- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 407
- Messages
- 5,564
- Reaction score
- 2,005
- Points
- 3,913
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
ইতি স্মৃতিগন্ধা
মূল লেখকঃ সাদাত হোসাইন
মূল লেখকঃ সাদাত হোসাইন
পর্ব - ১
ধামরাইয়ের বংশী নদীর তীরে বিশাল বালুর মাঠ। মাঠে তিল ঠাই নেই। লোকে লোকারণ্য। প্রতিবছরের মতো এ বছরও এখানে মেলা বসেছে–সঙ্গে রথযাত্রা। এবার অনিবার্য কারণে মেলার সময় এগিয়ে আনা হয়েছে। তাতে অবশ্য জৌলুস কিছু কমেনি। বরং বেড়েছে।
এবার বৃষ্টির উৎপাত নেই। জল-কাদা নেই। খটখটে শুকনো চারিদিক। আবহাওয়াও শীতল। ফলে লোক বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। মাসব্যাপী এই মেলায় দূর-দূরান্ত থেকেও নানা মানুষজন আসে। এবারও এসেছে। নদীর ঘাট গমগম করছে মাঝি-মাল্লাদের ভিড়ে। অসংখ্য নৌকা, বজরা বাঁধা ঘাটে। মেলা উপলক্ষে বিশাল বাজার বসেছে চারধারে। সেই বাজারে নানারকম পণ্য নিয়ে হাজির হয়েছে বৃহৎ-ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। দল বেঁধে বাউল সাধকরা এসেছেন। এসেছেন জটাধারী তান্ত্রিক, সাধুর দল। তারা উত্তর দিকে নদীর তীরঘেঁষে ডাল-পালা ছড়ানো বিশাল বটগাছের নিচে আসর জমিয়ে বসেছেন। সেখানেও কৌতূহলী মানুষ। বরিশালের পালরদি থেকে এসেছে দেশ বিখ্যাত লক্ষ্মণ দাশের সার্কাস। ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ থেকে এসেছে পুতুলনাচ ও যাত্রাপালার দল। চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। এই জনসমাগম অবশ্য বাড়তে থাকে দুপুরের পর থেকে। সময় যত গড়ায়, তত বাড়ে। নানা ধরনের লোক আসে এখানে। কুস্তি থেকে শুরু করে শারীরিক কসরত, জাদু, বায়োস্কোপ দেখানোর লোক যেমন আসে, তেমনি আসে বেদেদের দলও। তারা এসে মাদুর বিছিয়ে বসে। তারপর সাপের খেলা দেখায়। বাত-ব্যথা, যকৃতের পীড়া থেকে শুরু করে নারী-পুরুষের নানা গোপন অসুখ-বিসুখের ওষুধও বিক্রি করে। এদের প্রত্যেককে নিয়েই মানুষের আগ্রহ তুঙ্গে। ফলে চারদিকে তুমুল হুল্লোড়, ভিড়ভাট্টা, কোলাহল।
এ যেন এক হইহই কাণ্ড, রইরই ব্যাপার!
তবে মেলা ঘিরে এবার খানিক শঙ্কার কালো মেঘও জমেছে। এই মেলা মূলত আয়োজন করেন বিভুরঞ্জন রায়। তিনি এ অঞ্চলের বিগত জমিদার মনোহর রঞ্জন রায়ের পৌত্র। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পিতামহের রেখে যাওয়া সেই প্রভাব-প্রতিপত্তি আর তাদের নেই। ক্রমশই খর্ব হয়েছে। স্তিমিত হয়েছে জৌলুস। দেশভাগের সময় বড়সড় ধাক্কা খেয়েছিল রায় পরিবার। তখন তাদের অনেকেই দেশান্তরীও হয়েছিল। কিন্তু সদ্য কৈশোর পেরুনো বিভুরঞ্জন তাতে রাজি হননি। তিনি রয়ে গিয়েছিলেন। তার এই বিশাল পৈতৃক ভিটেতেই। খুব যে খারাপ থেকেছেন, তা নয়। কিন্তু হঠাৎ করেই মুক্তিযুদ্ধের সময় যেন নিজেকে আবিষ্কার করলেন নিজভূমে পরবাসী হিসেবে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভয়ানক বৈরিতার স্বীকার হতে হয় তাদের। ফলশ্রুতিতে সাময়িকভাবে দেশ ত্যাগও করতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু যুদ্ধের বছরতিনেক পর আবার নিজ দেশে ফিরে এসেছেন তিনি। ইচ্ছে ছিল সবকিছু আবার আগের মতো গুছিয়ে নিয়ে জাকিয়ে বসবেন। কিন্তু ততদিনে তার রেখে যাওয়া ভিটে-মাটি, পাড়া-প্রতিবেশী, চেনা মানুষদের অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। আগের অবনত, আন্তরিক মানুষগুলোও যেন হয়ে উঠেছে অচেনা, উদ্ধত, অন্য মানুষ।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, তার রেখে যাওয়া অনেক সম্পত্তিই ততদিনে বেদখল হয়ে গেছে। এমনকি এই নদীর তীরের বিশাল বালুর মাঠও বেহাত হয়েছে। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে দুষ্টু কিছু লোক। সেখানে তারা ইটের ভাটা বসিয়েছে। দিনরাত সেই ভাটার গনগনে আগুনে ইট পুড়ছে। সেইসঙ্গে পুড়ছে বিভুরঞ্জনের বুকও। এই দহন থেকে তাঁর মুক্তি মেলে না। প্রতিবছর কী আড়ম্বর করেই না মেলা বসত এখানে। আশপাশের বহু অঞ্চলের মানুষ ছুটে আসত একটু দর্শন, উদযাপনের জন্য। তাদের সকলের সবচেয়ে বড় আনন্দের উৎসব ছিল এই মেলা। ছোট-বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বার্ষিক বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলও। অনেকের কাছে এ যেন আবার এক তীর্থস্থানও। বছরান্তে এখানে না এলে তাদের আত্মার শান্তিটুকু আর মেলে না। ফলে এই মেলা হয়ে উঠেছিল ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের এক আশ্চর্য মিলনস্থল। অথচ সেখানেই কি না এখন আগুন জ্বলছে দিন-রাত!
সেই আগুনে কাঠ পুড়ে কয়লা হচ্ছে, মাটি পুড়ে ইট হচ্ছে আর বিভুরঞ্জনের হৃদয় পুড়ে হচ্ছে খাক।
বিভুরঞ্জন অবশ্য দেশে ফিরেই এই জায়গা উদ্ধারের চেষ্টায় নেমে পড়েছিলেন। তা পেরেছিলেন। কাজটা সহজ না হলেও মানুষের আবেগ-অনুভূতির কথা ভেবেই হয়তো প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রভাবশালী অনেকেই তাকে সমর্থন করেছে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে জায়গাটা শেষ অবধি উদ্ধার হয়েছে। তবে এতে করে বিভুরঞ্জনের ক্ষতিও কিছু কম হয়নি। তাঁর শত্রু বেড়েছে। যাদের বেশির ভাগই লুকানো ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে আছে একদম ঘাড়ের কাছে। যেকোনো সুযোগে সেই ছুরি পিঠে বিধিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না তারা।
বেশ কয়েক বছর বিরতির পর বছরতিনেক ধরে মেলা আবার শুরু হলেও তার আগের সেই জৌলুস যেন আর ফিরে আসছিল না। বিভুরঞ্জন নিজের সর্বোচ্চ পরিশ্রম দিয়ে চেষ্টা করছিলেন মেলাকে আবার আগের চেহারায় ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু পারছিলেন না। কোথায় যেন একটা খামতি থেকেই যাচ্ছিল। এই নিয়ে ভীষণ মনোকষ্টে ভুগতেন তিনি। কিন্তু নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত বিভুরঞ্জন কোনো সমাধান বের করতে পারেননি। তবে এবারের মেলা শেষ পর্যন্ত তার সেই মনোকষ্ট দূর করতে শুরু করেছে। দিন যত যাচ্ছে মেলা যেন ততই জমে উঠেছে। আরো বেশি জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ছাড়িয়ে যাচ্ছে আগের সব আয়োজনকে। কিন্তু তারপরও খুশি হতে পারছেন না বিভুরঞ্জন। তার মনের ঈশান কোণ থেকে শঙ্কার কালো মেঘ যেন আর দূর হচ্ছে না।
ফরিদ এই মেলার কথা শুনেছে ছোটবেলায়। তখন সে রাতে মামার সঙ্গে ঘুমাত। তার মামা আব্দুল ওহাব রাতভর গল্প করতেন। সেই গল্পে কতবার যে এই মেলার কথা এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। পরে সে নানা বই-পত্রেও পড়েছে। কিন্তু কখনোই নিজ চোখে দেখা হয়নি। দীর্ঘদিন থেকেই পারুর শরীর-মন ভালো নেই। একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। সারাক্ষণ কী এক অজানা আতঙ্কে জড়সড় হয়ে থাকে। কদিন আগে রাতের বেলায় জানালার বাইরে কাউকে দেখে প্রচণ্ড ভয়ও পেয়েছিল সে। কে হতে পারে লোকটা?
আজিজ মিয়া কি তবে তাদের খোঁজ পেয়ে গেছে? ভাবতেই ভয়ে শরীরে কাটা দিয়ে উঠেছিল ফরিদের। এমন অনুনমেয়, ভয়ানক মানুষ সে আর দেখেনি। ঘটনার পর থেকে পারুকে একা বাসায় রেখে রাতে আর কোথাও যাবে না বলেই মনস্থির করল সে। তবে তার চেয়েও জরুরি পারুকে নিয়ে কোথাও থেকে একটু ঘুরে আসা। একটু খোলা আকাশ, তাজা হাওয়া, লোকের সমাগমে খানিক সময় কাটানো। তাহলে হয়তো মুহূর্তের জন্য হলেও সে ভুলে থাকতে পারবে এই দুঃসহ ঘরবন্দি সময়। দমবন্ধ স্যাঁতসেঁতে অনুভব।
এই ভেবেই আজ এখানে এসেছে ফরিদ। সে ভেবেছিল বালুর মাঠ বুঝি সত্যি সত্যিই বালুর মাঠ। কিন্তু কাছে আসতেই ভুল ভাঙল তার। নদীর পাড় বলেই হয়তো মাটিতে জলের উপস্থিতি পেয়ে সবুজ ঘাসে ছেয়ে আছে পুরো মাঠ। সেই মাঠে যতদূর চোখ যায় কেবল মানুষ আর মানুষ। সঙ্গে হরেকরকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসা দোকান। দেকানগুলো মূলত তৈরি করা হয়েছে রংবেরঙের কাপড় টানিয়ে। ফলে চারদিকে তাকাতেই চোখে ভাসে কেবল বর্ণিল এক পৃথিবীর ছবি। সেখানে অসংখ্য সুখী মানুষের মুখ। যেন কোথাও কোনো দুঃখ নেই, দহন নেই, বিষাদ-বিসংবাদ নেই। সকলই কেবল আনন্দে পরিপূর্ণ। মানুষের চোখে মুখে কৌতূহল আর উচ্ছ্বাস।
পারু অবশ্য সবকিছু দেখে হকচকিয়ে গেছে। তার পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি। সে আজ খানিক সেজেছে। মুখে একটু প্রসাধনী মেখেছে। ঠোঁটজোড়াও খানিক রাঙিয়েছে। আর চোখভর্তি কাজল। তবে সবচেয়ে যে বিষয়টিতে ফরিদ আশ্চর্য হয়েছে, তা হলো পারু তার সিঁথিতে সিঁদুর পরেছে। বাসার সামনে দিয়ে কবে যেন এক ফেরিওয়ালা যাচ্ছিল। তার কাছ থেকে ফরিদকে না জানিয়েই গোপনে কিনেছিল সে। আজ পরেছে। এখন তাকে দেখতে লাগছে নতুন বউয়ের মতো। তার মুখ থেকে চোখ ফেরানো যায় না। বাসা থেকে বের হয়ে যখন তারা রিকশা নিল বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে, তখন ঝলমলে রোদ উঠেছে। সেই রোদ থেকে পারু তার চোখ আড়াল করতে যেতেই খেয়াল করল ফরিদ ড্যাবড্যাব চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। পারুর এত লজ্জা লাগছিল! সে গলা নিচু করে বলেছিল, ‘লোকে দেখলে কী বলবে?
কী বলবে?
বলবে লোকটা কী বেহায়া।’
“কেন?’
“কেন আবার? কেউ কারো দিকে এই রাস্তাঘাটে এভাবে তাকিয়ে থাকে?
‘কেউ থাকে কি না জানি না, তবে আমি থাকি। আমার বউয়ের দিকে আমি তাকিয়ে থাকতে পারব না?
‘আমি আপনার বউ?’ প্রশ্নটা করেই থমকে গেল পারু। ফরিদও। আসলেই তো, সে কি ফরিদের বউ? তাদের তো এখনো বিয়ে হয়নি। এমনকি কখনো হবে বলেও মনে হচ্ছে না। যে বিপদে তারা পড়েছে এই বিপদ থেকে মুক্তির কোনো উপায়ও তাদের জানা নেই। পারুর আচমকা মন খারাপ হয়ে গেল। এই জীবনে সে কি কখনো সত্যি সত্যি বউ হতে পারবে না?
ফরিদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যেই সম্ভবত বলল, কী হলো?
‘কিছু না। গম্ভীর গলায় জবাব দিল পারু।
বলো?
‘কিছু না।’ বলে সামান্য থামল পারু। তারপর বলল, আর আপনি এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না। এভাবে কেউ কারো দিকে তাকিয়ে থাকে না।
‘থাকে।
‘কে?
ফরিদ নির্বিকার গলায় বলল, “আমি।’
পারু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আপনি এমনভাবে তাকিয়ে থাকবেন না। আপনি এমনভাবে তাকিয়ে আছেন যে দেখে মনে হচ্ছে এর আগে কখনো আপনি আমাকে। দেখেননি!
‘দেখিইনি তো।
‘দেখিইনি মানে?
‘দেখিইনি মানে এর আগে কখনো এই তোমাকে আমি দেখিনি।
‘এই আমাকে মানে কী?
‘এই তোমাকে মানে…।’ বলে খানিক থমকাল ফরিদ। কী যেন ভাবল। তারপর বলল, “এই তোমাকে মানে হলো…এই যে লাল টুকটুকে নতুন বউয়ের মতো তোমাকে।
ফরিদ ভেবেছিল কথাটা শুনে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যাওয়া পারু খানিক আনন্দিত হবে। তার মন ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং পারু আরো গম্ভীর হয়ে গেল। তার মাথায় ঢুকে গেল ফরিদের কথাটা বউয়ের মতো তোমাকে। তার মানে সে আর কখনো সত্যি সত্যিই বউ হতে পারবে না? তাকে সারাজীবন থাকতে হবে ফরিদের বউয়ের মতো হয়েই?
বাকিটা সময় চুপ করে রইল পারু। ফরিদ কত কী চেষ্টা করল, কিন্তু লাভ হলো না। পারু আর সহজ স্বাভাবিক হতে পারল না। বরং কত কী ভাবতে লাগল একা একা। রাজ্যের দুশ্চিন্তা, দুঃখ যেন আবার ফিরে আসতে লাগল একে একে। তবে সেই সব দুশ্চিন্তা যেন এক ঝলকেই মিলিয়ে গেল হাওয়ায়।
যখন তারা মেলার মাঠের পাশে এসে দাঁড়াল, তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। পারুর আচমকা মনে হলো চোখের সামনে এমন আনন্দময়, এমন বিশাল, এমন জাঁকজমকপূর্ণ কিছু বহুকাল দেখেনি সে। তার আনন্দে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছিল রঙিন বেলুন হাতে প্রজাপতির মতো ভেসে বেড়ানো ওই শিশুদের সঙ্গে। কিংবা ওই যে চরকিতে উড়ে বেড়াচ্ছে হাসি হাসি মুখের মানুষগুলো, তাদের সঙ্গে। ওই হাওয়াই মিঠাইগুলো সব কিনে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল তার। এত আনন্দময় কেন সবকিছু? যেন কোথাও কোনো দুঃখ নেই, বিপদ-বিষাদ নেই। সকলই কেবল ভালো আর আলোময়। এই কোলাহল আর ভিড়ের ভেতর তার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে শক্ত করে তার হাতের মুঠোয় ফরিদের হাতটা ধরে রাখল, যদি হারিয়ে যায়–এই ভয়ে। তারপর বলল, এখানে আজ আমরা থাকব?
ফরিদ মৃদু হেসে বলল, হুম, থাকব।’
সারারাত?
সারারাত তো আর মেলা হয় না।’
যতক্ষণ হয়?
‘হু, থাকব।
‘আমি পুতুলনাচ দেখব?
আচ্ছা।
সার্কাসও দেখব।’ দূরের আকাশ সমান উঁচু প্যান্ডেল দেখিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল পারু। ওখানে কত বড় হাতি দেখেছেন? আমি ওই হাতিও দেখব।’
আচ্ছা।’ বলে মৃদু প্রশ্রয়ের হাসি হাসল ফরিদ।
ওই যে ওখানে বীণ বাজিয়ে সাপের খেলা দেখাচ্ছে, আমি সাপখেলা দেখব।
ফরিদ বলল, “চলো।’
তারা হেঁটে হেঁটে সাপের খেলার কাছে এলো। পারু অবশ্য বেশিক্ষণ দেখতে পারল না। গোখরা সাপগুলো যখন ভয়ানক ফণা তুলে ফোঁস-ফাঁস শব্দ করতে লাগল, তখন সে ভয়ে ফরিদের শার্টের আস্তিন চেপে ধরে ফ্যাকাশে গলায় বলল, আমার ভয় করছে। আমার ভয় করছে।’
‘কেন?’
জানি না কেন! তবে রাতে আর আমি ঘুমাতে পারব না। সারারাত দুঃস্বপ্ন দেখব। এই সাপগুলো তখন ঘুমের মধ্যে আমাকে তাড়া করতে থাকবে।’
ফরিদ তাকে শক্ত করে আগলে ধরে নিয়ে গেল নদীর কাছে। সেখানে বটগাছের তলায় বাউলরা একতারা বাজিয়ে গান গাইছে
‘ওহে মন কি মেলে সাধন ছাড়া, মন কি মেলে অহমে?
মনের মানুষ মিলবে যদি মনখানা রয় সহজে,
নষ্ট মনের হিসেব কঠিন, হিসেব কঠিন কু-মনে,
জীবন সহজ, যাপন সহজ, ভালোবাসার ভুবনে।
তবু কেন মনের মধ্যে ঘেন্না-বিবাদ বহ হে?
মনের মানুষ মিলবে যদি মনখানা রয় সহজে…।
পারু জানে না কেন, তার চোখে হঠাৎ জল চলে এলো। সে ফরিদের হাত চেপে ধরে বলল, আমি একটু এখানে বসি?
‘এখানে কোথায় বসবে?
‘এই ঘাসের মধ্যে?
ফরিদ কী ভেবে বলল, বসো।’
পারু আর কথা বলল না। সে তন্ময় হয়ে গান শুনতে লাগল। ফরিদ আচমকা আবিষ্কার করল, পারুর দু গণ্ড বেয়ে নেমে আসছে জলের ধারা। সে হাত বাড়িয়ে তাকে খানিক কাছে টেনে নিল। তারপর বলল, কী হয়েছে?
পারু জবাব দিল না। ফরিদ বলল, বাড়ির কথা মনে পড়ছে?
উঁহু।
তাহলে?
পারু সামান্য চুপ থেকে বলল, ‘বাবার কথা মনে পড়ছে। আমার সারাক্ষণ কী মনে হয় জানেন?
কী?
‘এই যে আমি যেখানে যেখানে যাচ্ছি, বাবাও ঠিক তার আশপাশে কোথাও আছে। আমাকে খুঁজছে। আমার খুব কাছেই কোথাও। আমি হঠাৎ পেছন ফিরে তাকালেই তাকে দেখতে পাব। একটু অপেক্ষা করলেই সে এসে আমাকে দেখতে পাবে। এই জন্য আমি সারাক্ষণ বাসার জানলা খুলে রাখতাম। আপনার নিষেধ সত্ত্বেও মাঝেমধ্যেই বাড়ির সামনের ওই রাস্তাটাতে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতাম। আমার কেবল মনে হতো, ওই বুঝি বাবা এসে আমাকে খুঁজে না পেয়ে চলে গেল। পথ ভুল করল।
ফরিদ কথা বলল না। তবে তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে সে পারুর হাতখানা ধরে রাখল। পারু খানিক চুপ করে থেকে বলল, “ওই যে গান গাইছে যে লোকটা, মুখভর্তি দাড়ি, লম্বা চুল মাথায়–ওই লোকটাকে কেমন আমার বাবার মতো লাগছে না?
‘তোমার বাবার মতো!’ ফরিদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তারপর বলল, কই? না তো!’
পারু সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না। চুপচাপ একদৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে বসে রইল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ বাদে বলল, তাও তো ঠিক। বাবার তো এমন চুল-দাড়ি নেই। অমন করে গানও গাইতে পারে না। তার পরও কেন যেন মানুষটার ওই চোখজোড়া দেখে আমার হঠাৎ মনে হলো, এ বুঝি বাবাই। বাবাও তো অমন করেই তাকাত। আচ্ছা, যদি এমন হয় যে বাবা আমার চিন্তায় অস্থির হয়ে এভাবেই গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়ায়? এভাবেই লম্বা চুল-দাড়ি নিয়ে পথে পথে ভিখারির বেশে ঘুরতে থাকে? আমি তো তাহলে তাকে দেখলেও কখনো চিনতে পারব না! পারব?
পারুর গলা ভারী। চোখের কোলে আবারও মেঘ জমতে শুরু করেছে। ফরিদ হঠাৎ দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, চলো তোমাকে চুড়ি কিনে দিই। ওই যে ওখানে দেখো, কী সুন্দর চুড়ি বিক্রি হচ্ছে।
এক প্রৌঢ়া রমণী রংবেরঙের কাঁচের চুড়ির পসরা সাজিয়ে বসেছে। তার সামনে রাখা বেতের ডালায় থরেথরে সাজানো বাহারি জিনিসপত্র। দেখেই মন ভালো হয়ে গেল পারুর। সে সেখান থেকে হাতভর্তি করে চুড়ি কিনল। কিনল চুলের ফিতা, টিপ, লিপস্টিক, ছোট্ট আয়না, গলার হারসহ আরো কত কী! ঘরের জন্য প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিসপত্রও কিনল। খানিক আগের মেঘলা আকাশে যেন ভোরের ঝলমলে আলো ফুটেছে। কিশোরী মেয়ের মতো উচ্ছ্বাস খেলা করছে তার চোখেমুখে। দেখে কী যে ভালো লাগল ফরিদের! সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। তার মুখে প্রশ্রয়ের হাসি। পারুর আনন্দ যেন আর ধরে না। তবে খানিক বাদেই ম্লান চোখে তাকাল সে। তারপর বলল, আপনার সব টাকা শেষ করে দিচ্ছি। আমি, তাই না?
ফরিদ বিচলিত ভঙ্গিতে বলল, ‘হুম।
ইশ! এখন তাহলে? পারু আঁতকে ওঠা গলায় বলল। এমনিতেই তো আপনার হাতে টাকা-পয়সা তেমন নেই। আর আমি কী না…।
ফরিদ এবার হাসল। তারপর বলল, এই পুরোটা মেলা আমি তোমাকে একদিন কিনে দেব। কিন্তু আজ তো পারব না। এইজন্য আজ অর্ধেক মেলা কিনে দেয়ার মতো টাকা নিয়ে এসেছি। অর্ধেক মেলায় তোমার হবে?
মানে?’ চোখ বড় বড় করে বিভ্রান্ত চোখে তাকাল পারু।
ফরিদ প্যান্টের ভেতরের দিকে পকেটে হাত ঢুকিয়ে একগোছা টাকা বের করল। তারপর বলল, আমার যে প্রায়ই বাড়ি ফিরতে দেরি হতো, কেন জানো?
পারু কথা বলল না। তবে উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল। ফরিদ বলল, এই যে এই মেলায় আসব তোমাকে নিয়ে, এইজন্য। আমি ওষুধের দোকানের বাইরেও কিছু কাজ জুটিয়েছিলাম। তাতে অবশ্য মাঝেমধ্যেই একটু-আধটু মিথ্যে বলতে হতো দোকানে। ফাঁকি-টাকিও দিতে হয়েছে কখনো কখনো। তবে শেষমেশ কিছু টাকাও জমেছে। কী এই টাকায় অর্ধেকটা মেলা কেনা যাবে না?
পারুর চোখে আবার জল চলে এলো। আজ তার কী হয়েছে কে জানে, কথায় কথায় চোখ ভিজে আসছে। এই কান্নায় দুঃখ যেমন আছে, তেমনি আনন্দও। এই যে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে, বিসর্জন দিয়ে এক অসীম অনিশ্চয়তার পথে সে পা। বাড়িয়েছে, সেই পথ তাকে শেষ অবধি ছুঁড়ে ফেলেনি। বরং প্রবল মমতায় বুকে টেনে নিয়েছে। পারু হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছতে মুছতে হেসে ফেলল। তারপর বলল, “এই কটা টাকায়তো অর্ধেকটা মেলা কেনা যাবে না।
‘তাহলে?’ ম্লান গলায় বলল ফরিদ।
পারু এই ভিড়ের মধ্যে ফরিদের আরো গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তারপর বলল, এই টাকায় পুরো পৃথিবীটা কেনা যাবে। আস্ত পৃথিবীটা।
কথাটায় কী ছিল কে জানে! ফরিদ এক হাত দিয়ে পারুকে তার আরো কাছে টেনে নিতে চাইল। কিন্তু পারল না। তার আগেই পেছন থেকে আসা তীব্র গতির ভিড়ের স্রোতে হঠাৎ ছিটকে গেল পারু। তখন বিকেল প্রায় মরে এসেছে। সন্ধ্যা নামাবে বলে অপেক্ষা করছে অন্ধকার। তবে সেই অন্ধকারের অপেক্ষাকে আরো প্রলম্বিত করে দিয়ে মেলার মাঠে একে একে জ্বলে উঠতে লাগল রংবেরঙের আলো। সেই আলোয় আরো রঙিন, আরো ঝলমলে হয়ে উঠতে লাগল চারপাশ। বিচলিত ফরিদ পেছন ফিরে তাকাল। আর ঠিক তখুনি লম্বা, গৌর বর্ণের একজন লোককে কেন্দ্র করে একটা ভিড় এগিয়ে আসতে দেখল সে। লোকটার নাকের নিচে পাকানো গোঁফ। মাথাভর্তি ঘন কালো চুল। পরনে ধবধবে সাদা সিল্কের পাঞ্জাবি। তিনি চারপাশটা দেখতে দেখতে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছেন। তার চোখে-মুখে স্পষ্ট পরিতৃপ্তির আভা। কয়েকজন দশাসই শরীরের লোক তার আগে আগে লাঠি হাতে লোকজন সরিয়ে জায়গা করে দিচ্ছে। এ কারণেই এদিকটাতে হঠাৎ ছোটাছুটি বেড়ে গেছে। ভিড় বেড়েছে। পারু সেই ভিড়েই ছিটকে গেছে।
ফরিদ খানিক পেছনে ছুটে গিয়ে তাকে খুঁজে বের করল। তারপর তার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো মেলা থেকে দূরে। এখানে তেমন কোলাহল নেই। সবকিছু শান্ত, চুপচাপ। কিন্তু তারপরও পারুর চোখে-মুখ থেকে ভয়ের ছাপটা যেন আর গেল না। সে শক্ত করে ফরিদের হাত ধরে বসে রইল। ফরিদ বলল, ভয় পেয়েছিলে?
পারুর ঠোঁট কাঁপছে। সে সম্ভবত ভিড়ের ধাক্কা, হুড়োহুড়িতে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তার লাল শাড়িতে ধুলোবালি লেগে আছে। ফরিদ তাকে আরো খানিকটা দূরে সরিয়ে নিয়ে এলো। এখানটাতে একদমই মানুষ নেই। পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে বংশী নদী। এই সময়ে নদী খুব একটা ভরভরন্ত না হলেও জলের অভাবও তেমন নেই। বরং মেলা থেকে ঠিকরে আসা রংবেরঙের আলো, নদীর ঘাটজুড়ে বাঁধা অসংখ্য নৌকা আর মাঝিদের হৈ-হুঁল্লোড়ে বেশ একটা জমজমাট ভাব। যদিও সন্ধ্যার ম্লান আলোয় বিশাল বংশী নদীর ওপারটা ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না। ফরিদ পারুকে একটা গাছের তলায় বসাল। তারপর বলল, কী হলো, তোমাকে এত ফ্যাকাশে লাগছে কেন?
পারু চেষ্টা করছে নিজেকে সামলে নেয়ার। কিন্তু পারছে না। সে প্রায় ভাঙা গলায় বলল, আমার খুব ভয় করছে। খুব ভয় করছে।’
‘কেন? এখানে ভয় পাওয়ার কী আছে?
‘আমি ঠিক জানি না। কিন্তু আমার খুব ভয় হচ্ছে।’
কীসের ভয়? এইটুকুতেই কেউ এত ভয় পায় নাকি বোকা মেয়ে?’ আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল ফরিদ।
‘আপনি যদি আমাকে আর খুঁজে না পেতেন?
কেন খুঁজে পাব না? একটু যেন অবাকই হলো ফরিদ।
‘এই যে এত ভিড় ওখানে। মানুষ যেভাবে পাগলের মতো এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছিল, আমি যদি হারিয়ে যেতাম? যদি আপনাকে আর খুঁজে না পেতাম?
ফরিদ পারুর পাশে বসল। তারপর আলতো হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বোকা মেয়ে, তুমি হারিয়ে যাবে কেন?’
‘আমি শুনেছি অনেকেই মেলায় হারিয়ে যায়। তারপর আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের। আজ যদি আমিও আর আপনাকে খুঁজে না পেতাম, তাহলে কী হতো আমার? কই যেতাম আমি? কী করতাম?
ফরিদ এবার হাসল। তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য খানিক রসিকতার স্বরেই বলল, কী আর করতে? আমাকে এখানে একা ফেলে রেখে ঢাকায় চলে যেতে। আমিও তোমাকে রাতভর খুঁজে না পেয়ে ভোরবেলা বাসায় ফিরে যেতাম। গিয়ে দেখতাম তুমি বাসায় আমার জন্য রান্নাবান্না করে অপেক্ষা করছ।’
‘আমি তো বাসা চিনি না। ঠিকানাও জানি না। যদি আমি সত্যি সত্যি হারিয়ে যেতাম…!’
পারুর ঠোঁট কাঁপছে। তার চোখে ভীত-সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। এই সামান্য ঘটনায় যে কেউ এমন ভয় পেতে পারে তা ফরিদের ভাবনাতেও ছিল না। তবে একটা বিষয় সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, গত কিছুদিনের ঘটনায় পারুর ভেতর স্থায়ী একটা ভয় ঢুকে গেছে। সে সারাক্ষণ ভাবতে থাকে এই বুঝি ভয়ংকর কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে। কিংবা ফরিদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এটা অনেকটা দুঃস্বপ্নের মতো। এই দুঃস্বপ্ন তাকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে, এর থেকে তাকে কী করে মুক্তি দেবে ফরিদ?
মেলার ঝলমলে ভাবটাও এখানে তেমন নেই। সন্ধ্যার ম্লান আলো ক্রমশই জেঁকে বসেছে। সেই আলোয় দু হাতে শক্ত করে পারুকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখল ফরিদ। তারপর তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “এত কষ্টে যাকে পেয়েছি, তাকে হারিয়ে ফেলা যায়?
পারু কথা বলল না। ফরিদ বলল, হারিয়ে ফেলার জন্য তো তোমাকে আমি পাইনি পারু। তোমাকে পেয়েছি এভাবে ধরে রাখার জন্য। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না?”
‘খুব করি।’ অস্ফুটে বলল পারু।
তাহলে?
‘তারপরও সারাক্ষণ ভয় হয়। মনে হয় যদি আপনাকেও হারিয়ে ফেলি। আপনি ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই…।’ কথাটা বললেও আচমকা থমকে গেল। পারু। যেন হঠাৎ করেই কিছু একটা মনে পড়েছে তার। কিন্তু সেই কথাটা এখন, এই মুহূর্তেই ফরিদকে বলবে কি না সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
ফরিদ সোজা হয়ে পারুর মুখোমুখি বসল। তারপর আঙুলের ডগায় তার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, যদি তোমার আর কেউ থাকত, তাহলে কি আমাকে হারিয়ে যেতে দিতে? নাকি তখন আর আমাকে হারিয়ে যেতে দিলেও কোনো ক্ষতি নেই?
পারু এই কথার উত্তর দিল না। তার কেবল মনে হতে লাগল, সে খানিক আগে যা বলেছে তা ঠিক করেনি। ফরিদ ছাড়াও এই মুহূর্তে তার সঙ্গে আরো একজন আছে। সেই একজনের কথা সে ভুলে গিয়েছিল। অথচ সে-ই তার সবচেয়ে অবিচ্ছেদ্য অংশ। সবচেয়ে আপনও। পারু স্পষ্ট টের পাচ্ছে তার শরীরের ভেতরে বেড়ে উঠছে আশ্চর্য মায়াময় এক অস্তিত্ব। ওই অস্তিত্বটুকুর জন্য হলেও সে ফরিদকে কখনো হারাতে দিতে চায় না। আচ্ছা, সে কি এখন ফরিদকে কথাটা বলবে? নাকি আরো খানিক অপেক্ষা করবে?
পারু অবশ্য কথাটা বলার সুযোগই পেল না। তার আগেই আচমকা উঠে দাঁড়াল ফরিদ। তারপর বলল, এই দেখো, সার্কাস দেখার সময় বোধহয় হয়েই এলো।
পারুর এখন আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। এই এখানেই চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে জানে, ফরিদ এখন আর তাকে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেবে না। সে তার মন ভালো করে দেয়ার জন্য নানা কিছু করতে থাকবে। তারপরও সে বলল, এখানে আরেকটু বসি?
‘এখানে? এই অন্ধকারে?
হুম।
“কেন?”
ভালো লাগছে।’
‘আপনার একা ভালো লাগলে তো হবে না ম্যাডাম। আমারওতো ভালো লাগতে হবে। না হলে কিন্তু আপনাকে একা এই অন্ধকারে রেখে আমি মেলা দেখতে চলে যাব।’ রসিকতার স্বরে কথাগুলো বলে সামান্য হাসল ফরিদ। তারপর মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে বলল, “জানি যাচ্ছি ফেলে সন্ধ্যা, সাথে তোমাকেও স্মৃতিগন্ধা।
‘এই লাইন দুটো আর কখনো বলবেন না তো।’ বিরক্ত গলায় বলল পারু।
‘কেন?
ভালো লাগে না আমার। মনে হয়, কেউ একজন চিরতরে বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। আর বিদায় নেয়ার আগে মন্ত্র পড়ে যাচ্ছে। চিরবিদায়ের মন্ত্র।’
পারুর কথা শুনে হা হা হা করে হাসল ফরিদ। তারপর কয়েক পা সামনে এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এলো। তারপর পারুকে ধরে দাঁড় করিয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিস করে বলল,
‘যেতে যেতেও ফিরে আসবার বাহানা কুড়াই,
স্মৃতিগন্ধা-অচেনা সন্ধ্যা, তোমাতে উড়াই।
ফরিদের এইটুকু কথায় কিংবা এই মন কেমনের সন্ধ্যায় কিংবা ওই বলার ধরনে কিছু একটা ছিল। পারুর আচমকা মন ভালো হয়ে গেল।