- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 409
- Messages
- 5,712
- Reaction score
- 2,175
- Points
- 3,913
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
একটি মায়াবী সকাল
মূল লেখকঃ রুচিরা সুলতানা
মূল লেখকঃ রুচিরা সুলতানা
স্যার, আম্মা জিজ্ঞেস করছে...আপনি দুধ চা খাবেন নাকি রং চা?
আমি এই প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।মাসল মেমোরি থেকে বললাম,
__আমি রং চা খাই না।
বলেই মনে হলো, কাজটা ঠিক করলাম না। গুঁড়াদুধের যা দাম!
মারুফদের অবস্থা সেরকম ভালো নয়। দীপু ভাই সেই কথা আগেই বলেছেন।
এই টিউশনিটা দীপু ভাই ঠিক করে দিয়েছেন। উনি আমার ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাই। মারুফকে আগে উনিই পড়াতেন।
দীপু ভাই মাস্টার্স ফাইনাল দিয়ে দিয়েছেন। এখন ক্যাম্পাস ছেড়ে শহরে গিয়ে উঠেছেন। চাকরি বাকরি পেতে হলে শহরে না থাকলে হয়না। উনি যাবার সময় টিউশনিটা আমাকে দিয়ে গেছেন। না হলে ক্যাম্পাসে টিউশনি জোটানো এতো সোজা না।
কোনো এক অজানা কারণে দীপু ভাই আমাকে ভীষণ স্নেহ করেন। উনি জানেন, একটা টিউশনি আমার খুব দরকার।
অবশ্য আমি আরেকটা টিউশনি করাই।ওটা শহরে। নিজের খরচ, পুরোটাই নিজেকে ম্যানেজ করতে হচ্ছে বলে আরো একটা টিউশনি খুব দরকার ছিলো আমার।
পরশুদিন রাতে কাটাপাহাড়ে হাঁটছিলাম,হঠাৎ দীপুভাইয়ের সাথে দেখা। বললো,
__ রবিন, ব্রো...আমি তো শহরে উইঠা গেসি।আমার ক্যাম্পাসের টিউশনিটা করবা নাকি তুমি? টাকা কিন্তু অতো বেশি না।ক্যাম্পাসের টিউশনিতে টাকা একটু কমই আসে, বুঝলা? স্যারদের পোলামাইয়া পড়াইলে অবশ্য ভালোই পাওয়া যায় কিন্তু ইউনিভার্সিটির অন্যান্য স্টাফ যারা আছে, তাগো বেশি টাকা দিয়া পড়ানোর সামর্থ্য নাই।মারুফ ছেলেটা খুবই ভালো। ওরে পড়াইতে কোনো কষ্ট নাই।যা বলবা, মুখস্থ কইরা ফেলবে।যা বুঝাইবা মন দিয়া শুনবে।ওর আব্বা এইখানে ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টে কি একটা পোস্টে জানি চাকরি করে। একদম এক তারিখে টাকা দিয়া দেয়। টিউশনির টাকাটা সময়মতো পাইলে ভাল্লাগে, কি কও?
আমি রাজি হতেই বললো,
ছেলেটার সামনের মাসে পরীক্ষা। কালকেই শুরু করো।
গতকাল দীপু ভাই এসে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেছে। আজকে সকাল থেকে পড়ানো শুরু করেছি। ক্লাসের আগে দুই ঘণ্টা পড়িয়ে দিলে সকালটা কাজে লাগবে আমার।
এমনিতে সকালে উঠা হয়না।উঠলেও পড়ালেখা হয়না। এদিকে শহরের টিউশনিগুলো আবার রাত ছাড়া পাওয়া যায় না।
চিটাগাং ইউনিভার্সিটি থেকে শহরে আসা যাওয়া করতে সময় লাগে অনেক।
রাতে দুইটা টিউশনি করলে, আসা যাওয়া মিলিয়ে যতটা সময় যাবে... নিজের লেখাপড়া গোল্লায় যাবে। এই টিউশনিটা পেয়ে সবদিক থেকেই উপকার হয়েছে।
তাছাড়া আমানত হল থেকে মারুফদের বাসায় হেঁটে চলে আসা যায়। ভাড়া বাবদ কোনো খরচ নেই।
টাকা পয়সা নিয়ে এতো চিন্তা কবে যে দূর হবে!কবে যে টাকা আর ব্যাংকের কার্ড দিয়ে মানিব্যাগ ভর্তি থাকবে... ভাবলে, দুনিয়াটা কেমন পানসে লাগে।
তাও ভালো, আপাতত সমস্যা মিটলো।
মনের আনন্দে সকাল সকাল উঠেই পড়াতে চলে এসেছি।আজকেই প্রথম এসেছি , তাই চায়ের কথাটা জিগ্যেস করলো।
আমিও বলে দিলাম রং চা খাই না।কি জানি দুধ চা দিতে উনাদের কষ্ট হয়ে যাবে কিনা।
এখন আবার বলবো কিনা যে রং চা দিলে সমস্যা নেই, বুঝতে পারছি না।
মনে মনে ঠিক করলাম, দীপু ভাইকে ফোন করে জেনে নিবো উনি কোন চা খেতেন।
মারুফদের বাসাটা ছোট। স্টাফদের কোয়ার্টার গুলো ছোট বলে অনেকেই নিজের খরচে টিন দিয়ে দু একটা বাড়তি রুম বানিয়ে নেয়। সরকারি জায়গা তো, সমস্যা হয় না।মারুফের আব্বাও তাই করেছে। তবু যথেষ্ট খালি জায়গা সামনে। অনেক রকমের ফুল-ফল, সবজি গাছ লাগানো। খুব ঠান্ডা ঠান্ডা একটা পরিবেশ ।
মারুফকে অংক বুঝিয়ে দিয়েছি। ছেলেটার মাথা সতিই
ভালো।নিজে নিজে অনেকগুলো অংক করে যাচ্ছে। পাশের ঘরে থাকা বাকি মানুষজনের কথাবার্তা আমার কানে আসছে। ওদের এখন সকালের নাস্তা খাওয়ার সময়।
ভিতর থেকে রুটি আলুভাজির গন্ধ ভেসে আসছে। সকাল সকাল রুটি স্যাঁকার গন্ধের সাথে আলুভাজির গন্ধ মিলে যা একটা কম্বো হয়...বাকি সব খাবার ফেইল।বাড়ি মৌ মৌ করে। ভরা পেটেও খিদে লাগিয়ে দেয় এই সুঘ্রাণ।
আমার মতো যারা বাড়ি থেকে দূরে থাকে, এই সুঘ্রাণে তাদের মন কেমন কেমন করে উঠে... মায়ের জন্য... নিজের ভাই-বোনের জন্য... বাড়ির জন্য... ছোটবেলার জন্য।
পাশের ঘরে নাস্তা খেতে খেতে অপ্রয়োজনীয় অনেক কথা হচ্ছে, হাসাহাসি,রুটি ভাজির ভাগাভাগি, ডিম ভাজি নিয়ে কাড়াকাড়ি হচ্ছে।
আমার মন কেমন করা অনুভূতিটা আরো তীব্র হচ্ছে।
আম্মা মারা গেছেন পাঁচ বছর হয়ে যাচ্ছে। আমার এস এস সি পরীক্ষার তখন দুই মাস মাত্র বাকি। আমাদের তিন ভাই আর আব্বা এই চারজন পুরুষ, তখন থেকে সকালে পাউরুটি কলা, ডিম সিদ্ধ অথবা ভাত খাই ।
আম্মা থাকতে সকালে রুটি হতো। পাতলা রুটি না হলে আব্বা খেতে চাইতেন না। আম্মা কি যে পাতলা তুলতুলে রুটি বানাতে জানতেন!সাথে মিহি কুচি করে কাটা আলুভাজি। একটা ডিম ভাজি করে আমরা তিন ভাইকে সমানভাগ করে দিতেন আম্মা। একটু কম বেশি হলেই যুদ্ধ বেঁধে যেতো।
মারুফের ভাই-বোন আর আব্বা-আম্মার গল্প আর খুনসুটি শুনতে শুনতে বুকটা ভারী হয়ে এসেছে আমার। কতদিন যে পাতলা রুটি আর আলু ভাজি খাই নি। আম্মার সাথে সাথে সেইসবও মাটি চাপা পড়ে গেছে ।
__আসসালামুয়ালাইকুম স্যার। কেমন আছেন? আমি মারুফের আব্বা। দীপু স্যারের সাথে গতকাল আসছিলেন শুনলাম, আমার সাথে তো দেখা হয় নাই। ছাত্রের অবস্থা কেমন বুঝতেসেন, স্যার? একটু দেইখেন ছেলেটারে। একটু বুঝাইয়েন ওরে।যেই যুগ আসছে, লেখাপড়া না করলে আমাদের তো আর কোনো দিকে যাওয়ার রাস্তা নাই।
__জি , অবশ্যই।মারুফ তো খুব ভালো ছেলে মাশাআল্লাহ।
মারুফের আব্বাকে আমার খুব ভালো লাগলো। আমার সব খোঁজ খবর নিলেন।তারপর ভিতরে চলে গেলেন।
দশ মিনিট পর একটা প্লেটে রুটি ,আলুভাজি আর অর্ধেক মতো ডিম ভাজি নিয়ে ঢুকলেন। রুটিগুলো খুব পাতলা, আলু খুব মিহি করে কাটা।ডিমটাও ছোটবলার মতো ভাগ করা। কোনো আভিজাত্য নেই, চাকচিক্য নেই... খাঁটি মমতায় ভরপুর একটা প্লেট।
__স্যার, আমরা গরীব মানুষ। বেশি কিছু আয়োজন করার সামর্থ্য নাই। আপনি খাইলে খুব খুশি হবো স্যার। আমিও খুব অল্প বয়সে আম্মারে হারাইসি। কষ্ট করসি জীবনে। অনেক কষ্ট করসি।
আমি খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।কি বলবো বুঝতে পারছি না। এইরকম ভালোবাসার দেখা তো আজকাল আর পাই না।
উনার মতো অল্প সামর্থ্যবান একজন মানুষ আমার জন্য যে খাবারটা সামনে এনে দিলো, তার দাম ঠিক কতো সেটাতো উনাকে বোঝাতেও পারবো না।
মারুফের আম্মার বানানো পাতলা রুটি আর মিহি কুচির আলুভাজি মুখে পুরে, আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।
প্রথমদিন পড়াতে এসে স্যার কাঁদছে... ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত।মারুফ অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
মারুফের এই অবাক চোখ দেখতে আমার ভালো লাগছে। এইরকম ভালো লাগা জীবনে খুব কমই আসে।
সমাপ্ত