুনি বসে থাকতে দেখে।
দিনমানে অন্য দৃশ্য। বাড়ির কাছেই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। মাঠভর্তি বক। আমার নানাজান আবুল হােসেন শেখ দোনলা বন্দুক হাতে বক শিকারে বের হন। আমি তাঁর সঙ্গী। ছররা বন্দুকের গুলি হলো। অনেকগুলি বিক একসঙ্গে মারা পড়ল। তাদের গায়ের ধবধবে পালক রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে–আমি চোখ বড় বড় করে দেখছি। মাথার উপর মৃত বকদের সঙ্গীরা ট্যা ট্যা শব্দে ঘুরছে, অদ্ভুত সব দৃশ্য।
নানার বাড়ির স্মৃতি মাথায় রেখেই লীলাবতী উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম। সেই সময়ের রহস্যময়তাকে ধরার চেষ্টা। লেখাটা ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছিল অন্যদিন পত্রিকায়। কোনো ধারাবাহিক লেখাই আমি শেষ করতে পারি না। খেই হারিয়ে ফেলি। আগ্রহ কমে যায়। লীলাবতীর ক্ষেত্রেও তাই হলো। একসময় লেখা বন্ধ করে দিলাম। অন্যদিন-এর সম্পাদক মাজহারকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে বললাম, ভালো লেখা যত্ব নিয়ে লিখতে হয়, তাড়াহুড়া করা যায় না। তুমি মন খারাপ করো না। একসময় এই লেখা আমি শেষ করব।
আমি আমার কথা রেখেছি। বইমেলায় লীলাবতী বের করতে পেরে মাজহার নিশ্চয়ই খুশি। আমিও খুশি। লেখাটা সিন্দাবাদের ভূতের মতো অনেকদিন ঘাড়ে চেপে ছিল— এখন নেমে গেছে।
লীলাবতী উপন্যাসের সব চরিত্ররা ভালো থাকুক। তাদের প্রতি এই আমার শুভকামনা।
হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্লী, গাজীপুর।

********************

রেললাইনের উপর একটা বক বসে আছে। মেছো বাঁক। এ ধরনের বক বিলের উপর উড়াউড়ি করে। অল্প পানিতে এক ঠ্যাঙ ড়ুবিয়ে মাছের সন্ধানে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের ডাঙায় আসার কথা না। আর যদি আসেও গম্ভীর ভঙ্গিতে রেললাইনে বসে থাকার কথা না। সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত চোখে বকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এর ঘটনাটা কী? এ কী চায়?
বকটা ধবধবে সাদা। পানির বকের পালক সাদাই হয়। সারাক্ষণই পানিতে ডোবাড়ুবি করছে। পালকে ময়লা লেগে থাকা? কোনো কারণ নেই। ডাঙার বকের পালক এত সাদা না— বাদামি রঙ। মেছো।ক পানিতে যেমন এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে থাকে, রেললাইনের উপরও এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে আছে। শ্যাথ, নড়াচ্ছে না, শরীর নড়াচ্ছে না, স্থির দৃষ্টি। সিদ্দিকুর রহমানের বিস্ময় আরো প্রবল হলো, বকটা কী দেখছে? বিলের পানিতে এভাবে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার অর্থ আছে— মাছের গতিবিধি লক্ষ করা। এখানে বকটার একদৃষ্টিতে রেললাইনের পাথরের দিকে তাকিয়ে থাকার অর্থ কী? সে কি রেললাইনের পাথর দেখছে?
ঝিকঝিক শব্দ আসছে। ট্রেন চলে এসেছে। সিদ্দিকুর রহমান যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখান থেকে ট্রেন দেখা যাচ্ছে না। ঘন জংলায় আড়াল করে রেখেছে। কিন্তু ইঞ্জিনের শব্দ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। যে-কোনো মুহূর্তে ট্রেন দেখা যাবে। বকটা এখনো নড়ছে না। রেললাইনের কম্পন তার অনুভব করার কথা। ধ্যান ভঙ্গ হবার সময় এসে গেছে। সিদ্দিকুর রহমান বুকের ভেতর সামান্য চাপ অনুভব করলেন। অতিরিক্ত উত্তেজনায় তার এরকম হয়। বুকে চাপ ব্যথা বোধ হয়। নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়।
রেলের ইঞ্জিনটা এখন দেখা যাচ্ছে। কয়লার ইঞ্জিন। বুনকা বুনকা ধোঁয়া ছাড়ছে। কী সুন্দর দৃশ্য! বকটাকেও দেখা যাচ্ছে। বক আগের মতোই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। সিদ্দিকুর রহমান অস্থির বোধ করলেন। হুশ! হুশ! শব্দ করে বকটাকে তাড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করছে কিন্তু গলা কেমন যেন আটকে আছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। বুকে চাপ ব্যথা। তিনি তাকালেন রেলের ইঞ্জিনের দিকে। ভালো স্পিড দিয়েছে। ট্রেন ছুটে যাচ্ছে বকটার দিকে। সিদ্দিকুর রহমানের হঠাৎ মনে হলো, তিনি আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। গাঢ় ঘুমে তার চোখের পাতা নেমে এসেছে। চারদিকে অদ্ভুত এক শান্তি-শান্তি নীরবতা। বাতাস মধুর ও শীতল। বুকের ব্যথাটা নেই। নিঃশ্বাসের কষ্ট নেই।
একসময় তিনি চোখ মেললেন। অবাক হয়ে দেখলেন মাঠের উপর তিনি লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে আছেন। তার বাঁ-দিকে প্ৰকাণ্ড শিমুল গাছ। গাছটার ছায়া পড়েছে তাঁর শরীরে। ছায়াটা এমনভাবে পড়েছে যেন মনে হচ্ছে তিনি একটা ছায়ার চাঁদর গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন। তার চোখের সামনে আশ্বিন মাসের মেঘশূন্য আকাশ। আকাশে দুটা চিল উড়ছে। অনেক উঁচু দিয়ে উড়ছে। তাদের দেখাচ্ছে বিন্দুর মতো। তিনি উঠে বসলেন।
ফাঁকা মাঠ। আশেপাশে কেউ নেই। থাকার কথাও না। রেললাইনের উপর বকটা দাঁড়িয়ে নেই। সে ট্রেনের নিচে চাপাও পড়ে নি। চাপা পড়লে তার রক্তমাখা শরীর পড়ে থাকত। সিদ্দিকুর রহমান দুই হাতে ভর দিয়ে হেলান দেয়ার ভঙ্গিতে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন। বিকেলের আলো দ্রুত কমে আসছে। রেললাইনের ওপাশের জলে কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। কয়েকটা ক্যাচ ক্যাচি পাখি তার পায়ের কাছেই ঘোরাফেরা করছে। তিনি চাপা গলায় বললেন–‘হুশ! হুশ! সেইসঙ্গে ডান পায়ে মাটিতে বাড়িও দিলেন। পাখিগুলি একটু দূরে চলে গেল— তবে ভয় পেয়ে উড়ে চলে গেল না। ক্যাচক্যাচি পাখিগুলি চড়ুই পাখির মতোই সাহসী। এরা মানুষের আশেপাশে থাকতে পছন্দ করে। ধূসর বর্ণের পাখি। চোখ হলুদ। সারাক্ষণ ক্যাচক্যাচ করে বলেই নাম ক্যাচ ক্যাচি পাখি। তাদের আরো একটা বিশেষত্ব আছে–এরা সাতজনের একটা দল বানিয়ে থাকে। ক্যাচ ক্যাচি পাখির বাকে সবসময় সাতটা পাখি থাকবে। সাতের বেশিও না, কমও না। যদি কখনো কেউ দেখে দলে সাতটার কম পাখি আছে, তাহলে তার ঘনিষ্ঠ কোনো একজনের মৃত্যু ঘটে। অর্থহীন প্রচলিত প্রবাদ, তার পরেও ক্যাচক্যাচি পাখি দেখলেই সবাই পাখি গোনে। সিদ্দিকুর রহমানও গুনতে শুরু করলেন। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়। একটা পাখি তো কম! তিনি আবারো গুনলেন। পাখি ছয়টা। এর মানে কী? পাখি ছয়টা কেন?
ধুলাবালির উপর বসে থাকার কোনো অর্থ হয় না। কিন্তু তাঁর উঠতেও ইচ্ছা! করছে না। বরং আবারো শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে। সন্ধ্যা না মিলানো পর্যন্ত শুয়ে থাকলে মন্দ হয় না। সন্ধ্যা মিলাবে। ঘন হয়ে কুয়াশা পড়বে। আজ চাঁদের নয় তারিখ, চাঁদের আলো আছে। সেই আলো কুয়াশায় পড়বে। কুয়াশাকে মনে হবে চাঁদের আলোর হাওর। সেই হাওরের ভেতর দিয়ে বাড়িতে পৌছে যাওয়া। খোলা মাঠে চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নানান বিষয়ে চিন্তা করতে খারাপ লাগার কথা না। তাঁর বয়স সাতান্ন। এই বয়সে মানুষ পার করে আসা জীবনের কথা চিন্তা করে। সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ করে। কোনো হিসাবই মেলে না। এই বয়সটা হিসাব মেলানোর জন্যে ভালো না।
সিদ্দিকুর রহমান চারদিক দেখে নিয়ে আবারো শুয়ে পড়লেন। পাঞ্জাবিতে ধুলা যা লাগার লেগে গেছে। বাড়িতে পৌছে গরম পানি দিয়ে গোসল দিতে হবে। বড় এক বালতি গরম পানিতে সামান্য কিছু কপূরদানা ছেড়ে দিয়ে আরাম করে গোসল। পানিতে কপূর দিয়ে গোসলের অভ্যাস তিনি পেয়েছেন তাঁর প্রথম স্ত্রী আয়নার কাছ থেকে। কপূর দিয়ে গোসলের জন্যে আয়নার শরীরে কপূরের গন্ধ লেগে থাকত। কাপড়ে কপূরের গন্ধ লাগলে কাপড় বাসিবাসি মনে হয়। মানুষের গায়ে এই গন্ধ আবার অন্যরকম লাগে। আয়না। কতদিন আগে চলে গেছে, কিন্তু তার অভ্যাস রেখে গেছে। মানুষ কখনো পুরোপুরি চলে যায় না। কিছু-না-কিছু সে রেখে যায়।
তিনি আয়নার চেহারা মনে করার চেষ্টা করলেন। চট করে চেহারা চোখে ভেসে উঠল। এটাও একটা আশ্চর্য হবার মতো ঘটনা। আগে অনেকবার চেষ্টা করেছেন, চেহারা মনে করতে পারেন নি। লম্বা মুখ, সরু কপাল, বড় বড় চোখ। চোখের রঙ বাদামি। একটা কিশোরী মেয়েকে শাড়ি পরিয়ে বড় করার চেষ্টা করলে যেমন দেখায় তাকে সেরকম দেখাচ্ছে। সে তরুণীও না, কিশোরীও না। দুয়ের মাঝামাঝি থেকেই আয়না তার ক্ষুদ্র জীবন শেষ করে গেল। আফসোসের ব্যাপার। খুবই আফসোসের ব্যাপার।
নবপরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে তিনি যখন প্রথম বাড়িতে ঢোকেন তখন তাঁর দাদিজান ফুলবানু জীবিত। বুড়ির বয়স সত্ত্বরের উপরে। মেরুদণ্ড বেঁকে গেলেও শক্তসমর্থ শরীর। কানে শুনতে পান না। কিন্তু চোখে খুব ভালো দেখেন। নতুন বউকে দেখে ফুলবানু বিরক্ত মুখে বললেন–শুনছি বউ হেন, বউ তেন। কই গায়ের রঙ তো ময়লা! ভালো ময়লা। তিন রাইজ্য খুঁইজ্যা কী বউ আনল?
সিদ্দিকুর রহমানের এক ফুপু বললেন, আম্মা। আপনি কী বলেন? কী সুন্দর চাপা রঙ!
ফুলবানু বললেন, হাতের আর মুখের চামড়ার রঙ কোনো রঙ না। পেটের চামড়ার রঙ আসল। পেটের চামড়া দেখছো? ও নতুন বউ, শাড়ির আঁচলটা টান দিয়া পেট দেখাও।
নতুন বউ দাদিজানের কথা শুনে কেঁদে কেটে অস্থির।
রাতে সিদ্দিকুর রহমান স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, দাদিজানের কথায় তুমি কিছু মনে করবে না। দাদিজান এরকমই। আয়না ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিল, কেউ আমাকে কোনোদিন কালো বলে নাই।
কেউ বলে নাই, এখন একজন বলেছে। তাতে কী?
তাতে অনেক কিছু।
সিদ্দিকুর রহমান শান্ত গলায় বললেন, গায়ের রঙ কিছু না বউ। মনের রঙ আসল রঙ। মনের রঙ কালো না হলেই হয়।
নতুন বউ তাকে অবাক করে দিয়ে বলল, এটা তো ভুল কথা। আমার গায়ের রঙ কালো হলে আপনি কি আমাকে বিবাহ করতেন? আপনারা প্রথম খুঁজেছেন রঙ। আপনারা সম্বন্ধ করতে গিয়ে কোনো মেয়ের মনের রঙ কী সেই খোঁজ নেন নাই। মনের রঙ দেখা যায় না। গায়ের রঙ দেখা যায়। আমি কি ভুল বলেছি?
সিদ্দিকুর রহমান জবাব দেন নি, তবে স্ত্রীর উপর সামান্য বিরক্ত হয়েছেন। নতুন বউ মুখের উপর কটকট করে এত কথা বলবে কেন? বাসররাতে স্বামী কথা বলবে, স্ত্রী লম্বা ঘোমটা টেনে বসে থাকবে। মাঝে মাঝে হ্যা-নাসূচক মাথা নাড়বে। এটাই চিরকালের নিয়ম।
নতুন বউয়ের মুখের উপর কথা বলার এই স্বভাব অল্পদিনেই স্পষ্ট হয়ে উঠল। এই মেয়ে মুখ বন্ধ রাখে না। কেউ কিছু বললে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়। ফুলবানু নাতবউয়ের উপর খুবই বিরক্ত হলেন। তিনি তার নাম দিলেন—কটর কটর পক্ষী। বাড়িতে কেউ এলেই ফুলবানু আয়োজন করে নতুন বউয়ের নতুন নাম শুনিয়ে তার দোষ-ত্রুটি নিয়ে গল্প করতে বসেন–ভাটি অঞ্চলের মেয়ে। পানির মধ্যে বড় হইছে। পাইন্যা স্বভাব হইছে। পাইন্যা স্বভাব কী বুঝলা না? পানি কী করে? গড়াইয়া চলে। নয়া বউ গড়াইয়া চলে। সবসময় গড়াইতেছে। মেয়ের কেমন বাপ-মা কে জানে! কোরান মজিদ পাঠ করতে শিখে নাই। নাতবাউরে সেদিন বললাম— কোরান মজিদ পাঠ কইরা শুনাও। সুরা ইয়াসিন পাঠ করো। নাতবউ বলল, সে কোরান মজিদ পড়তে শিখে নাই। তোমরা কেউ এমন কথা কোনোদিন শুনছো— মেয়েরে কোরান মজিদ পাঠ করতে না শিখাইয়াই মেয়ে বিবাহ দিয়েছে? ছিছিছি! ঝাড়ু মারি এমন বাবা-মা’র মুখে। এরা শিয়াল কুত্তার অধম।
আয়না কোরান মজিদ পাঠ করতে পারে না। শুনে সিদ্দিকুর রহমানও বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি মনের বিরক্তি চেপে রেখে বলেছিলেন— কোরান মজিদ পাঠ করতে পারাটা খুবই প্রয়োজন। তুমি শিখে নাও। জুম্মাঘরের মওলানা সাহেবরে বলব। তুমি বোরকা পরে তাঁর কাছে সবক নিবা। আয়না। তাকে বিস্মিত করে বলেছিল, কোরান মজিদ তো আমি পড়তে পারি।
পড়তে পারো তাহলে দাদিজানের কাছে মিথ্যা বললে কেন?
উনি কানে শোনেন না। উনি কোরান মজিদ পাঠ কী শুনবেন?
তোমাকে পড়তে বলেছে তুমি পড়বে। উনি শুনতে পান কি পান না সেটা উনার ব্যাপার।
উনার কোনো কথা আমি শুনব না।
কেন শুনবে না?
উনি আমার সাথে অশ্লীল কথা বলেন।
কী অশ্লীল কথা?
সেটা আমি বলতে পারব না। আমি মুখে আনতে পারব না।
গ্ৰামদেশের বৃদ্ধারা নাতবউয়ের সঙ্গে অশ্লীল কথা বলে। এতে দোষ হয় না।
দোষ-গুণের কথা না। আমার ভালো লাগে না।
তোমার ভালো লাগা দিয়ে তো দুনিয়া চলবে না।
না চললে না।
সিদ্দিকুর রহমান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি দুষ্ট প্রকৃতির মেয়ে।
আয়না সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি দুষ্ট প্রকৃতির মেয়ে না। আপনার দাদি দুষ্ট প্রকৃতির। আপনিও দুষ্ট প্রকৃতির। দুষ্ট দাদির নাতি দুষ্ট হয়।
সিদ্দিকুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, আমার সম্পর্কে যা ইচ্ছা বলো কোনো ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার দাদি সম্পর্কে এই ধরনের কথা আর কোনোদিন বলবে না। শৈশবে আমার মা-বাবা মারা গিয়েছিলেন। আমাকে মানুষ করেছেন। আমার দাদিজান। এটা মাথায় রাখবা।
আয়না শান্ত গলায় বলেছে, এটা আপনি মাথায় রাখেন। উনি আপনাকে মানুষ করেছেন। আমাকে করেন নাই। আমি উনাকে দুষ্ট মহিলা বলব।
এই পর্যায়ে সিদ্দিকুর রহমান রাগ সামলাতে পারেন নি। আয়নার গালে চড় বসিয়ে দিলেন। আয়না ব্যাপারটার জন্যে প্রস্তুত ছিল না। সে খাটের এক কোনায় বসেছিল— খাট থেকে হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেল। সিদ্দিকুর রহমান তুলতে গেলেন। তার আগেই আয়না উঠে পড়ল। শান্ত ভঙ্গিতে খাটের যে জায়গায় আগে বসেছিল সেই জায়গায় বসল। যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে বলল, আপনার দাদিজান আমার শরীর শুকে বলেছেন–আমার শরীরে পরপুরুষের গন্ধ আছে। আপনার গায়ের গন্ধ উনি চিনেন। আপনার গায়ের গন্ধ না-কি আমার শরীরে নাই। প্রথম যে-পুরুষের সঙ্গে মেয়ে শোয় সেই পুরুষের গন্ধ গায়ে লেগে যায়। আমি না-কি বিয়ের আগে অন্য পুরুষের সঙ্গে শুয়েছি। সেই পুরুষের টক-টক গন্ধ আমার গায়ে আছে। যে মহিলা এমন কথা বলেন তাকে আমি দুষ্ট মহিলা বলব।
সিদ্দিকুর রহমান কী বলবেন ভেবে পেলেন না। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। স্ত্রীর গালে চড় মারার ব্যাপারটায় তিনি নিজেও হ’কচাকিয়ে গেছেন। এখন আয়না। কী বলছে সেটা তার মাথায় ঢুকছে না। তার উচিত এখনি স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাওয়া। কীভাবে চাইবেন তাও বুঝতে পারছেন না।
আয়না বলল, আমি কাল সকালে বাপের বাড়ি চলে যাব। আমাকে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। যদি না করেন তাহলে আমি নিজেই চলে যাব। যতদিন আপনার দাদি জীবিত থাকবেন ততদিন আমি আসব না। উনার মৃত্যু-সংবাদ পাওয়ার পর আসব।
এটা কেমন কথা?
কেমন কথা আমি জানি না। আপনার সঙ্গে আমার আর কোনো কথাই নাই। কাল সকালে আমাকে বাপের দেশে পাঠাবেন।
মুখে বললে তো হয় না, আয়োজন করতে হবে। সঙ্গে লোক দিতে হবে। একা তোমাকে কোনোদিনই ছাড়ব না।
লোক জোগাড় করেন। যতদিন না লোক জোগাড় হয়েছে ততদিন আমি এই বাড়ির কিছু খাব না। পানিও না।
তুমি বাড়াবাড়ি করছি।
মানুষমাত্রই অল্পবিস্তর বাড়াবাড়ি করে। আপনিও করেন। আমিও করি। আপনি চড় দিয়ে বাড়াবাড়ি করেছেন, আমিও খাওয়া বন্ধ করে বাড়াবাড়ি করব।
এই বলেই খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আয়না শুয়ে পড়ল। সিদ্দিকুর রহমান অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, আয়না ঘুমিয়ে পড়েছে।
আয়না সত্যি সত্যি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিল। সিদ্দিকুর রহমান নানানভাবে চেষ্টা করলেন, কোনো লাভ হলো না। তার পরের দিন দুপুরে নান্দাইল রোড স্টেশনে তিনি স্ত্রীকে তুলে দিতে গেলেন। ট্রেনের কামরায় ওঠার পর আয়না এক চুমুক পানি খেয়ে তার অনশন ভঙ্গ করল।
ফুলবানু ঘোষণা করলেন, আয়নাকে ফিরিয়া আনার কোনো চেষ্টা করলে তিনি সবার সামনে গুড়ের শরবতে ইদুর-মারা বিষ গুলো খাবেন। যদি না খান তাহলে তিনি সতী মায়ের সতী কন্যা না। বাজারের বেবুশ্যা। তিনি শুধু যে একা বেবুশ্যা ৩া না, তার মাও বেবুশ্যা। তার পরেও সিদ্দিকুর রহমান আয়নাকে ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেছেন। নিজে গিয়েছেন। কয়েকবার। লোক পাঠিয়েছেন। আয়না রাজি হয় নি। তার এক কথা— যতদিন বুড়ি বেঁচে থাকবে ততদিন আমি যাব না। বুড়ি যেদিন মারা যাবে তার পরদিন আমি উপস্থিত হব।
আয়না পরের বছরই সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেল। ফুলবানু আরো এগার বছর বেঁচে রইলেন। শেষের দিকে ফুলবানু চোখে দেখতে পেতেন না। একেবারেই কানে শুনতে পেতেন না। হাঁটাচলার শক্তি নেই। ঘা হয়ে শরীর পচে গেল। চিত-কাত করে শোয়াতে গেলে হাত দিয়ে তাকে ধরা যায় না। কচি কলাপাতা গায়ের উপর দিয়ে ধরতে হয়। সেই কলাপাতাও গায়ে লেগে যায়। পাতা টেনে তোলার সময় তিনি ব্যথায় চিৎকার করেন। এমন অবস্থাতেও মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে কথা বলার শক্তি এবং প্রবল ঘ্ৰাণশক্তি নিয়ে তিনি বেঁচে রইলেন।
বয়সের সঙ্গে এই দু’টি শক্তি বেড়েছে। বাড়ির সীমানার ভেতর কেউ ঢুকলেই তিনি গন্ধ শুকে শুকে বলে দেন কে ঢুকেছে।
পাকনা বড়ই খাইয়া কে ঘরে ঢুকছে? কে ঢুকছে? লাটসাবের নাতি হও আর যে-ই হও মুখ ধুইয়া আয়। চুকা গন্ধ আসন্তাছে। চুকা গন্ধে বয় (বমি) আসন্তাছে। যে আসছে সে তো পিসাব কইরা পানি নেয় নাই। আমি পিসাবের গন্ধও পাইতেছি।
ততদিনে সিদ্দিকুর রহমান দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন। স্ত্রীর নাম মোসাম্মত রমিলা খাতুন। থালার মতো গোলাকার মুখ। রুগ্ন শরীর কিন্তু কাজ করার অস্বাভাবিক ক্ষমতা। রমিলার উপর ভার পড়ল ফুলবানুর সেবা-শুশ্রুষার। রমিলা খুবই দক্ষতার সঙ্গে তাঁর দাদিশাশুড়ির সেবা করতে শুরু করল। ফুলবানুর রমিলাকে পছন্দ হলো। সারারাত ফুলবানুর ঘুম হয় না। গল্প করার জন্যে রমিলাকে ডেকে আনেন। গলা নিচু করে জগতের অশ্লীলতম গল্প করতে থাকেন। বিকারগ্রস্ত মানুষের প্রলাপ। রমিলাকে মাথা নিচু করে শুনতে হয়। একটু পরে পরে ‘হুঁ’ বলতে হয়।
ও নাতবউ শোনো, ঘোড়ার চেট দেখছো? দেখো নাই? না দেখলে গফ যেটা করতেছি। এইটা বুঝবা না। সিদ্দিকরে বলো মর্দ ঘোড়া একটা আনতে। ঘোড়ার পুটকিতে ঝাড়ু দিয়া খোঁচা দিলে ছলাৎ কইরা বাইর হয়। একটা দেখনের মতো জিনিস। হি হি হি হি।
মৃত্যুর তিন মাস আগে ফুলবানুর জবান বন্ধ হয়ে গেল। তিনি ঠোট নাড়েন, জিভ নাড়েন – কোনো শব্দ বের হয় না। এই সময় তাঁর শরীর থেকে তীব্ৰ পচা গন্ধ বের হতে শুরু করল। সিদ্দিকুর রহমান বসতবাড়ি থেকে অনেক দূরে পুকুরপাড়ে তড়িঘড়ি করে ছনের ঘর তুলে তাঁর দাদিজানকে সেখানে পাঠিয়ে দিলেন। সেবা করার জন্যে রমিলা সঙ্গে গেল। জুম্মাঘরের মওলানা সাহেবকে এনে ফুলবানুর মৃত্যু প্রার্থনা করে বিশেষ দোয়ার ব্যবস্থা হলো। এক লক্ষ দশ হাজার বার দুরুদে শেফা পাঠ করা হলো। তার পরেও মৃত্যু আসে না।
রাত একটু বাড়লেই পুকুরপাড়ের ছনের ঘরের চারপাশে শিয়াল হাঁটাহাঁটি করে। রমিলা ঘরের ভেতরও মানুষজনের হাঁটাহাঁটির শব্দ পায়। তাদের ফিসফাস কথা শানে। এরা এই জগতের মানুষ না–বিদেহী আত্মা। হয়তো ফুলবানুর মৃত পিতামাতা। তাদের সন্তানকে দেখতে এসেছে। ভয়ে রমিলার হাত-পা কাপে। রমিলা ভয় প্রকাশ করে না। খাটের চার মাথায় চারটা হারিকেন জ্বলিয়ে আয়াতুল কুরসি পড়ে রাত কাটায়। মাঝে মাঝে তার কাছে মনে হয়, কে যেন পেছন থেকে তার ঘাড়ে হিমশীতল নিঃশ্বাস ছাড়ে। সে পেছন ফিরে তাকায় না। মাথা আরো নিচু করে কোরানশরিফের পাতা উল্টায়। পেছনে তাকালে সত্যি সত্যি যদি কিছু দেখা যায়! কী দরকার?
এক শ্রাবণ মাসের মধ্যরাতে রমিলার মুক্তি ঘটল। ফুলবানু হঠাৎ গোঙানি ধরনের শব্দ করে নিথর হয়ে গেলেন। রমিলা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। ফুলবানুর ঘরের দরজা ভালোমতো বন্ধ করে পুকুরপাড়ে চলে গেল। গায়ে সাবান ডলে মনের আনন্দে সাতার কেটে পুকুরে গোসল করল। ভেতর বাড়িতে ফিরে এসে ভেজা কাপড় বদলে পাটভাঙা নতুন একটা শাড়ি পরল। চুল বঁধিল। চোখে কাজল দিল। সূর্য ডোবার পর আয়নায় নিজেকে দেখা নিষেধ, তার পরেও অনেকক্ষণ আয়নায় নিজেকে দেখে সিদ্দিকুর রহমানের শোবার ঘরের বন্ধ দরজার কড়া নাড়ল। সিদ্দিকুর রহমান ভীত গলায় বললেন, কে? কে?
রমিলা শান্ত গলায় বলল, আমি। খারাপ সংবাদ আছে। আপনার দাদিজান মারা গেছেন।
কী সর্বনাশ! বলো কী! কখন?
এই তো কিছুক্ষণ। দরজা খোলেন।
তিনি দরজা খুলে স্ত্রীকে দেখে খুবই অবাক হলেন। মরা-বাড়িতে সে এত সাজপোজ করেছে কেন? তার কি মাথায় গোলমাল হয়েছে! যে-যন্ত্রণা তার উপর দিয়ে গিয়েছে মাথায় গোলমাল হবারই কথা।
রমিলা বলল, আপনি যান। মুনশি-মওলানা খবর দেন, আত্মীয়স্বজন খবর দেন। আমি কিছুক্ষণ শান্তিমতো ঘুমাব। অনেকদিন আমি শান্তিমতো ঘুমাইতে পারি না। কেউ যেন আমারে না ডাকে।
মরার সময় দাদিজান কি কিছু বলেছেন? অনেক সময় মৃত্যুর আগে-আগে জবানবন্ধ মানুষের জবান খুলে যায়। কথা বলে। দাদিজান কিছু বলেছেন?
হ্যাঁ, বলেছেন। তিনি বলেছেন আপনি যেন আপনার প্রথম স্ত্রীর সন্তানটাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসেন। নিজের সন্তান অন্যখানে মানুষ হবে এইটা কেমন কথা?
সত্যি বলেছেন?
রমিলা ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, না, দাদিজান কিছু বলেন নাই। মৃত্যুর সময় তার জবান খুলে নাই। এইটা আমার নিজের কথা। আপনার প্রথম স্ত্রীর ঘরে যে মেয়েটা আছে সে এখন কত বড়?
অনেক বড় হয়েছে। দশ-এগার বছর। সে আসবে না। আগেও কয়েকবার চেষ্টা করেছি। তার মামারা দেয় না। সেও আসতে চায় না।
আবার চেষ্টা করেন। চেষ্টা করতে তো দোষ নাই। মেয়েটার নাম কী?
ভালো নাম লীলাবতী। সবাই লীলা বলে ডাকে।
বাহ, সুন্দর নাম– লীলা! তারা যদি দুই ভইন থাকত। তাইলে পরের ভইনের নাম হইত খেলা। দুই ভইনের একত্রে নাম— লীলা-খেলা।
বলতে বলতে রমিলা হেসে ফেলল। শব্দ করে হাসি। হাসির দমকে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। একসময় সে হাসি সামলাবার জন্যে মুখে আঁচলাচাপা দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। মাথার ঘোমটা খুলে শাড়ির আঁচল চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
সিদ্দিকুর রহমান অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার, হাসে। কেন?
রমিলা বলল, জানি না কেন হাসি।
হাসি থামাও।
থামাইতে পারতেছি না।
সে হাসতেই থাকল।
রমিলার মাথা-খারাপের লক্ষণ সেদিনই প্রথম প্রকাশ পেল।
 
Back
Top