Collected একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু - আসিফ রহমান জয়

dukhopakhidukhopakhi is verified member.

Special Member
Registered
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
407
Messages
5,564
Reaction score
2,005
Points
3,913
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
*****একটি স্বপ্নের অপমৃত্যু*****

মূল লেখকঃ আসিফ রহমান জয়





সাততলা বিল্ডিঙ্গের ছাদের এই কর্ণারটা সিয়ামের খুব পছন্দ। প্রায়ই বিকালবেলা, সূর্য্য ডোবার ঠিক আগে তাকে একা একা এখানে চা খেতে দেখা যায়। সে নিজেই ফ্লাস্কে করে চা বানিয়ে নিয়ে আসে। সারাদিন পড়াশোনার করার ফাঁকে বিকেলবেলা একটু রেস্ট নেয়া হয়।

আজ ভোর বেলাতেও তাকে চায়ের কাপ হাতে দেখা গেলো। আজ অবশ্য তার প্লান অন্যরকম। ঘড়িতে এখন ৫টা বেজে ৫০ মিনিট। ঠিক সকাল ৬ টার সময় সে এই ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বে।

আকাশটা আজ বেশ পরিস্কার। গত রাতে জোর বৃষ্টির পর আজ সকাল থেকেই স্নিগ্ধ, মনোরম বাতাস বইছে। বাতাসের গতি কখনো ধীরে, কখনো জোরে।

সিয়াম বিল্ডিঙ্গের নীচে নীল পানির পাম্পের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে প্রায়ই খেলার ছলে ছাদ থেকে নীচে পানির পাম্প লক্ষ্য করে থুতুর দলা ফেলে। কখনো হয়তো ছোট ছোট ইটের টুকরো কুড়িয়ে ওপর থেকে পাম্পের পাইপের ওপরে ফেলে, নিশানা প্রাকটিস করে।

নীচের রাস্তায়, পাম্পের পাশের মসজিদ থেকে হাতে গোনা কিছু মুসুল্লি বের হয়ে সামনের চায়ের দোকানে ভিড় জমিয়েছে। সিটি করপোরেশনের ঝাড়ুদাররা কেউবা রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছে, কেউবা এককোনে বিড়ি ধরিয়ে টুকটাক আড্ডা দিচ্ছে। মহল্লার পাহারাদাররা তাদের নাইট শিফট শেষ করে লাইন ধরে মোড়ের বড় রাস্তার দিকে যাচ্ছে।

কোমর সমান উঁচু ছাঁদের পাঁচিল। সিয়াম সাধারনতঃ পাঁচিলের ওপর হালকা ভাবে হেলান দিয়ে বসে থাকে। তারপর চা খেতে খেতে সামনের বিল্ডিঙ্গের রুপাদের তিনতলা বাসার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই সময় যদি রুপা বারান্দায় থাকে, তাহলে দুজনে ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলে।

আজ আর সে রুপাদের বাসার দিকে তাকালো না। সে ধীরে ধীরে রেলিঙ্গের ওপর দুই পা তুলে উবু হয়ে বসলো। নীচের দিকে তাকাতেই অজানা ভয়ে পা কেমন যেনো থরথরিয়ে কেঁপে উঠলো। বাতাসের বেগ ক্রমশই বাড়ছে।

সিয়ামের চা খাওয়া শেষ হয়েছে। সে ধীরে ধীরে হাতের চায়ের মগটা পানির ট্যাঙ্কের দিকে তাক করে ছেড়ে দিলো। মগটা পড়ছে তো পড়ছেই...অনন্তকাল ধরে পড়ছে...আজ কেন যেনো ঠিক ট্যাঙ্কের পাইপের ওপর পড়লো। পড়েই ঠাস করে একটা আওয়াজ তুলে গুড়িয়ে গেলো।

সামনের কোনাকুনি বিল্ডিঙ্গের তিন তলার রুপা নামের লম্বার চুলের মেয়েটার এই সময় ঘুমানোর কথা। সে প্রতিদিন একটু দেরী করেই ঘুম থেকে ওঠে। আজ কীভাবে যেনো সকাল-সকাল ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো। টেনশন! সিয়ামের আজ মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেবার কথা। এবার চান্স পাবে কিনা কে জানে? পরীক্ষা অবশ্য বেশ ভালো হয়েছিলো। কিন্তু এবারই শেষ সুযোগ। বাবা-মার সাথে তার কথা হয়ে আছে। সিয়াম মেডিকেলে চান্স পেলে আর কোনো অসুবিধা হবে না।

বিক্ষিপ্ত চিন্তিত মন নিয়ে সে একা একা বারান্দায় বসে ছিলো। মগ ভাঙ্গার শব্দ শুনে চমকে উঠে সিয়ামকে ছাদের কোনায় উবু হয়ে বসা অবস্থায় দেখলো। কি ব্যাপার! সিয়াম তো সকালে ছাদে আসে না। আর ও রেলিঙ্গের ওপর দুই পা তুলে উবু হয়ে কেনো বসে আছে? উপর থেকে কি কিছু ফেললো? এতো সকালে রুপার বাসার সবাই ঘুমাচ্ছে, আওয়াজ করে ডাকা কি ঠিক হবে? রুপা হাত নেড়ে চাপা গলায় ডাকতে লাগলো-
-এই যে... সিয়াম ভাই... এই যে...সিয়া---ম...

মসজিদের মোয়াজ্জিন আকরাম মোল্লা চা খেতে খেতে তার সাথের মুসল্লিদের আঙ্গুল তুলে বয়ান করছিলেন -বুঝলেন তো...কাল কেয়ামতে সবার মাথার এক হাতের ওপরে সূর্য্য নেমে আসবে... তখন...
মগ ভাংগার আওয়াজে তিনি চমকে উঠে তাকালেন। তার আঙ্গুল ওপর দিকেই তোলা থাকলো। তিনি চোখ কুঁচকে ছাদের দিকে তাকালেন
-আরেহ... জসীম সাহেবের ছেলে সিয়াম না? এই ছেলে ছাদের রেলিং এর উপর উঠছে কেন? পড়ে যাবে তো!... এই সিয়াম...সিয়াম...আরে এই ছেলে...
তার সাথের মুসুল্লি, চায়ের দোকানদার সবাই একসাথে সিয়ামের নাম ধরে ডাকতে লাগলো।

এলাকার কমিশনার এনায়েত খান সাথে বডিগার্ড আর এলসেশিয়ান কুকুর নিয়ে মর্নিং ওয়াকে বের হয়েছেন। সবার চেঁচামেচি শুনে উনি এগিয়ে এসে সিয়ামকে একইভাবে উবু হয়ে ছাঁদের পাঁচিলের ওপর বিপজ্জনকভাবে বসে থাকতে দেখলেন।
-আরে এই ছেলে কে? এভাবে বসে আছে কেন? পড়ে যাবে তো?
-ভাই, জসীম সাহেবের ছেলে সিয়াম।
-এই সিয়াম... এই ছেলে... এই...
এনায়েত খানের ডাকাডাকি শুনে তার সাথের কুকুরটাও ঘেউ ঘেউ করা শুরু করে দিলো।

পাশের বিল্ডিং এর কেয়ারটেকার নওশাদ, তিনতলার কাজের বুয়া রেশমাকে ছাদের ওপর হাত টেনে ধরলো। রেশমা হাত ঝটকা মেরে বলে
-ছিঃ আফনে দিনে-দুপুরে আমার হাত টান দেন কুন সাহসে? কেউ যদি দেইক্কালায়?
নওশাদ হাসে-
-আরে ধুর, তুমি তো আমারে জবাব দিলা না। আর এইহানে আমগো দেখবো কেডা? আসো...কাছে আসো?
-মাথা খারাফ হইসে নাকি আফনের? ওই দেহেন.. হেই বিল্ডিঙ্গের ছাদে উইটা কেডা?
নওশাদ ঘুরে সিয়ামকে উবু হয়ে পাঁচিলের ওপর বসে থাকতে দেখে।
-আরে... এই সিয়াম ভাই... এই আফনে পাঁচিলে উপরে উইঠা কি করেন?...সিয়াম ভাই... এই সিয়াম ভাই...

এতো চিৎকার-চেঁচামেচি, কোনো কিছুই সিয়ামের কানে গেলো না। তার চোখের সামনে একে একে ভেসে উঠতে লাগলো তার বাবার কথাগুলো-
-আমি একটুর জন্য চান্স পাইনি। আমার অনেক ইচ্ছা ছিলো ডাক্তার হবার। আমি পারিনি, তুই পারবি। এই একটা জিনিসই তোর কাছে চাই। পারবি না বাবা?
মা প্রতিটা পরীক্ষার রেজাল্ট শুনেই দুই হাত তুলে বলতেন-
-আলহামদুলিল্লাহ। আমি জানতাম তুই অনেক ভালো রেজাল্ট করবি। আল্লাহ তোকে অনেক বড় করবেন। তুই ঠিক ডাক্তারীতে চান্স পাবি।
রুপার কথা-
-বাবা-মার কোনো আপত্তিই নেই। শুধু তুমি মেডিকেলে চান্স পাও। ডাক্তার জামাই তাদের খুব পছন্দ।

গতকাল রাতে মেডিকেল পরীক্ষার রেজাল্ট ওয়েবসাইটে পাবলিশড হয়েছে। সেখানে সিয়ামের রোলনাম্বার নেই। এটাই ওর শেষ সুযোগ ছিলো।

সেই ছোটবেলা থেকে কতো পরিশ্রম! ভালো স্কুলে ভর্তি হওয়া, স্কুলে ভালো রেজাল্ট করা, এসএসসি, এইচএসসি, কতো টিউশনি, কতো রাত জাগা, কতো টেনশন!

সে আর কোনোদিন ডাক্তার হতে পারবে না। ওর বাবার এতো টাকা নেই যে, প্রাইভেট মেডিকেলে পড়াতে পারবে। সে তো পরীক্ষা খারাপ দেয় নি।
কিন্তু আগের রাতে কারা নাকি প্রশ্নপত্র আউট করেছিলো... ওরা... ওরা... হয়তো চান্স পেয়েছে। ওরাও কি ওর মতো এতো পরিশ্রম করেছিলো?

ছোটোবেলা থেকেই কেন ওর ওপর এতো চাপ! এতো প্রেশার! ভালো ছাত্র হওয়াটা কি অপরাধ! ভালো ছাত্র হলেই কি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে? ভালো ছাত্র হলেই কি বাবা-মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে হবে। কি জানি হয়তো তাই!

সিয়ামের ফোন বাজছে। রুপা পাগলের মতো ওকে বার বার ফোন করছে।
দৌড় লাগিয়েছে চায়ের দোকানদার, এনায়েত সাহেব, মোয়াজ্জিন সাহেব, মসজিদের মুসল্লিরা।
এই ছেলে কি বিপদ ঘটাবে নাকি!
হুইসেল বাজাতে বাজাতে ছুটে আসছে গার্ড! এই বিল্ডিঙ্গের দাড়োয়ান কোথায়! গেট খোলো!

সিয়াম আকাশের দিকে তাকালো। মাথার ওপরে দু’টো পাখি ডানা মেলে উড়ছে। আহা... ওদের কি শান্তি!
ঠান্ডা বাতাস বইছে। খুব শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে, ও যেন শীতল কোনো পুকুরে গলা অব্দি ডুবিয়ে বসে আছে।

ঘড়িতে এখন ৬ টা বেজে ১ মিনিট। সিয়ামের এখন কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না। নিজেকে এখন মুক্ত মনে হচ্ছে। মুক্ত বিহংগের মতো স্বাধীন! সিয়াম পাখির মতো দু’দিকে হাত মেললো।

ভারী কি একটা আওয়াজে জসীম সাহেবের ঘুমটা চটে গেলো। বাইরে মানুষজনের হৈ-চৈ শোনা যাচ্ছে। জসীম সাহেব বিরক্ত হলেন। তার ঘুম পুরোপুরি ভাঙ্গেনি। ঘুমের ঘোরেই তিনি টের পেলেন যে, তিনি খুব সুন্দর স্বপ্ন একটা দেখছেন। চোখ না খুলেই তিনি এসির রিমোট হাতড়ে টেম্পারেচার একটু কমিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুলেন। স্বপ্নটা যেনো ভেঙ্গে না যায়, এজন্য তিনি বালিশে মাথাটা আরেকটু গুজে দিলেন।

জসীম সাহেবের ঘুম গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগলো!

সেদিনের সবগুলো পত্রিকায় মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল ফলাও করে ছাপা হলো। তার পাশেই ছোট করে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাসের ঘটনায় গঠিত দুই মাস আগের তিন-সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটির তদন্তের অগ্রগতির খবরটাও ছাপা হলো-
-“তদন্ত এখনো চলমান...খুব শীঘ্রই রিপোর্ট যথাযথ কতৃপক্ষের কাছে প্রকাশ করা হবে।”
 
Back
Top