Collected আজ চিত্রার বিয়ে - হুমায়ূন আহমেদ

dukhopakhidukhopakhi is verified member.

Special Member
Registered
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
363
Messages
4,913
Reaction score
1,267
Points
3,863
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
আজ চিত্রার বিয়ে


হুমায়ূন আহমেদ






পর্ব - ১
আজ চিত্রাদের বাড়ির পরিস্থিতি খুবই অস্বাভাবিক। অথচ বাড়ির সবাই ভাব করছে যেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।
আজকের দিনটা আলাদা কোনো দিন না। অন্য আর দশটা দিনের মতোই। সবাই অভিনয় করে স্বাভাবিক থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। অভিনয় করে স্বাভাবিক থাকা বেশ কঠিন ব্যাপার।
চিত্রাদে বাড়ির কেউই অভিনয়ে তেমন পারদর্শী না। কাজেই বাড়ির সবাইকে খানিকটা অস্বাভাবিক লাগছে। সবচে অস্বাভাবিক লাগছে চিত্রার মা শায়লা বানুকে। সামান্য কোনো উত্তেজনার বিষয় হলেই তার প্যালপেটিশন হয়, কপাল ঘামতে থাকে, ঘন ঘন পানির পিপাসা পায়। এই তিনটিই এখন তার হচেছ। অথট ভাল করছেন কিছুই হয়েছে না। তার সামনে পিরিচে ঢাকা পানির গ্লাস। কিন্তু তিনি এখনো গ্লাসে চুমুক দেন নি।
তারা সবাই অপেক্ষা করছে একটা টেলিফোন-কলের অন্যে। চিত্রার মেজোখালা উত্তরা থেকে টেলিফোনটা করবেন। বিশেষ খবরটা দেবেন। ইয়েস অথবা নো।
চিত্রার বিয়ের আলাপ-আলোচনা চলছে। বরপক্ষের লোকজন দুই দফা মেয়ে দেখে গেছে। কিন্ত তাদের কথাবার্তা মোটেই স্পষ্ট না। হ্যাঁ-না বলা দূরে থাকুক, কোনো ইঙ্গিত পর্যন্ত দিচ্ছে না।
ছেলে সবার খুব পছন্দের। লম্বা, গায়ের রঙ বিলেতি সাহেবদের মতো। বাবা-মার একমাত্র ছেলে। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। ছেলের বাবার ঢাকা শহরেই তিনটা বাড়ি। তার চেয়েও আশ্চর্য কলা তাদের নাকি লন্ডনেও একটা বাড়ি আছে। ছুটি কাটাতে তারা যখন লন্ডন যায় তখন হোটেলে ওঠে না, নিজেদের বাড়িতে ওঠে। ছুটি কাটাতে সব সময় যে লন্ডন যায় তাও না। গত বছর গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। বড়লোকদের দুটা ভাগ আছে। এক ভাগ হলো সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া গ্রুপ। ছুটি ছাটায় এরা সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার বাইরে যেতে পারে না। আরেক ভাগ আমেরিকা-লন্ডন অপ। চিলার যার সঙ্গে বিয়ের কথা হচেই সে আমেরিকা-লন্ডন পের।
সেই তুলনায় চিত্রারা কিছুই না। ঢাকা শহরে তাদেরও একটা বাড়ি আছে। দোতলা ফাউন্ডেশনের একতলা বাড়ি। এই বাড়ির জুনো ব্যাংকে লোন আছে বিশ লাখ টাকা। প্রতি দুমাস পরে পরে ব্যাংক থেকে একটা চিঠি আসে। তখন চিত্রার মা শায়লা বানুর মুখ শুকিয়ে যায়। সংসার চালানো, ব্যাংকের লোন দেয়া, দুই মেয়ের পড়াশোনা সবই তার একার দেখতে হয়। চিত্রার বাবা চৌধুরী খলিলুর রহমান মোটেই সংসারী মানুয় না। তিনি এজি অফিসের বিল সেকশানের নিচের দিকের অফিসার। চাকরি শুরু করেছিলেন হেড এসিসটেন্ট হিসেবে। দুটা প্রমোশন পেতে তার কুড়ি বছর লেগেছে। অফিসে যাওয়া, অফিস থেকে ফেরা। মাঝে মধ্যে অফিস থেকে ফেরার পথে টুকটাক কাঁচাবাজার করা ছাড়া সংসারে তার কোনো ভূমিকা নেই।
শায়লা বানু সংসারের এই অবস্থাতেও মোটামুটি ভেলকি দেখিয়েছেন। যাত্রাবাড়িতে সাড়ে তিনকাঠা জমির উপর বাড়ি করেছেন। রাজমিস্ত্রি ডেকে বাড়ি বানিয়ে ফেলা না, রীতিমতো আর্কিটেক্ট দিয়ে ডিজাইন করে বাড়ি বানানো। বাড়ির অর্ধেকটা ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়ার টাকায় ব্যাংকের লোন শোধ দেয়া হচ্ছে। তিনি নিজে এনজিওতে একটা চাকরি যোগাড় করেছেন। সন্ধ্যার পর তাকে কাজে যেতে হয়। বয়স্কদের নিক্ষরতা দূর করার একটা প্রকল্পের তিনি শিক্ষিকা। এই চাকরিতেও তিনি খুব ভালো করছেন। শিক্ষিকা থেকে তিনি এখন হয়েছেন প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর। এনজিওর বেতন ভালো। বেতনের একটি টাকাতেও তিনি হাত না দিয়ে সংসার চালানোর চেষ্টা করেন। টাকাটা জমা হচ্ছে মেয়েদের বিয়ের খরচের জন্যে। তা ছাড়া এই বাড়ি তার দোতলা করা ইচ্ছা। দোতলা হয়ে গেলে পুরো একতলাটা তিনি কোনো এনজিওকে ভাড়া দিয়ে দেবেন। সে রকম কথাও হয়ে আছে।
তিনি যে অবস্থানে আছে। সেখান থেকে মেয়ের এত ভালো নিয়ে আশা করা ঠিক না। তিনি আশাও করেন নি। চিত্রা খুবই সুন্দরী মেয়ে, কিন্তু গায়ের রঙ ময়লা। বাংলাদেশে মেয়ের সৌন্দর্যবিচারে গায়ের রক্তের ভূমিকাই প্রধান। গায়ের রঙ ধরে শাদা হলে ট্যারা চোখের মেয়ে, ভালো করে তাকালে যার নাকের নিচে সূক্ষ্ম গো দেখা যায় তাকেও রূপবতী হিসেবে গণ্য করা হয়। শাশুড়ি পাড়া-প্রতিবেশীকে গুন আহ করে সৃষ্ট দেখাতে দেখাতে গোপন অহঙ্কার নিয়ে লেন আমার বউয়ের গায়ের রঙটা ময়লা, খুব শখ ছিল— রঙ দেখে বউ আনব। কি আর করা, সব শখ তো পূরণ হয় না।
শায়লা শানুর সব শখই মনে হয় পূরণ হতে যাচেছ। খুবই আশ্চর্যজনকভাবে আমেরিকা-লন্ডন গ্রুপের একনে পাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। চিত্র কার্জন হল থেকে যাছিল ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে। এর আগের দিন বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তায় পানি জমে আছে। সে সাবধানে ফুটপাত দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার পাশ শেষে একটা পাজেরো জিপ গেল এবং তাকে পানিতে-কাদায় মাখামাখি করে ফেলল। এরকম পরিস্থিতিতে গাড়ি কখনো দাঁড়ায় না। দ্রুত চোখের আড়াল হয়ে যায়। চিত্রার ব্যাপারে সেরকম হলো না। গাড়ি একটু সামনে গিয়েই ব্রেক কমে দাঁড়াল। গাড়ি যে চালাচ্ছিল সে নেমে এল (অত্যন্ত সুপুরুষ এক যুবক। গায়ের রঙ সাহেবদের মতো। উচ্চতা ছয় ফুট এক ইঞ্চি। পরনে মার্ক এন্ড স্পেনসার কোম্পানির গাঢ় নীল রেজার।) যে নেমে এল তার নাম আহসান খান। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। এই হলো যোগাযোগের সূত্র।
এই যোগাযোগের মধ্যেও ভাগ্যের একটা ব্যাপার আছে বলে শায়লা মনে করেন। বিয়ের ব্যাপারটা নাকি পূর্বনির্ধারিত। শায়লা শানুর ধারণা আল্লাহ ঠিক করে রেখেছেন এখানে বিয়ে হবে। সে-কারণেই চিত্রা কাদা-পানিতে মাখামাখি হয়েছে। তবে তিনি ঠিক ভরসাও পাচ্ছেন না। ছেলেপক্ষের মানুষরা, হা-না। মেয়ে পছন্দ হয়েছে, মেয়ে পছন্দ হয় নি এইসব কিছুই বলছে না। ছেলে মে খুব আগ্রহী তার আগ্রহেই বিয়ে হয়ে এরকমও মনে হচ্ছে না। ছেলে খুব আগ্রহী হলে টেলিফোন করত বা ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে চিত্রার খোঁজ করত। তাও করে নি। বরং পাত্র পক্ষের মধ্যে কেমন গা-ছাড়া গা-ছাড়া ভাব। মেয়ে দেখতে অনেক মিষ্টিটিষ্টি নিয়ে আসে এটাই নিয়ম। ওরা এনেছে একটা কে। সোনারগাঁও হোটেলের দামি কেন এটা সত্যি, তারপরেও তো কেক। বিশাল কোনো কেক না, চার পাউন্ডের কেক। চিলা যখন চা নিয়ে ওদের সামনে গেল তপন ছেলের মা হঠাৎ মোবাইল টেলিফোন নিয়ে অতি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। চিলার সঙ্গে কোনো কথা নেই— চিত্রার দিকে ভালো করে তাকালেনও না। কার সঙ্গে বিরাট গল্প জুড়ে দিলেন। টেলিফোনেই হাসাহাসি। এমন কোনো জরুরি টেলিফোন নিশ্চয়ই না। বয়স্ক একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন। তিনি ঘরে ঢোকার পর থেকে গভীর মনোযোগ দিয়ে টাইম পত্রিকা পড়া শুরু করলেন। পত্রিকা তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। চিলা তার সামনে চায়ের কাপ দিতেই তিনি বললেন, সরি আমি চা-কফি কিছুই খাই না। বলেই আবার টাইম। পড়া শুরু করলেন।
শায়লা বানু পর শাবারদাবারের আয়োজন করেছিলেন। গানের তৈরি পিঠা, চটপটি, সমুচা, পরোটা, মাংস, মিষ্টি, মলমূল। এত পাবার দেখে অন্তত অদ্রতা কনে বলা উচিত ছিল— এত আয়োজন। সেসব কিছুই না। ছেলের ছোটচাচা শুধু একটা পাটিসাপটার অর্ধেকটা নিলেন, হাত দিয়ে চাপ দিয়ে ভেতরের ক্ষীরটা বের কনের খোসার অর্ধেকটা গেলেন। ছেলের মা শুধুই এককাপ চা। চানোর কাপ হাতে নিয়ে দুটা চুমুক দিয়ে কাপ নামিয়ে রাখলেন এবং আবারও মোবাইল টেলিফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
চিত্রা সম্পর্কে শায়লা শানুর অনেক কিছুই বলার ছিল। কি কি বলবেন সব গুছিয়ে রেখেছিলেন। কথাগুলি এমনভাবে বললেন যেন মেয়ের বদনাম করা। হচ্ছে। আসলে বদনামের আড়ালে প্রশংসা। যেমন আমার মেমোটা খুবই খেয়ালি। তার খেয়ালির জন্যে মাঝে মাঝে এমন বিরক্ত লাগে। এস,এস,সি, পরীক্ষার দুদিন আগে হঠাৎ সে সব বইপত্র গুছিয়ে তুলে ফেলল আর পড়লে না। তার নাকি পড়া শেষ। আমি অনেক মাধমকি করলাম, রাগারাগি করলাম, কিছুতেই বই খুলবে না। বই দেখলেই তার নাকি বমি আসে। বললে বিশ্বাস করবেন না এক মাস পরীক্ষা চলল, এই এক মাস সে বই খুলল না। আমি তো ধরেই নিয়েছি এই মেয়ে পাস করবে না। রেজাল্ট বের হলে দেণি ছয়টা লেটার পেয়েছে। আর দশ-পনেরো নাম্বার পেলে পেস থাকত।অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন
পড়াশোনার এই অংশ বলা হবার পর–গানের ব্যাপারটা নিয়ে আসতেন। মুখে বিরক্তি নিয়ে বলতেন, মেয়েটার গানের গলা এত ভালো, কি গান করলে না। তার নাকি ভালো লাগে না। টিচার রেখে দিয়েছি। সপ্তাহে দুদিন আসে, সঙ্গে তবলটি আসে। সে রেয়াজ করবে না। গানের স্যারের সঙ্গে রাজ্যের পছন্ন। তলটির সঙ্গে গল্প। একদিন দেখি সে তবলচির কাছ থেকে তবলা বাজানো শিখছে। মেয়েমানুষ তবলা বাজাড়ে দেখতে কেমন লাগে বলুন তো! টিভিতে সেদিন গানের অডিশন দিতে যাবে, আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি সঙ্গে যাব। হঠাৎ সে বেঁকে বসল অডিশন দিতে যাবে না। তার নাকি ইচ্ছা করছে। শেষপর্যন্ত রাজি হলো, কি শর্ত দিয়ে দিল বাড়িতে কোনো মেহমান এলে আমি বলতে পারব না, চিত্রা-মা একটা গান শুনাতো। বলুন এই মেয়েকে নিয়ে আমি কী করি? শেষপর্যন্ত তার শর্তেই রাজি হলাম। প্রথম অডিশনেই পাস করল। সে এখন টিভিতে নজরুলগীতিতে এনলিস্টেড। প্রতি তিন মাসে একটা করে প্রোগ্রাম পায়। সেই প্রোগ্রামও সে মিস করে। গতবার প্রোগ্রামটা ইচ্ছা করে মিস করল। সেদিন তার বান্ধবীর জন্মদিন। সে টিভিতে যাবে না। বান্ধবীর জন্মদিনে যাবে। শিল্পকলা একাডেমি থেকে টার্কিতে একটা গানের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পেয়েছিল। সরকারি অনুষ্ঠান কৃত সম্মানের ব্যাপার। অথচ কিছুতেই
তাকে রাজি করাতে পারলাম না।
এই গলে শোনার পর ছেলেপক্ষের কেউ না কেউ অবশ্যই বললে, বাহ খুব। তো গুণী মেয়ে, দেণি একটা গান শুনি।
শায়লা বানু সেই ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন। তবলচি এনে রেখেছিলেন। সঙ্গে একজন বাঁশিবাদক। কোন গান চিত্র গাইবে সেটাও ঠিক করে অনেকবার করে গাওয়ানো হয়েছে—
পথ চলিতে যদি চকিতে
কভু দেখা হয় পরাণ প্রিয়।
শায়লা বানু মেয়ের গান শুনানোর কোনো সুযোগই পেলেন না। গুছিয়ে রাখা কোনো কথাই কেউ শুনল না। বরং তাকে অত্যন্ত অপমানসুচক একটা কথা শুনতে হলো। ছেলের মা বললেন, আপনাদের বাথরুমটা একটু ব্যবহার করব। বলেই একপা এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, বাথরুম পরিষ্কার আছে তো?
অপমান গারো লাগার কথা। শায়লা বানুর নিজের পরিষ্কারের বাতিক আছে। তাঁর বাড়ি তিনি ছবির মতো গুছিয়ে রাখেন। তাকে কি-না বলা বাথরুম পরিষ্কার আছে তো? ড্রয়িং রুমের সঙ্গের বাথরুমটা তিনি ঘষে ঘষে চকচকে করে রেখেছেন। বাথরুমের বেসিনের উপর ছোট টবে চার ধরনের অর্কিড রেখেছেন। বাথরুমে এয়ার ফ্রেসনার দিয়েছেন। তার ধারণা এই বাথরুম যত পরিস্কার ছেলেপক্ষীয়দের কোনো বাথরুম এত পরিষ্কার না।
শায়লা বানু সৌখিন মানুষ। তিনি তার বাড়ির সামনে গোলাপবাগান করেছেন। সেই বাগানে চল্লিশ ধরনের গোলাপ আছে। তিন রকমের বাগানবিলাস লাগানো হয়েছে। সেই গাছ বড় হয়ে বাড়ির ছাদ পর্যন্ত উঠেছে। বাড়ির সামনে একটা অংশ তিনি রেখেছেন রঙিন মাছের জন্যে। ছোয় টোবাকো, পাড়টা মার্বেল দিয়ে বাঁধানো। চৌবাচ্চায় কিছু রঙিন মাছ। এই মাছের জন্যে শায়লা বানুকে কম কষ্ট করতে হয় না। মাছের খাবার দিতে হয়, প্রতিদিন পানি পরিষ্কার করতে হয়। সন্ধ্যাবেলায় মাছগুলিকে চৌবাচ্চা থেকে তুলে জারে করে ঘরে নিয়ে আসতে হয়। এইসব ব্যাপারে বাড়ির কেউ যে তাকে সাহায্য করে না, বরং উল্টোটা করে। চিলার বাবা রাতের খাবার পর মাছের চৌবাচার পাশে বসে সিগারেট খান। এবং জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরা চৌবাচ্চায় ফেলেন। এই নিয়ে রাগারাগি কম হয় নি।আমার আশেপাশের সেরা রেস্টুরেন্ট
একা তিনি কতদিক সামলাবেন? মেয়ের বিয়ে যদি শেষপর্যন্ত ঠিক হয়ে যায়। তাহলেও বিপদ আছে। বিয়ের পুরো ব্যাপারটা তাকে একা সামাল দিতে হবে। ব্যাংকে টাকা যা আছে তাতে বিয়ের খরচ উঠবে না। টাকা ধার করতে হবে। সাভারে তিন কাঠার একটা প্লট কেনা আছে। সেটা বিক্রি করতে হবে। জমি বিক্রি কেনার চেয়ে অনেক কঠিন। এই কঠিন কাজটা তাকেই করতে হবে।
টেলিফোন বাজছে।
এটাই কি সেই বিশেষ টেলিফোন? শায়লা বানুর বুক ধক ধক করছে। তার হাতের কাছেই টেলিফোন, তিনি পরলেন না। অবহেলার ভঙ্গিতে বললেন, মীরা টেলিফোনটা ধর তো। মীরা তার দ্বিতীয় মেয়ে। এবার এস,এস,সি, দিয়েছে। তিনি মেয়ে ভাগ্যে ভাগ্যবতী। তার এই মেয়েটা রূপবতী। সবচে বড় কথা এর গায়ের রঙ ভালো। এর বিয়ে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতে হবে না। শায়লা বানু দুই মেয়ের কথা ভেবে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মেয়েরা তার বাবার রূপ পেয়েছে। মেয়েদের বাবা যৌবনে অসম্ভব রূপবান ছিলেন। শায়লা বানুর বাবা ছেলের রূপ দেখে মুখ হয়েছিলেন। শুধুমাত্র তার আগ্রহেই বিয়েটা হয়। শায়লার বিয়েতে মত ছিল না। বি.এ. পাস একটা ছেলে, চাকরি নেই। পরিবারের অবস্থা ভালো না। তার সঙ্গে কিসের বিয়ে? কিন্তু শায়লার বাবার এক কথা, আমি আমার জীবনে এত সুন্দর ছেলে দেখি নি। এই ছেলে হাত ছাড়া করা যাবে না। আমার পরিবারের রূপ নেই, এই ছেলে রূপ নিয়ে আসবে।ফ্যামিলি ট্যুর প্যাকেজ
শায়লার বাবা তার রূপবান জামাই-এর পরিণতি দেখে যেতে পারেন নি। শায়লার বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি মারা যান। মৃত্যুর সময় তার রূপবান জামাই পাশেই ছিল। অত্যন্ত সুপুরুষ একজন যুবক ছেলের দিকে তাকিয়ে তার আনন্দময় মৃত্যু হয় বলে শায়লার ধারণা।
শায়লা মীরার দিকে তাকিয়ে আছেন। মীরা টেলিফোনে কেমন যেন মাথা নিচু করে কথা বলছে। তার মুখ লালচে দেখাচ্ছে। ভালো লক্ষণ না। প্রেম-প্রেম খেলা না তো? সেরকম কিছু হলে শুরুতেই খেলা বন্ধ করতে হবে। শায়লা বললেন, কার টেলিফোন
মীরা হাত দিয়ে রিসিভার চেপে ধরে বললেন, আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে। কথা বলতে গিয়ে তার গলা কেপে গেল। চোখের দৃষ্টি নেমে গেল।
মেয়েটার নাম কী?
নাম ইতি।
ওদের বাসা কোথায়?
মগবাজারে।
বাবা কী করেন?
কাস্টমসে চাকরি করেন।
শায়লা বানু এতগুলি প্রশ্ন করলেন জানার জন্যে যে মীরা আসলেই কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে নাকি কোনো ছেলের সঙ্গে। ছেলের সঙ্গে কথা বললে এত দ্রুত প্রশ্নের জবাব দিতে পারত না। গণ্ডগোল করে ফেলত। সবচে ভালো হতো যদি তিনি বলতেন, দেখি টেলিফোনটা দে তো। আমি একটু ইতির সঙ্গে কুণা বলি। এটা করা ঠিক হবে না। বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। তবে তিনি যে প্রশ্নগুলি করেছেন সেগুলি কাজে লাগবে। দিন দশেক পর প্রশ্নগুলি আবার তিনি মীরাকে করবেন। ইতিদের বাসা কোথায়? ইতির বা কী করেন? ইতি বলে সত্যি যদি কেউ থেকে থাকে তাহলে মীরা ঠিকঠাক প্রশ্নের জবাব দেবে। আর ইতি কোনো বানানো বান্ধবী হলে উত্তর দিতে গিয়ে জট পাকিয়ে ফেললে।
মীরা টেলিফোনটা রাখ তো। জরুরি কল আসবে। লাইন বিজি রাখলে লল না।
মীরা লুট করে টেলিফোন রেখে গল্প থেকে বের হয়ে গেল। শায়লা বের হলেন। বাগানের ফুলগাছে পানি দেবেন। বাগানবিলাসে শুয়োপোকা হয়েছে। গাছে ওষুধ দেবেন। টেলিফোনটা এর মধ্যে চলে আসার কথা। এখনো আসছে
কেন বুঝতে পারছেন না। তাহলে কি ওরা না বলে দিয়েছে? বড় আপা লজ্জায় পড়ে দুঃসংবাদটা দিতেন না।
চিত্রা মাছের চৌবাচ্চায় কাছে বসে আছে। তাকে খুব একটা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে না। সে খুব আগ্রহএর সঙ্গে মাছ দেখছে। মা’কে বারান্দায় আসতে দেখেই চিত্রা বলল, মা তোমার জন্যে তিনটা দুঃসংবাদ আছে একটা ছোট, একটা মান্মারি এবং একটা বড়। কোন দুঃসংবাদটা আগে শুনতে চাও?
শায়লা বিরক্ত গলায় বললেন, যা বলার সহজ-স্বাভাবিকভাবে বলবি। পেঁচিয়ে কথা বলবি না। ছোট-বড়-মাঝারি দুঃসংবাদ আবার কী?
মেজাজ খারাপ কেন মা?
মেজাজ খারাপ না, পেচানো কথা শুনলেই আমার রাগ লাগে।
মেজাজ খারাপ থাকলে নরমাল কথা শুনলেও রাগ লাগে। আর যদি মেজাজ ভালো থাকে তাহলে পেঁচানো কথা শুনলেও মনে হয় বাহু সাধারণ কথাকেই মেয়েটা কি সুন্দর করে পেঁচিয়ে বলছে। আমার মেয়ে পাচকুমারী। যা-ই হোক দুঃসংবাদগুলি মানের ক্রমানুসানে বলছি। সবচে কম দুঃসংবাদ হলো— মাছের চৌবাচ্চায় ভুটা সিগারেটের টুকরা ভাসছে। তার চেয়েও হাইডোজের দুঃসংবাদ হচ্ছে—একটা মাছ মরে ভেসে উঠেছে। এখন শোনো সবচেয়ে খারাপ দুঃসংবাদটা। সবচে খারাপ সংবাদ হলো— চিত্র কথা বলা বন্ধ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।
বলে ফেল। চুপ করে আছিস কেন?
দুঃসংবাদ আস্তে আস্তে দিতে হয় এই জন্যে চুপ করে আছি। যা-ই হোক বলে ফেলি— বড়খালা বিয়ের যে খবরটা দেবেন বলেছেন সেই খবরটা হলো— না। ওরা তোমার বড়মেয়ের ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড না। সোনারগাঁও হোটেল থেকে আনা চার পাউন্ডের কেকের টাকাটা ওদের পানিতে গেছে।
তুই কী করে জানলি?
যেভাবেই হোক জেনেছি। বড়খালা দুপুরেই খবর পেয়েছেন, খবরটা দিতে তার কষ্ট লাগতে বলে এখনো দিচ্ছেন না।
তুই কখন জেনেছিস?
আমিও তখনই জেনেছি।
কিভাবে জেনেছিস?
চিত্রা হাসিমুখে বলল, মা তুমি ভুলে গেছ যে আমার একটা মোবাইল টেলিফোন আছে।
তোকে কে থর দিয়েছে?
কে দিয়েছে এটা মোটেই ইম্পর্টেন্ট না। খবরটা কি সেটা ইম্পর্টেন্ট। মা শোনো, মরা মাছটা এখন কী করবে?
শায়লা তিক্ত গলায় বললেন, মরা মাছু আমি কি করব মানে? মরা মাছ মানুষ। কী করে?
চিত্রা বলল, রান্না করে খায়, এইটুকু জানি। এই মাছ তুমি নিশ্চয়ই রান্না লবে না।
চিত্র তুই ঢং করছিস কেন? তোর ঢংটা তো আমি বুঝতে পারছি না। বরপক্ষের ওরা না করেছে, তার জন্যে তোকে ঢং করতে হবে কেন?
তুমি খুবই মন খারাপ করে আছ তোমার মন খারাপ ভাবটা কমানোর অনন্য করছি।
শায়লা পানির ঝাড়ি হাতে নিয়ে গাছে পানি দিতে গেলেন। তার রীতিমতো কান্না পাচ্ছে। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন এই বিয়েটা হবে। বিয়ের পর মেয়েসামাই হানিমুন করতে চলে যাবে ইউরোপে। মানুষকে এই খবরটা দেয়াতেও তো আনন্দ। দুলী-দুঃখী মুখ করে বলা— মনটা খুব খারাপ। মেয়ে-জামাই হানিমুন করতে ইউরোপ যাচ্ছে। সুইজারল্যান্ডে হানিমুন করবে সেখান থেকে ফ্রান্স আর ইতালি হয়ে দেশে ফিরবে। মেয়েটাকে এতদিন দেখা না ভেবেই কেমন যেন লাগছে। আমি ওদের বললাম, তোরা দেশে হানিমুন কর। দেশে কত সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে সেখানে যা, কক্সবাজার যা, টেকনাফ যা, কুয়াকাটা মা। সমুদ্র ভালো না লাগলে রাঙ্গামাটি যাঁ, জাফলং যা। দুজনের মধ্যে ভালোবাসা থাকলে চাঁদপুরও যা সিঙ্গাপুরও তা। এইসব কিছুই বলা যাবে না। সাধারণ কোনো একটা ছেলের সঙ্গে চিত্রার বিয়ে হবে। যে নতুন বউকে নিয়ে রিকশায় শ্বশুর বাড়িতে আসবে। রিকশা ভাড়া কমানোর জন্যে রিকশাওয়ালার সঙ্গে চেঁচামেচি করবে।আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার
চিত্রা মার দিকে তাকিয়ে বলল, মা শুধু-শুধু গাছে পানি দিচ্ছে। আকাশে কি রকম মেঘ করেছে দেখ। এক্ষুণি বৃষ্টি নামবে।
শায়লা জবাব দিলেন না। চিত্রা বলল, মা আমার একটা অনুরোধ রণিবে? প্লিজ। স্কলারশিপের পনেরোশ টাকা আমার কাছে আছে। চল সবাই মিলে বাইরে খেতে যাই। ফুর্তি করে আমি। তুমি মুখ ভোতা করে আছ দেখতে অসহ্য লাগছে।
আমার মাথা ধরেছে আমি কোথাও যাব না।
চিত্রা বলল, মা শোনে ওরা তিনবার করে আমাকে দেখে গিয়ে জানিয়েছে মেয়ে পছন্দ হয় নি। আমি কি পরিমাণ অপমানিত হয়েছি তুমি বুঝতে পারছ না? তুমি মনখারাপ করে অমাৱ অপমানটা আরো বাড়াচ্ছে। হাতমুখ ধুয়ে একটা ভালো শাড়ি পরে চল যাই হৈচৈ করে আসি।
বললাম তো আমার মাথা ধরেছে। তা ছাড়া চাইনিজ-ফুড আমার ভালোও লাগে না।
যাবে না?
না।
চিত্রা চিন্তিত গলায় বলল, মা আরো একটা দুঃসংবাদ আছে। তোমার মাছদের মধ্যে মড়ক লেগেছে, আরেকটা মাছ মারা গেছে। দাড়িওয়ালা একটা গোল্ডফিশ ছিল না। ঐ টা।
বৃষ্টির ফোটা পড়তে শুরু করেছে। এখনো শায়ালা গাছে পানি দিচ্ছেন। ঘরে টেলিফোন বাজছে শায়লার তাতে কোনো ভাবান্তর হচ্ছে না। অথচ কিছুক্ষণ আগেই টেলিফোনের শব্দ শুনলেই চমকে উঠছিলেন। মীরা বারান্দায় এসে অবাক হয়ে বলল, মা তুমি বৃষ্টির মধ্যে গাছে পানি দিচ্ছে কেন? শায়লা পানির ঝাঝরি নামিয়ে রাখলেন।
মীরা বলল, বড়খালা টেলিফোন করেছেন। তোমাকে চাচ্ছেন।
 
Back
Top