ঢাকা টু হুলারহাট

dukhopakhi

Well-Known Member
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
115
Messages
1,101
Reaction score
134
Points
1,213
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
*****ঢাকা টু হুলারহাট*****

মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু






বড় বিশৃঙ্খল জীবনযাপন করি তখন । লন্ডনের এক সফটওয়্যার কোম্পানির ঢাকা শাখায় চাকুরী করি । লন্ডনের সাথে সময় মিলাতে দুপুর ১টার সময় অফিসে যাই ফিরি রাত দশটার পরে । নাস্তা সকাল এগারোটায়, অফিসে লাঞ্চ বিকাল তিনটায় আর রাতের খাবার খেতে খেতে প্রায়ই বারোটা বাজে । পেশাটার প্রতি একটা দরদ সব সময়ই ছিলো তার উপর লন্ডন অফিস কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে ডিরেক্টর হিসাবে প্রমোশন দিলো । একটা সম্পুর্ন প্রডাক্ট তৈরী করবার দায়িত্ব আগে থেকেই ছিলো । এর সাথে যুক্ত হলো অফিস চালাবার দায়িত্ব । নিজেকে কেমন গুরুত্বপুর্ন মনে হয় (হায় এজগতে কেউই যে তেমন গুরুত্বপুর্ন না সেই শিক্ষা তখনও ভালোভাবে হয় নাই...) । মাঝে দুইবার লন্ডন গিয়ে দেখলাম প্রডাক্টটার ভবিষ্যৎ সত্যি বেশ ভালো । উৎসাহ আরো বাড়ে । সবার আগে অফিসে যাই ফিরি সবার শেষে । সে এক নেশাগ্রস্থ সময় ।

এমন সময়ই হঠাৎ আমার জন্ম সনদপত্রের দরকার পড়লো । কোনো কিছু না দেখেই অফিসের ড্রাইভারকে দিয়ে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে একটা সনদপত্র নিয়েও আসলাম । কিন্তু পাসপোর্ট খুলে দেখি জন্মস্থান লিখেছি পিরোজপুর । মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো । জীবনের দশমিক এক শতাংশ সময় পিরোজপুর না থেকেও নিজেকে বরিশাইল্লা বলি । বলতে ভালো লাগে ...সেটা ঠিক আছে । কিন্তু এখন এই ঝামেলা অসহ্য মনে হয় । আর তাছাড়া আমার সত্যিকার জন্মস্থান আসলে পিরোজপুর না । খুলনার ফুলতলা । তাও কেনো যে পাসপোর্টে জন্মস্থান পিরোজপুর লিখলাম আল্লাহই জানে । পিরোজপুরের সেহাংগল গ্রামে চাচাতো ভাই হুমায়ুনকে ফোন করি । দুইদিন পরে হুমায়ুন জানালো আমাকে এক দিনের জন্য হলেও যেতে হবে । সশরীরে না গেলে নাকি সরকারী অফিসার কাগজটা দেবেন না ।

ঐ সময়ে অফিসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আবার লন্ডনে । তাই আমার অফিসে থাকা অপরিহার্য । অন্তত এইরকম একটা ভুল ধারনাই ছিলো । পরিকল্পনা করলাম শুক্রবার সন্ধ্যায় লঞ্চে গিয়ে শনিবার কাজ করে আবার রবিবারেই ঢাকা ফেরত আসবো । শনি-রবি অফিস ছুটি । তাই কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না । চাচাতো ভাই হুমায়ুনও পরিকল্পনামতো ঢাকা আসলো ।

অফিসে আরো একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন । শুক্রবার একটু আগেই অফিসে যাই । দুইজনের ইন্টারভিউ নিয়ে দুপুর দুইটা-আড়াইটা নাগাদ অফিস থেকে বের হয়ে সদরঘাট চলে যাবো । এই ছিলো পরিকল্পনা । প্রথমজনের ইন্টারভিউ নিলাম । প্রার্থীর দুই বছরের অভিজ্ঞতা আছে । কিন্তু আমরা যা চাচ্ছি অভিজ্ঞতা তার সাথে মেলে না । তাও চাইতেও বড় কারন তার অভিজ্ঞতা আসলে তাকে কিছু বাজে অভ্যাসে অভ্যস্ত করে ফেলেছে । দ্বিতীয় জন আসলো আধা ঘণ্টা দেরী করে । সদ্য পাশ করা ঝকঝকে তরুন প্রকৌশলী । কোনো কমার্শিয়াল অভিজ্ঞতা নাই । কিন্তু ছাত্রকালীন সময়ে কিছু কাজ করেছে এবং সেগুলো দেখে বেশ ভালো লাগলো । আরো কিছু কথাবার্তা বলে ভালো লাগাটা বাড়লো । আমি চাকুরীর প্রস্তাব দিলাম । তার চোখে মুখে খুশির ছায়া দেখলাম । কিন্তু একটু পরেই যখন বেতনের পরিমান বললাম দ্রুত মেঘ ঘনিয়ে এলো সেই মুখেই ।
“আমি যে তিনটা টিউশনি করি তা থেকেইতো এর চাইতে বেশী আয় করি ।“ আধার মুখে বলে যুবক ।
-এটাতো শুরু । আর টিউশনিতো আর আপনার পেশা হবে না, তাই না ? আমি মৃদু হেসে উত্তর দেই ।
“তাও আমার বন্ধুরা গ্রামীন/একটেলে এর চাইতে অনেক বেশী টাকায় চাকুরী করছে ।“
-দেখুন শুধু টাকাই কোনো পেশার মূল কারন হতে পারে না । আপনার মেধা নিয়ে আপনি এর চাইতে কম পরিশ্রমেও হয়তো কাচকি মাছের আড়ৎদারী করলে ভালো করবেন । কিন্তু আপনিতো আর তা করবেন না । আমি বোঝাবার সুরেই বলি ।
“আপনি কেনো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন ?” হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করে যুবক ।
-মানে ?
“না আপনি কেনো ইতিহাস, ভুগোল কিংবা রাস্ট্রবিজ্ঞান পড়েন নাই ?” উত্তরে কি বলবো আমি বুঝতে পারি না ।
“সরল উত্তর হলো আপনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন কারন ঐটা পড়লে একটা ভালো চাকুরী পাওয়া যায় । আর ভালো চাকুরী মানেই বেশী টাকা । তাই না ? জানেনতো ‘অর্থই সকল অনর্থের মূল’ ভাবসম্প্রসারনটা পকেটে অনেক টাকা থাকলেই সব চাইতে ভালো লেখা যায় । ” আমি বেশ অবাক হয়ে যাই । একযুগ আগে আমিও টেবিলের ঐ প্রান্তে ঠিক ওভাবেই বসে ছিলাম । কিন্তু এই কথাগুলো বলার মত সাহস কিংবা ব্যক্তিত্ব আমার ছিলো না । উত্তরে তাই আমার অনেক কিছু বলার থাকলেও বলি না । বরং আমার বাজেটের বাইরে আরো একটা প্রস্তাব দেই । জানি এর জন্য আমি বিপদেও পড়তে পারি ।
“আপনাকে ধন্যবাদ । গ্রামে বাবার জমি বিক্রির টাকায় আমি পড়াশুনা করেছি । আমাকে অনেক টাকা আয় করতেই হবে । ভেবেছিলাম আপনাদের বিদেশী কোম্পানী ...কিন্তু এখন দেখছি সময় নষ্ট ।“ বলে চলে যায় যুবক । মুখের মধ্যে কেমন তেতোভাব নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আতকে উঠি । ঘড়ির ঘণ্টার কাটা অনেক আগেই তিনটা অতিক্রম করেছে । তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হই । চাচাতো ভাই হুমায়ুনকে নিয়ে সদরঘাট রওনা হই ।

কোলাহলপূর্ণ সদরঘাট । সব লঞ্চই মনে হয় ছেড়ে গেছে ভেবে দুশ্চিন্তায় ছিলাম । পৌছে দেখি ঢাকা টু হুলারহাট লাইনের চার পাঁচটা লঞ্চ তখনও ঘাটে ভেড়ানো । জলকপোত নামটা পরিচিত লাগায় ঐদিকে যাই ।
“মেবাই ঐটার কেবিনে খালি উড়াশ (ছারপোকা) । চলো পারাবতে যাই ।“ চাচাতো ভাই হুমায়ুন বলে । অতএব হুমায়ুন এর কথামতো পারাবতে উঠি । কেবিন ঠিক করার কাজ হুমায়ুনই করে ।

সব কিছু ঠিক হবার পরে কেবিনে ব্যাগটা রেখে বাইরে এসে দাড়াই । সাথে সাথে এক দমকা শৈশব এসে হুমড়ি খেয়ে পরে । লঞ্চের গায়ে লাগানো কয়েকটা নৌকা, মাল উঠাচ্ছে । প্লাটফরমে হকারদের চিৎকার । ডেকে চাদর বিছিয়ে কিছু যাত্রী বসে আছে, এক একটা চাদরের সীমানাই এক একটা পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা । আগামী দশ বারো ঘণ্টার জন্য । বালিস, হাত পাখা আর ছয় বাটির টিফিন ক্যারিয়ারটা রেখে সবাই একটু হাত পা ছড়িয়ে বসেছে । ছেলেবেলায় ঠিক এভাবেই তিন চারবার গ্রামে গিয়েছি বাবা মার সাথে । তারপর কিভাবে যেনো ঢাকায় ঢাকা পরে গেলাম । আসলে জানি কিভাবে...সাত ভাইবোনের বড় সংসার । একজনের এস,এসসি পরীক্ষা শেষ হয়তো আর একজনের এইচ,এস,সি পরীক্ষা শুরু হয় । সবাই মিলে গ্রামে যাওয়া আর হয় না । এভাবেই গ্রামের সাথে সুতাটা আলগোছে আগলা হয়ে যায় ।

একটু পরেই বুড়িগঙ্গার কালো পানি ভেদ করে লঞ্চ ছাড়ে । পনের বিশ মিনিট পরে সভ্যতা-উন্নতির কটু গন্ধটাও পিছনে ফেলে আসি । হালকা ঝিরি ঝিরি বাতাসে দাঁড়িয়ে দুরের এক গ্রামের কিছু গাঢ় সবুজ গাছের আড়ালে সূর্যটাকে হারিয়ে যেতে দেখলাম । একটু ঠাণ্ডা লাগাতে কেবিনে ঢুকে পরি । হুমায়ুনের সাথে টুকটাক আলাপ করি ।
-কালকে কিন্তু কাজটা হতেই হবে ।
“তুমি চিন্তা হইরো না । মোরা হুইপের লোক (আমাদের এলাকার সাংসদ তখন সংসদের হুইপ)।“ বলে আশ্বস্ত করে হুমায়ুন । এমন সময় বাইরে হৈ হট্টগোল শুনতে পাই । কেবিনের দরজা খুলে আমি হুমায়ুন দুজনেই বের হয়ে আসি ।
“এক কাপ চায়ের কথা বললে আধা ঘণ্টা লাগে । এই হইলো ভি আই পি কেবিনের সার্ভিস । ডাক তোর মাস্টাররে । “ গলায় মোটা চেইন, হাতে দামী ঘড়ি এক ভদ্রলোক বাজখাই গলায় চিৎকার করছেন । ভদ্রলোক মনে হয় আমার ডান পাশের কেবিনের যাত্রী ।
‘এদের সাথে কথা বইলা কি লাভ । তুমি আব্বারে একটা ফোন দেও । দেখবা লঞ্চের সারেং লঞ্চ চালানো বাদ দিয়া তোমার পা টিপতে আইছে ।“ পিছন থেকে এক রমণী হাত নেড়ে নেড়ে কথাগুলো বললো । লঞ্চের এই জন্ডিস আলোতে দশ ফুট দুরের চেহারাটা খুব ভালোভাবে দেখতে না পেলেও মহিলার বাবা যে কেউকেটা সেটা শরীরভর্তি গয়না দেখেই বোঝা যায় ।
“শোন তোগো এই লঞ্চের মত দশটা লঞ্চ আমি দিনে রাইতে কেনতে পারি । বেডা মানুষ চিনস না ।“ আমাদের মত আরো দুই চারজন শ্রোতা দর্শক পেয়ে হম্বি-তম্বি বাড়ে । যার উপর হম্বি-তম্বি চালানো হচ্ছে সেই বেয়ারা চুপচাপ এককোনে দাড়িয়ে আছে । এমন সময় আমার বাম দিকের কেবিনের দরজা খুলে গেলো । দরজার ওপাশ থেকে একজন জ্যোতির্ময় বৃদ্ধের আবির্ভাব হলো । ইচ্ছে করেই ‘আবির্ভাব’ শব্দটা লিখলাম । কারন এটাই ওনার সাথে যায় । গমের মত গায়ের রং, মাথার চকচকে টাক থেকে এই জন্ডিস আলোও প্রতিফলিত হচ্ছে । ধবধবে সাদা পায়জামা,পাঞ্জাবী চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মাঝারী উচ্চতা বয়সের ভারে একটুও নুয়ে যায় নাই ।
“কি হয়েছে ?” মনে হলো গভীর কোনো কুয়ার তল থেকে কেউ কথা বললো ।
‘স্যারের চা দিতে দেরী হইছে ।‘ এতক্ষণ পরে কথা বললো বেয়ারা ।
“যাত্রীদের সেবার দিকে খেয়াল রাখবা না । এখন থেকে আর দেরী করো না ।“ সামান্য দুইটা বাক্যের আড়ালে ভদ্রলোকের প্রবল ব্যক্তিত্ব সবাইকেই শান্ত করে । দ্রুত সবাই চলে যায় । আমি আবার কেবিনে ঢুকতে যাবো এমন সময় বামের কেবিন থেকে এক রূপসী তরুণী বের হয়ে আসে । কয়েক পা হেটে গিয়ে তরুণী রেলিঙে দাঁড়ায় । কেমন যেনো একটু এলোমেলো হাটার ভঙ্গি । আমি কেবিনে না ঢুকে দরজাতেই দাঁড়িয়ে থাকি । এক মিনিট পরেই বৃদ্ধের গলা শোনা যায় । “রেবা ভিতরে আসো” । সাথে সাথেই তরুণী ঘুরে আবার একটু এলোমেলো পায়ে কেবিনের দিকে আসতে থাকে । দরজায় দাঁড়ানো আমাকে দেখে একটু হাসেও । কিন্তু হাসিটা যেন কেমন লাগে ।

কেবিনে ঢুকে হুমায়ুনের সাথে গ্রাম, আত্মীয়-স্বজন আর গ্রামের রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতে থাকি । একটু পরেই বেয়ারা আসে রাতের খাবারের অর্ডার নিতে ।
‘ভাতের সাথে সালুন কি নিবেন ?‘
আমি হুমায়ুনকে দেখিয়ে বলি ঐ অর্ডার দিবে ।
“আর কোনো ঝামেলা হইছে ?” আমি জিজ্ঞেস করি বেয়ারাকে ।
‘না স্যার । চৌহিদারের পুত আছেলে । কেমনে কেমনে গারমেন্ট হইরা এহন কোটি কোটি টাহার মালিক । মানুরে মানু মনে হরে না । বিয়া হরছে আবার আর এক নেতার মাইয়ারে । সেরের উপর সোয়া সের…‘
“তাহলে এদেরকে তুমি চেনো ?”
‘অ্যা কন কি? চিনমু না ক্যা । মোগো বাড়ির তিন গ্রাম পরেইতো হেগো বাড়ি ।‘
“আর ঐ বুড়া ওনাকেও চেনো ?”
‘না স্যার হেরে চিনি না । তয় লঞ্চে এইরহম যাত্রী উঠে । দেখপেন হারা রাত দরজা খুলবো না । দরবেশ এর মত চেহারার খাচ্চর শয়তান । হারা রাত ফুর্তি হরবো হালার বুইড়া ।‘

অর্ডার নিয়ে বিদায় হয় বেয়ারা । ব্যাগ থেকে একটা বই খুলে পড়ার চেষ্টা করি । অল্প আলোয় পড়ার কারনে অল্প সময়েই মাথা ধরে যায় । বই বন্ধ করতেই খাবার আসে । খাবার খাই । ইলিশ মাছটা খুব ভালো ছিলো । হুমায়ুন আবার একটু অসুস্থ । তাই ওকে ঘুমিয়ে পড়তে বলি । আমিও ঘুমাবার চেষ্টা করি । ঘন্টাখানেক চেষ্টার পরে হাল ছেড়ে দেই । কেবিন থেকে বের হয়ে আসি । হাটতে হাটতে ডেকে আসি । এখানেও অধিকাংশ যাত্রী কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে । এক কিনারে কয়েকজন তাস খেলছে । পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই । টুয়েন্টি নাইন খেলছে চারজন । পাঁচ মিনিট খেলা দেখে চলে আসবো এমন সময় একজন বললো
“মেবাই একটু হাতটা ধরেন । মোর এট্টু টয়লেটে যাইতে হবে ।“ লঞ্চে অপরিচিত লোকজনদের সাথে বেশী মেলামেশা ঠিক না । অনেক আজব কাহিনী শুনছি । কিন্তু তেমন চিন্তা হয় না । বসে যাই খেলতে ।
‘আমনে খালি কলটা ঠিকমতো দিয়েন । বাকীটা আমি দেহুম ।‘ আমার পার্টনার বলে ।
-হয় আপনার পার্টনার হইলো ম্যারাদোনা । আর একজন বলে ।
“আরে রাখ রাখ ম্যারাদোনা । ঐ গল্পটা হুনছোসতো ।
কাক্কু বউ লইয়া ঘোরতে বাইর হইছে । রাস্তায় এক আন্ধা ফহির কাক্কুর বউরে দেইখ্যা কইলে ‘ও সুন্দরী বুবু দুইটা টাহা দিয়া জান ‘ । কাক্কু হের বউয়ের দিগে চাইয়া কইলে ‘দেও বউ দুইডা টাহা দিয়াই দেও ...বেডা হাচ্ছইও অন্ধ‘।“ সবাই হেসে উঠে ।
‘বেডা তোর এতবড় সাহস মোরে নিয়া টিটকারি মারস ।‘ যাকে ম্যারাদোনা বলা হচ্ছে সে কপট রাগের সাথে বলে ।
“মেবাই সাহসের দেখছো কি সাহস ছেলে মোগো প্রাইভেট মাস্টেরের । মোর বাফের কাছ থেইক্কা টাহা নিয়া মোরেই কেউন্নাইয়া থুইয়া যাইতে ।“ এভাবেই হাসি আনন্দের সাথে আধাঘন্টা খেলে কেবিনে ফিরি । আবার ঘুমাবার চেষ্টা করি । ঘুম আসে না । মাঝে আরো একবার কেবিন থেকে বের হই । লঞ্চ তখন চাঁদপুর ঘাটে ভেড়ানো ।

এরপরে ঘণ্টা দুয়েকের একটা ঘুম হয় । বিছানায় শুয়েই ঘড়িতে দেখলাম রাত চারটা বাজে । পাশের বিছানায় হুমায়ুন নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছে । কেবিনের দরজা খুলে বাইরে আসতেই দেখি পাশের কেবিনের সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটা চেয়ারে বসে আছেন । আমি রেলিঙয়ের কাছে গিয়ে দাড়াতেই ...
“কোথায় যাবা ?” সেই জলদগম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন ভদ্রলোক । আমি ছোট করে উত্তর দেই । বেয়ারার কথা মনে করে এই লোকের সাথে বেশী কথা বলতে ইচ্ছা করে না । কিন্তু ভদ্রলোক আমি কি করি, কোথায় থাকি এরকম আরো দুই চারটা প্রশ্ন করেন । আমি এক দুই কথায় উত্তর দেই । নিতান্তই সৌজন্যবশত । কোনো পাল্টা প্রশ্ন করি না ।

“আমিও তোমার বাবার মত চাকুরীর প্রয়োজনে গ্রাম ছাড়ি প্রায় ৫০ বছর আগে । সেভাবে আর ফেরা হয় নাই । এখন নাতনি নিয়ে গ্রামে যাচ্ছি জমি-জমা সংক্রান্ত ব্যাপারে ।“
-নাতনি বুঝি আপনার খুব আদরের ? আমি কৌতুহলীস্বরে জিজ্ঞেস করি ।
“নাতি নাতনি আমার আরো আছে । তবে আমার এই নাতনির আমি ছাড়া কেউ নাই ।“ থমথমে গলায় বলেন বৃদ্ধ ।
-কেনো বাবা মা ?
“আছে আবার নাইও । আমার বড় ছেলে নিজের পছন্দমতো বিয়ে করে । আমি আপত্তি করি নাই কারন আপত্তি করলেও লাভ হোতো না । বছর দুয়েক পরেই আমার এই নাতনির জন্ম হয় । বছর দুই তিন ভালোই ছিলো । তারপর বোঝা যায় ওর মানসিক বৃদ্ধি খুব খুব মন্থর । কিছুদিনের মধ্যেই এই নিয়ে শুরু হয় সাংসারিক ঝামেলা । ওরা স্বীকার করে না কিন্তু ওদের বিচ্ছেদের মূল কারণই ছিলো আমার এই নাতনি ।“
-তারপর?
“তারপর আর কি । নাতনিকে আমিই নিয়ে আসলাম । ছেলে এখন আর এক বিয়ে করে আমেরিকায় । বউও অস্ট্রেলিয়ায় আর এক সংসারে ব্যস্ত । বছরে এক দুইবার ফোন করে মেয়ের খবর নেয় । ব্যস ঐ পর্যন্তই । গল্পে নাটকে সিনেমায় বাবা-মার ভালোবাসা নিয়ে কত গল্প পড়েছি দেখেছি । কিন্তু নিজ জীবনেই রেবার মত হতভাগ্য সন্তানও দেখতে হলো । ফুলের মত মেয়েটা । আমার শুধু চিন্তা হয় আমি যখন থাকবো না তখন রেবার কি হবে ?“

এতটুকু বলেই হঠাৎ চুপ করে যান বৃদ্ধ । একজন সদ্য পরিচিত লোককে এতকিছু বলায় হয়তো একটু বিব্রতও বোধ করেন । বেয়ারা দুইকাপ চা দিয়ে যায় । পুব আকাশে নদীর গর্ভ থেকে লাল কুসুমের আভা দেখা যায় । চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আমরা দুইজন তা দেখতে থাকি ।
 
Back
Top