- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 407
- Messages
- 5,564
- Reaction score
- 2,005
- Points
- 3,913
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
হাজার টাকার ঋণ
(অন্তর্জাল হতে সংগৃহীত)
(অন্তর্জাল হতে সংগৃহীত)
দশম শ্রেণীতে পড়তাম। আম্মা ১০০০ টা টাকা দিলেন। সাথে একটা বাজারের লিস্ট। বাজার করতে গিয়ে পকেটে হাত দিয়ে দেখি টাকা গায়েব। ছোট পথ বিধায় তন্ন তন্ন করে টাকা খুঁজতে লাগলাম। মধ্যবিত্ত সংসার। ১০০০ টাকা বলতে আমাদের কাছে পাহাড়সম। পাবো না জেনেও পাগলের মত টাকা খুঁজতেছি। দেরি দেখে ঘর থেকে ছোটভাই পিটুকে আমার খোঁজে পাঠিয়েছেন আম্মা। ঘরে নাকি। রান্না চড়ানো হয়নি এখনো। আমি প্রচন্ড টেনশনে মুখগোমড়া করে বসে আছি। পিটু বাড়ি চল বাড়ি চল বলে ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলো। ঠাস করে গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। পিটু হততম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি হু হু করে অবুঝের মত কান্না করতে লাগলাম। পিটুর ফর্সা গালে দাগ বসে আছে।
সে কি বুঝলো ঠিক জানি না। বাড়ি ফিরে গেলো। আমি ভয়ে অস্থির।আজকে পিঠের ছাল বোধয় আর থাকবে না। কি জানি পিটু গিয়ে মাকে কি বলে। পালিয়ে যাবো কিনা তাও বুঝতে পারছি না। আমি কি ভেবে স্তব্ধ হয়ে বসে কান্না করতে লাগলাম।
একটু পর দেখি পিটু হাতে মাটির একটা ব্যাংক নিয়ে আমার কাছেবএগিয়ে আসছে। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। পিটু এসে বললো ভাইয়া ব্যাংকটা ভেঙ্গে ফেলো। জানিনা কতটাকা হয়েছে। একবছর ধরে জমিয়েছি। বাবা প্রতিদিন দুটাকা দেয়। মাও দিতো। ভাইয়া তুমিও অনেক টাকা দিয়েছো।আমার কাছে হিসেব আছে। তুমি এ পর্যন্ত একশো পঞ্চান্ন টাকা দিয়েছো। কিছু না ভেবে পিটুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
বোধয় অনেক্ষণ ধরে কেঁদেছি। পিটু বললো ভাইয়া শুধু কি কান্না করতে থাকবে নাকি ব্যাংকটা ভেঙ্গে টাকা বের করবে। মা অপেক্ষা করছে
তো।
দুভাই মিলে রাস্তার উপর ব্যাংক ভেঙ্গে টাকা গুনছি। আমার মনে হলো এই দৃশ্যটা পৃথিবীর সবচাইতে সেরা একটি দৃশ্য। প্রায় বারোশত টাকা জমিয়েছে পিটু। অনেকদিনের জমানো টাকা খরচ
করতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু আমার উপায় নেই। বাজার বাবত নয়শো টাকা খরচ করেছি। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে পিটুর জন্যে নতুন একটা ব্যাংক কিনলাম এবং সেখানে বাকী টাকাগুলো ফেলে দিলাম। তার কাছে ওয়াদা করলাম এবার থেকে আমিও টাকা জমিয়ে তার দেয়া ঋণ
শোধ করবো। সে তাকিয়ে হাসলো। পিটু আর আমি দুভাই দুটো জিলাপী কিনে বাজার সহ বাসায় রওয়ানা হয়েছি।
সেদিন দেরি করার জন্যে মার হাতে অনেক মার খেয়েছি। কিন্তু পিটুর ভালোবাসার কাছে সেদিন মারগুলো অতি তুচ্ছ মনে হল।
পিটুর সপ্তম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। সে পাশ করতে পারেনি। আমি বেশ চিন্তিত। বাবা নিশ্চই পিটুকে আস্ত রাখবে না। ঘরে গিয়ে বাবাকে কিছু জানাই নি। মা বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেন। আমি ভয়ে ভয়ে জবাব দিলাম পিটু ফেল করেছে। মা বেশ বিব্রত বোধ করলেন। এটা বাবাবে বললে ছোট্ট পিটুকে আস্ত রাখবেন না। বাবা বেশ রাগী কিনা! কিন্তু সে রাতে বাবা কেমন করে জানি জেনে গেলেন ব্যাপারটা। স্কুলে ফোন করেছিলেন বোধয়। তারপর ছোট্ট
পিটুকে এমন মার মারলেন দেখে আমি আর মা কাঁদতে লাগলাম।
পিটুকে সেদিন বাঁচাতে পারিনি ভয়ে। রাতে মা জুবুথুবু হয়ে কাঁদছেন। বাবা অনেক বকেছেন মা কে। আমি জানি পিটু কোথায় লুকিয়ে থাকবে। আমি চুপি চুপি রান্নাঘরে গিয়ে প্লেটে ভাত বেড়ে পুরোনো আসবাব রাখার ঘরের ছাদে উঠে গেলাম। হাতে ভাতের প্লেট পকেটে মোমবাতি
আর দেয়াশলাই। পিটুর সারাগায়ে মারের দাগ। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। সাথে আমি কাঁদছি।মোমবাতি জ্বালিয়ে পিটুকে ভাত খাইয়ে দিলাম। পিটু বললো ভাইয়া আমাকে কি কোনো ক্রমেই অষ্টম শ্রেণীতে তুলতে পারবে না? পরেরবার থেকে খুব ভালো করে পড়বো। আর দুষ্টুমি করবো না। সত্যি বলছি তোমায়।
কিচ্ছু ভাবিনি সেদিন। পরেরদিন সোজা গিয়ে মাস্টার চাচার পা চেপে ধরেছি। কঠিন শপথ করে বলেছি আমি খুব করে পড়াবো চাচা। আপনি না বলেন আমি ভালো ছাত্র। মেধাবী ছাত্র।আমার ভবিষ্যৎ
নাকি উজ্জ্বল। চাচা আপনার সেই মেধাবী ছাত্রই আপনার পা ছুয়ে বলছে আমার ছোট্ট পিটু পারবে। দয়া করে পিটুকে পাশ করিয়ে দিন।
মাস্টার চাচার মন গললো। বোর্ড পরীক্ষা ছিলো না বিধায় হেডস্যারকে খুব রিকোয়েস্ট করে পিটুকে অষ্টম শ্রেণীতে তুলে দিলো।
ঠিকই পরের বছর অবিশ্বাস্য ভাবে পিটু চারটা সাবজেক্ট লেটার মার্ক নিয়ে বেশ ভালোভাবে পাশ করলো। আমার কষ্ট পিটু সার্থক করলো। পুরো স্কুলে সবচাইতে বেশি নম্বর পেলো। আমার খুশি দেখে কে। খুশিতে আমি পিটুকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কাঁদলাম। বেশ মন ভরেই কাঁদলাম। ঠিক যেদিন হাজার টাকা হারিয়ে ফেলেছিলাম সেদিনের মত। বাবা কাঁদলেন। কাঁদলেন মা আর মাস্টার চাচা।
অর্থকষ্টের মধ্যেও খুশিতে বাবা ঘোষণা করলেন আমরা বেড়াতে যাবো। নীলগিরির নীল আকাশে সবাই হারিয়ে যাবো। ২৭ ডিসেম্বর গেলাম পুরো একটা দিন অনেক মজা করলাম। রাতে ফেরার পথে ঘন কুয়াশার কারণে আমাদের ড্রাইভার দিক হারিয়ে ফেললো। গাড়ি উঁচুনিচু রাস্তার পাশের খাদে পড়ে গেলো।
ঠিক কতদিন পর জানি না। চোখ খুলে দেখলাম বাবা-মার চোখ ভীষণ ফোলা। তারা আমাকে জাগতে দেখে হু হু করে
কেদে উঠলো। মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলাম। মনের অজান্তে অস্ফুট স্বরে পিটু পিটু করতে লাগলাম। চোখের কোণায় অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। জানি না কেনো। হ্যাঁ সেদিন আমি জাগলেও পিটু আর জাগেনি। দুর্ঘটনার সাথে সাথেই আমার ছোট্ট পিটু আর ড্রাইভার মারা যায়। মা-বাবাও কম বেশি
ব্যাথা পান। আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আর পিটুকে সেদিনই
দাফন করা হয়।
সুস্থ হওয়ার পরে পিটুর কবরের পাশে দাড়িয়ে চিৎকার করে বললাম পিটু ওঠ আমার ভাই। তোকে আমি নবম শ্রেণীতে ভর্তি করবো। তুই হবি আমার স্কুলের ছাত্র হয়ে পাশ করা প্রথম ডাক্তার। তুই আমার কাছে ওয়াদা করেছিলি পিটু ভালো করে পড়বি। তোকে উঠতে হবে পিটু। তোর হাজার টাকার ঋণ যে শোধ করা হলোনা!