হামিদ চাচা ইয়াকুব আর দাবা

dukhopakhi

Well-Known Member
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
115
Messages
1,101
Reaction score
134
Points
1,213
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
*****হামিদ চাচা ইয়াকুব আর দাবা*****

মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু





দাবা খেলায় আমার গুরুর নাম আব্দুল হামিদ চাচা । তখন সপ্তম শ্রেনীতে পড়ি । থাকি ঢাকার মহাখালী টিবি গেইট এলাকার এক গলিতে । চুয়াল্লিশ ফুট লম্বা আর সাড়ে চার ফুট চওড়া গলি । গলির মাথায় রাস্তা । সেই রাস্তায় হামিদ চাচার গম ভাঙ্গানোর দোকান । তৎকালের পারিবারিক শ্রমবিভাগ অনুসারে আমি তখন রেশনের দায়িত্বে । রেশন তোলা, গম ভাঙ্গিয়ে আটা করা এসবই দায়িত্বের মধ্যে পরে । ওহহো মধ্যম আয়ের বাংলাদেশে রেশন কি তাওতো একটু বলা দরকার ।

রেশন হলো স্বল্পমূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যর দোকান । সরকার পরিচালিত । ঐ সময়ের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্তের বিশাল সহায় ছিলো রেশন কার্ড । রেশনের চালটা খুব খারাপ থাকতো তাই কেনা হতো না । তবে গম, চিনি, তেল কিনতাম । রেশনের গম ভাঙ্গিয়ে আটা, আটা থেকে আটার রুটি ...আমাদের মত পরিবারে যা ছিলো প্রতিদিনের সকালের নাস্তা । মাঝে মাঝে রাতেও রুটি খেতাম । তবে সেটা ছিলো ‘সদাভঙ্গুর মধ্যবিত্ত মর্যাদার’ জন্য হানিকর । তাই রাতে রুটি খেলেও বাইরে বলার নিয়ম ছিলো না ।

হামিদ চাচার ছিলো গম ভাঙ্গানোর দোকান । লাইন করে গমের ব্যাগগুলো রাখা হতো । একজনের গম ভাঙ্গানো হলে আর একজনেরটা মেশিনের উপরের দিকের চোঙ্গায় ঢেলে দেওয়া হতো । ভাঙ্গানো হলে টাকা দিতে হতো ওজন অনুসারে । চাচা ছিলেন একহারা লম্বা মানুষ । মাথার কোঁকড়ানো চুলগুলো সব সময় কেমন ধুসর মনে হতো...আটার কারনে । খুব পান খেতেন । হাসলে তাই সাদা দাতের সাথে লাল মাড়িও দেখা যেতো । দোকানটা প্রয়োজনের চাইতে অনেক বড় ছিলো । একদিকে এক বড় বেঞ্চ ছিলো । সেখানেই নিয়মিত দাবা খেলা হতো । তিন চারজন ছিলো খুব ভালো খেলোয়াড় । ইদ্রিস আলী নামে একজনতো তখন জাতীয় জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন ছিলেন । অনেক পরে জানতে পারি হামিদ চাচাও প্রথম বিভাগ দাবা লীগে খেলেছেন এবং একবার নিয়াজ মোরশেদকেও হারিয়েছিলেন ।

গমের ব্যাগটা লাইনে দিয়ে খেলা দেখতাম । কাজের ফাকে ফাকে হামিদ চাচাও আসতেন বেঞ্চের পাশে । ফুর্তিবাজ চাচার মুখে থাকতো মজার মজার ছড়া ...
আটার রুটি কলের পানি
রাত পোহালেই টানাটানি
দুই মনি বস্তা
চেয়্যারম্যানের নাস্তা
কিংবা উচু গলায় মজার গান ...
আগে যদি জানতাম বন্ধু তুমি হইবা পর
উস্টা দিয়া কইতাম তোরে দূরে গিয়া মর ।
আমার বেশ ভালো লাগতো এসব । একদিন দোকানে গিয়ে দেখি দাবার বোর্ডটা সাজানো কিন্তু কোনো খেলোয়াড় নাই । আমি দোকানে ঢুকতেই হামিদ চাচা বলেন “পিচ্চি খেলবি নাকি ?” আমি খুশীমনে রাজী হয়ে যাই ।

“তোরেতো প্রায়ই দেখি খেলা দেখতে । ৬৪ ঘরের এই খেলা কিন্তু অত সোজা না । অনেক কিছু জানতে হয় ।“ এভাবেই হামিদ চাচার কাছে আমার দাবা খেলার শিক্ষা শুরু হয় । খুব শীঘ্রই জেনে যাই দাবার পরিভাষা ... সৈন্যকে পন, হাতিকে বিশপ, ঘোড়াকে নাইট, নৌকাকে রুখ ইত্যাদি । এই সময়ে একটা ছোট দুর্ঘটনা আমার দাবা শেখার সহায়ক হয় । আমাদের ফুটবল খেলার বল ছয় নাম্বার বাসের চাকার তলে পরে । চাদা তুলে আর একটা বল কিনতে সময় লাগবে । তাই বিকেলে ফুটবল খেলার বদলে চাচার দোকানে দাবা খেলি । বিকেলে সাধারনত অন্য খেলোয়াড়রা আসেন না । আমার মত মনোযোগী উৎসাহী খেলোয়াড় পেয়ে চাচাও খুশী মনেই শিখান । সাথে স্বভাবসুলভ মজার মজার কথা বলেন ।
“বুঝছস দাবা খেলাটা অনেকটা জীবনের মত...দুনিয়ার মত । ওপেনিং ভালো না হইলে জেতা খুব কঠিন । আবার এই দেখ সারা খেলাটা হইলো একটা অপদার্থ রাজাকে বাচাবার জন্য । দুনিয়াতেও দেখবি একই নিয়ম । একটা রাজা আর একটা সৈন্যর পার্থক্য কি জানোস ? রাজা ডানে-বামে কিংবা পিছনে পালাইতে পারে । দুনিয়াতেও দেখবি রাজারা শুধু পিছনে পালাইতেই ওস্তাদ...।“ খেলার মাঝে মাঝে এইসব কথাগুলোও আমার খুব ভালো লাগে ।

উৎসাহ বাড়তে থাকে । টিফিনের পয়সা বাচিয়ে রানী হামিদের ‘মজার খেলা দাবা’ বইটা কিনে ফেলি । রুই লোপেজ, সিসিলিয়ান, ইংলিশ, কারোকান ডিফেন্সসহ গোটা দশেক অপেনিং শিখে ফেলি । হামিদ চাচা একদিন কয়েকটা রাশিয়ান দাবার ম্যাগাজিন দিলেন । অনেক সময় ব্যয় করি ম্যাগাজিনগুলো নিয়ে । মধ্য গেমের হিসাবনিকাশও মোটামুটি বুঝে যাই ।

“এত শিখলি এখনোতো আমাকে একবারও হারাতে পারলি না । আজকে যদি হারাইতে পারোস তরে এক কেজি জিলাপী খাওয়ামু ।“ এক বিকেলে চাচার দোকানে ঢুকতেই চাচা বলেন । খেলা শুরু করি । সাদা নিয়ে নতুন শেখা ইংলিশ ওপেনিং দিয়ে শুরু করি । খেলার মাঝখানে হঠাৎ হামিদ চাচা তার ঘোড়াকে আমার এক সৈন্যর কোনাকুনি স্থানে চাল দিলেন । চাচা প্রায়ই এরকম করেন । দাবার ভাষায় যাকে বলে স্যাক্রিফাইস । আগে না বুজেই খেয়ে ফেলতাম এবং কয়েক চাল পরেই হেরে যেতাম । আজকে হিসাব করা শুরু করলাম । পনের মিনিট হিসাব করে দেখলাম ঘোড়া স্যাক্রিফাইসের মূল কারন আসলে চার চাল পরে আমার মন্ত্রী খাওয়া । তবে আমার কালো হাতির একটা চাল মন্ত্রীকেতো বাচাবেই উল্টা তার রাজা বিপদে পড়ে যাবে । হিসাব করে তাই দিলাম এবং দেখলাম আমার হিসাব একেবারে নির্ভুল । খেলা দ্রুত শেষের দিকে চলে গেলো । ততক্ষণে আরো দুইজন নিয়মিত খেলোয়াড় উপস্থিত । আমি ভীষণ উত্তেজিত । অপর পাশে চাচা নির্বিকারভাবে মিটিমিটি হাসছেন । একটু পরেই জিতে গেলাম । চাচা এক কেজি জিলাপী কিনে আনলেন । অনেক লোক ততক্ষণে জুটে গেছে । আমার ভাগ্যে বেশী জিলাপী জুটলো না । অবশ্য জিলাপী আমি খুব পছন্দও করি না । যদিও জুমার নামাজের পরে সুবোধ বালকের মত মসজিদে বসে থাকি মিলাদ এবং মিলাদ শেষে জিলাপীর ঠোঙ্গার আশায় ।

সেই শুরু । স্কুল-পাড়া-মহল্লায় ভালো দাবা খেলোয়াড় হিসাবে একটু নাম ডাক হয় । ব্যস অতটুকুই । বড় পরিসরেও চেষ্টা করি বেশ কয়েকবার । প্রতিবারই ব্যর্থ । কারন হামিদ চাচার ভাষায় “সিলি মিস টক “...অর্বাচীন ভুল । আরো পরে বুঝতে পারি সমগ্র জীবনটাই আসলে “সিলি মিস্টেক-টকের” সমষ্টি মাত্র । সবার কথা বলছি না ...শুধুই নিজের কথা বলছি ।

আরো অনেক অনেক পরে আবার কিছুদিন নিয়মিত দাবা খেলা হয় । হঠাৎ জোমাক নামে এক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী পাই । জোমাক হলো আসলে সাউথ আফ্রিকার ইন্টারটোল, ইংল্যান্ডের স্যার ওয়েন উইলিয়ামস আর বাংলাদেশের আব্দুল মোনেম লিমিটেডের এর সমন্বয়ে এক যৌথ প্রতিষ্ঠান । যমুনা ব্রিজ রক্ষণাবেক্ষণের কাজ পায় পাঁচ বছরের জন্য । জোমাকের সিংহভাগ অংশীদার ছিলো ইন্টারটোল । তাই তারাই ছিলো মূল ব্যবস্থাপনায় । যমুনা ব্রিজ সংলগ্ন ভুয়াপুরে অফিস । থাকি এখন যেটা যমুনা রিসোর্ট সেখানে । বাড়ী গাড়ী সবই অফিসের খরচায় । এসব মাত্রাধিক্য সুযোগ সুবিধাই ঢাকার বাইরে এই চাকুরী নেবার মূল কারন । আমি যোগদান করার এক সপ্তাহ পরেই ফটোকপি মেশিনের সামনে এক দীর্ঘদেহী সাদা চামড়ার লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি । কাছে যেতেই গম্ভীর মুখে বলেন
“আমার নাম গ্যাভিন ক্যাসন । আমি একজন সাউথ আফ্রিকান ডাম্বো (বোকা) । জানোতো সাউথ আফ্রিকান ডাম্বো কি করে ?“
আমি মাথা নেড়ে জানাই, জানি না ।
“সাউথ আফ্রিকান ডাম্বো ফটোকপি করার পরে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে কোথাও বানানের ভুল আছে নাকি । আমি এখন তাই করছি ।“ কৌতুকটার চাইতেও বলার ভঙ্গিটা চমৎকার লাগে । আমি হেসে ফেলি ।
“তোমাকে হাসতে হবে না । আমি তোমার বস না । ঐ গল্পটা জানোতো –
বসের কৌতুক শুনে প্রতিদিন সবাই হাসে । সব চাইতে বেশী হাসে এক তরুন । কিন্তু সেইদিন তরুন একেবারেই হাসল না । বসসহ সবাই বেশ অবাক । ‘তোমার শরীর ভালো আছেতো’ বস উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞেস করে । ‘জ্বি স্যার শরীর ভালো আছে । তবে কাল থেকে আমি আর এই চাকুরী করছি না তাই আমার আর হাসারও দরকার নাই ।‘ “ গম্ভীরভাবে বলে গ্যাভিন ।

এভাবেই প্রথম গ্যাভিনের সাথে পরিচয় হয় । চমৎকার হাসিখুশি মানুষ । পরবর্তীতে গ্যাভিনের স্ত্রী মার্টিনের সাথেও পরিচয় হয়...আমার, আমার স্ত্রীর । খুব সহজেই পারিবারিক বন্ধুত্ব তৈরী হয় গ্যাভিন পরিবারের সাথে । যে বন্ধুত্ব এতদিন পরেও অটুট আছে । গ্যাভিনের মাধ্যমেই সাউথ আফ্রিকা সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা হয় । সাউথ আফ্রিকার নিরাপত্তা নিয়ে যে গল্পগুলি শোনা হয় সেগুলি রীতিমত ভীতিকর । সাউথ-আফ্রিকার সাদা-কালো দ্বন্ধের কথা জানতাম । গ্যাভিনের মাধ্যমে জানি সাদা-সাদা দ্বন্ধের কথা । ডাচ বংশোদ্ভুত আফ্রিকানাস সাদা আর ব্রিটিশ বংশোদ্ভুত ইংলিশ সাদার দ্বন্ধ । দুই বছর পরে সুদুর বাংলাদেশেও এই দুই সাদার দ্বন্ধ দেখার দুর্ভাগ্য হয় । সে গল্প আর একদিন হবে ।

চমৎকার নিরিবিলি পরিবেশ । রাতেরবেলা দূর থেকে আলো ঝলমল ব্রিজটাকে বিয়ে বাড়ী বলে ভুল হয় । যেখানে থাকি সেখানে সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট ...সব কিছুই খুব বেশী সুন্দর । আমার আর স্ত্রীর খুব খুব ভালো লাগে । সমস্যা একটাই অফিসের পরে করার খুব বেশী কিছু নাই । সামান্য কেনাকাটা করতে হলেও হয় পচিশ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইল অথবা ত্রিশ কিলোমিটার দূরে সিরাজগঞ্জ যেতে হয় । এইরকম সময়েই একদিন গ্যাভিন দাবার কোর্ট খুলে বসে । অল্প কিছুক্ষণ খেলার পরেই বুঝতে পারি গ্যাভিন তেমন ভালো খেলোয়াড় না । প্রচুর ভুল করেও দেখি আমিই জিতে যাই এমনকি গুরুর শেখানো “নো ক্যাস্লিং নো উইনিং“ তত্ত্বকে ভুল প্রমান করে ক্যাস্লিং না করেও জিতি । গ্যাভিনের কোনো পরদাদার পরদাদা রবার্ট ব্রুস ছিলো কিনা জানি না, তবে প্রায় প্রতিদিনই গ্যাভিন নতুন উদ্যমে খেলা শুরু করে । ফলাফল একই ।

এভাবেই দিন যায় । বয়সের কারনেই হোক কিংবা নিছক সময় কাটাবার জন্যই হোক আমার কাজের বাইরেও আরো অনেক কাজের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি । একসময় খেয়াল করি কম্পিউটার সিস্টেমের বাইরে গোটা ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের সাথেই আমি কাজ করছি । কেরোবীন আর মোশাররফ নামে খুব দক্ষ দুইজন ইলেক্ট্রিশিয়ান ছিলো । বিশেষ করে কেরোবীন । যেকোনো কাজ একটু বুঝিয়ে দিলেই কেরোবীন নিখুত দক্ষতার সাথে করে ফেলতো । গ্যাভিনের সাথে দাবা খেলার সময় মাঝে মাঝেই কেরোবীন বিভিন্ন কাজে আসে । মাঝে মাঝে একটু খেলাও দেখে ।
“স্যার আমাদের এলাকায় ইয়াকুব নামে এক লোক আছে । তাকে গত পাঁচ বছর দাবা খেলায় কেউ হারাতে পারে নাই । আপনার কথা তাকে বলছি । একদিন খেলবেন নাকি স্যার ।“ অফিসে একদিন কেরোবীন বলে ।
-তাই নাকি । এক বন্ধের দিন নিয়ে এসো । খেলবো । আমি ছোট করে উত্তর দেই ।

পরের শুক্রবারেই বিকেলের দিকে কেরোবীন আসে ইয়াকুবকে নিয়ে । ছোট-খাটো মানুষ ইয়াকুব । ভাঙ্গা গাল, দড়ি পাকানো শরীর, ক্রমশ দৃশ্যমান টাক একেবারেই সাধারন চেহারা ইয়াকুবের । তবে চোখ দুটো এই সাধারন মুখে ঠিক মানানসই না । চোখে সুরমা দেওয়া কারন সেটা না । ঐ সময়ে অনেকেই চোখে সুরমা দিতো । ভাসা, ভাসা নিখুত চোখ...কবিরা যাকে বলে স্বপ্নময় চোখ । ইঞ্জিনিয়ারিং মেস ছুটির দিন একেবারে ফাঁকা থাকে । সেখানেই খেলা শুরু করি ।

সাদা নিয়ে আমি হাতির সামনের সৈন্য দুই ঘর আগে দিয়ে প্রথম চাল দেই । বিপরীতে ইয়াকুব ঘোড়ার সামনের সৈন্য এক ঘর আগে দেয় । তখনি বুঝে যাই ইয়াকুব আসলে খেলার অনেক কিছুই জানে না... অন্তত ওপেনিং জানে না । এই দুর্বল শুরুর জন্যই নয় দশ চাল পরেই আমি একটা সৈন্য জিতে নেই । কিন্তু খেলা যত গড়াতে থাকে ততই ইয়াকুব দুর্দান্ত সব চাল দিতে থাকে । কোনো বিচিত্র কারনে আমিও সেইদিন নিখুত খেলতে থাকি । খেলার মাঝপথে দুই হাতি আর এক নৌকা দিয়ে এক অসাধারন ফাদ পাতে ইয়াকুব । অন্য যেকোন দিন হলে আমার চোখে এই ফাদের সব দিক চোখে পড়তো না । কিন্তু সেইদিন সব কিছু পরিষ্কার দেখতে পাই । এমনকি ফাদের মাঝে ছোট একটা খুতও চোখে পরে । সেই খুতকে কাজে লাগিয়ে কয়েক চাল পরেই আরো একটা সৈন্য জিতে নেই । যেহেতু দুইটা সৈন্য বেশী তাই আমি খুব দ্রুত কাটাকাটি করে শেষ খেলার দিকে যেতে চাই । ইয়াকুব চেষ্টা করে ঠেকাবার । কিন্তু আমি তখন অপ্রতিরোধ্য । সময় যত যায় ইয়াকুব কেমন অস্থির আচরন করতে থাকে । প্রথমে মাথার চুল জোরে জোরে টানা পরে নিজের গালে নিজেই চড় দেয়া । এতটাই বেশী যে এক পর্যায়ে আমি জিজ্ঞেস করি - আপনি ঠিক আছেনতো ইয়াকুব ।
“জ্বি স্যার । “ বলেই কেমন লজ্জা পায় ইয়াকুব । কিছুক্ষণ পরেই জিতে যাই । শেষ চালের পরে তাকিয়ে দেখি ইয়াকুবের চোখ কেমন উদভ্রান্ত । স্বপ্নময় চোখের কিনারে সামান্য পানিও মনে হয় দেখতে পাই । একটু অবাক লাগে ।
“স্যার আর একটা গেম খেলি ।“ গলায় অনেক মিনতি নিয়ে বলে ইয়াকুব । আমারও ইচ্ছা করে । কিন্তু সেইদিন বাসায় ঢাকা থেকে মেহমান আসবে । তাই ইচ্ছা থাকলেও আর খেলতে পারি না ।

পরের সপ্তাহে অফিসে আসা যাবার পথে দুইদিন ইয়াকুবকে রাস্তায় দেখি । একদিন আমাদের হাউজিং এর গেটেও দেখি । ব্যস্ততার জন্য তেমন পাত্তা দেই না । কিন্তু একদিন কেরোবীন আসে আমার অফিসরুমে ।
“স্যার আপনার কাছে হারার পর ইয়াকুবতো প্রায় পাগল হইয়া গেছে ।“
-কি বলো । এইটাতো সামান্য একটা খেলা । আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি ।
“মানুষটা এমনিতেও ভাদাইম্মা । দাবা খেলা ছাড়া কিছুই করে না । বাপ-দাদার জমি-জমা বেচতে বেচতে প্রায় শেষ । একটা বউ ছিলো সেইটাও দেড় বছর আগে চইলা গেছে । না যাইয়া করবো কি এইরকম ভাদাইম্মার সাথে কি সংসার করা যায় ।“
-আমিতো মনে হয় গতকালও আমাদের হাউজিং এর গেটে ওকে দেখলাম ।
“মনে হয় আপনার সাথে খেলার জন্য ঘুরতাছে । আজব লোক । “ কেরোবীন এর সাথে কথা শুনে কেমন মায়া লাগে ইয়াকুবের জন্য । পরের শনিবার যখন ইয়াকুবকে গেটে দেখি তখন গাড়ি থামাই । দুই একটা কথা বলার চেষ্টা করি । এক দুই শব্দের বেশী বলে না ইয়াকুব । অগত্যা আবার খেলতেই বসি । সেইদিন দুইটা গেম খেলি । দুইটাতেই দুর্বল ওপেনিং হয় ইয়াকুবের । কিন্তু তাও আমি দুইটাতেই হারি । প্রথমটাতে খেলার মাঝপথে আমার সেই বিখ্যাত ‘সিলি মিস্টেকে’ একটা হাতি হারাই । তারপরে আর খেলা বাচাবার প্রশ্নই ওঠে না । তবে দ্বিতীয় গেমে নৌকা বিসর্জন দিয়ে এমন চমৎকার একটা খেলা খেললো ইয়াকুব...আমার মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না ।

এর পরের সপ্তাহে আবার খেলি এবং আবার হারি । পরে আর খেলা হয় না । নির্জনতার কোলাহলে আমি,বউ দুজনেই তখন একটু ক্লান্ত । সুযোগ পেলেই ঢাকা চলে যাই । এছাড়া অফিসেও ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনেক কাজের সাথে জড়িয়ে গেছি ।

প্রায় এক মাস পরে ইয়াকুবের সাথে দেখা হয় স্থানীয় বাজারে । সাধারনত এই বাজারে আমি আসি না । সেইদিন খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় গেলাম । দেখি বিশাল এক বাঘৈর মাছ নিয়ে ইয়াকুব বসে আছে । বাঘৈর মাছটা শুধু যমুনা নদীতেই পাওয়া যায় । মাছের গায়ে বাঘের মত ছোপ ছোপ দাগ বলেই মনে হয় নাম বাঘৈর । স্বাদ অন্যরকম...বেশ ভালো । দাম জিজ্ঞেস করলাম । ইয়াকুব আমাকে মাছটা এমনিতেই দিয়ে দিতে চাইলো । অনেক জোর করেই দাম দিলাম ।
“ঠিক আছে স্যার, দামতো দিলেন । চলেন এক কাপ চা খাবেন । এইবার না করতে পারবেন না ।“ অতএব ইয়াকুবের সাথে এক টঙয়ের দোকানে বসি ।
-তুমি কি মাছ ধরো ? আমি জিজ্ঞেস করি ।
“আগেতো স্যার কিছু করতাম না । এখন একটু শুরু করছি ।“
-ভালো, কাজ করাতো ভালো ।
“স্যার আগে ভাবতাম সব চাইতে বুদ্ধির খেলা যে দাবা সেইখানে আমাকে কেউ হারাইতে পারে না । আমিতো তাইলে অন্যরকম মানুষ...কিন্তু...আপনি...“
-ভালো মাছ পাইলে হাউজিং এর গেটে দিয়া যাইও । আমিতো সব সময় এই বাজারে আসি না । ইয়াকুবের কথার মাঝখানেই আমি প্রসঙ্গ বদলাই ।
“ঠিক আছে স্যার । কাজ করি কিন্তু স্যার সংসারে কেউ নাই । বিয়া করছিলাম টিকে নাই । জমিলা আমারে ছাড়তো না । হের ভাইয়ারে হেরে জোর কইরা অন্য জায়গায় বিয়া দিলো ।“ আমি কিছু বলি না...বলার থাকে না । চা শেষ করে মাছ নিয়ে বাসায় আসি ।

পরের সপ্তাহেই অফিস থেকে ফেরার পথে গেটে ইয়াকুবকে দেখে গাড়ি থামাই ।
-কি ব্যাপার ইয়াকুব । কোনো মাছ নিয়ে এসেছো নাকি ?
“জ্বি না স্যার ।“
-আমিতো আজ দাবা খেলতে পারবো না ।
“জ্বি না স্যার, খেলতে আসি নাই...একটা কথা ছিলো স্যার...” ইয়াকুব কথা শেষ করতে পারে না । এর মাঝেই ওয়াকি টকিতে জানতে পারি পশ্চিম টোল প্লাজার সিসিটিভি সিস্টেমে সমস্যা হয়েছে ।
-আর একদিন এসো ইয়াকুব । তোমার কথা শুনবো ।
“ঠিক আছে স্যার । আমার জন্য দোয়া করবেন ।“ বলেই একটু অপ্রত্যাশিত ভাবেই আমাকে জড়িয়ে ধরে । আমি আবার গাড়ি ঘুরিয়ে পশ্চিম টোল প্লাজার দিকে যাই ।

দুইদিন পরে কেরোবীন এর সাথে ওয়ার্কশপে দেখা হয় ।
“স্যার ইয়াকুব কি করছে শুনছেন ?”
-কি করেছে ।
“বউটারতো আর এক জায়গায় বিয়া হইছিলো । সেইখানে একটা বাচ্চাও হইছে । সেই বউরে বাচ্চা সহ নিয়া গত পরশুদিন রাতে ভাগছে । ওরমতো একটা ভাদাইম্মা এইরকম কাজ করবে...বউটার কি আক্কল তাও কেউ বুঝতাছে না । এইরকম একটা লোকের সাথে কেউ ভাগে ।“

গত পরশুদিন বিকালেই যে ইয়াকুবের সাথে দেখা হয়েছিলো তা আর কেরোবীনকে বলি না । ইয়াকুব কি কথা বলতে এসেছিলো তাও আর কোনোদিন জানা হয় না । দাবা খেলায় সামান্য এক হার গোটা এক মানুষকেই কি বদলাতে পারে...সম্ভব ?? বুদ্ধির খেলায় ভালো ইয়াকুব জীবনের খেলায়ও কিছু করবে সেই আশাই করি... দুর্বল ওপেনিং সত্ত্বেও ।
 
Back
Top