Collected বিপদ - হুমায়ূন আহমেদ

dukhopakhidukhopakhi is verified member.

Special Member
Registered
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
407
Messages
5,564
Reaction score
2,011
Points
3,913
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
বিপদ

মূল লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ
পর্ব - ১
আফসারউদ্দিন খুব গম্ভীর ধরনের একটা দেশি জাহাজ কোম্পানির বড় অফিসার। বড় অফিসাররা এমনিতেই গাড়ীর হয়ে থাকেন। ইচ্ছে না-করলেও তাঁদের গাষ্ঠীর থাকতে হয়। আফসার সাহেবের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে-রকম নয়। তিনি এই গান্তীর্য নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছেন। কঠিন হয়ে থাকতেই তাঁর ভালো লাগে। হাসি-তোমাশা, ঠাট্টা-ফাজলামি তাঁর একেবারে সহ্য হয় না। তাঁর কথা হল-হাসিতামাশাই যদি লোকজন করবে। তাহলে কাজ করবে। কখন? পৃথিবীটা কোনো নাট্যশালা না যে হাসি-তামাশা করে লোক-হাসাতে হবে।
আফসার সাহেবের দুর্ভাগ্য, তাঁর আশেপাশের মানুষজনের স্বভাব তাঁর স্বভাবের একেবারে উন্টো। তাঁর স্ত্রী মীরা সৰ্ব্বক্ষণই হাসছেন। কারণ্যে-অকারণে হাসছেন। এই তো সেদিন তাঁদের কাজের ছেলে কুদ্দুস হাত থেকে ফেলে টী-পট ভেঙে ফেলল। এই দেখে মীরা ফিক করে হেসে ফেললেনঃ আফসার সাহেব বললেন, একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। হাত থেকে ফেলে একটা দামি জিনিস ভেঙেছে। এতে হাসির কী হল?
মীরা বললেন, দী-পট ভেঙেছে দেখে হাসি নি। টী-পট ভাঙার পর কুদ্দুস কেমন হতভম্ব হয়ে ভাঙা পটটার দিকে তাকিয়ে ছিল তাই দেখে হোসে ফেললাম।
তার মুখের ভঙ্গি দেখে তুমি হেসে ফেললে?
হ্যাঁ।
দয়া করে আমার সামনে এই কাজটা করবে না। হাসতে ইচ্ছা করলে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে হাসবে।
মীরা আবার হেসে ফেললেন। আফসার সাহেব বললেন, হাসলে যে?
তুমি কেমন গম্ভীর মুখে কথা বলছি তাই দেখে—
দয়া করে আমার সামনে থেকে যাও।
মীরা উঠে চলে যান, তবে হাসতে-হাসতে যান। তা দেখেও আফসার সাহেবের গা জ্বালা করে।
তাঁর দুই মেয়ে সুমী আর রুমীও অবিকল মার মতো। দিন-রাত হাসছে। তারা মাঝেমাঝে স্কুলের মজার-মজার সব ঘটনা বাবাকে বলতে আসে। ঘটনা বলবে কি, বলার আগেই হাসি।
আফসার সাহেব শীতল গলায় বলেন, কী বলতে চোচ্ছ ঠিকমতো বল। এত হাসলে বলবে কী করে?
না-হাসলে এই ঘটনা বলা যাবে না। বাবা! হি-হি-হি-হয়েছে কি, আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে অরুণা-হি-হি-হি-সে করল কি, হি-হি-হি—
চুপ কর।
ঘটনাটা শোন বাবা। ভারি মজার— তারপর অরুণা-হি-হি-হি।
স্টপ। স্টপ।
অরুণার গল্প বলা হয় না। মেয়ে দুটি দুঃখিত হয়। তবে সেই দুঃখও খুব সাময়িক। আবার কোনো- একটা মজার ঘটনা ঘটে। এক বোন অন্য বোনের গায়ে হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়ে।
আজ সোমবার।
আফসার সাহেব নাশতা খেতে বসেছেন। তাঁর দুই মেয়ে সুমী রুমী বসেছে দু পাশে। রুমী কী একটা হাসির কথা বলতে যাচ্ছিল। বাবা কড়া করে তার দিকে তোকানোর কারণে সে চুপ করে গেল। সুমী তখন কী একটা বলতে গেল! মীরা চোখের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলেন। নাশতার টেবিলে হাসাহসি না-হওয়াই ভালো। মীরা টী-পট থেকে কাপে চা ঢালছেন। হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা ঘটল। মেঝে থেকে লাফ দিয়ে একটা বিড়াল আফসার সাহেবের কোলে এসে বসল। আফসার সাহেব লাফ দিয়ে তিন হাত ওপরে উঠে গেলেন। যে-পিরচে ডিম, রুটি, মাখন এবং পনিরের টুকরো সাজানো ছিল তা ছিটকে পড়ল মেঝেতে। পুরো ঘটনোটা ঘটল দু সেকেণ্ডের ভেতর।
সুমী রুমী খিলখিল করে হেসে ফেলল। তারা জানে এখন হাসা মানেই বিপদ।। ভয়ংকর বিপদ। বাবা প্রচণ্ড রাগ করবেন! কিন্তু কিছুতেই তারা হাসি থামাতে পারল না। মীরা খুব চেষ্টা করছেন না-হাসতে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছেন। লাভ হচ্ছে না। হাসি এসে যাচ্ছে। আর বুঝি আটকানো গেল না।
আফসার সাহেব মেঘগর্জন করলেন, রুমী সুমী, তোমরা আমার সামনে থেকে উঠে গেলে আমি খুশি হব।
মেয়ে দু জন তৎক্ষণাৎ ছুটে ঘরে চলে গেল। ঘরের ভেতর থেকে তাদের হাসি শোনা যাচ্ছে—হা-হা-হা– হি-হি-হি।ভ
এবার মীরাও হেসে ফেললেন। তবে শব্দ করে নয়, নিঃশব্দে। হাসির কারণে তাঁর হাত কাঁপছে। চায়ের কাপে ঠিকমতো চা চালতে পারছেন না।
মীরা।
কি?
হাসছ কেন জানতে পারি?
হাসি এসে গেল। তাই হাসছি। বিশেষ কোনো কারণে নয়।
কেন হাসি এসে গেল তা জানতে পারি?
সরি।
সরির কোনো ব্যাপার না। তুমি বল কেন হাসলে?
মীরা গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি কেমন চমৎকার শূন্যে উঠে গেলো! হঠাৎ মনে হল, পৃথিবীতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বলে কিছু নেই। দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগল। তাই হাসলাম।
তুমি যদি আমার সামনে থেকে চলে যাও আমি খুশি হব।
সত্যি চলে যেতে বলছ?
যদি হাসি বন্ধ করতে না পার তাহলে অবশ্যই চলে যাবে।
তোমার নাশতা তো বিড়াল ফেলে দিয়েছে। নাশতা নিয়ে আসি?
না।
চা দিই, নাকি চা-ও খাবে না? ভালো করে তাকিয়ে দেখ, আমি কিন্তু হাসছি না। গম্ভীর হয়ে আছি।…
বলতে-বলতে মীরা ফিক করে হেসে ফেললেন। খানিকট চা ছিলকে টেবিলে পড়ে গেল। তিনি টী-পট নামিয়ে রেখে প্রায় ছুটে শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। দুই মেয়ের হাসির সঙ্গে যুক্ত হল তাঁর হাসি।
চায়ের কোপ হাতে আফসার সাহেব এক-একা বসে আছেন। তাঁর মন বিষগ্ন। শোবার ঘর থেকে মা এবং দুই মেয়ের হাসির শব্দ ভেসে আসছে। হাসির জোয়ার নেমেছে। রাগে আফসার সাহেবের গা জ্বলে গেল। যে-বিড়ালের জন্যে এত কাণ্ড, সে নিশ্চিন্ত এবং আনন্দিত ভঙ্গিতে মেঝেতে পড়ে থাকা ডিম, পনির এবং মাখন-রুটি খাচ্ছে। সে একা খাচ্ছে না, তার সঙ্গে দুটো বাচ্চাও আছে। তারাও খাচ্ছে এবং মাঝেমাঝে চোখ তুলে আফসার সাহেবকে দেখছে। আফসার সাহেবের ইচ্ছে করছে প্রচণ্ড লাথি দিয়ে বিড়ালটাকে ফুটবলের মতো দূরে ছুঁড়ে দেন।
মেঝে পরিষ্কার করার জন্যে কাজের ছেলে কুদ্দুস এসেছিল। আফসার সাহেব তার দিকে রাগী চোখে তাকাতেই সে ভয় পেয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। তারও কি হাসির রোগ আছে? রান্নাঘর থেকে হাসির মতো আওয়াজ আসছে। হ্যাঁ, কুদ্দুস ব্যাটাও হাসছে।
বিড়াল পরিবার মহানন্দে খেয়ে যাচ্ছে। আফসার সাহেবের রাগ ক্রমেই বাড়ছে। তিনি ঠিক করে ফেললেন-ডান পায়ে বিড়ালটার গায়ে একটা দুৰ্দান্ত কিক বসাকেন, যাতে সে ভবিষ্যতে কখনো এইভাবে তাঁকে অপদস্থ না-করে। বসাতে যাবেন, তখন একটা ব্যাপার ঘটল। তিনি পরিষ্কার শুনলেন-মা-বিড়ালটা যে-সব কথা বলছে তা তিনি বুঝতে পারছেন। ম্যাও ম্যাও করেই নিচু গলায় কথা বলছে, কিন্তু তিনি প্রতিটি শব্দ বুঝতে পারছেন। এ কী অদ্ভুত কাণ্ড!
মা-বিড়ালটা বলছে, খোকাথুকু সাবধান! লোকটা আমাদের দিকে তাকাচ্ছে, মতলব ভালো না। মনে হচ্ছে উঠে দাঁড়াবে।
একটা বাচ্চা বিড়াল বলল, উঠে দাঁড়ালে কী হয় মা?
লাথি মারতে পারে। তোমরা একটু দূরে সরে যাও।
কতটা দূরে যাব?
খুব বেশি দূর যেতে হবে না। লাথি মারলেও সে তোমাদের মারবে না। আমাকে মারবে। মানুষ কখনো বিড়ালের বাচ্চার গায়ে হাত তোলে না।
কেন মা?
মানুষের মনে মায়া বেশি, এই জন্যে। তবু সাবধানের মার নেই। এই লোক খুব রেগে আছে। রেগে গেলে মানুষের মাথার ঠিক থাকে না। কি করতে কি করে বসবে। কী দরকার রিস্ক নিয়ে?
রিস্ক কী মা?
রিস্ক হচ্ছে একটা ইংরেজি শব্দ। এর বাংলাটা ঠিক জানি না।
বিড়ালের বাচ্চা দুটি অনেকটা দূরে চলে গেল। সেখান থেকে তাকিয়ে রইল আফসার সাহেবের দিকে। আফসার সাহেব পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলেন। ব্যাপারটা কী? বিড়ালের মানুষের মতো কথা বলার কোনোই কারণ নেই। শুধুমাত্র রূপকথার বইতে পশু-পাখি মানুষের মতো কথা বলে। এটা কোনো রূপকথা নয়। তিনি বিংশ শতাব্দীতে বাস করছেন। বাবর রোডের দোতলা বাসার ডাইনিং রুমে বসে আছেন। অফিসের গাড়ি চলে এসেছে, এখন অফিসে যাবেন। এই সময় বিড়ালের ভাষা তিনি বুঝতে পারছেন, তা হতেই পারে না। বিড়াল একটিমাত্র শব্দ জানে-মিয়াঁও। এই শব্দের কোনো মানে নেই। আর থাকলেও মানুষের তা বোঝার কথা না।
আফসার সাহেব সিগারেট ধরালেন।
একটা বিড়ালের বাচ্চা তখন কথা বলে উঠল, মা, লোকটা সিগারেট ধরিয়েছে। এখন বোধহয় আর আমাদের মারবে না।
বিড়ালের মা বলল, আমারও তাই ধারণা। তবে খোকাখুকু, এখন একটু সাবধানে থাক। কারণ লোকটা জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরা ছুঁড়ে ফেলবে। গায়ে লাগলে তোমাদের পশমে আগুন ধরে যাবে। মনে নেই একবার জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরায় পা দিয়ে পা পুড়িয়ে ফেললে, মনে আছে?
আছে। আচ্ছা মা, তোমার এত বুদ্ধি কেন?
দূর বেটিা আমার বুদ্ধি নেই।
তোমার অনেক বুদ্ধি। তুমি লাফ দিয়ে ওই লোকটার কোলে বসলে-এই জন্যেই তো সে নাশতার প্লেট মেঝেতে ফেলে দিলা তার নাশতা এখন আমরা খাচ্ছি। আচ্ছা! মা, তুমি রোজ এই রকম কর না কেন?
এ-রকম রোজ করা যায় না। পরপর দুদিন করলেই এরা রাগ করবে। আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দেবে। একদিন করেছি। তো, সবাই ভাবছে অ্যাকসিডেন্ট।
অ্যাকসিডেন্ট কী মা?
অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে একটা ইংরেজি শব্দ। এর মানে দুর্ঘটনা।
তুমি ইংরেজিও জান?
অল্প-অল্প জানি, শুনে-শুনে শিখেছি। বাটার মানে মাখন, চীজ হল পনির, নরমাল ওয়াটার মানে পানি, তবে ফ্রীজের পানি না।…
ইস্‌ মা, তোমার যে কী বুদ্ধি!
আফসার সাহেবের মাথা ঘুরছে। গা-হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। এ-সব কী? তাঁর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এ-সব তো মাথা-খারাপের লক্ষণ। তিনি দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করলেন তাঁর বংশে কোনো পাগল আছে কি না। মনে পড়ল না। তিনি তাকালেন। বিড়ালগুলির দিকে।
ছোট বিড়ালটা বলল, মা-দেখ, লোকটা আমার দিকে তাকাচ্ছে।
বিড়ালের মা বলল, লোকটা-লোকটা বলছি কেন? এইসব অসভ্যতা। আমরা উনার বাড়িতে থাকি। সম্মান করে কথা বলা উচিত।
কী বলব মা?
স্যার বল। স্যার বলাই ভালো। কিংবা ভদ্রলোক বলতে পার।
ভদ্রলোক বলা কি ঠিক মা? উনি একবার আমাদের বস্তায় ভরে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন।
ফেলে তো দেয় নি।
উনার মেয়েগুলির জন্যে ফেলেননি। মেয়েগুলি কাঁদতে লাগল। লোকটা ভালো না মা। খারাপ লোক। সবসময় বকাঝকা করে।
সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত হয়ে আসে। বকাঝকা করবে না তো কি! এই সব ছোটখাটো দোষ ধরতে হয় না।
একবার তোমার গায়ে লাথি দিয়েছিল মা!
মনের ভুলে দিয়েছে। রোজ তো আর দেয় না।
আফসার সাহেব আর সহ্য করতে পারলেন না। কী সর্বনাশ, এ-সব কী হচ্ছে! ক্লান্ত গলায় ডাকলেন, মীরা-মীরা। প্লীজ, তাড়াতাড়ি আস!
মীরা ছুটে বের হয়ে এলেন। রুমী সুমীও এল। তারা অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। কুদ্দুসও রান্নাঘর থেকে মাথা বের করেছে। মীরা বললেন, কী ব্যাপার?
আফসার সাহেব কিছু বলতে পারলেন না। তিনি বিড়ালের কথা বুঝতে পারছেন, এই হাস্যকর কথা তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব না। নিশ্চয়ই তাঁর শরীর খারাপ করেছে। মাথায় রক্ত উঠে গেছে কিংবা এই জাতীয় কিছু।
মীরা বললেন, তোমার মুখ এমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ করেছে?
হুঁ। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল।
নিশ্চয়ই প্ৰেশার। মহসিনকে খবর দেব? ও এসে তোমার প্ৰেশার মেপে দেবে।
কাউকে খবর দেবার দরকার নেই।
প্ৰেশার মাপলে ক্ষতি তো কিছু নেই। আর শোন, আজ অফিসে যাবারও দরকার নেই। প্রচুর ছুটি তোমার পাঞ্ছনা। অতিরিক্ত কাজের চাপে তোমার এই অবস্থা হয়েছে। সুমী, যা তো, নিচে গিয়ে ড্রাইভারকে বলে আয় আজ তোর বাবা অফিসে যাবে না।
মীরা তাঁকে বিছানায় গুইয়ে দিলেন। জানালার পর্দা টেনে ঘর খানিকটা অন্ধকার করে দিলেন।
তুমি চুপচাপ শুয়ে বিশ্রাম নাও। আমি মহসিনকে খবর দিচ্ছি। ও বিকেলে এসে তোমার প্ৰেশার মাপবে।
আফসার সাহেব কিছু বললেন না। মহসিন এসে তাঁর প্ৰেশার মাপবে এই খবরও তাঁর ভালো লাগল না। মহসিন মীরার সবচেয়ে ছোট ভাই। কিছুদিন হল ডাক্তারি পাস করে বের হয়েছে। এমনিতে ছেলে খুব ভালো, তবে ঠাট্টা-তামাশা বড় বেশি করে। সহ্য করা যায় না।
মীরা।
কি?
মহসিনকে খবর দেবার দরকার নেই।
আচ্ছা যাও, খবর দেব না।
তুমি একটু বস তো আমার পাশে।
মীরা বসলেন। কপালে হাত দিয়ে স্বামীর গায়ের উত্তাপ দেখলেন। গা ঠাণ্ডা, জ্বর নেই। কিন্তু চোখ-মুখ যেন কেমন দেখাচ্ছে। যে-কোনো কারণেই হোক মানুষটা খুব ভয় পেয়েছে। গলার স্বরও জড়ানো।
মীরা।
কী?
আফসার সাহেব ইতস্তত করে বললেন, তুমি কি বিড়ালের কথা বুঝতে পার?
মীরা হতভম্ব হয়ে বললেন, বিড়ালের কথা বুঝতে পারি মানে! এ-সব কী বলছ?
আফসার সাহেব অত্যন্ত বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, আমার ধারণা বিড়াল মাঝেমাঝে মানুষের মতো কথা বলে। মন দিয়ে শুনলে ওদের সব কথা বোঝা যায়।
মীরা বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি ওদের কথা বুঝতে পারছ?
হ্যাঁ।
বুঝতে পারলে ভালো। এখন ঘুমুতে চেষ্টা কর।
আফসার সাহেব চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন। রুমী সুমী স্কুলে গেল না। মাঝেমাঝে পা টিপে-টিপে এসে বাবাকে দেখে গেল। সুমী বাবার কানে-কানে বলল, তোমার কী হয়েছে বাবা? তিনি জবাব দিলেন না। তাঁর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।
মা-বিড়ালটা একবার এসে ঘুরে গেল। সে দুঃখিত গলায় তার বাচ্চাদের বলল, বেচারা আজ অফিসে গেল না কেন বুঝতে পারছি না। অসুখবিসুখ করল কি না কে জানে? চারদিকে ইনফ্লুয়েঞ্জা হচ্ছে।
একটা বাচ্চা বলল, ইনফ্লুয়েঞ্জা কী মা?
একটা রোগের নাম। এইসব তুমি বুঝবে না। সবসময় প্রশ্ন করে বিরক্ত করবে না।
প্রশ্ন না করলে জানব কী করে?
মা-বিড়াল বলল, এখন এ-ঘর থেকে চলে যাও। বেচারা ঘুমানর চেষ্টা করছে। তাকে ঘুমুতে দাও।
ইনফ্লুয়েঞ্জা কী, তা তো তুমি বললে না!
বললাম তো ইনফ্লুয়েঞ্জা একটা অসুখের নাম। তখন জ্বর হয়, মাথায় পানি ঢালতে হয়।
আমাদের কি ইনফুয়েঞ্জা হয়?
না, আমাদের হয় না।
আমাদের কী কী অসুখ হয় মা?
আহ্‌, চুপ কর তো! বেচারাকে কি তোমরা ঘুমুতে দেবে না?
আমাদের কী কী অসুখ হয় সেটা যদি তুমি আমাদের না-বল তাহলে আমরা শিখব কী করে?
বারান্দায় চল। কারান্দায় বলব।
বিড়াল তার দু বাচ্চাকে নিয়ে বের হয়ে গেল। বাচ্চা দুটির যাবার তেমন আগ্ৰহ নেই। বারবার ফিরে তাকাচ্ছে।
আফসার সাহেব সারা দিন বিছানায় শুয়ে রইলেন। তাঁর বুক ধকধক করছে, মাথা ঘুরছে। এ কী সমস্যা! এ কী সমস্যা!
সন্ধ্যাবেলা তাঁর ছোট শ্যালক মহসিন এসে উপস্থিত। সঙ্গে প্ৰেশার মাপার যন্ত্র। মীরা বলেছিল তাকে খবর দেবে না। কিন্তু খবর দিয়েছে। মীরা কথা রাখেনি। আফসার সাহেব মহসিনকে সহ্যই করতে পারেন না, দেখামাত্র তাঁর মাথায় রক্ত উঠে যায়। আজও উঠে গেল। মহসিন দাঁত বের করে বলল, কেমন আছেন দুলাভাই?
তিনি শুকনো গলায় বললেন, ভালো।
শুনলাম আজ অফিসে যান নি।
শরীরটা ভালো লাগছে না।
শুয়ে-শুয়ে কী করছেন?
কিছু করছি না।
বুবু বলছিলেন–আপনি নাকি এখন অ্যানিম্যাল ল্যাংগোয়েজে এক্সপার্ট হয়ে গেছেন—হা-হা-হা।
আফসার সাহেবের ইচ্ছে করল। ফাজিলটার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন।
বিড়ালের সব কথা নাকি বুঝে ফেলছেন?
আফসার সাহেব চুপ করে রইলেন। মহসিন বলল, বিড়াল কোন ভাষায় কথা বলে দুলাভাই? সাধুনা চলিত?
আমার শরীরটা ভুলো লাগছে না।–তুমি অন্য ঘরে যাও।
রাগ করছেন নাকি?
না, রাগ করছি না। তুমি আমাকে একটু একা থাকতে দাও!
আগে প্ৰেশারটা মাপি, তারপর যত ইচ্ছা একা থাকবেন।
প্ৰেশার মাপা হল। দেখা গেল প্ৰেশার স্বাভাবিক। মহসিন বলল, আপনার সমস্যা কি জানেন দুলড়াই? আপনার সমস্যা হচ্ছে-গাষ্ঠীর্য একটু সহজ হোন। স্বাভাবিকভাবে হাসি-তামাশায় জীবন পার করার চেষ্টা করুন। দেখবেন, বিড়ালের কথা আর শুনতে পাচ্ছেন না।
তুমি যাও তো এ-ঘর থেকে।
যাচ্ছি। কয়েকটা ঘুমেরট্যাবলেট দিয়ে যাচ্ছি। রাতে দুটা খেয়ে ঘুমুবেন। আপনার ঘুম দরকার।
আফসার সাহেব মীরার ওপর খুবই রাগ করলেন। মীরা কাজটি ঠিক করে নি। কেন সে এই ব্যাপারটা জানাচ্ছে? বিড়ালের কথা বুঝতে পারার পুরো ব্যাপারটা যে হাস্যকর তা কি তিনি বোঝেন না? খুব ভালো বোঝেন। তিনি জানেন, তাঁর কোনো সমস্যা হয়েছে… হয়তো মাথা গরম হয়ে আছে কিংবা কানো কোনো সমস্যা হয়েছে। এটা কি লোকজনকে বলে বেড়ানোর মতো ঘটনা? সবকিছু সবাইকে বলতে নেই, এই সাধারণ বুদ্ধি কি মীরার নেই?
দেখা গেল, সন্ধ্যা নাগাদ লোকজনে বাড়ি ভরে গেল। ঢাকার আত্মীয়স্বজনরা অনেকেই এসে গেছেন। সবার মুখে রহস্যময় হাসি। রাগে-দুঃখে আফসার সাহেবের চোখে পানি এসে গেল।
এমন অবস্থা হবে জানলে তিনি কিছুতেই মীরাকে ব্যাপারটা বলতেন না।
 
Back
Top