- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 115
- Messages
- 1,101
- Reaction score
- 134
- Points
- 1,213
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
*****সভ্যতার অগ্রগতি*****
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
ফেনী রেলষ্টেশনে গত এক ঘণ্টা যাবত বসে আছি । না কোনো ট্রেন ধরার জন্য বসে নাই । বসে আছি রেলের এক কর্মকর্তার অপেক্ষায় । টিকিটিং সিস্টেমের নতুন টার্মিনাল বসাবার জন্য কিছু ওয়্যারিং করাতে হবে । যদিও আমাদের কাজ কিন্তু করাতে হবে রেলের লোক দিয়েই । আমি ঐসময়ে কুমিল্লা থাকার কারনে অফিস আমাকেই দায়িত্ব দিলো । সকালের ট্রেনে ফেনী এসেছি । এখন প্রায় এগারোটা বাজে । রেল কর্মকর্তা ওমর সাহেব কখন অফিসে আসবে কেউ জানে না । এখন কোনো ট্রেন নাই । বুকিং ক্লার্করা চা-সিগারেট সহযোগে আড্ডায় ব্যস্ত, প্লাটফর্মে একটা মাদী কুকুর তিনটা বাচ্চাসহ শুয়ে আছে, স্টেশনের বাইরে একমাত্র রিক্সার গদীতে বসে রিক্সাওয়ালা মনের সুখে সিগারেট টানছে...চারিদিকে কেমন সুন্দর অলসতা, স্থিরতা । কিন্তু এসব দেখেও মনে স্থিরতার বদলে কেমন বিরক্তি দানা বেঁধে উঠছে...
“কে...কে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে ?” বলতে বলতে একজন ছোট-খাটো মধ্যবয়স্ক মানুষ ষ্টেশনে আসেন ।
-জ্বি, আমি । চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের নাম পরিচয় দেই । আসার কারণটাও বলি ।
“আসো ভিতরে এসে বসো ।“ খেয়াল করি উনি আমাকে তুমি করে বলছেন । আমার সাধারন সমস্যা । দৈহিক গড়নই মূল কারন । মোটা-তাজা হবার জন্য ইউরিয়া সার বাদে বাকী সব কিছু চেষ্টা করেছি । লাভ হয় নাই । চেহারায় একটু ভারিক্কি আনার জন্য মাঝখানে সপ্তাহ দুয়েক গোফ রাখার চেষ্টা করেছিলাম । ফলাফল আরো করুন । লালমাটিয়ার আড়ং এর সামনে দাঁড়িয়ে রিক্সা খুজছি । হঠাৎ এক সুন্দরী মহিলা এসে বললেন ‘এই একটা রিক্সা ধরে দেও না ।‘ এর পরের দিনের ঘটনা আরো করুন । থাক এসব । নিজের অপমানের কথা এত ঢাক-ঢোল বাজিয়ে না বলাই ভালো ।
ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওমর সাহেবের সামনের চেয়ারে বসলাম ।
“তোমার কাজের জন্যতো ইলেক্ট্রিশিয়ান লাগবে । এখন পাবো কিনা কে জানে । এই শহীদ...” বলে একজনকে ডাক দিয়ে ইলেক্ট্রিশিয়ানের খোজে পাঠান ওমর সাহেব । দুজনের জন্য চায়ের কথাও বলেন । চা আসে । ওমর সাহেব আলাপ শুরু করেন । প্রাথমিক বিরক্তিটা দ্রুত কেটে যায় । দিলখোলা মানুষ ওমর সাহেব । রাজশাহী বাড়ী । কথা বলেন বেশ মজা করে ...
“বুঝলা এইখানে পানিশমেন্ট পোস্টিঙে আছি । মনে হয় বছরখানেক থাকতে হবে । সরকারী চাকুরীর এ,বি,সি ভুলে গেছিলাম তাই এই অবস্থা । এ,বি,সি কি জানোতো ?”
-জ্বি না । আমি ছোট করে উত্তর দেই ।
“এ তে হইলো অ্যাভয়েড । কাজ আসলেই চেষ্টা করবা অ্যাভয়েড করতে । বি তে হইলো গিয়া বাইপাস । বাইপাশ মানে কি বুঝছো ?” আমি উত্তর দেবার আগেই ওমর সাহেব আবার বলা শুরু করেন...
“পাস আর বাইপাসের মধ্যে কিন্তু ফারাক আছে । পাস দিলে তোমারে আবার ব্যাক পাস দিতে পারে । তাই কাজ এমনভাবে বাইপাস করবা যাতে তোমার কাছে আর ফিরা না আসে ।“
-সি তে কি ? আমি আবার ছোট করে জিজ্ঞেস করি ।
“কাজ অ্যাভয়েড কিংবা বাইপাস করতে পারো নাই । তাইলে কি করবা জানো । একটা কমিটি কইরা ফালাইবা । সি তে হইলো কমিটি । কাজ খারাপ ভালো যাই হোক তোমাকে যেনো কেউ দায়ী করতে না পারে । দায় সব কমিটির । এই এ,বি,সি থিওরী মেনে অনেকদিন ভালো ছিলাম । ভুতে কিলাইছিলো তাই কিছু কাজ করতে গিয়েছিলাম । ফলাফল পানিশমেন্ট পোস্টিং ।“ এভাবেই কথা চলতে থাকে । আমার বেশ ভালো লাগে । একটু পরেই শহীদ এসে জানায় ইলেক্ট্রিশিয়ান আজ ছুটিতে ।
“তোমাকেতো তাহলে আর একদিন আসতে হবে । ফিরবে কিভাবে ?”
-প্লান ছিলোতো কাজ শেষ করে বিকেলের ট্রেনে ফিরে যাবো । এখনতো আর কিছু করার নাই । দেখি বাসেই ফিরে যাবো ।
“বিকেলের ট্রেনেই ফিরো । চলো বাসায় যাইয়া আড্ডা দেই । এইখানে অল্প কিছুদিন এসেছি । তোমার সাথে আড্ডা দিতে ভালোই লাগবে ।“
-আজ থাক । অন্য আর একদিন যাবো । আমি আপত্তি করার চেষ্টা করি ।
“এত ফর্মালিটি করো কেন মিয়া । তাছাড়া এখান থেকে বাস স্ট্যান্ড গিয়ে বাসে উঠে যতক্ষণে ফিরবে তার আগেই ট্রেনে ফিরতে পারবা ।“
অতএব ওমর ভাইয়ের বাসায় যেতেই হয় । ষ্টেশন থেকে কাছেই বাসা । দরজা যিনি খোলেন তিনি যে ওমর ভাইয়ের স্ত্রী সেটা বোঝাই যায় । ভদ্রমহিলা এককালে অনেক সুন্দরী ছিলেন সেটা বোঝা যায় । এখনও যথেস্ট সুন্দরী...এতটাই যে ওমর ভাইকে তার পাশে বেমানানই লাগে । ওমর ভাই পরিচয় করিয়ে দেন ।
“সানু ভাত দেও তাড়াতাড়ি । “ ওমর ভাই বলেন ।
-ভাই আড্ডা দিতে এসেছি । খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ঝামেলা কেনো । আমি আপত্তি করি ।
‘ছোট ভাই তোমাদের বাসায় দুপুর বেলায় কেউ গেলে কি খেতে বলো না । আর এই মানুষটার সাথে এইসব ফর্মালিটি করে লাভ নাই । কি চিজ জানো নাতো ?’ সানু ভাবী হাসতে হাসতে বলেন ।
“আর তুমি খুব ভালো । আমাকে প্রথম দিনে কি বলেছিলে বলব ছোট ভাইকে ।“ ওমর ভাই পাল্টা উত্তর দেন ।
‘খবরদার । ছেলেটার সাথে আজকেই পরিচয় । কি ভাববে ?’
“ভাবাভাবির ধার আমি কি কোনোদিন ধারছি । শোনো ছোট ভাই । ভালো ফুটবল খেলতাম । মাঝে মাঝেই এখানে সেখানে খ্যাপ খেলতে যেতাম । খ্যাপ খেলা কি জানোতো ?”
-জ্বি জানি ।
“একদিন অন্য এক পাড়ায় খ্যাপ খেলতে গিয়ে দেখি পাশের এক দোতলা বাসার বারান্দায় এক আসমানের পরী দাড়াইয়া খেলা দেখতাছে । কি আর খেলা । একটু পর পর আসমানের পরীর দিকেই খালি চোখ যায় । দুই গোল খাওয়ার পরে একজন আইসা বললো ঠিক মতো না খেললে পা দুটো নিয়া কিন্তু বাসায় যাইতে পারবা না । একটা গোল দিয়েই বারান্দায় চোখ । দেখি পরী আনন্দে হাততালি দিচ্ছে । আমারে আর পায় কে । হ্যাট্রিক করলাম । এক সপ্তাহ ঐ পাড়ায় ঘোরাঘুরি করলাম । কিন্তু আমার অত ধৈর্য নাই । একদিন কলেজে যাবার রাস্তায় ঠিকই মুখোমুখি হলাম । ভালো লাগার কথা বলতেই কি বললো শুনবা ?“
-কি ?
“একটা হরলিক্স এর কৌটা কিনা বাসায় যান । নিয়মিত হরলিক্স খেয়ে বড় হয়ে তারপর দেখা করবেন ।“
‘কি করবো অতটুকু একটা মানুষ । তখন মুখটাও ছিলো বাচ্চা বাচ্চা ।‘ ভাবী হাসতে হাসতে বললেন ।
‘হইসে এখন হাতমুখ ধুয়ে আসো ।‘ ভাবী তাড়া দেন । আমার খুব খুব ভালো লাগে এই স্বল্প পরিচিত যুগলকে । মনেই হয় না মাত্র অল্প কিছুক্ষণ আগে এদের সাথে পরিচয় হয়েছে ।
খেতে বসে আরো মজার মজার কথা বলতে থাকেন ওমর ভাই । মাঝে মাঝে ভাবীও খুনশুটি মুলক কথা-বার্তা বলতে থাকেন ।
-ভাই ভাবীকে কিভাবে রাজী করালেন সেটাতো বললেন না । আমি জিজ্ঞেস করি ।
‘খবরদার । এইসব নিয়া আর আলাপের দরকার নাই ।‘ ভাবী বাধা দেন ।
“পোলাপান মানুষ শুনতে চাইছে । অসুবিধা কি ?“
‘অসুবিধা আছে । শোনো ছোট ভাই । ঘটনা বিশেষ কিছু না, আমিওতো মানুষ, মায়া দয়া আমারোতো আছে ।‘ ভাবী হাসতে হাসতে বলেন ।
“ঠিক আছে তাহলে আমাদের বিয়ের গল্প বলি ।“
-আচ্ছা । বিয়ের গল্পই বলেন । কিভাবে প্রস্তাব পাঠালেন । আমি আবার জিজ্ঞেস করি ।
“তুমি যে এত বোকা এইটা বুঝতে পারি নাই ।“
-কেনো ভাই ?
“আমার খোমা দেইখাও যে মনে করে আমি প্রস্তাব করবো আর সানুর বাবা-মা খুশী মনে আমার সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবে, সে বোকা নাতো কে বোকা ?”
-তাহলে ?
“আরে ভাইগা যাইয়া বিয়ে করেছি । এক বন্ধুদের আমবাগান আছে চাপাইনবাবগঞ্জ । বিয়ে করে বউ নিয়ে গেলাম সেই আমবাগানে । আমবাগানের পাশেই ছোট একটা বাড়ী । আমের মৌসুমে এক-দুইজন লোক থাকে এখানে । তখন শীতকাল । বাড়ীতে কেউ নাই । আমাদের দুজনকে রেখে বন্ধুরা রাজশাহী ফিরে গেলো । কথা হলো দুইদিন পরে আবার আসবে আমাদের বাসা আর সানুদের বাসার খবর নিয়ে । খাবার ভালোই রেখে গেলো । কিন্তু খেয়াল করি নাই যে দুইটা পাতলা কাথা ছাড়া তেমন গরম কোনো গরম কাপড় নাই ঘরে । উত্তরবঙ্গে খুব ঠান্ডা পরে । বিশেষ করে রাতে । মানুষজন বাসর জাগে গল্প করতে করতে । আমরা ঠাণ্ডায় ঠক ঠক করতে করতে রাত জাগলাম । দুইদিন পরে বন্ধুরা এলো আরো দুঃসংবাদ নিয়ে । সানুর বাবা নাকি মহা খেপেছে । থানা-পুলিশ করে একাকার । বন্ধুরা পরামর্শ দিলো বর্ডার পাড়ি দিয়ে ইন্ডিয়া গিয়ে কিছুদিন থাকতে । হাতে দুইহাজার টাকা দিয়ে বর্ডার পার করে দিলো বন্ধুরা । প্রথম তিন-চার দিন ভালোই গেলো । তারপরেই শুরু হলো অর্থকষ্ট । এমনও দিন গেছে সারাদিন শুধু দুইটা লুচি পরাটা আর সবজির তরকা খেয়ে দিন কাটাইছি । একজন আর একজনকে বলতাম ‘দেখেছো ইন্ডিয়ার আলো বাতাসে মনে হয় কিছু আছে । একদম ক্ষুধা লাগে না ।‘ কিযে কষ্ট ...“ মুখে কষ্টের কথা বলছেন অথচ ওমর ভাই সানু ভাবী দুজনের চোখে মুখেই কি অদ্ভুত সুখের ছায়া । ইসসস সবাই যে কেনো এই কষ্ট পায় না ...
সেদিন ফিরে আসলাম । পরেরদিন রেলের ফোনে ওমর ভাই জানালেন ইলেক্ট্রিশিয়ান পরের সপ্তাহে আসবে । আরো অনেকক্ষণ গল্প করলেন । পরের সপ্তাহে গেলাম । ইলেক্ট্রিশিয়ান ফরিদকে নিয়ে ওমর ভাই প্রস্তুত ছিলেন । ফরিদকে কাজ বুঝাইয়া দিলাম । নিজেও কিছু কাজ করলাম । বিকেলে ফেরার আগে ওমর ভাইয়ের বাসায় আধা ঘণ্টা সময় কাটালাম । আগের মতই খুব ভালো লাগলো ।
পরেরদিন আবার গেলাম । কাজ শেষ হয়ে যাবার কথা । কিন্তু সুইচ অন করতেই ইউ,পি,এসের পিছন থেকে ধোয়া বের হলো । ইলেক্ট্রিশিয়ান ফরিদ কোথাও শর্ট সার্কিট করে রেখেছে । ভাগ্য ভালো ইউ,পি,এস এর ফিউজটা জ্বলে যাওয়াতে আর কোনো ক্ষতি হয় নাই । ওমর ভাই ফরিদকে ডাকলেন ।
“এইটা কি কাজ করলা । জানো এখনই লাখ টাকার ক্ষতি হতে পারতো ।“ ওমর ভাই রাগতস্বরে বলেন ।
‘স্যার আমার কোনো দোষ নাই । এইটা আগের ইলেক্ট্রিশিয়ান দেলোয়ারের ভুল । আসেন স্যার দেখাই ।‘ ফরিদ বলে ।
“ভুল হয় মানুষের । আর যে ভুলটা অন্যের ঘাড়ে চাপাইয়া দিতে পারে তাকে কি বলে জানো? অফিসার । তুমিতো বিরাট অফিসার হইয়া গেছো ফরিদ । যাও এই স্যারের সাথে যাইয়া কাজটা শেষ করো ।“ বেশ রাগী গলায় বলেন ওমর ভাই । ফরিদও আর তেমন কথা বাড়ায় না । পুরোনো ওয়্যারিং অনেকখানি আবার নতুন করে শুরু করতে হয় । সেদিন আবার ট্রেন লেট করে দুই ঘণ্টা । তাই ওমর ভাইয়ের বাসায় বেশ কিছুটা সময় কাটে । আলাপের এক পর্যায়ে ভাবী বলেন
‘ওমরের গান শুনেছো ?’
-নাতো ।
“তোমার পকেটে যথেস্ট টাকা পয়সা আছেতো ?” ওমর ভাই পরিহাসসুরে জিজ্ঞাসা করেন ।
-কেনো ? আমি জিজ্ঞেস করি ।
“দুনিয়ায় দুই ধরনের শিল্পী আছে । একদলকে টাকা দিয়ে গান গাওয়াতে হয়, আর একদলকে টাকা দিয়ে গান থামাতে হয় ।“ স্বভাবসুলভ ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলেন ওমর ভাই । কিন্তু যখন হারমোনিয়ামটা নিয়ে গান শুরু করেন আমি স্তব্দ হয়ে যাই । এত সুন্দর গলার গান আমি অনেক অনেক দিন শুনি নাই । দুই তিনটা গানের পরেই আমি বলি ...
-ভাই । আপনার গানের গলা অসাধারন । গানটাকে সিরিয়াসলি নেন ।
“আরে রাখো, তোমার ভাবীর পীড়াপীড়িতে রেডিওতে দুইবার অডিশন দিছিলাম । দুইবারই ফেল । তোমার ভাবীকে মুগ্ধ করার জন্য গান শিখেছিলাম । সে মুগ্ধ হইলেই হবে...”
দুইদিন পরেই আবার যাই । সব ঠিকঠাক থাকলে এখানে আর আসতে হবে না । এবার সব ঠিকই থাকে । খুব তাড়াতাড়িই সব কাজ শেষ হয়ে যায় । ওমর ভাই আগেই বলে রেখেছিলেন আজকে তার বাসায় খেতে হবে । যথারীতি আড্ডা দিতে দিতে খাওয়া চলে ।
‘ছোটভাই আজমির শরীফ যাবো । আমাদের জন্য একটু দোয়া কোরো ।‘ হঠাৎ কথার মাঝখানে সানু ভাবী বলেন ।
‘ষোলো বছর বিয়ে হলো এখনো আমাদের কোনো সন্তান নাই।‘
“তুমি আবার কি শুরু করলা । সন্তান না হলে কি সুখী হওয়া যায় না । “ ওমর ভাই বাধা দেবার চেষ্টা করেন ।
‘সত্যি ছোটভাই, একজন মানুষ জীবনে যা পেতে পারে তা প্রায় সবই আমি পেয়েছি । বিয়ের পরে আত্মীয়-স্বজন বন্ধুরা অনেকে জিজ্ঞেস করেছে -কি দেখে আমি ওমরকে বিয়ে করলাম । এখন আর কেউ করে না । সবাই জানে আমি কি পেয়েছি । কিন্তু এখন যখন ওর আত্মীয়স্বজনরা সন্তানের প্রসঙ্গ তোলে তখন আমার খুব কষ্ট হয় । ওমর অবশ্য কখনোই পাত্তা দেয় না । কিন্তু আমার খুব কষ্ট হয় । এক জীবনে এত ভালোবাসা পেয়েছি ... শুধু একটা সন্তান’ ...কথা শেষ করতে পারেন না সানু ভাবী । গলা ধরে আসে । ওমর ভাই এটা সেটা বলে পরিবেশ স্বাভাবিক করেন ।
কিছুক্ষণ পরে আবার ষ্টেশনে আসি ফিরতি ট্রেন ধরার জন্য । ওমর ভাইও সাথে আসেন । ষ্টেশনে ঢোকার মুখেই মানুষের জটলা দেখি । বয়স্ক এক ভদ্রলোক বেশ উত্তেজিতভাবে এক মহিলার হাত ধরে আছেন । মহিলার পোশাক চুল সব অবিন্যস্ত ।
‘আপনারা যাই বলেন । আমি একে পুলিশে দেবো । এইসব মহিলা আসলে পাগল সেজে বাচ্চা চুরি করে ।‘ ওমর ভাই ভিড়ের মাঝে এগিয়ে যান । ভদ্রলোককে কি বলে বোঝালেন শুনতে পারি না । কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসলে জিজ্ঞেস করি
-কি ঘটনা ওমর ভাই ।
“ঘটনা তেমন জটিল কিছু না । এই পাগলী রাস্তাঘাটে থাকে । কয়েকবছর আগে পাগলী প্রেগন্যান্ট হয়ে যায় । এলাকার মুরুব্বীরা প্রথমবার এবরেশান করে । কিছুদিন পরে পাগলী আবার প্রেগন্যান্ট হয় । বারবার ঝামেলার চাইতে এইবার পাগলীর লাইগেশন করানো হয় । সেই থেকে পাগলী বাচ্চা পোলাপান দেখলেই কোলে নিয়ে দৌড় দেয় । দেখলাইতো আমার বউ বাচ্চা-বাচ্চা করে কি পাগল আর এইখানে এই পাগলী । সবই এই নিষ্ঠুর দুনিয়ার খেলা ।“ উদাসভাবে বলেন ওমর ভাই ।
ট্রেনের জানালায় বসে আমার হঠাৎ একটা ছবির কথা মনে হয় । আমজাদ হোসেনের “কাল সকালে” । মূল গল্পটাই গ্রামের এমন এক পাগলীকে নিয়ে । পাগলী গর্ভবর্তী হলে গ্রামের বিচারে সাব্যস্ত হয় পরেরদিন সকালে পাগলী অনাগত সন্তানের পিতা হিসাবে যার নাম বলবে সেই হবে দোষী । এরপরে রাতের আধারে গ্রামের মাতবর আসে টাকা পয়সা গয়না নিয়ে । এরপর একে একে আসে স্কুল মাস্টার, মসজিদের ইমামসহ আরো গন্যমান্য লোকেরা । সবাই সাথে করে টাকা গয়না নিয়ে আসে । পাগলীকে সবার একই অনুরোধ ‘তুই আমার নামটা বলিস না ।‘
আর যাই হোক স্টেশনের এই পাগলীকে নিয়ে এমন সমস্যা হবার কোনো সম্ভাবনা নাই । মানুষ-সমাজ-সভ্যতা যে এগিয়ে গেছে তাতে আমার কোনোই সন্দেহ থাকে না ...