Collected ইস্টিশন - হুমায়ূন আহমেদ

dukhopakhidukhopakhi is verified member.

Special Member
Registered
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
407
Messages
5,564
Reaction score
2,011
Points
3,913
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
ইস্টিশন

মূল লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ






পর্ব - ১
আমার বড় ভাই দ্বিতীয় বারের মতো স্কুল ফাইন্যাল ফেল করে খুবই রেগে গেল। সাধারণ রাগ না, ভয়ংকর রাগ। কাছে গেলে ফোঁসফোঁস শব্দ পর্যন্ত শোনা যায়। বাবা আমাকে ডেকে বললেন, কয়েক দিন ওকে ঘাঁটাবি না। দূরেদূরে থাকবি। দ্বিতীয়বার ফেলটা সব সময় মারাত্মক। তিনবার ফেল করে ফেললে আবার সব স্বাভাবিক। ফেলটা তখন ডাল ভাতের মতো হয়ে যায়। যারা এমনিতেই রাগী স্বভাবের তিনবার ফেল করার পর তাদের মধ্যেও মোলায়েম ভাব চলে আসে। গলার স্বরও মেয়েলি হয়ে যায়। তিনবার ফেলের এটাই আসল মজা।
বাবা পাঞ্জাবির পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে বললেন, যা রঞ্জুর হাতে দিয়ে আয়। এই সময় হাতে টাকা পয়সা থাকলে মনটা শান্ত থাকে। মন শান্ত থাকা এখন বাঞ্ছনীয়। মন শান্ত না থাকলে উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলতে পারে।
আমি বাবার সঙ্গে ইস্টিশনঘর পর্যন্ত যাচ্ছি। ছুটির দিনে বাবাকে ইস্টিশনঘর পর্যন্ত এগিয়ে দেয়া আমার অনেক দিনের অভ্যাস। আগে তার আঙ্গুল ধরে ধরে যেতাম। এখন আঙ্গুল ধরতে লজ্জা লাগে। আঙ্গুল না ধরলেও তাঁর পাশাপাশি গা ঘেঁসা চাই। বাবার গা ঘেঁসে হাঁটলে তাঁর শরীরের ঘামের। গন্ধ পাওয়া যায়। বাবার ঘামের এই গন্ধটা খুবই মজার। বাবা দীর্ঘ নিশ্বাস। ফেলে বললেন, রঞ্জুর জন্যে বড়ই চিন্তাযুক্ত। উল্টাপাল্টা কিছু না করলেই হয়।
আমি বললাম, উল্টাপাল্টা কী করবে?
ধর ফাঁস নিয়ে ফেলল। তিন গজ নাইলনের দড়ি কিনে শিমুল গাছের ডালে ঝুলে পড়ল। তিন গজ এক নম্বুরি নাইলনের দড়ির দাম পনেরো টাকা। পনেরো টাকা যোগাড় করা কঠিন কিছু না। মেট্রিকের রেজাল্টের পর খুব কম হলেও দেড় দুইশ ছেলে ঝুলে পড়ে। গাছে ঝুলল, পুট করে জিব বের হয়ে পড়ল–সব শেষ।
কী সর্বনাশ!
সর্বনাশ বলে সর্বনাশ। গাছে—মাছে সর্বনাশ। স্কুলে আমার এক ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল বিধু। ভালো নাম বিধায়ক আমরা ডাকতাম বিন্দু বিধু। বিন্দুর মতো ছোট খাট বলেই বিন্দু বিধু। ইংরেজীতে BB, হিন্দু তো এই জন্যে পড়াশোনায় মারাত্মক টাইপ। হিন্দুরা পেয়াজ খায় না বলে পড়াশোনায় ভাল হয়। স্কুলে বরাবর ফার্স্ট হত। এই বিধু মেট্রিকে ফেল হয়ে গেল।
তুমি পাশ করলে?
প্রথম চান্সে পারি নি। আমাদের সময় প্রথম চান্সে কেউই পারত না। বিন্দু বিধু যে বার ফেল করল সেবার আমিও ফেল। সেকেন্ড চান্সে কেটে বের হয়ে গেলাম। আমার কথা বাদ দে বিধুর কথা শোন। ও যখন দেখল পত্রিকায় রোল নাম্বার নেই–তখন গরুর গলার দড়ি খুলে নিয়ে কাঁঠাল গাছে ঝুলে পড়ল। তখন নাইলনের দড়ি ছিল না। গরুর গলার গোবর মাখা দড়িই ভরসা। বিশ্রী অবস্থা। জিব বের হয়ে আছে। ধুতি লুঙ্গির মতো প্যাঁচ দিয়ে পরেছিল সেই ধুতি খুলে পড়ে গেছে। ইয়েটা দেখা যাচ্ছে। ফাঁস নিয়ে মরা মানুষের ইয়ে আবার খুবই লম্বা হয়ে যায়। একটা নেংটা মানুষ দড়িতে ঝুলছে। কেউ যে গিয়ে ধুতি পরিয়ে দেবে সেই উপায় নেই। পুলিশ আসার আগে কিছুই করা যাবে না। যে এই কাজ করবে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাবে। হাজতে ঢুকিয়ে রুলের ডলা দেবে। ফাঁসির মরা কখনো দেখেছিস?
না।
খবর্দার দেখবি না। রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। এক সপ্তাহ ভাত খেতে পারবি না।
বাবা পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। সিগারেট খাবার সময় বাবা কোনো কথা বলেন না। খুবই উদাস হয়ে থাকেন। তখন তাঁকে দেখে মনে হয় তিনি খুবই দুঃখী একজন মানুষ। বাস্তবে তিনি মোটেই দুঃখী মানুষ না, হাসি খুশি মানুষ। তাঁকে আমি কখনো রাগতে দেখি নি, উঁচু। গলায় কথা বলতে শুনি নি। মা যখন বাবার সঙ্গে রাগারাগি করেন, বাবা খুব আগ্রহ নিয়ে মার কথা শুনেন। তখন তাঁকে দেখে মনে হয় মার প্রতিটি কথায় তিনি মজা পাচ্ছেন। মার রাগ যখন শেষ সীমায় চলে যায় তখন বাবা বলেন, সুরমা তোমার প্রতিটি কথাই কারেক্ট। আমি তোমার সঙ্গে এগ্রি করছি। সেন্ট পারসেন্ট এগ্রি। এখন তুমি আমাকে যা করতে বলবে, আমি করব। পায়ে
ধরতে বললে ধরব। নো প্রবলেম। স্ত্রী যদি স্বামীর পায়ে ধরতে পারে। স্বামীও পারে। এতে কোনো পাপ হয় না। স্বামী স্ত্রীর একে অন্যের পায়ে ধরা জায়েজ আছে।
বাবার এ ধরণের কথায় হঠাৎ মার মধ্যে একটা বিস্ফোরণের মতো হয়। তিনি হাতের কাছে যা পান ছুঁড়ে মারতে শুরু করেন। বাবাকে তখন খুবই অসহায় লাগে। যত অসহায়ই লাগুক এই সময় বাবার আশেপাশে থাকা খুবই বিপজ্জনক বলে আমি কখনো থাকি না। থাকি না বলেই জানি না, ঝড়টা কী ভাবে কাটে। কী ভাবে বাবা মার মধ্যে মিলমিশ হয়। শুধু এক সময় দেখা যায়। বাবা ভেতরের বারান্দায় বেতের মোড়ায় বসে পান খাচ্ছেন। মা আঙুলের ডগায় করে বাবার জন্যে চুন নিয়ে এসেছেন। বাবা মার আঙুল থেকে নিজের আঙুলে চুন নিয়ে আয়েশ করে জিবের ডগায় লাগাচ্ছেন। আঙুল থেকে আঙুলে চুন নেয়া খুবই অলক্ষুণে। এতে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। শুধু স্বামী স্ত্রীর বেলায় সুলক্ষণ। স্বামী-স্ত্রীর বেলাতেই শুধু আঙুল থকে আঙুলে চুন নিলে সুসম্পর্ক হয়।
বাবা বারান্দায় মোড়ায় বসে পান খাচ্ছেন আর মা আঙুলে চুন নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, দেখতে বড় ভালো লাগে।
আচ্ছা এখন আমাদের পরিচয়টা দিয়ে নিই। আমার বাবার নাম আজহার উদ্দিন। তিনি নান্দাইল রোড স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। বয়স পঞ্চাশের ওপর। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো বলে, দাঁতগুলি ধবধবে শাদা দেখায়। মনে হয় দাঁতে লাইট ফিট করা। অন্ধকারে জ্বলে। বাবা যেমন রোগা তেমন লম্বা। বাবার বন্ধুরা তাঁকে আজহার উদ্দিন ডাকে না, ডাকে তালগাছ উদ্দিন। এতে বাবা খুবই মজা পান। কেউ তাঁকে তালগাছ উদ্দিন ডাকলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর করে আরেকটু লম্বা হন। জোকারি করতে বাবার খুব ভালো লাগে।
আমার মার নাম সুরমা। সিলেটের এক নদীর নামে তাঁর নাম। বাবা মাঝে মাঝে আদর করে তাঁকে কুশিয়ারা ডাকেন। কুশিয়ারাও সিলেটের আরেক নদী। কুশিয়ারা নদীটা ছোট হলেও সুরমার চেয়েও নাকি সুন্দর, টলটলা পানি। নদীর তলার বালি পাথর সব দেখা যায়। মা বয়সে বাবার চেয়ে অনেক ছোট। তাঁর বয়স খুব সম্ভব পঁয়ত্রিশের মতো। সব সময় তিনি কোনো-না-কোনো অসুখে ভুগেন। যখন তাঁর কোনো অসুখবিসুখ থাকে না তখন তাঁর আধাকপালী মাথা ব্যথা হয়। এই সময় ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে তাঁকে শুয়ে থাকা লাগে। কোনো রকম শব্দ করাও তখন নিষিদ্ধ। কেউ তখন শব্দ করে নিঃশ্বাসও ফেলতে পারবে না, এমন অবস্থা।
মার আধকপালী অসুখে বোধ হয় কোনো সমস্যা আছে। কারণ এই। অসুখটা যখন হয় তাঁর চেহারা তখন অন্য রকম হয়ে যায়। কী রকম অদ্ভুত করে তিনি সবার দিকে তাকান। মাঝে মাঝে এমনও হয় তিনি কাউকে চিনতে পারেন না। একদিন মার এ রকম মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। আমি না জেনে তাঁর ঘরে ঢুকে পড়েছি। অবাক হয়ে দেখি গরমের মধ্যে তিনি কাঁথা গায়ে দিয়ে বসে আছেন। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন–এই ছেলে এই, তোমার নাম কী? এইখানে কী চাও? যাও বাসায় যাও। দুপুর বেলা কেউ অন্যের বাড়িতে বসে থাকে, তোমার লজ্জা নাই?
আমি মার কথা শুনে অবাক হয়ে বললাম, মা আমাকে চিনতে পারছ না। আমি টগর।
মা আমার দিকে তাকালেন। তাঁর তাকানো দেখেই বুঝলাম তিনি আমাকে মোটেও চিনতে পারেন নি। মা বললেন, টগর তোর নাম? আমার সঙ্গে ফাজলামি? আমি তোর মুরুব্বি না? এই বলেই তিনি চক্ষের নিমিষে বালিশের নিচে রাখা সুপারি কাটার ছরতা আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। ছরতা লেগে আমার মাথা কেটে গেল। এরপর আর কখনো আধকপালী মাথা ব্যথা উঠার সময় আমি মার ঘরে ঢুকি না।
আমার স্কুলের বন্ধুদের অনেকের ধারণা মার মাথা খারাপ। তাঁকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হয়। এটা ঠিক না। মাকে কখনো তালাবন্ধ করে রাখা হয় না। মার যখন মাথা ব্যথা থাকে না তখন তিনি সবার সাথে মজা করেন। সবচে বেশি মজা করেন রঞ্জু ভাইয়ার সঙ্গে। মা রঞ্জু ভাইয়াকে যতটা পছন্দ করেন রঞ্জু ভাইয়া মাকে তারচে তিনগুন বেশি পছন্দ করে। মার মাথা ব্যথা অসুখ হলে–রঞ্জু ভাইয়া স্কুলে যাবে না। মার ঘরের বন্ধ দরজার আশেপাশে। ঘুর ঘুর করবে। ঘরের ভেতর থেকে খুট করে কোনো শব্দ হলেই রঞ্জু ভাইয়া বলবে–মা তোমার কিছু লাগবে? বাইরে থেকে কথা বললেও রঞ্জু ভাইয়াও অসুখের সময় মার ঘরে ঢুকবে না। আমার মতো সেও মার ঘরে ঢুকতে ভয় পায়।
মার অসুখবিসুখ এবং আধকপালী রোগে ঘরের কাজ কর্মের কোনো অসুবিধা হয় না। বাবার দূর সম্পর্কের এক বোন (রহিমা ফুপু) সব কাজ করেন। এই মহিলা আশ্চর্য ধরণের মহিলা। খুবই রূপবতী। তাঁকে দেখলে মনে। হয় তিনি সব সময় সেজেগুজে আছেন। চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো, শাড়িটা সুন্দর করে পরা। তাঁকে কখনো কাজ করতে দেখা যায় না, অথচ ঘরের প্রতিটি কাজ তিনি করেন। তাঁর একটা মাত্র মেয়ে কুসুম। মেয়েকে নিয়ে তিনি আমাদের সংসারে থাকেন কারণ তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। রহিমা খালার মেয়েটা তাঁর মার মতোই সুন্দর। তবে চেহারা কেমন যেন ভোঁতা ভোঁতা। তার পরেও কুসুম আপুকে দেখতে খুবই ভালো লাগে। আমার সব সময় ইচ্ছা করে তার আশেপাশে থাকতে। কুসুম আপু খুবই অহংকারী। সহজ ভাবে সে তাকাতেই পারে না। সব সময় বিরক্ত চোখে তাকায়। আমি কোনো কারণে তার কাছে গেলে সে ভুরু কুচকে বলবে, এই টগর! তুই সব সময় মেয়েদের আশেপাশে ঘুরঘুর করিস কেন? মেয়েদের গায়ের গন্ধ নাকে না গেলে ভাল লাগে না? এখনই এই অবস্থা? ফাজিল কোথাকার। গন্ধ নেবার সময় হোক, তখন গন্ধ নিবি। যা সামনে থেকে।
কুসুম আপু ক্লাস টেনে পড়ে। আগামী বছর সে এস. এস. সি. দেবে। তবে রঞ্জু ভাইয়ের মতো ফেল করবে না। এক চান্সেই পাশ করবে। কুসুম আপু ছাত্রী খুবই ভালো। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে। ক্লাস এইটেও বৃত্তি পেয়েছে।
আমরা থাকি রেল কোয়ার্টারে। ইস্টিশন ঘরের কাছেই লাল ইটের পাকা দালান। কোয়ার্টারটা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। জায়গায় জায়গায় সেই দেওয়াল ভেঙ্গে গেছে এবং সেই সব ভাঙ্গা জায়গায় আপনা আপনি লেবু গাছ গজিয়েছে। প্রকান্ড সব গাছ। খুব ফুল ফোটে, কখনো লেবু হয় না। গাছের মধ্যেও নারী পুরুষ আছে। আমাদের লেবু গাছ গুলোর মধ্যে একটা ছাড়া সবই নাকি পুরুষ। যে নারী গাছটা আছে সেটাতেও লেবু হচ্ছে না। বাবার ধারণা, পুরুষ গাছের সঙ্গে থেকে-থেকে মেয়ে গাছটার মধ্যেও পুরুষালী ভাব চলে আসছে। আমাদের। রেল কোয়ার্টারে প্রতি বর্ষায় ঘরে সাপ ঢোকে। বাস্তু সাপ বলেই কখনো মারা হয় না। তবে বাবা চিন্তিত হয়ে কার্বলিক এসিড কিনে এনে ঘরে ছড়িয়ে দেন। বাবার আবার খুবই সাপের ভয়। রেল কোয়ার্টারে তিনটা মোটে ঘর। একটাতে থাকেন মা-বাবা। একটায় রহিমা ফুপু আর কুসুম আপু। আর একটা হল বৈঠক খানা। সেখানে বড় চৌকি পাতা আছে। এই চৌকিতে থাকি আমরা দুই ভাই। রেল কোয়ার্টারের ভেতরের বারান্দার একটা অংশ বাঁশের দরমা দিয়ে ঢেকে ঘরের মতো করা হয়েছে। প্রায়ই বাবাকে সেখানে থাকতে হয়। কারণ মার আধাকপালী মাথাব্যথা উঠলে তিনি কাউকে সহ্য করতে পারেন না। তখন তিনি একা থাকেন। আমার ধারণা তখন বাবাও মাকে আমাদের মতো ভয় পান।
বারান্দায় বাবার ঘরটা খারাপ না। খুব বাতাস আসে। শুধু বর্ষা বাদলার দিনে সমস্যা হয়, বৃষ্টির পানি ঢোকে। বাবা বালিশ হাতে খুবই লজ্জিত ভঙ্গিতে আমাদের ঘরে ঘুমুতে আসেন। ভাইয়ার মেজাজ যেদিন ভালো থাকে সেদিন বাবা আমাদের সঙ্গে ঘুমুতে পারেন। ভাইয়ার মেজাজ খারাপ থাকলে সে রাগী রাগী গলায় বলে, এতটুকু একটা খাটে তিনজন মানুষ ঘুমাব কীভাবে? আমরা কি বামুন?
বাবা মিনমিনে গলায় বলেন, আমি রোগা মানুষ এক হাত জায়গা হলেই হবে। দড়ির মতো পড়ে থাকব। তোরা বুঝতেও পারবি না।
গরমের মধ্যে চাপাচাপি করে ঘুমাতে পারব না।
গরম কই দেখলি? ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। কাথা-শীত পড়ে গেছে।
কাঁথা-শীত পড়লে তুমি কাঁথা গায়ে দিয়ে থাক। আমার গরম লাগছে।
বাবা আর কথা বাড়ান না। ছাতা হাতে ইস্টিশনঘরে ঘুমাতে যান। ইস্টিশনঘরে সিন্দুকের মতো বড় একটা বাক্স আছে। সেই সিন্দুকের ওপর পাটি পাতা আছে। বাবাকে মাঝে মধ্যেই সেই সিন্দুকের বিছানায় ঘুমুতে যেতে হয়। ইস্টিশন ঘরটা খারাপ না, শুধু ঘর ভর্তি মাকড়শা। সব সময় দেখা যাবে তিন চারটা বড় বড় মাকড়শা পেটে ডিম নিয়ে ঘুরছে। বাবার ধারণা ইস্টিশন ঘরটা মাকড়শাদের মাতৃসদন। গর্ভবতী সব মাকড়শা ইস্টিশন ঘরে সন্তান খালাস করার জন্যে চলে আসে। আমি মাকড়শা ভয় পাই বলে কখনো বাবার সঙ্গে ইস্টিশন ঘরে ঘুমুতে যাই না।
সবার কথা বলতে গিয়ে আমি দেখি নিজের কথাই বলতে ভুলে গেছি। আমার নাম টগর। আমার জন্মের সময় বাবা ছিলেন বারহাট্টা স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। আমাদের রেল কোয়ার্টারে দুটা টগর গাছ ছিল। দুটা গাছেই প্রচুর টগর ফুল ফুটতো। টগর ফুল দেখেই বোধ হয় বাবা আমার নাম রেখেছিলেন টগর। ফুলের নামে ছেলেদের নাম রাখলে তারা মেয়েলি স্বভাবের হয়। সামান্য কিছুতেই পুত পুত করে কাঁদে। কথাটা খুব ঠিক, আমিও কাঁদি। এবার আমি ক্লাস সিক্সে উঠেছি। রেজাল্ট আউটের দিন আমাদের ক্লাস টিচার বদরুল স্যার আমাকে হেডস্যারের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ভেরি ব্রিলিয়ান্ট। অংকে। একশতে একশ পেয়েছে। এক নম্বর কাটা যায় নাই।
হেডস্যার হাই তুলতে তুলতে বললেন, ও।
বদরুল স্যার আমার দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বললেন, হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হেড স্যারকে কদমবুসি করে দোয়া নে। গাবগাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে? দোয়া নিবি না?
আমি কদমবুসি করলাম। হেডস্যার বিরস গলায় বললেন, মন দিয়ে।
লেখাপড়া করবি। Knowledge is power মনে থাকে যেন। Knowledge বানান কর দেখি।
আমি নলেজ বানান করলাম। হেডস্যার বললেন, রাস্তাঘাটে যদি কোনো দিন দেখি হাতে বিড়ি সিগারেট তাহলে কিন্তু টান দিয়ে কান ছিড়ে ফেলব। ছেড়া কান পার্সেল করে মক্কা শরীফে পাঠিয়ে দেব। যা এখন।
বদরুল স্যার আমাকে নিয়ে বের হয়ে এলেন। তিনি অবিশ্যি আমাকে ছেড়ে দিলেন না। নিয়ে গেলেন এসিসটেন্ট হেড স্যারের ঘরে। ঠিক আগের মতো গলায় বললেন, ভেরি ব্রিলিয়ান্ট অংকে একশতে একশ পেয়েছে। এক নম্বরও কাটা যায় নাই। চৌবাচ্চার অংকটা কেউ রাইট করতে পারে নাই। সে রাইট করেছে।
এসিসটেন্ট হ্যাডস্যার হাই তুলতে তুলতে বললেন, কার ছেলে?
স্টেশন মাস্টার সাহেবের ছেলে। যে সেকেন্ড হয়েছে তার সাথে এই ছেলের একশ আঠারো নম্বরের ডিফারেন্স।
এসিসটেন্ট হেড মাস্টার সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, মুসলমানের ছেলে–জাত সাপ হয়ে জন্মায়। কিছুদিন পরেই হয়ে যায় ঢোঁরা সাপ। বিষের কারবার নাই। শুধুই ডােরাকাটা। শুধুই ফোঁসফোঁস। দেখবেন এক চান্সে এস এস সি পাস করবে না। অংকে একশ পেয়েছে বললেন না? গোল্লা খাবে সেই অংকে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে লিখে রাখেন। অনেক তো দেখলাম।
বদরুল স্যার এসিসটেন্ট হেডস্যারের কথায় মন খারাপ করলেন। তবে দমলেন না। আমাকে নিয়ে গেলেন টিচার্স কমন রুমে। তখন কী জন্যে জানি
আমার চোখে পানি আসি পানি আসি ভাব হল। ফুলের নাম রাখার এই সমস্যা, কারণ ছাড়াই চোখে পানি আসবে। বদরুল স্যার থমথমে গলায় বললেন, ছাগলের মতো কাঁদছিস কেন? খবর্দার কাঁদবি না। বেটাছেলেদের জীবনে একবার মাত্র কাঁদার পারমিশন আছে। Only once. সেই একবারটা একেক জনের জন্যে একেক রকম। কান্না বন্ধ কর। চোখ মুছ।
তিনি পকেট থেকে একটা এক টাকার নোট বের করে বললেন, যা বাদাম কিনে খা। আর শোন বাড়িতে গিয়ে বাবা মা সবাইকে কদমবুসি করে দোয়া নিবি। মুরুব্বিদের দোয়া হল লাইফ জ্যাকেটের মতো। লাইফ জ্যাকেট ছাড়া সমুদ্র পার হওয়া যায় না। দুনিয়াটা হল সমুদ্র। আমি তোর অংক খাতা দেখে খুবই খুশি হয়েছি। আজকে আছরের নামাজের সময় তোর জন্যে খাস দিলে দোয়া করবো। আছর ওয়াক্তের দোয়া কোনোসময় বিফল হয় না। কারন আছর ওয়াক্তে ইউনুস নবী মাছের পেট থেকে নাজাত পেয়েছিলেন এবং আছর ওয়াক্তেই কেয়ামত হবে।
বদরুল স্যারকে আমি খুব পছন্দ করি। শুধু আমি একা না, স্কুলের সব। ছাত্র পছন্দ করে। অথচ তিনিই এই স্কুলের সবচে রাগী স্যার। তিনি অনেক ধরনের ধমক দিতে পারেন। তাঁর সবচে কঠিন ধমকের নাম–পিসাব ধমক। এই ধমক যে খায় সে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে। আবার এমনও ইতিহাস আছে যাকে পিসাব ধমক দিয়েছেন তার কিছু হয় নি কিন্তু তার পাশে বসা ছাত্রের কারবার হয়ে গেছে।
বদরুল স্যারেরও আমার মার মতো সমস্যা আছে। স্কুলের বাইরে কোনো ছাত্রকে তিনি চিনতে পারেন না। সালাম দিলে মাথা ঝুকিয়ে সালাম নেন মুখের দিকে তাকান। বিড়বিড় করেন কিন্তু চিনতে পারেন না। একবার আমি রাস্তায় স্যারকে সালাম দিলাম। স্যার সঙ্গে সঙ্গে বললেন–ওয়ালাইকুম সালাম। জি আমি ভালো আছি।
 
Back
Top