- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 407
- Messages
- 5,564
- Reaction score
- 2,005
- Points
- 3,913
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
বৈরাম খাঁ
(অন্তর্জাল হতে সংগৃহীত)
(অন্তর্জাল হতে সংগৃহীত)
ইতিহাসের হার না মানা এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ও বীর সেনাপতি
বৈরাম খাঁ মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। তিনি ছিলেন মোগল সৈন্যবাহিনীর প্রধান সেনাপতি। সম্রাট হুমায়ুনের অত্যন্ত আস্থাভাজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং এক ক্ষুরধার কূটনীতিবিদ;
সম্রাট হুমায়ূনের মৃত্যুর পর ছিলেন সম্রাটের পুত্র আকবরের একজন অভিভাবক, প্রধান পরামর্শদাতা, উপদেষ্টা, শিক্ষক এবং সম্রাটের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগী।
ভারত উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্য বিস্তারে তার একনিষ্ঠতা, বিশ্বস্ততা এবং অবদান ছিল প্রশ্নাতীত।
জন্ম
১৫০১ খ্রিস্টাব্দে, হিমশীতল আফগানিস্তানের বাদাখশান প্রদেশে এক অভিজাত তুর্কি বংশে জন্ম নেন বৈরাম খাঁ।
তখনকার বাদাখশান ছিল সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সামরিক কৌশলের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, পারস্য ও মধ্য এশিয়ার প্রভাব যেখানে ছড়িয়ে ছিল সর্বত্র।
তার পিতা ছিলেন কারা ফনলু গোত্রের বাহারলু বংশের উত্তরাধিকারী,এক সাহসী, যোদ্ধাপরায়ণ গোষ্ঠী, যারা কয়েক দশক ধরে পশ্চিম পারস্যের শাসনক্ষমতা ধারণ করেছিল।
এই কারা ফনলু গোত্র ছিল মূলত তুর্কি উপজাতি, যারা পারস্য এবং মধ্য এশিয়ায় বিভিন্ন সময়ে সামরিক প্রতিভা ও কৌশলের জন্য খ্যাত ছিল। বৈরাম খাঁ’র পরিবারও এই ঐতিহ্যের বাইরে ছিল না।
তার পূর্বপুরুষরা মোগল সম্রাট বাবরের অনুগত সেনানী হিসেবে কাজ করেছেন। তারা ছিলেন বাবরের নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ রক্ষীবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যুদ্ধের কঠোর বাস্তবতা, রাজনৈতিক সংঘাত, এবং বংশগত সামরিক দায়িত্ব—এসবই যেন শৈশব থেকে বৈরাম খাঁ’র রক্তে প্রবাহিত হতে থাকে।
তৎকালীন পারস্যের রাজা শাহ তামাস্পের দরবারে বৈরাম খাঁ একবার উপস্থিত হলে, তার প্রজ্ঞা, কূটনীতি ও সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে রাজা তাকে “খাঁ” বা “খান” উপাধি প্রদান করেন। এর পূর্বে তার আসল পদবী ছিল ‘বেগ’। ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘জওহর আবতাচির’ থেকে জানা যায়, এই ‘বেগ’ উপাধি ছিল তুর্কি ও পারস্য অঞ্চলের উচ্চপদস্থ সেনানায়কদের সম্মানসূচক নাম।
শৈশব থেকেই বৈরাম খাঁ ছিলেন শিক্ষাপ্রেমী, ধর্মপরায়ণ এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন। তিনি শুধু অস্ত্র চালনায় দক্ষ ছিলেন না, কুরআন, ফার্সি সাহিত্য, ইতিহাস এবং যুদ্ধকৌশল সম্পর্কেও গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তরুণ বয়সেই তার নেতৃত্বের গুণ এবং বিচক্ষণতা তাকে সেনাবাহিনীর চোখে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব করে তোলে।
বাল্যকাল থেকেই তিনি এক দিকে যেমন ছিলেন তরবারির ধার, তেমনই ছিলেন কলমের বলিষ্ঠতাও। এই দুইয়ের মিলনই পরবর্তীকালে তাকে শুধু একজন সেনাপতি নয়, বরং সম্রাট হুমায়ুনের পরম বিশ্বস্ত কূটনীতিক, পরামর্শদাতা এবং নবীন আকবরের অভিভাবক করে তোলে।
কৈশোর: শিক্ষা ও মানসিক গঠন
বৈরাম খাঁর কৈশোর ছিল ধ্যান-ধারণা, শিক্ষা ও অনুশীলনের সময়। পরিবার থেকে তিনি শিখেছিলেন ধর্মীয় মূল্যবোধ,কুরআন পাঠ, হাদীস ও ইসলামিক আইন ছিল তার প্রাথমিক পাঠ্য। ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য ছিল তার সাংস্কৃতিক ভিত্তি। একই সঙ্গে তিনি মনোযোগী ছিলেন ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন এবং সামরিক কৌশল শেখার দিকে।
এ সময়েই তিনি লক্ষণীয়ভাবে কৌতূহলী ও নিরবচ্ছিন্নভাবে নিজেকে গঠনের জন্য উদ্গ্রীব ছিলেন। দরবারের ভাষা, নৈতিকতা, সামরিক শৃঙ্খলা,সবকিছুর প্রতি তার ছিল গভীর অনুরাগ। তরুণ বয়সে তিনি তলোয়ার চালানো, ঘোড়সওয়ারি, ধনুর্বিদ্যা ও কৌশলগত যুদ্ধনীতি আয়ত্ত করেন। কৈশোরেই বোঝা গিয়েছিল, এই তরুণ কেবল একজন সেনানায়ক হবেন না,তিনি হবেন এক রাজপুরুষ, এক দূরদর্শী কূটনীতিক।
যৌবন: নেতৃত্বে প্রথম উত্থান
বৈরাম খাঁর যৌবনকালেই বাবরের সেনাদলে যোগ দেওয়ার সুযোগ ঘটে। তুর্কি রীতি অনুযায়ী, পরিবারের তরুণ সদস্যদের সামরিক অভিজ্ঞতা অর্জন ছিল বাধ্যতামূলক। বাবরের অধীনে যুদ্ধক্ষেত্রে তার আত্মপ্রকাশ ছিল সাহসিকতার প্রতীক। ক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন বাবরের আস্থাভাজন,তাঁর অসাধারণ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, ধৈর্য, কৌশলী দৃষ্টি এবং বিশ্বস্ততা বাবর খুব দ্রুতই লক্ষ্য করেন।
বাবরের মৃত্যুর পর হুমায়ুন যখন সিংহাসনে আসেন, তখন বৈরাম খাঁ একজন পরিণত তরুণ,যিনি শুধু একটি তলোয়ারধারী সেনানায়ক নন, বরং একজন বিচক্ষণ পরামর্শদাতা। হুমায়ুনের কঠিন রাজনৈতিক যাত্রায় বৈরাম খাঁ হয়ে ওঠেন তার ছায়াসঙ্গী। সম্রাটের নির্বাসন, পলায়ন, এবং আফগান শেরশাহ সূরীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে বৈরাম খাঁ ছিলেন অপরিহার্য কাণ্ডারির মতো।
এই যৌবনকালেই তিনি ইরানে গমন করেন এবং শাহ তামাস্পের দরবারে তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতার জন্য ভূয়সী প্রশংসা পান। এখানেই শাহ তামাস্প তাকে “খাঁ” উপাধিতে ভূষিত করেন।
হুমায়ুনের উত্থান ও বৈরাম খাঁর ভুমিকা
সম্রাট বাবরের মৃত্যুর পর ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুন সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তার সিংহাসনের পথ মসৃণ ছিল না,রাজ্যজুড়ে ছিল দুর্বল প্রশাসন, ভেতরে বাইরে প্রতিপক্ষের জাল, আর সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠছিল আফগান নেতা শের খান (পরবর্তীতে শেরশাহ সূরী)। এই সময় বৈরাম খাঁ সম্রাট হুমায়ুনের পাশে দাঁড়ান একজন অনুগত সহযোগীর মতো।
তিনি শুধু একজন সেনানায়ক হিসেবেই নয়, বরং এক প্রাজ্ঞ কূটনীতিক ও পরামর্শদাতা হিসেবে হুমায়ুনের প্রতিটি সংকটের মুহূর্তে অমূল্য সহায়তা দেন। শের খান যখন হুমায়ুনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে একের পর এক যুদ্ধে তাকে পরাজিত করতে থাকে, তখন বৈরাম খাঁ-ই ছিলেন সেই দৃঢ় কণ্ঠ, যে হুমায়ুনকে আত্মসমর্পণের পরিবর্তে সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন।
পরাজয়, নির্বাসন ও ইরানে গমন
১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে কন্নৌজের যুদ্ধে হুমায়ুন পরাজিত হন এবং মোগল সাম্রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। এই কঠিন সময়ে, বৈরাম খাঁ হুমায়ুনের সঙ্গ ত্যাগ করেননি। তিনি হুমায়ুনের সাথে দীর্ঘ ১৫ বছর নির্বাসনে কাটান, কখনো সিন্ধ, কখনো কাবুল, কখনো পারস্যে। এটি কেবল রাজনৈতিক নয়, এক মানবিক পরীক্ষার সময় ছিল।
ইরানের শাহ তামাস্পের দরবারে যখন হুমায়ুন শরণার্থী হিসেবে উপস্থিত হন, তখন বৈরাম খাঁ তার পক্ষ থেকে কূটনৈতিকভাবে আলোচনায় নেতৃত্ব দেন। তার কৌশলী বুদ্ধিমত্তায় শাহ তামাস্প মোগলদের সেনাসহ সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেন এবং সেখান থেকেই মোগল সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতি শুরু হয়।
শাহ তামাস্প, বৈরাম খাঁ’র ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে তাকে “খাঁ” উপাধি দেন এবং বিশেষ মর্যাদা প্রদান করেন।
সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার ও বৈরাম খাঁর বিজয়যাত্রা
১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে, বৈরাম খাঁর কৌশলে ও নেতৃত্বে হুমায়ুন দিল্লি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। এই পুনরুদ্ধারের প্রতিটি পদক্ষেপে বৈরাম খাঁ ছিলেন সামনে। পাঞ্জাব, লাহোর, আগ্রা, দিল্লি...এক এক করে দখল হয় মোগলদের হাতে। হুমায়ুন সিংহাসনে ফিরে আসেন।
কিন্তু এর এক বছর পরই হুমায়ুন দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। তখন আকবর মাত্র ১৩ বছরের কিশোর। সাম্রাজ্য আবার এক অশান্তির মোড়ে দাঁড়ায়। এই সময় বৈরাম খাঁই দায়িত্ব নেন আকবরকে সিংহাসনে বসানোর, সাম্রাজ্য রক্ষার এবং তরুণ সম্রাটকে গড়ে তোলার।
তিনি হয়ে ওঠেন “রেজেন্ট” বা অস্থায়ী শাসক, এবং আকবরের অভিভাবক।
আকবরের অভিভাবক, সাম্রাজ্যের রেজেন্ট ও শেষ অধ্যায়ের ট্র্যাজেডি
১. আকবরের রেজেন্ট হিসেবে বৈরাম খাঁর শাসনকাল
হুমায়ুনের আকস্মিক মৃত্যুর পর দিল্লির সিংহাসন শূন্য হয়ে পড়ে। সেসময় সাম্রাজ্যের অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক—ভিতরের ষড়যন্ত্র, বাহ্যিক আক্রমণ, এবং তরুণ সম্রাট আকবরের বয়স মাত্র ১৩ বছর। এই সংকটময় মুহূর্তে বৈরাম খাঁ সাম্রাজ্যের রেজেন্ট বা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কার্যত পুরো প্রশাসন, সেনাবাহিনী এবং রাজদরবার পরিচালনা করতে শুরু করেন।
১৫৫৬ সালে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে বৈরাম খাঁর নেতৃত্বে মোগল সেনাবাহিনী আফগান নেতা হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য (হেমু)-কে পরাজিত করে। এই যুদ্ধ শুধু আকবরের রাজ্য পুনর্দখলের সূচনা নয়, মোগল সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধশেষে বৈরাম খাঁ ঘোষণা করেন:
"সম্রাট আকবর আজ থেকে ভারতের প্রকৃত অধিপতি,আমি শুধু তাঁর খেদমতে নিযুক্ত এক অনুগত সেনাপতি।"
তবে বাস্তবে, পরবর্তী প্রায় চার বছর (১৫৫৬-১৫৬০) সাম্রাজ্য শাসনের কার্যকরী ক্ষমতা ছিল বৈরাম খাঁর হাতে। তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত আমিরদের বরখাস্ত করেন, সেনানীদের পুরস্কৃত করেন, রাজকোষ মজবুত করেন এবং সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে নতুন করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
২. সামরিক সফলতা, কঠোরতা ও প্রশাসনিক প্রভাব
বৈরাম খাঁর শাসনকালে তিনি অত্যন্ত কঠোর প্রশাসনিক নীতি গ্রহণ করেন। দুর্বল রাজ্যযন্ত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন, বিদ্রোহীদের কঠোরভাবে দমন করেন, এবং আকবরের নামে সাম্রাজ্য বিস্তারে একনিষ্ঠভাবে কাজ চালিয়ে যান।
কিন্তু তার এই কঠোরতা ও একচেটিয়া ক্ষমতা দ্রুতই কিছু অভিজাত আমিরদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি যেমন মাহম আনগা (আকবরের ধাত্রী মা) এবং তার পুত্র আদম খান,তারা আকবরকে প্রভাবিত করতে থাকেন যে বৈরাম খাঁ খুব বেশি ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছেন, এবং তিনি আকবরের স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করছেন।
এর মধ্যেই ঘটে আরেকটি ঘটনা,বৈরাম খাঁ একজন শত্রু বংশের আমিরকে ক্ষমা না করে হত্যা করেন, যার ফলে আকবর বিরক্ত হন। ধীরে ধীরে তরুণ আকবর নিজে শাসনের কর্তৃত্ব নিতে উদ্যোগী হন এবং ১৫৬০ সালে লাহোর থেকে দিল্লিতে ফিরে বৈরাম খাঁকে সরাসরি পদত্যাগ করতে বলেন।
৩. পতন, ক্ষমতা ত্যাগ ও মৃত্যু
সম্রাট আকবরের বিরাগভাজন হওয়ার মধ্য দিয়ে বৈরাম খাঁ’র পতনের সূত্রপাত
নাবালক সম্রাটের অভিভাবক হিসেবে বৈরাম খাঁ চার বছর ধরে ১৫৫৬ থেকে ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোগল সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতা নিজের মতো করে পরিচালনা করতে থাকেন।
কিন্তু এর পর থেকেই তার পতনের শুরু। জীবনের চল্লিশটি বছর মোগল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন পদে থেকে সম্রাটের অনুগত, অভিভাবক এবং বিশ্বস্ততার প্রতীক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হন বৈরাম খাঁ। কিন্তু মোগল দরবারের অন্য সহকর্মীদের কাছে তিনি খুব একটা পছন্দের পাত্র ছিলেন না।
বৈরাম খাঁ ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের লোক। সংখ্যাগরিষ্ঠ মোগল আধিকারিকরা সুন্নি ধর্মের অনুসারী ছিলেন। ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের একটা বৃহৎ অংশের কাছে খুব একটা জনপ্রিয় ছিলেন না তিনি।
এছাড়া নাবালক সম্রাটের অভিভাবক হিসেবে তিনি যে রাজক্ষমতা ভোগ করতে শুরু করেন, তাতে সহকর্মীদের আস্থায় না নেয়া, সম্রাটের অনেক নির্দেশকে আমলে না নেয়ায় ধীরে ধীরে নিজেকে দাম্ভিক এবং অহংকারী হিসেবে অন্যদের কাছে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকেন। আর এভাবে তিনি হয়ে পড়েন অনেকেরই বিরাগভাজন।
বৈরাম খাঁ ছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তার পরিচালনা ও আকবরের নেতৃত্বে পানিপথের যুদ্ধ জয় করতে মোগল সেনাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। দিল্লি ও আগ্রা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় মোগল সেনাবাহিনী। তবে এই যুদ্ধেই বৈরাম খাঁর সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে আকবরের।
দিল্লী জয়ের সময় সম্রাটের নির্দেশ অমান্য করে সেনাপতি হিমুকে নির্মমভাবে হত্যা করেন বৈরাম খাঁ। এমনকি যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রেও অনেক বিষয়ে সম্রাট অবগত ছিলেন না। ফলে এই যুদ্ধে সম্রাটের ভূমিকার থেকেও বৈরাম খাঁ’র নির্দেশ ও যুদ্ধ পরিচালনায় তারই প্রধান ভূমিকা ছিল, যেখানে সম্রাটের ভূমিকা ছিল নিতান্তই গৌণ। এছাড়াও প্রধান সেনাপতি বৈরাম খাঁ আকবরকে পুতুল ভূমিকায় রেখে মোগল প্রশাসনের সকল সিদ্ধান্ত প্রদানে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন।
আর এতে আকবরের মাতা হামিদা বানু প্রতিনিয়ত বৈরাম খাঁ’র কার্যক্রমে শঙ্কাবোধ করতেন এই ভেবে যে, বৈরাম খাঁ হয়তো কখনো তার সন্তান এবং মোগল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী আকবরের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন না। আকবরকে সারা জীবন হয়তো থেকে যেতে হবে বৈরাম খাঁ’র পুতুল হিসেবে।
এদিকে আকবর বৈরাম খাঁ’র তত্ত্বাবধানে নিজেকে একজন আদর্শ সম্রাট হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিনিয়ত সচেষ্ট ছিলেন। শুধুমাত্র পুতুল সম্রাট হিসেবে থাকার জন্য নয়, তার চিন্তা চেতনায় আর ভাবনাতে ভারত উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্যের একমাত্র ক্ষমতাধর ব্যক্তি হবেন তিনি। ভবিষ্যতের একমাত্র মোগল সম্রাট হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে থাকেন।
আর তাই ১৫৬০ সালে আকবর যখন আঠারো বছর পূর্ণ করেন, তখনই মোগল সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতা নিজের অধীনে নিয়ে আসতে সংকল্পবদ্ধ হন। ক্ষমতাধর অনেককেই ধীরে ধীরে প্রশাসন থেকে সরিয়ে দিতে থাকেন যাতে তার ওপর কেউ প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। কিছুদিনের মধ্যেই সম্রাট বৈরাম খাঁকে শাসন ক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাকে এবং তার পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি জায়গা বরাদ্দ করেন।
সম্রাটের এমন অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তে বৈরাম খাঁ অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। কিন্তু ততদিনে মোগল সেনার সবধরনের নিয়ন্ত্রণ আকবর নিজের হাতে নিয়ে ফেলেছেন। ফলে এই বিদ্রোহ বৈরাম খাঁর জন্য লাভজনক হলো না। তিনি পরাজিত হন।
পরে তিনি তার কৃতকর্মের জন্য সম্রাটের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আকবর বৈরাম খাঁকে ক্ষমা করে দিলেও তাকে বিশ্রামে যাওয়ার শর্ত দেন। এতে বৈরাম খাঁ আকবরের ওপর মনঃক্ষুণ্ন হন।
কিন্তু সম্রাটকে কিছু না বলে তিনি আকবরের সাম্রাজ্যেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়ার আর্জি জানান। কিন্তু সম্রাট এতে রাজি হননি। সম্রাট বৈরাম খাঁকে মক্কায় পাঠাতে চান বিশ্রামের জন্য।
ঐতিহাসিক আবুল ফজলের লেখা ‘আইন-ই-আকবর’ বইয়ের ৩২৪-২৫ পৃষ্ঠায়ে উল্লেখিত আকবরের এমনি এক বার্তা। এই বার্তাতে লেখা ছিল-
“আপনার সততা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত রয়েছি। আমি আপনাকে এই সাম্রাজ্যের সবধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করছি। এখন থেকে এই সাম্রাজ্য পরিচালনায় সবধরনের সিদ্ধান্ত নিজের হাতে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আমার একান্ত ইচ্ছে আপনি দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে অবসর নিয়ে পবিত্র মক্কার উদ্দেশে তীর্থযাত্রা শুরু করুন। এই মোগল সাম্রাজ্যকে দীর্ঘদিন সেবা করার জন্য হিন্দুস্থানের একটি উপযুক্ত জায়গা আপনার পরিবার, আপনার জীবনধারণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রদান করা হচ্ছে যা থেকে উপার্জিত রাজস্ব আপনার এবং আপনার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য প্রেরণ করা হবে। ”
বৈরাম খাঁ আহত ও বিষণ্ন হৃদয়ে বিশাল মোগল সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতির পদ ত্যাগ করে পবিত্র ওমরাহ পালনের জন্য মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি, মক্কায় যাওয়ার পথে গুজরাটের একটি এলাকায় সম্রাট আকবরের পাঠানো গুপ্তঘাতকরা মোগল সেনাপতি বৈরাম খাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
মোঘল সাম্রাজ্যের জন্য সারাজীবন বীরের মতো লড়াই করে যাওয়া নিবেদিতপ্রাণ দুর্ধর্ষ বীর সেনাপতির শেষটা হয় একদম করুনভাবে