পাঠকের মৃত্যু – বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়

dukhopakhi

Well-Known Member
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
115
Messages
1,101
Reaction score
134
Points
1,213
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
পাঠকের মৃত্যু

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়​






প্রায় দশ বৎসর আগেকার কথা।

আসানসোল স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় বসিয়াছিলাম। ঠিক আমার পাশেই আর একজন বসিয়াছিলেন। তাঁহার হাতে একখানি বই ছিল। বেশ মোটা একখানি উপন্যাস। আলাপ-পরিচয় হইলে জানিতে পারিলাম যে ভদ্রলোককে ট্রেনের জন্য সমস্ত দিন অপেক্ষা করিতে হইবে।

আমার ট্রেনের সময় ঘন্টা- তিনেক দেরি ছিল।
আমরা উভয়েই বাঙালি।



সুতরাং পাঁচ মিনিট পরেই তাঁহাকে যে প্রশ্নটি আমি করিলাম তাহা এই– “আপনার বইখানা একবার দেখতে পারি কি?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখুন না…”

এই উত্তরই স্বাভাবিক এবং আশাও করিলাম।
অবিলম্বে বইখানা দখল করিয়া বসিলাম।
দু:সহ গ্রীষ্মের দারুণ দ্বিপ্রহর।
আসানসোল স্টেশনের টিনের ছাদ।
সমস্ত কিছু তলাইয়া গেল।
উপন্যাস অদ্ভুত।

বহির মালিক ভদ্রলোক আড়-নয়নে একবার আমার পানে চাহিয়া একটু ভুরু কুঞ্চিত করিলেন এবং একটি টাইম-টেবিল বাহির করিয়া তাহাতেই মনোনিবেশ করিলেন।
আমি রুদ্ধশ্বাসে পড়িয়া চলিলাম।


চমৎকার বই।
বস্তুুত এমন ভালো উপন্যাস আমি ইতোপূর্বে পড়ি নাই।
একেবারে যেন জুড়াইয়া দিতেছে।


দুই ঘন্টা কাটিল।
বহির মালিক ভদ্রলোক টাইম টেবিলটি বারংবার উল্টাইয়া অবশেষে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন-
“আপনার ট্রেনের তো আর বেশি দেরি নেই। এইবার…”
বলিয়া একটু গলা খাঁকারি দিলেন।

আমি তখন তন্ময় ।

চকিতে একবার হাত ঘঁড়িটার পানে চাহিয়া দেখিলাম। এখনও ঘন্টাখানেক সময় বাকি আছে। বই কিন্তু অর্ধেকের উপর বাকি। বাক্যব্যয় করিয়া সময় নষ্ট করিলাম না। গোগ্রাসে গিলিতে লাগিলাম।

অদ্ভুত বই।
বাকি ঘন্টাটা যেন উড়িয়া গেল।
আমার ট্রেনের ঘন্টা পড়িল।
বই এর তখনও অনেক বাকি।
রোখ চড়িয়া গিয়াছিল।

বলিলাম “নেকস্ট ট্রেনে যাব… এ বই শেষ না করে উঠছি না!” বহির মালিক ভদ্রলোক একটু একটু কাশিয়া নির্বাক হইয়া রহিলেন। ট্রেন চলিয়া গেল বই পড়িতে লাগিলাম।
শেষ কিন্তু করিতে পারি নাই।


শেষের দিকে অনেকগুলি পাতা ছিল না।
বহির মালিককে বলিলাম…


“এহ, শেষের দিকে এতগুলো পাতা নেই। আগে বলেননি কেন? ছি ছি…”
এতদুত্তরে ভদ্রলোক কেবল নিষ্পলকনেত্রে আমার দিকে চাহিয়া রহিলেন। দেখিলাম তাঁহার রগের শিরাগুলি স্ফীত হইয়া উঠিয়াছে।

দশ বৎসর পর উক্ত পুস্তকখানি আর একবার আমার হস্তগত হইয়াছিল।
আমার ভাগিনেয়ীর শ্বশুরায়লে।

তাহাকে পৌঁছাইতে গিয়াছিলাম। সেইদিনই ফিরিয়া আসার কথা। কিন্তু বইখানির লোভে থাকিয়া গেলাম।
সুযোগমত বইখানি সংগ্রহ করিয়া আবার সাগ্রহে পড়া শুরু করা গেল। খাপছাড়াভাবে শেষটুকু না পড়িয়া গোড়া হইতেই জমাইয়া পড়িব ঠিক করিলাম।

কয়েক পাতা পড়িয়াই কেমন যেন খটকা লাগিল।

উল্টাইয়া দেখিলাম হ্যা, সেই বই ই তো!

আবার কয়েক পাতা অগ্রসর হইলাম নাহ, কেমন যেন গোলমাল ঠেকিতেছে।
তবু পড়িতে লাগিলাম।

কিছুক্ষণ পরে মনে হইল নাহ, আর তো চলে না।
এ কি সেই বই যাহা আমি আসানসোল স্টেশনে দারুণ গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহরে ঊর্ধ্বশ্বাসে তন্ময় হইয়া পড়িয়াছিলাম?

এমন রাবিশ মানুষে লেখে!
এ শেষ করা তো অসম্ভব!

দশ বৎসর আগেকার সেই উৎসুক পাঠক কবে মারা গিয়াছিল টেরও পাই নাই।
এবারও বই শেষ হইল না।
 
Back
Top