Collected অরণ্যের দিনরাত্রি - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

dukhopakhidukhopakhi is verified member.

Special Member
Registered
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
363
Messages
4,918
Reaction score
1,275
Points
3,863
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
অরণ্যের দিনরাত্রি


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়






পর্ব - ১


সকালবেলা ধলভূমগড় স্টেশনে চারজন যুবক ট্রেন থেকে নামলো। ছোট্ট স্টেশন, সারা দিন-রাতে দু’তিনবার মাত্র সরব হয়ে ওঠে, বাকি সময়টা অলস ভাবে নিঝুম। আলাদা টিকিট কালেক্টার নেই, স্টেশনমাস্টার নিজেই ট্রেন থেকে নামা ছোট্ট যাত্রীদলের দিকে এগিয়ে আসেন টিকিটের জন্য—যাত্রীরা অধিকাংশ স্থানীয় লোক, নেংটি পরা সাঁওতাল আর ওরাওঁ—তাদের প্রত্যেকেরই কাঁধে একখানা করে লাঠি, আট হাত শাড়ি ফেরতা দিয়ে পরা মেয়েরা—আম্রপল্লবের মতন তারা পাঁচজন পাঁচজন হাত ধরাধরি করে থাকে ও গানের সুরে কথা বা ঝগড়া করে যায়, এ ছাড়া দু’চারজন আধা-বিহারী আধা-বাঙালীবাবু কিংবা পাইকার।
এর মধ্যে ঐ চারজন যুবক একটুখানি নতুনত্ব, কেননা এই জায়গায় কখনো চেঞ্জাররা আসে না, সে-রকম কোনো ব্যবস্থাই নেই। ছোট্ট একটুখানি শহর-সাজা গ্রাম, থাকলেও হয়, না থাকলেও ক্ষতি ছিল না—এমন ভাব; দু’চারখানা বাড়ি ফুরোতে না ফুরোতেই শুরু হয়ে গেছে জঙ্গল। যুবক চারজনের বয়েস পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে, প্রত্যেকেরই সুঠাম স্বাস্থ্য, হাতে ভালো চামড়ার সুটকেস, হোল্ডঅল, টেরিলিন জাতীয় সুদৃশ্য পোশাক পরিহিত, ওদের মুখ চোখ দেখলেই আর কারুকে বলে দিতে হয় না যে, ওরা কলকাতার মানুষ।কাপড়ের সেরা দোকান
স্টেশনমাস্টার মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা বেড়াতে এলেন বুঝি?
ওদের মধ্যে একজন প্যান্টের এ-পকেট ও-পকেট খুঁজছিল। পিছন পকেটের চামড়ার ব্যাগ থেকে বেরুলো ভাড়ার রসিদ, তখন সে জবাব দিলো, হ্যাঁ, সেইরকমই, দেখা যাক! আমাদের কাছে কিন্তু টিকিট নেই! মাঝরাত্রে টিটি’র কাছে ভাড়া দিয়ে এই রসিদ নিয়েছি। চলবে তো?
স্টেশনমাস্টার এক পলক উঁকি দিয়ে দেখেই বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক আছে। এই সময় এখানে বেড়াতে এলেন? আপনাদের তো অসুবিধে হবে···
—কেন, অসুবিধে কিসের? আপনার তো কোনো অসুবিধে হচ্ছে বলে মনে হয় না!
—থাকবেন কোথায়? এখানে তো—
—সে আমরা যা-হোক ব্যবস্থা করে নেবো।
ওদের মধ্যে আরেকজন বললো, কেন, এখানে একটা বাংলো আছে না? তাই শুনেই তো এলাম!
—তা আছে, যদি জায়গা পান দেখুন, তাছাড়া খাবার-দাবারেরও অসুবিধে হবে।
—আপনি যদি খাবার-দাবার পান, তাহলে আমরা পাবো না কেন?
—কিছু পাওয়া যায় না এখানে স্যার! জংলীদের জায়গা, মাছ নেই, দুধ নেই, মাংসও সপ্তাহে দু’একদিন—আপনারা একটু আনন্দ-টানন্দ করতে এসেছেন—
ওদের মধ্যে যার সবচেয়ে দীর্ঘ চেহারা, মাথার চুল কোঁকড়ানো, প্যান্টের পিছন পকেটে হাত, সে হা-হা করে হেসে উঠলো। বললো, কি করে বুঝলেন, আমরা আনন্দ করতে এসেছি? কলকাতায় কি আনন্দ কম?
আরেকজন এগিয়ে এলো, আপাতত আমরা অন্তত একটা আনন্দ পেতে চাই। এখানে চায়ের ব্যবস্থা-ট্যবস্থা আছে কোথাও?
স্টেশনমাস্টার বিমর্ষভাবে বললেন, স্টেশনে কিছু নেই, এ লাইনটাই এ রকম, একটু এগিয়ে—কলকাতার মতন রেস্টুরেন্ট অবশ্য পাবেন না, তবে বাজারের মধ্যে দু’একটা চায়ের দোকান—
—বাজার কত দূরে?
—কাছেই, ঐ তো—
প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে ওরা ওভারব্রীজে উঠলো। নরম সকালের হাওয়া আলগা ভাবে খেলা করে গেল ওদের চোখে মুখে চুলে, ছানার জলের মতন আলো চারিদিকে, ওভারব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে ওরা চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখলো। ডান দিকে যতদূর দেখা যায় ঢেউ খেলানো মাঠ ও ছোট ছোট টিলা, বহুদূরে আবছা একটা পাহাড়, বাঁ দিকে জঙ্গল শুরু হয়েছে, জঙ্গল কেটে চলে গেছে রেল লাইন—এইমাত্র ছেড়ে যাওয়া ট্রেনটা এখনো অস্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। নতুন জায়গায় ঢোকার আগে ওরা যেন ওভারব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখছে। সামনেই বাজার, গোটা তিরিশেক পাকা বাড়ি একটু দূরে দূরে ছড়ানো, তারপর এক পাশে মাঠ, এক পাশে জঙ্গল।
ওরা ঘুরে ঘুরে পুব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ চারিদিকেই দেখলো। আর বিশেষ কোনো বৈচিত্র্য নেই। একজন বললো, ধলভূমগড় নাম যখন, তখন একটু দুর্গ-টুর্গ থাকা তো উচিত। কোথায়, দেখতে তো পাচ্ছি না।
—জঙ্গলের মধ্যে ভাঙাচুরো কোথাও পড়ে আছে হয়তো।
মাথার ওপরের আকাশ গভীর সমুদ্রের মতন নীল। এক ছিটে মেঘ নেই। ওদের মধ্যে একজনের হাতে একটা পাকানো খবরের কাগজ ছিল, সে সেটা ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো, বিদায়।
তার পাশের জন বললো, এই সঞ্জয়, কাগজটা ফেললি কেন?
—ধুৎ! খবরের কাগজের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে চাই না।
—ফেরার সময় জুতো মুড়ে নিয়ে যাবার জন্য কাজে লাগতো।
—তখন দেখা যাবে। দে, সিগারেট দে।
খবরের কাগজটা হাওয়ায় দুলতে দুলতে নিচে লাইনের ওপর গিয়ে পড়ে ছড়িয়ে গেল। কি একটা কাপড় না সিগারেট কোম্পানির আধপাতা জোড়া বিজ্ঞাপনের ছবিতে স্যুট-টাই পরা একজন লোভী লোকের হাত একটি শালোয়ার কামিজ পরা খুকীর শরীর দোলাচ্ছে। ওভারব্রীজের রেলিং ধরে ঝুঁকে সেদিকে তাকিয়ে একজন বললো, সঞ্জয়, ঐ ছবির ওপর ঠিক টিপ করে থুতু ফেলতে পারবি?
—ছেলেটার মুখে না মেয়েটার মুখে?
—তুই ছেলেটার, আমি মেয়েটার।
হাওয়ায় থুতু উড়ে যাচ্ছে, সোজা নিচে পড়ছে না। বিজ্ঞাপনের ছবি অম্লানই রইলো। বিরক্ত হয়ে একজন জ্বলন্ত সিগারেটটা ছুঁড়ে মারলো। সেটাও কাগজের ওপর দিয়ে গড়িয়ে নিচে চলে গেল কোথায়।
সবচেয়ে লম্বা যুবকটি বললো, এই, কি ছেলেমানুষী করছিস! তাড়াতাড়ি চল, চা না খেয়ে পারছি না!
ওভারব্রীজ পেরিয়ে একটু দূরেই একটা বড় চাতাল। একটা বট গাছের নিচে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো অনেকখানি বেদি, সেখানে দশ-বারোটা আদিবাসী মেয়ে ঝুড়ি নিয়ে বসে আছে। তার ওপাশে কয়েকটা ছোট দোকান, ছোটখাটো বাজারের মতন। বাজারটায় যেন কোনো প্রাণ নেই, মানুষজনের ভিড়ে জমজমাট নয়। পটল ওজন করছে একটা লোক, কিন্তু কি রকম অলস তার ভঙ্গি, দুটো দিচ্ছে, তিনটে কমাচ্ছে, ওজন আর ঠিকই হয় না—তার সামনে দাঁড়ানো খদ্দেরটিরও যেন কোনো তাড়া নেই—সিনেমা দেখার মতন গভীর মনোযোগে দেখছে পটল মাপা। এক পাশে ডাঁই করা কতকগুলো কুমড়োর চূড়ার ওপর চুপটি করে বসে আছে একটা ঘেয়ো কুকুর।
মেয়েগুলো শুধু বসেছে আলাদা—এদের থেকে দূরে, পরিষ্কার উঁচু চাতালে। প্রত্যেকের কাঁখালে একটা করে ঝুড়ি, ঝুড়িতে করে কি বেচতে এসেছে তা দূর থেকে দেখা যায় না। কিন্তু ওদের সামনে কোনো খদ্দের দাঁড়িয়ে নেই। সঞ্জয় বললো, অসীম, দ্যাখ তো ওদের কাছে ডিম আছে নাকি? তা হলে কয়েকটা ডিম কিনে নে, চায়ের সঙ্গে খেতে হবে তো।
অসীম ও আরেকজন এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি রে, তোদের কাছে ডিম আছে! আণ্ডা?
পা ঝুলিয়ে বসা মেয়েগুলো এ-ওর গায়ে ঠেলা দিয়ে মুখ টিপে হাসলো, কেউ বা গ্রীবা সামান্য বেঁকিয়ে বাঁ দিকের কাঁধে মুখ গুঁজলো। কেউ কোনো উত্তর দিলো না।
—আণ্ডা মিলেগা? আণ্ডা হায় তুমরা পাশ?
মেয়েগুলো পূর্ববৎ তরঙ্গের মতন সবাই হাসিতে দুললো, পরস্পর গা ঠেলাঠেলি করলো, ওদের মধ্যে দু’একজন জলে ঘটি ডোবানোর মতন গুপ গুপ করে হাসলো, কিন্তু উত্তর দিলো না।
তখন পর্যন্ত ওরা ঐ মেয়েগুলো সম্পর্কে কোনোই ধারণা করে নেয়নি, নতুন জায়গায় এসে হাল্কা চোখে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক, কোনো ব্যস্ততা নেই। বাজারে ঢোকার আগে, এক কোণে বসা এই মেয়েগুলোকে চোখে পড়লো বলেই যেন কিছু জিনিস কেনার কথা মনে পড়েছে, জিনিসপত্র তো কিছু কিনতেই হবে—আর কিনতে হলে ময়লা ধুতি জড়ানো রুক্ষ দাড়িওলা দোকানিদের বদলে—এই হাসিখুশী সোমত্থ মেয়েগুলোর কাছ থেকেই কিছু কেনার কথা স্বাভাবিক ভাবেই ওদের মনে আসে। দাম হয়তো একটু বেশি নেবে, তা হোক, সঙ্গে তো বাতাস-খুশী করা হাসি দেবে! শহুরে ছেলে, সকালবেলা ডিম কেনার কথাই ওরা প্রথম ভেবেছে। ডিম না থাকে—মেয়েদের যে-কোনো সওদা, শিম বরবটি কিংবা আলু-পেঁয়াজ যাই হোক—তাও হয়তো কিনবে।
অসীমরা এগিয়ে এসে মেয়েগুলোর ঝুড়িতে উঁকি মারলো। কিছু নেই, ফাঁকা ঝুড়ি, সবারই ফাঁকা ঝুড়ি। ওরা একটু অবাক হলো। নীলপাড় শাড়ি পরা একটি কচি-মুখ মেয়েকে অসীম বললো, কি রে, সব ফুরিয়ে গেছে? ডিম-টিম নেই কারুর কাছে?
মেয়েটি ঝংকারময় গলায় বললো, ডিম নেই তো দেখতেই পেছিস! অ্যাঁ!
—কিছু নেই তো এখানে বসে আছিস কেন?
—বসে আছি, হাওয়া খেতে মন লয়! তুহার তাতে কি?
অসীম বললো, আরেঃ, এইটুকু লঙ্কার ঝাল তো কম নয়। দেখছি ঝগড়া করতে চাইছে। কী দোষ করলুম বাপু?—সে তার বন্ধুদের দিকে ফিরে বললো, আশ্চর্য ব্যাপার মাইরি, এতগুলো মেয়ে খালি ঝুড়ি নিয়ে এমনি এমনি সকালবেলা বসে আছে!
আশপাশের দু’চারজন লোক কৌতুহলী হয়ে ওদের দেখছিল টেরা চোখে, একটা হলুদ গেঞ্জি পরা ছোকরা ওদের দিকে ঘন হয়ে এসে শুনছিল ওদের কথা। সে বললো, উ মেয়েগুলো সব জন খাটে বাবু। ডিম বেচে না।
—জন খাটে মানে?
—রাজমিস্তিরির কাজে জোগান দেয়, ইঁট বয়।
—তা এখানে বসে আছে কেন?
—ইখানে বসে থাকে, যদি কারুর দরকার হয় তো ডেকে খাটাতে লিয়ে যায়।
—ও, বুঝলুম। তা এখানে আর প্রত্যেক দিন কী এত রাজমিস্তিরির কাজ হয় কে জানে। থাকগে, তোমাদের এখানে ডিম পাওয়া যাবে?
—ডিম তো মিলবে না আজ, সেই হাটবার, মঙ্গলবার।
—হাটবার ছাড়া আর ডিম পাওয়া যাবে না?
—যাবে, সে আপনার হোটেলে।
—ওঃ, হোটেলও আছে এখানে? আচ্ছা, রেস্ট হাউসটা কত দূরে?
—ওসব কিছু তো এখানে নাই বাবু।
—নেই মানে? আলবৎ আছে। ফরেস্ট রেস্ট হাউস।
—ফরেস্‌ট বাংলা? সে আপনার সেই দিকে, জঙ্গলে।
—ঠিক আছে, এখানে রিক্সা-টিক্সা পাওয়া যায়?
—আজ্ঞে না, রিক্সা ইদিকে কোথায় পাবেন, এসব জংলা জায়গা—বাবুরা তো কেউ আসে না তেমন, যারা আসে তারা মোটর আনে—
লোকটির নাম লখা, তাকে ওরা তল্পিদার হিসেবে নিযুক্ত করলো। লোকটির কাঁধে কিছু মোটঘাট চাপিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললল ওরা চারজন—সঞ্জয়, অসীম, শেখর এবং রবি। কাল রাত্তিরেই হয়তো বৃষ্টি হয়েছে, সরু রাস্তায় প্যাচপ্যাচ করছে কাদা, দু’পাশে কয়েকটা মুদির দোকান, সিমেন্ট সুরকির আড়ত, নোংরা ভাতের হোটেল, একটা সেলুনও আছে, সিগারেটের দোকানে ঝ্যান ঝ্যান করে রেডিও বাজছে।
একটা দোকান বেছে নিয়ে ওরা বাইরের বেঞ্চিতে বসে গরম জিলিপি আর সিঙ্গাড়ার সঙ্গে চা খেলো। গেলাসের চায়ে কী রকম কাঁঠাল কাঁঠাল গন্ধ, এঁটো শালপাতায় এসে বসেছে নীল রঙের ডুমোডুমো কাঁঠালে মাছি। দোকানের বাকি লোকরা নিজস্ব কথা বলা থামিয়ে ওদের দিকেই চেয়ে আছে। যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য তাদের সকলেরই মুখভঙ্গি ব্যগ্র। ওরা চারজন অন্য কোনোদিকেই মনোযোগ দিলো না, নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতে লাগলো, রেডিওর ফাটা আওয়াজটা খুবই বিরক্ত করছিল, অসীম উঠে দাঁড়িয়ে বললো, চল এগোই।
 
Back
Top