- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 115
- Messages
- 1,101
- Reaction score
- 134
- Points
- 1,213
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
*****ছাইরঙা দুনিয়ার ছাইরঙা মানুষ*****
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
ছুটির দিনে এই মেসে মাঝে মাঝেই আসি । বাসা থেকে সামান্য দুরে হলেও হেটেই আসা যায় । এই মেসে আসার সুত্র হলো হাবিব ভাই । কানাডিয়ান সিডার তিন মাসের এক প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় । দারুন মজার মানুষ । পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির শারীরিক খর্বতা অনায়াসে জয় করেছেন প্রানচাঞ্চল্য আর মনের উদারতা দিয়ে । কিছু কিছু মানুষ আছে না যারা যেখানেই যান কেমন যেন একরাশ উচ্ছ্বাস, আনন্দ নিয়ে যান, যার কারনে রামগরুড়ের ছানাও হাসতে বাধ্য হয় হাবিব ভাই ঠিক সেরকম একজন মানুষ ।
মেসে ঢুকতে ঢুকতে শুনি মান্না দের গান বাজছে । ক্যাসেটে । তার মানে হাবিব ভাই মেসেই আছেন ।
-কিসব প্যান প্যানানি গান শুনস, সব সময় । দরজার ভিতরে পা দিয়েই মিলন ভাইয়ের কথা শুনতে পাই । মিলন ভাই এই মেসের আরেক বাসিন্দা । লম্বা চওড়া সুদর্শন মানুষ । হাবিব ভাইয়ের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু । এখন এক বেসরকারি ব্যাংকে চাকুরী করেন হাবিব ভাইয়ের মতই । তবে দুজনের ব্যাংক আলাদা । শেয়ার মার্কেটে বড়রকম ধরা খেয়ে বেশ কিছুদিন মনমরা ছিলেন । এখন যেকোন মুল্য আমেরিকা যাবার চেষ্টায় ব্যস্ত । ইত্তেফাকের পাত্রী চাই পৃষ্ঠাটা খুটিয়ে পড়েন । যদি কোনো বিজ্ঞাপন থাকে আমেরিকা প্রবাসী ডিভোর্সী বা বিধবা মহিলার জন্য পাত্র আবশ্যক তাহলে দুই-তিনদিন তা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন । ছবি-বায়োডাটা পাঠান বক্স নাম্বারে । কয়েকদিন পরে পত্রিকা অফিসেও খোজ নেন ।
“শুনছো টিটু । এইসব গান নাকি প্যানপ্যানানি । ‘মেলায় যাইরে’ কইয়া চিক্কুর দিলেই নাকি গান হয় ।“
-হয়ইতো । তুই কি শুনস । ‘চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি’ । তেলানি মার্কা গান । শুনলে গা জ্বলে ।
“এই গানটা নিয়া কিছু বলবি না । এইটা আসলে আমাকে উদ্দেশ্য করেই মান্না দে গাইছে ।“ গম্ভীর কন্ঠে বলেন হাবিব ভাই ।
-মান্না দে তো তোর দুলাভাই লাগে । তাই তোকে উদ্দেশ্যে করে গান গাইছে । বিদ্রূপাত্মকভাবে বলেন মিলন ভাই ।
“যা বুঝস না তাই নিয়া লাফালাফি করস । শিরীন যে আমার চাইতে লম্বা এইটাতো দেখছসই । চাঁদ দেখতে চাইলেতো উপরের দিকে চাইতে হয় । আমি উপরের দিকে চাইয়া শিরীনের মুখ দেখছি । তোর মতো লাম্বুর জন্য যদি গাইতো তাইলে কি গাইতো জানস ।“
-কি?
“কেচো দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি । তোর বউ হবে অনেক ছোট তাই তুই নিচের দিকে তাকানো ছাড়াতো বউ এর মুখ দেখতে পারবি না । আমি সারাজীবন বউ এর কাছে মাথা উচু করে কথা বলবো আর বেটা তুই সারাজীবন বউ এর কাছে মাথা নিচু করে কথা বলবি ।“
আহ, ঝগড়াটাও কি দারুণ । এইজন্যইতো এখানে আসতে ভালো লাগে ।
“ঐ বেটা প্যানপ্যানানি গান শুনুক চলো আমরা দুইজন ক্যারাম খেলি ।“ বলে ঘরের এককোনে যেখানে ক্যারামটা সব সময় বিছানো থাকে সেদিকে যান মিলন ভাই । হাবিব ভাই জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সামনের হোটেলে চা-পুরির অর্ডার দেন । সময়টা খুব চমৎকার কাটে । ঘণ্টা তিনেক পরে ফেরার সময় মিলন ভাই বলেন আগামী শুক্রবার অবশ্যই আসবা হাবিব প্রমোশন পাইছে, ফিস্ট হবে ।
পরের শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে মেসে যাই । হাবিব কিংবা মিলন ভাই নাই মেসে । তবে সাত্তার চাচা আছেন । এই মেসের সর্বশেষ বাসিন্দা । কঠোর নীতিবাগিশ । সরকারী চাকুরী করেন । ঘুষ খান না এবং প্রতি দশটা বাক্যে একবার হলেও তা বলেন । চাকুরীর টাকায় ঢাকায় সংসার নিয়ে থাকা সম্ভব না বলে এই মেসে থাকেন । পরিবার পরিজন রাজশাহী শহরে থাকে ।
“ও তুমি আসছো । বসো এরা মনে হয় একটু পরেই আইসা পড়বে ।“ হাতের পত্রিকাটা গোটাতে গোটাতে বলেন সাত্তার চাচা ।
“তোমার চাকরির খবর কি ?” আন্তরিকভাবে জিজ্ঞেস করেন সাত্তার চাচা ।
-জ্বি ভালো । আমি ছোট করে উত্তর দেই ।
“যে যাই বলুক এইসব বি,সি,এস দিয়ো না । সরকারী চাকুরীর উপর ঘেন্না ধইরা গেছে । আমার মত সৎ লোকের জন্য সরকারী চাকুরী না । আমার বড় সাহেব এইবার হজ্বে যাইবো । তার কথা শোনো । তার আগে জানালাটা খুইলা হারুকে দুইকাপ চা দিয়া যাইতে বলোতো ।“
আমি জানালাটা খুলে লাগোয়া হোটলের হারুকে দুইকাপ চায়ের কথা বলে এসে আবার সাত্তার চাচার সামনে বসি ।
-আপনার বড় সাহেবের কি কথা ? আমি প্রসঙ্গে ফিরে আসি ।
“শোনো দুইবছর আগে বড় সাহেব ব্যাংকে একটা নতুন একাউন্ট খোলে । কি কাজে জানো ? হজ্বের টাকা জমাবার জন্য । বেতনের টাকা সব সেই একাউন্টে জমা রাখছে । হালাল টাকা দিয়া হজ্ব করার জন্য । নিজের মুখে সেই বললো আজ । একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হইছিলো -বেতনের হালাল টাকা দিয়া হজ্ব করবেন তাহলে এই দুইবছর কি টাকা দিয়া খাইলেন ? এইসব কথা বইলা লাভ নাই । সব পইচা গেছে ।“
-জ্বি চাচা । আপনার মত মানুষতো আর এই যুগে নাই । আমি বলি ।
“শোনো আমিও কিন্তু একবার ঘুষ খাইছি । প্রমান করার জন্য যে আমি ঘুষ খাইতে পারি...” এই গল্পটা আগে না হলেও দশবার শুনেছি সাত্তার চাচার মুখে । কিভাবে ওনার ডিপার্টমেন্টের এক বড় অফিসারের ফাইল আটকাইয়া ঘুষ খাইছিলেন তার বিশদ বর্ননা । শুনতে এখন ক্লান্তি লাগে । হাবিব, মিলন ভাই হৈ হৈ করে মেসে ঢুকে সেই ক্লান্তি থেকে মুক্তি দেন ।
-চাচা এই নেন আপনার ক্যাপসুল । আজকে মিটফোর্ডের ঐদিকে একটু গেছিলাম । বলে মিলন ভাই কয়েকপাতা ক্যাপসুল দেন সাত্তার চাচার হাতে ।
-আর শোনেন ক্যাপসুল খাবার আগে দুই সাইডে একটু কাইটা ফালাইয়া দিয়েন ।
“কেনো ?” সাত্তার চাচা কৌতুহলী স্বরে জিজ্ঞেস করে ।
-তাইলে আর সাইড ইফেক্টের ভয় থাকবে না । গম্ভীরভাবে বলেন মিলন ভাই । এভাবেই শুরু হয়ে যায় । একটু পরেই ব্রিজ খেলতে বসে যাই । আমার পার্টনার হাবিব ভাই আর মিলন ভাইয়ের পার্টনার সাত্তার চাচা । নিত্যকার মতো ।
একটু পরেই ঝামেলা লাগে । সেটাও নিত্যকার মতো...
“কিং, জ্যাক, টেন সহ চার কার্ড নিয়া কোন আক্কেলে তিনটা স্পেড কল করলা ।“ সাত্তার চাচা মাথা নাড়তে নাড়তে বলেন ।
-অসুবিধা নাই । কিছু শর্টইতো খাইছি । দেখেন না কয়েকটা গেম দিয়া পোষাইয়া দিমুনে । মিলন ভাই নরমসুরে বলেন ।
“অসুবিধাতো অবশ্যই আছে । খেলার একটা নিয়ম কানুন আছে না । “
-বুঝেন না কেন ওরা গত ৬/৭ বার খেলা নিছে ।
“তাই বইলা এইভাবে কল দিবা ।“
-চাচা শুনেন । আপনে বুড়া মানুষ । আপনার দেখলেও চলে ...আমার দেখলেই চলে না ...আমার করতেও...
“বেয়াদব, আদবকায়দা শিখো নাই । তোমাদের সাথে আর কখনোই খেলব না । “ বলে রাগে অগ্নিমূর্তি হয়ে সাত্তার চাচা উঠে যান । আমরা তেমন বিচলিত হই না । কারন এখনি মিলন ভাই চাচার পা চেপে ধরবে । ধরেও তাই...
-মাফ কইরা দেন চাচা । আমিতো আসলে বুঝাইছি খেলা না নিলে ব্রিজ খেলার কি মজা । পা ধরেই বলেন মিলন ভাই । দ্রুত পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায় । খেলার পরে কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে বসি ।
-চাচা কথায় কথায় এত রাগেন । এইটাতো ঠিক না । বয়স হইছে । আর আপনি যেভাবে ভাবেন দুনিয়াটা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট আসলেতো তা না । খেতে খেতে মিলন ভাই সাত্তার চাচাকে বলেন ।
“তোমাদের দুনিয়া রঙ্গিন হইতে পারে । আমার দুনিয়া ন্যায়-অন্যায়, সৎ-অসৎ, সাদা-কালোই ।“ সাত্তার চাচা দৃঢ়স্বরে উত্তর দেন ।
-দুনিয়া সাদা-কালো কিংবা রঙ্গিন না চাচা । দুনিয়াটা হইলো গ্রে । ছাইরঙা । বুঝাইয়া বলি ।
‘ধুর কি শুরু করছস । কাচ্চিটা কেমন হইছে সেইটা বল ?‘ হাবিব ভাই কথার মাঝখানে মিলন ভাইকে থামাইয়া দেন । ছাইরঙা দুনিয়ার বর্ণনা না শুনেই খাওয়া শেষ করি ।
এরপরে বিভিন্ন কাজে কয়েক সপ্তাহ হাবিব ভাইয়ের মেসে যাওয়া হয় না । হঠাৎ একদিন হাবিব ভাই অফিসে ফোন করেন ।
“কি মিয়া তোমার কোনো খবর নাই ।“
-জ্বি, হাবিব ভাই একটু ব্যস্ত ছিলাম ।
“ব্যস্ততা রাখো মিয়া । এই শুক্রবার সন্ধ্যায় চইলা আসো ।“
-কেনো ? হাবিব ভাই, কোনো প্রোগ্রাম ?
“তেমন কিছু না । শিরীন চাকরী পাইছে । আমার কয়েকজন বন্ধুকে নাকি চায়নিজ খাওয়াবে ।“ কথাগুলি প্রবল উচ্ছাসের সাথে বলেন হাবিব ভাই ।
হাবিব ভাইয়ের প্রেমিকা শিরীন আপাকে দেখার কৌতুহল ছিলো । তার উপর আবার চায়নিজ এর দাওয়াত । শুক্রবার হাজির হয়ে যাই মেসে । মিলন ভাই, সাত্তার চাচা তৈরী কিন্তু হাবিব ভাই তখনও লুঙ্গি পরে ঘোরাঘুরি করছেন । হাবিব ভাইয়ের বিছানার উপর তিনটা প্যান্ট আর আটটা শার্ট সাজানো । সবগুলিই ধোয়া-ইস্ত্রি করা । উনি সিন্ধান্ত নিতে পারছেন না কোনটা পরবেন । আমি একটু অবাক হই । হাবিব ভাই যতটুকু জানি পোশাক নিয়ে বেশী মাথা ঘামান না । তবে অবাক হবার আরো বাকী ছিলো । প্রায় দশ-পনের মিনিট আমাকে, মিলন ভাইকে সাত্তার চাচাকে জিজ্ঞেস করে পোশাক ঠিক করলেন । জামাটা পড়ার পরে দেখি উনি বিছানার উপরে উঠে গেলেন ।
-কি ব্যাপার হাবিব ভাই ? আবার বিছানার উপর উঠলেন কেনো ? আমি জিজ্ঞেস করি ।
“বিছানায় উঠছে প্যান্ট পরার জন্য । নিচে দাড়াইয়া প্যান্ট পরলে নাকি প্যান্টের নিচে ময়লা লেগে যায় । শিরীনের সাথে প্রতিবার দেখা করার সময় কত যে ঢং করে হাবিব ।“ মিলন ভাই উত্তর দেন । হাবিব ভাই কিছু বলেন না । কিছু বলার অবস্থায়ও হয়তো উনি নাই । বেশ নার্ভাস । আরো অনেক সময় নিয়ে জুতা পরেন । মেস থেকে বের হই । বের হবার সাথে সাথেই আবার ফিরতে চান হাবিব ভাই ।
“হাবিব চায়নিজ হোটেলে টয়লেট খুব ভালো থাকে । দোহাই লাগে আবার টয়লেট করতে ঢুকিস না ।“ মিলন ভাই ক্ষিপ্তস্বরে বলেন ।
-নাহ নাহ । এইটা ইমার্জেন্সী । বলেই আবার তালা খুলে মেসে ঢুকেন হাবিব ভাই । অবশেষে আরো মিনিট বিশেক পরে শেষ পর্যন্ত রওনা হতে পারি । আশ্চর্য হাবিব ভাইয়ের মত একজন চৌকস মানুষ... মানুষকে যে কখনোই পুরো চেনা যায় না সেই সত্যটাই আবার নতুন করে জানলাম । চায়নিজে গিয়ে শিরীন আপার সাথে পরিচয় হলো । দেখায়,কথায় দারুন চৌকস তরুণী । লম্বায় আসলেও হাবিব ভাইয়ের চাইতে বেশ কিছুটা বড় । হাবিব ভাইকে পুরো সময়টায় কেমন বোকা বোকা লাগে...হয়তো সব প্রেমিককেই এমন লাগে ।
জীবনের ব্যস্ততা বাড়ে । অনেকদিন আর হাবিব ভাইদের মেসে যাওয়া হয় না । ফার্মগেটে একদিন ছয় নম্বর বাসে উঠেই সাত্তার চাচার সাথে দেখা । বাসটা বেশ কিছুটা ফাঁকা থাকাতে চাচার পাশের আসনেই বসি ।
“তোমার যে অনেকদিন দেখা নাই ।“ চাচা জিজ্ঞেস করেন ।
-জ্বি একটু ব্যস্ত ছিলাম । উত্তর দেই ।
“হাবিবের খবর কিছু জানো ?”
-নাতো ?
“কি জানি ঝামেলা হইছে শিরীনের সাথে । ছেলেটা কেমন যেন হইয়া গেছে । মেসে আইসো সময় কইরা ।“ চাচার মুখে কথাটা শুনে একটু অবাক হলাম ।
“এদিকে আমার নিজেরও ঝামেলা যাইতাছে ।“ চাচা আবার বলা শুরু করেন ।
-আপনার আবার কি ঝামেলা ?
“মেয়ের বিয়া নিয়া । দুইটা ছেলেই যোগ্য । একজন রাজশাহীরই এক কলেজের শিক্ষক । আর একজন এই ঢাকা শহরেই থাকে । কাস্টমস অফিসার । টাকা পয়সা বেশ ভালো । দেখতে শুনতে তেমন ভালো না অবশ্য । তবে আমার পছন্দ কাস্টমস অফিসারই । মেয়ের সুখতো আমাকে দেখতে হবে ।“
-তাতো অবশ্যই । নিজের বিস্ময় গোপন করেই বলি ।
হাবিব ভাইয়ের খবর জানতে ঐ সপ্তাহেই যাই মেসে । মেসে ঢুকেই দেখি দুই-আড়াই বছরের এক ছেলে মেসের এই মাথা থেকে ঐ মাথা দৌড়ে বেড়াচ্ছে । সাত্তার চাচার সামনে এক মহিলা বসা । পোশাক-চেহারায় গ্রামের সরলতা আছে ।
“শুনছো মিলন নাকি চার বছর আগে গ্রামে বিয়ে করেছে । এইযে মিলনের স্ত্রী আর ছেলে ।“ সাত্তার চাচা আমাকে দেখেই বলেন । বিশাল মেস রুমের এককোণে হাবিব ভাইকে দেখি । কিন্তু মিলন ভাইকে কোথাও দেখি না ।
-চাচাজি । সে আমারে কখনোই মেসের ঠিকানা দেয় নাই । অফিসের ফোন নম্বরও দেয় নাই । (তখন মোবাইল ফোনের যুগ ছিলো না) । আমার এক চাচাতো ভাই খবর দিলো সে নাকি বিয়া কইরা আমেরিকা যাওয়ার চেষ্টা করতাছে । তাই অনেক কষ্ট কইরা এই ঠিকানা যোগাড় করছি ।
“ঠিক আছে মা । মিলন মাথা গরম কইরা কই বাইর হইয়া গেলো । চিন্তা কইরো না যাবে আর কোথায় ফিরবেই ।“ সাত্তার চাচা বলেন । আমি কি বলব বুঝতে না পেরে ঘরের দুরের কোনায় হাবিব ভাইয়ের কাছে যাই ।
-আপনারও কি সমস্যা শুনলাম হাবিব ভাই ।
“ঠিকই শুনছো ।“
-কি সমস্যা ?
“মিথ্যা কইরা বলছিলাম আমি ঢাকা ভার্সিটি থেকে পাস করছি ?”
-এতটুকুই ?
“না আরো আছে । বলছি আমি বাবা মার একমাত্র সন্তান । “ বলে একটু চুপ করেন হাবিব ভাই ।
“আরো বলছি আমার বাবা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল । আসলে প্রাইমারী স্কুল মাস্টার । আরো বলছি ...আসলে নিজের সম্বন্ধে যা বলছি তার আশি ভাগই মিথ্যা ।“ শুনে আমি কিছু বলি না...বলার থাকে না ।
“সব কিছু মিথ্যা হইলেও ওকে যে ভালোবাসি এইটা এক বিন্দুও মিথ্যা না । খোদার কসম ।“ শেষ কথাগুলো কেমন হাহাকারের মত শোনায় । আমার আর ভালো লাগে না । তাড়াতাড়ি মেস থেকে বের হয়ে আসি । বের হতেই দেখি মেসের লাগোয়া হোটেলেই মিলন ভাই দুইহাতে মাথা চেপে বসে আছেন । আমি কিছু না বলে সামনের চেয়ারে গিয়ে বসি । দুই কাপ চায়ের অর্ডার দেই ।
“বাবায় জোর কইরা বিয়া দিছে । চেহারা সুরততো দেখছো । এই বউ কোথাও চালানো যায় ।“ অনেক অনেকক্ষণ পরে নিজে থেকেই বলেন মিলন ভাই । আমি কিছু না বলে চায়ের কাপে চুমুক দেই ।
“এই চোর-বাটপারের দেশে থাকমু না । আরে আমি যদি কোনোমতে আমেরিকা যাইতে পারি, তাইলেতো তোদেরও নিয়া যামু । চাচাতো ভাই কি যাইয়া বললো আর তুইও নাচতে নাচতে চইলা আইলি । আহাম্মক মেয়েমানুষ ।“ গজগজ করতে করতে বলেন মিলন ভাই । আমি এবারো কিছু বলি না ।
ঐ মেসে আর কখনো যাওয়া হয় নাই । মাঝখানে কিছুদিন অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে ছিলাম । অফিসে ফিরে শুনি হাবিব ভাই দুইবার ফোন করেছিলেন । ফিরতি ফোন করতেও দেরী হয় । প্রায় একসপ্তাহ পরে ফোন করি ।
“মিলনের সাথে তোমার কোনো যোগাযোগ হইছে ইদানীং ?” ফোন ধরেই হাবিব ভাই জিজ্ঞাসা করেন ।
-নাতো ? আমি উত্তর দেই ।
“বইলো না । মানুষ চিনতে এত ভুল হয় । ‘বাবার অসুখ ইন্ডিয়া নিয়া যাইতে হবে’, এই কথা বইলা আমার কাছ থেকে আর সাত্তার চাচার কাছ থেকে প্রায় তিন লাখ টাকা নিয়া সে লাপাত্তা । অফিসে খোজ নিছি । সে চাকুরীও ছাইড়া দিছে মাস খানেক আগে ।“
-তিনলাখ টাকাতো অনেক টাকা ।(ঐসময়ে চালের কেজি ছিলো ১৫ টাকা) । আশ্চর্য । মিলন ভাইকে এইরকমতো কখনো মনে হয় নাই । আমি বলি ।
“আর বইলো না । ওর বিয়ের ব্যাপারটা আমি অনুমান করেছিলাম । কিন্তু ওযে এতবড় বাটপাড় । ভাবতেই পারি নাই । সাত্তার চাচার জন্য কষ্ট লাগে । সৎ মানুষ । মেয়ের বিয়ের জন্য প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে টাকা উঠাইছিলেন । সেই টাকাই মিলনকে দিছেন । তোমার কাছ থেকে আবার টাকা নেয় নাইতো ?” আসলে কিছু টাকা নিয়েছিলেন মিলন ভাই । তবে সেটা তিন লাখ টাকার তুলনায় কিছুই না । তাই বলতে ভালো লাগলো না ।
-না হাবিব ভাই । আমার কাছ থেকে কোনো টাকা নেন নাই মিলন ভাই । আমি উত্তর দেই ।
-শিরীন আপার কি খবর ? ঝামেলা মিটছে ? আমি জিজ্ঞেস করি ।
“নাহ । সেতো আমার কোনো কথাই শুনতে চায় না । শুনছি এক বিদেশী পাত্রের সাথে বিয়ের কথাবার্তা চলছে ।“ কেমন হতাশ নিরুত্তাপ গলায় বলে হাবিব ভাই । শুনতে বেশ খারাপ লাগে আমার ।
জীবন জীবনের মতই এগোতে লাগলো । রিক্সাওয়ালার সাথে পাঁচ টাকার জন্য দশ মিনিট খ্যাচ খ্যাচ করি ...টেলিফোনের লাইন ম্যানকে নিজে থেকেই দুইশো টাকা দেই মাসে...অফিসে বসের কাছে হারানো ব্যক্তিত্ব পিওনের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করি । সীমিত সামর্থ্য আর অসীম চাওয়া নিয়ে নিয়ত চেষ্টা করি কিভাবে আর একটু বেশী ভালো থাকা যায় । এ এক নেশার মত । আজ এতকাল পরেও সেই নেশায় ভাটা পড়লেও শেষ হয়ে যায় নাই...আমাদের মত মানুষদের হয়তো কখনো শেষ হয় না ।
মাস ছয়েক হাবিব ভাইয়ের সাথে কোনো যোগাযোগ ছিলো না । এতটুকু জানি মিরপুরের কোথাও বাসা ভাড়া নিয়েছেন । সাত্তার চাচা কোথায় আছেন তা ঠিক জানি না । আমিও চাকুরী বদল করেছি...সেই চিরন্তন আর একটু ভালো থাকার আশায় । এমন সময় একদিন হাবিব ভাই ফোন করে ...
“মিয়া একেবারে ভুইলাই গেলা ।“ স্বভাবসুলভভাবে কথা শুরু করেন হাবিব ভাই ।
-না হাবিব ভাই । ভুলি নাই । নতুন চাকুরী । তাই একটু ব্যস্ত । আমি কৈফিয়ত দেবার চেষ্টা করি ।
“যাই হোক শোনো মিয়া আমার বিয়া । আগামী শুক্রবার বরযাত্রা । রবিবার বৌভাত । বরযাত্রায় মুন্সিগঞ্জ যাইতে হবে তাই একটু সকাল সকাল চইলা আইসো ।“
-অভিনন্দন হাবিব ভাই । অবশ্যই আসবো । পাত্রী কে ?
“এইটা কেমন প্রশ্ন করলা ? শিরীনরে ছাড়া আমি আর কাউকে বিয়া করতে পারি এই কথা তোমার মাথায় আসলো কি করে ?”
-সরি হাবিব ভাই । ভুল হয়ে গেছে ।
“ঠিক আছে শুক্রবার সকাল সকাল চইলা আইসো ।“ বইলা মিরপুরের ঠিকানাটা ভালোভাবে দেন হাবিব ভাই। আমার মনে অনেক প্রশ্ন থাকলেও জিজ্ঞাসা করতে পারি না ...করা হয় না ।
শুক্রবার সকাল সকালই যাই মিরপুরের ঠিকানায় । ছোট একটা বাসায় অনেক মানুষ । সবাই হাবিব ভাইয়ের আত্মীয় স্বজন । চেনার মধ্যে শুধু হাবিব ভাইয়ের বাবাকে চিনি । একবার মেসে দেখা হয়েছিলো । ‘ও তুমি চইলা আসছো । খুব ভালো করছো’ এতটুকু বলেই হাবিব ভাই ব্যস্ত হয়ে যান অন্যকিছুতে । আমি বাড়ির বাইরে এসে দাড়াই । একটু পড়েই পিঠে কারো হাত টের পাই । ঘুরেই দেখি সাত্তার চাচা ।
-কেমন আছেন চাচা । আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগছে ।
“আমি ভালো আছি । তোমার খবর কি ?” আমি উত্তর দেবার আগেই
“দাড়াও পরিচয় করিয়ে দেই । এই হলো আমার মেয়ের জামাই । নাম সদরুল । কাস্টমসে আছে ।“ বলে এক স্বাস্থ্যবান যুবকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন । অমায়িক ভদ্রলোক । আমার সাথে কয়েকটা কথা বলে বাসার ভিতরে চলে যান সদরুল সাহেব ।
-আপনি এখন কোথায় আছেন চাচা ?
“আমি মেয়ে,জামাইয়ের সাথেই থাকি এখন । উত্তরাতে । জামাইতো দেখলা । টাকা পয়সা যেমন আছে মনটাও তেমন উদার । হাবিবের বিয়ার বরযাত্রার গাড়িতো সদরুলই দিলো । আমি কিছুই বলি নাই । কয়েকদিন আগে নিজে থেকেই এসে বললো ‘বাবা আপনারা অনেকদিন একসাথে ছিলেন । আমি নতুন গাড়ী কিনছি । হাবিব সাহেবের আপত্তি না থাকলে আমার গাড়ীতেই বর যাইতে পারে । আমার বস এর একটা বড় মাইক্রো আছে । সেটাও নেয়া যাবে ।‘ চিন্তা করছো কত বড় মন !”
বলার সময় আনন্দে, গর্বে চাচার মুখটা ঝলমল করে । আমার দেখতে বেশ ভালো লাগে ।
আরো কিছুক্ষণ পরে মোটামুটি সবাই প্রস্তুত বরযাত্রার জন্য । আচমকা কোথা থেকে এক মহিলা এসে সাত্তার চাচার পা জড়িয়ে ধরে । আমিসহ আশেপাশের সবাই একটু হকচকিয়ে যাই । প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পরে একটু দুরে ছেলেকে কোলে নিয়ে মিলন ভাইকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অনুমান করি ।
-মাফ কইরা দেন চাচাজি । টাকাটা সে নিছিলো ব্যবসা করার জন্য । আল্লায় দিলে শোধ কইরা দিবো । আমগোরে ঢাকা নিয়া আসছে । মানুষটাতো খারাপ না । দুইন্নাডাই এমন । হাবিব ভাইয়ের কাছে পরে মাফ চামু । আপনে মাফ না করলে পা ছাড়মু না । বলে কাদতে থাকেন মিলন ভাইয়ের স্ত্রী ।
“কি মুশকিল । টাকার জন্য আমার মেয়ের বিয়েতো আর ঠেকে যায় নাই । আমার মেয়ে আল্লাহর রহমতে সুখেই আছে । মাফ আমি অনেক আগেই কইরা দিছি । তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠো । বরযাত্রায় বেশী দেরী করা ঠিক না ।“ প্রশান্ত মুখে বলেন সাত্তার চাচা ।
ছাইরঙা দুনিয়ার কিছু ছাইরঙা মানুষ গাড়িতে উঠে বসি ...