- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 115
- Messages
- 1,101
- Reaction score
- 134
- Points
- 1,213
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
*****আপনজন*****
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
‘ইট ইজ স্টিংকিং হট । দিস ইজ হোয়াই আই ডিডন্ট ওয়ান্ট টু কাম ।‘ আঠারো বছরের যুবক নাহিদ সামান্য রাগী গলাতেই বলে ।
-হোয়াট ডিড ইউ সে ? ১৫ সীটের মাইক্রো বাসের মাঝের আসন থেকে মাহমুদ ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে ।
“আহ তুমি চুপ করোতো । শফিক গাড়ীর এসিটা ফুল করে দেওতো । এন্ড নাহিদ ইউ শুডন্ট সে দ্যাট । “ মাহমুদের স্ত্রী ঝর্না তাড়াতাড়ি সামাল দেন । নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখ । গাড়ীর ড্যাসবোর্ডে বাইরের তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ২৭ ডিগ্রী । দেশের হিসাবে অতটা গরম না । তবে নিউজার্সির হিসাবে অনেকই গরম ।
দুইদিন আগে টরন্টো থেকে মারুফ ফোন করে । তখন নিউজার্সিতে রাত দেড়টা । গত দুইবছর যাবত যে ভয়টা ছিলো সেই দুঃসংবাদটাই শোনা হয় । ফোনটা রেখে স্ত্রী ঝর্নাকে কেমন নিরুত্তাপভাবে খবরটা দেয় মাহমুদ । দিয়ে বিছানার পাশে থম ধরে বসে থাকে কিছুক্ষণ । ঝর্না ফুপিয়ে কাদতে কাদতে কি বলে কিছুই শোনা হয় না মাহমুদের । টেলিফোনটা আবার বাজতে থাকে । একবার বাজতে বাজতে কেটে যায় । আবার রিং হতে কেমন জম্বির মত ফোন ধরে মাহমুদ । মেহেদী ফোন করেছে সিডনী থেকে । এরপরে আরো আধাঘণ্টা দেশ, কানাডা আর আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে আরো ৫/৬ টা ফোন আসলো । এতগুলো ফোনের পর কেমন পরিশ্রান্তের মত মুখ তুলে মাহমুদ বলে ‘এক কাপ কফি দেওনা ।‘ পরিচিত ভঙ্গির কথাটা শুনে একটু স্বস্থি পায় ঝর্না । মাহমুদের শরীরটাও বিশেষ ভালো না । হাই ব্লাড প্রেশার ডায়াবেটিসতো আছেই ইদানীং যোগ হয়েছে তিরিক্ষি মেজাজ । ছেলে-মেয়ে, বিশেষ করে ছেলেটা এসব মানতে চায় না । সবদিক সামাল দিতে দিতে মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে ঝর্নার ।
ঝর্না কফি নিয়ে এসে দেখে মাহমুদ তখনও ফোনে ব্যস্ত । তবে গলার স্বর কিছুটা স্বাভাবিক । প্রায় ঘন্টাখানেক পরে ফোন রেখে মাহমুদ বলে
“কালকে দুপুরেই ফ্লাইট । সবাই যাচ্ছি । মারুফ আর মেহেদীও যাচ্ছে । সবাইকে নিয়েই । শফিক বলেছে মার লাশ দুইদিন রাখা যাবে । আমরা যাবার পরেই দাফন হবে ।“
-কিন্তু নাহিদ, লুনার স্কুল । ওরাতো এখনও জানেই না ।
“সকালেই স্কুলে ফোন করবো । নয় দিনের জন্য যাওয়া । এসব ক্ষেত্রে অসুবিধা হয় না । ওদেরকে ঘুম থেকে উঠাও ।“ এরপরে আর কথা থাকে না । নাহিদ লুনাকে ঘুম থেকে উঠালেন ঝর্না । খবরটা শুনে লুনার মুখে একটু আধার নেমে এলেও নাহিদের তেমন ভাবান্তর হলো না । বরং দেশে যাবার কথা শুনে একটু বিরক্তই হলো ।
‘মাম মাই স্কুল, বাস্কেটবল ম্যাচ ...’ । মৃদুস্বরে আপত্তি করার চেষ্টা করে নাহিদ ।
-লিসেন নাহিদ । দিস ইজ নট এ টাইম টু আরগু । উই আর গোয়িং । ছেলেকে কথা বাড়াবার সুযোগ দেয় না ঝর্না । এরপরের সময়টুকু ঝড়ের মত গেলো । মাহমুদ, ঝর্না কাজের জায়গায় ফোন ইমেইল করলো । সুটকেস গোছানো, ফ্রিজ খালি করা, ডাক্তার এপয়েন্টমেন্ট বদলানো । এর মাঝে ফোনতো আছেই । দুইবার টরন্টো-সিডনিতেও কথা বলতে হলো । ওরাও অবশ্য একইরকম তাড়ার মাঝে আছে । তাই দরকারী কথাটুকুই শুধু বলা হয় ।
সময় মেনে তিনটা ফ্লাইট আড়াই ঘণ্টার ব্যবধানে ঢাকা নামে । ঘণ্টাখানেক পরে আর একটা ফ্লাইটে সবাই মিলে যশোরও ঠিকমতোই আসা হয় । ঢাকা এয়ারপোর্টে তিন ভাইয়ের দেখা হওয়ার সময়টুকু বাদ দিলে কেউই তেমন আবেগও প্রকাশ করে নাই । দীর্ঘ যাত্রায় সবাই ক্লান্ত-শ্রান্ত । দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই শফিকের পড়াশুনা কম হলেও দারুন চালাক চতুর । তাইতো বুদ্ধি করে এই দামী মাইক্রোবাসটা ভাড়া করেছে । বাসের মধ্য বরফ ঠাণ্ডা বেশ কিছু পানির বোতলও রেখেছে ।
মাইক্রোবাস যশোর থেকে খুলনার দিকে যাচ্ছে । সবারই চোখ ঢুলুঢুলু । কিন্তু শফিক বেশ টেনশনে আছে । দুই বছর আগে চাচীর ব্রেইন স্ট্রোক করার কিছুদিন পর থেকেই আছে সে চাচীর বাসায় । তিন প্রবাসী ছেলে প্রথম দুইমাস একজনের পর একজন এসে থেকেছে । দুইমাস পর হাসপাতাল থেকে চাচীকে বাসায় নিয়ে আসা হলো সামান্য উন্নতি নিয়ে । উন্নতি বলতে চাচী শুধু কথা বলতে পারে আর মাথাটা নাড়াতে পারে । সেই থেকে শফিক আর শফিকের মা আছে চাচীর সাথে । তিনভাই টাকা পয়সা পাঠায় আর শফিক খরচ করে । মা একটু বোকা আছে শফিকের । সেটাই প্রথম দুশ্চিন্তা শফিকের । বার বার করে সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে মাকে । তাও মা যে কখন কি বলে । তবে নিজের কাছে পরিষ্কার শফিক । এমনতো না যে সে চাচীকে অসুধ কিনে দেয় নাই । অসুধ,ফিজিও সব নিয়মিতই সে করেছে । কিন্তু আটাত্তর বছরের বৃদ্ধাতো চাইলেও ভালো খাইতে পারে না । তাই... । তাছাড়া মাঝে মাঝেই এটা সেটা বলে কিছু টাকা নিয়েছে । ব্যাবসাটা প্রায় দাঁড়িয়ে গেছে ...। আরো একটা চিন্তা নাজু । বড়লোকের মেয়ে নাজুকে বলা হয়েছে এত বিশাল বাড়িটা দাদার বাড়ি । এখন তিনভাই মিলে বাড়িটা যদি বিক্রি করে দেয় । নাজুকে কথাটা হয়তো মিথ্যা বলেছে কিন্তু ভালোবাসাটাতো মিথ্যা না । কিন্তু কেউই এসব বুঝতে চায় না ...শফিক জানে নাজুও বুঝবে না ।
ঘন্টা দেড়েক পরেই খুলনার পাবলায় সালেহা মঞ্জিলের সামনে থামে মাইক্রোবাস । থমথমে মুখে গাড়ী থেকে বের হয় তিন ভাই । তিন বউও নেমে আসে ছেলে মেয়ে সহ । মুহূর্তে শোক নেমে আসে বিশাল বাড়িতে । বাসার সামনের উঠানে সাদা কাফনে মোড়ানো দুইদিনের লাশ । আতর, লোবান আর চাপাতার মিশ্র গন্ধে ছেয়ে আছে চারপাশ ।
-মিয়াভাই লাশ আর বেশিক্ষণ রাখা যাবে না । মাহমুদের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে শফিক । মাহমুদও মৃদুস্বরে মারুফ আর মেহেদীকে একই কথা বলে । বুড়ি ছোয়ার মত সবার এক নজর দেখা হয়ে গেলেই সালেহা বেগমের লাশ রওনা হয় চুড়ান্ত গন্তব্যে ।
তিনদিন পরের সকাল । প্রাথমিক শোক কেটে গেছে । তিনভাই সস্ত্রীক নাস্তা করছে । বাচ্চারা সব ঘুমে ।
‘শান এখন কেমন?’ মাহমুদ জিজ্ঞেস করে ।
‘কাল রাত নয়টার পরে আর টয়লেট হয় নাই দাদা ।‘ ছোট ভাইয়ের স্ত্রী রুমু উত্তর দেয় ।
‘রঞ্জুও শুনলাম কাল রাতে বমি করেছে ?’ ছোট ভাই মেহেদী জিজ্ঞেস করে ।
‘হ্যা । সাথে সাথে স্যালাইন খাওয়াইছি ।‘ মেঝ বউ শিলা উত্তর দেয় ।
‘ভালোমত খেয়াল রেখো শিলা । গত দুইদিন শানকে নিয়ে যা হলো এরকম হলেতো হাসপাতালেই থাকতে হবে বাকী কয়দিন ।‘ মাহমুদ আবার বলে ।
‘এর মাঝে গতকাল আবার তোমাদের ছোট মামি এসে এক গাদা কথা শুনিয়ে গেলো ।‘ ঝর্না একটু ঝাঝের সাথে বলে ।
‘মামি আবার কি বলল?’ মারুফ জিজ্ঞেস করে ।
‘জানো না তোমার ছোট মামি মিস্টি মিস্টি করে কত তিতা কথা বলতে পারে ।‘ মারুফের স্ত্রী শিলা উত্তর দেয় ।
‘বলো না কি বলছে ?’ মারুফ আবার জিজ্ঞেস করে ।
‘কি আবার বলবে । বলল জানো আমার বড় ছেলেকে কি বলি - বলি যে তোকে বড় করার চেয়ে একটা অস্ট্রেলিয়ান গরু বড় করাই ভালো । গরুর দুধ বেচে অনেক টাকা পাওয়া যাইতো । বুড়া বয়সে আমার ভাগ্য ভালো হলে তুই কিছু টাকাইতো দিবি । দেখ না সালেহা বুবুকে । কত কষ্ট করে তিন ছেলেকে মানুষ করলো । বয়সকালে একটা ভালো শাড়ীও ছিলো না । কোনো বিয়ে শাদীতে যাইতো না শুধু ভালো কাপড় নাই এজন্য । কি লাভ হইছে এত কষ্ট করে । এখন অন্ধকার অপরিষ্কার এক ঘরে শুয়ে আছে । দূর সম্পর্কের বাটপার দেবরের ছেলে আর তার মার তদারকিতে ।‘ শিলার কথা শুনে সবার মুখ কালো হয়ে যায় ।
‘ছোট মামির কথা বাদ দেও । আর্মি অফিসারের বউরা নাকি এক র্যাঙ্ক উপরে থাকে । জামাই ক্যাপ্টেন হইলে বউ মেজর । ছোট মামি সব সময় ছিলো দুই র্যাঙ্ক উপরে । মামাতো ব্রিগেডিয়ার হয়ে অবসর নিছে । মামি হিসাবমতে তাহলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল । গতবছর ছোট মামি তার এই ছেলের জন্যই কতবার ফোন করেছে । আমেরিকার ভিসার জন্য । আমি স্পন্সরশীপ ঠিকই পাঠিয়েছি । এমব্যাসি ভিসা না দিলে আমি কি করবো ।‘ মাহমুদ বলে ।
‘যাই বলো । শফিক কতটা মার যত্ন নিছে সন্দেহ আছে । মার রুমটা দেখছো কি অপরিষ্কার । শফিককে টাকাতো অনেক দেওয়া হতো । ‘ মেহেদী চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে ।
‘হুমম । চাচীও জানি কেমন ? কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলে শফিক জানে ।‘ রুমু বলে ।
‘এছাড়া আমাদেরতো কোনো উপায় ছিলো না । সুস্থ অবস্থায়ইতো মা আমাদের কারো বাসায় দুই মাসের বেশী থাকতে চাইতো না । আর এরকম অবস্থায় ...’ কথা শেষ করে না মাহমুদ । তিন ভাইয়ের বউই মনে মনে বলে – ‘আমাদের বাসায় ঠিকই থাকতে চাইতো । ঠিকমতো সময়, যত্ন না দিলে মা কিভাবে বিদেশে থাকবে ।‘ অন্য অনেক কিছুর মত এই ভাবনার সত্যতাও অমীনাংসিত থেকে যায় ।
‘শফিক কোথায় গেলো ?’ ক্ষনিকের নীরবতা ভেঙ্গে মারুফ জিজ্ঞেস কর ।
‘বললোতো একটা গাড়ী আনতে যাচ্ছে । কারো যদি কোথাও যেতে হয় ।‘ মাহমুদ বলে ।
‘গাড়ী লাগবে না । চলো হাটতে হাটতেই বি, এল কলেজের মোড়ে যাই ।‘ মেহেদী বলামাত্রই সবাই উঠে পড়ে ।
‘যেখানেই যাও । তাড়াতাড়ি আসবা । আজকের দিনটাইতো মনে হয় সবাই একসাথে আছি । কাল আমি বাবার বাড়ি যাবো ।‘ ঝর্না বলে ।
তিন ভাই বাড়ী থেকে বের হয় । কয়েক মিনিট হাটতেই রাস্তার পাশের এক হোটেল থেকে এক বৃদ্ধ জোরে ডেকে উঠেন ...
‘এই ডলার, দিনার, রিয়াল । এদিকে আসো ।‘ ডাকটা শুনে তিন ভাইয়ের বুকেই কি যেন ছলাৎ করে উঠে । বহু বহু দিন পরে এই নামে তাদেরকে কেউ ডাকলো । অথচ আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে এই নামেই পরিচিত ছিলো পিঠাপিঠি তিন ভাই । জুটমিলের ওভারশিয়ারার আফসারুদ্দিনের মেধাবী তিন ছেলে ।
‘কেমন আছেন চাচা ?’ হোটেলের ভিতর যেয়ে মেহেদি ওরফে রিয়াল জিজ্ঞেস করে ।
‘আমার আর থাকা । বুড়া বয়সে যতটুকু ভালো থাকা যায় । তোমার বাবা আমার বন্ধু মানুষ ছিলো জানোতো ? তোমরা বসো । এই ভালো দেখে তিন কাপ চা দে । এই তিনভাইকে চিনোস ? তোরা চিনবি কিভাবে ? এই তিনভাই এই এলাকার গর্ব । চিনা রাখ ।‘ এমনভাবে বলে বৃদ্ধ । তিন ভাইয়েরই খুব ভালো লাগে । তিনভাই বৃদ্ধের সামনে বসে ।
‘তোমরা আসছো খবর পাইছি । ভাবছিলাম গতকাল যাবো । কিন্তু বাতের ব্যথাটা বাইরে যাওয়াতে । তোমার বাবা ছিলেন মাটির মানুষ । তোমার বাবার কোনো ব্যাঙ্ক একাউন্ট ছিলো না জানো । বলত সেলিম আমার সম্পদ হইলো তিন ছেলে । দেখছো না নাম রাখছি ডলার, দিনার, রিয়াল । আরে আমি নিজেইতো ব্যাঙ্ক । আফসোস সে কিছুই দেইখা যাইতে পারলো না । ডলার তুমি পাশ করার সাথে সাথেইতো তোমার বাবা মারা গেলো তাই না ?‘
‘জ্বি চাচা ।‘ মাহমুদ ওরফে ডলার উত্তর দেয় ।
'ভাবীরে মাঝে মাঝে দেখতে যাইতাম । সেতো নিজেই এখানে থাকতে চায় । তারপরো তোমরা তিনভাই টাকা পয়সা দিয়ে ভাবীর কোনো অযত্ন হইতে দেও নাই । আজকাল দেশে যারা থাকে তারাও এত করতে পারে না । আমার প্রায় সব ছেলেইতো ঢাকায় । একজন আছে সেও বলতাছে ঢাকায় চলে যাবে । না গিয়ে করবেই বা কি?'
এভাবেই আরো কিছুক্ষণ সেলিম চাচার সাথে সময় কাটিয়ে হোটেল থেকে বের হয় তিনভাই । হাটতে হাটতে হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলে মারুফ ।
‘হাসছিস কেনো মেজ ভাই ।‘ মেহেদি জিজ্ঞেস করে ।
‘ঐ ঈদের কথা মনে আছে দাদা ।‘ মারুফ উত্তর দেয় ।
‘কোন ঈদ ?’ মাহমুদ জিজ্ঞেস করে ।
‘ঐ যে আব্বা আমাদের তিন ভাইয়ের জন্য একই শার্টের কাপড় কিনলো । প্যান্টের কাপড়ও কিনলো একই । আগের ঈদগুলোতেও একইভাবে কিনেছে । মনে হয় কাপড় বেশী কিনলে দাম একটু কম পাওয়া যেতো । দরজির দোকান থেকে জামা প্যান্ট নিয়ে আসলাম আমি । ঈদের দিন নতুন জামা প্যান্ট পড়ে বের হতেই সামনে পড়লো এই সেলিম চাচা । আমাদের দেখে সেলিম চাচা বলেছিলো – আফসার ঈদের দিনও পোলাপানরে স্কুল ড্রেস এর মত প্যান্ট শার্ট বানাইয়া দিছে । যাও বাবারা লেফট রাইট করতে করতে যাও । দাদা তুই মনে হয় তখন ক্লাস টেনে । কথাটা আমাদের দুই ভাইয়ের তেমন না লাগলেও তোর খুব লেগেছিলো । বিকেল পর্যন্ত বাসা থেকেই বের হস নাই । কিভাবে যেনো আব্বাও জেনেছিলো । এরপর থেকে আমরা তিনভাই তিন রকমের শার্ট-প্যান্ট পেতাম ঈদে । মনে আছে ?’
‘খুব মনে আছে । কিসব দিন ছিলো । ঈদের ড্রেস এর কথা বাবা জেনেছিলো । কিন্তু বছরের পর বছর একই সোয়েটার পরে স্কুলে গেছি । স্কুলে আমাকে কি নামে ডাকতো জানিস ?‘ মাহমুদ বলে ।
‘জানি । ইয়েলো মাংকি । হলুদ সোয়েটারের জন্য । একই কারনে মেজভাইকে ব্লু মাংকি আর আমাকে অ্যাস মাংকি বলতো ।‘ মেহেদি উত্তর দেয় । মাহমুদ একটু অবাক হয় ।
‘বাবার কিনতু সত্যি কোনো ব্যাংক একাউন্ট ছিলো না ।‘ মাহমুদ কেমন দুরাগত স্বরে বলে ।
‘আই হেইট দিজ ।‘ নাহিদ রাগতভাবেই বলে । রাত সোয়া সাতটা বাজে । বিদ্যুত নাই প্রায় দেড় ঘণ্টা । এতক্ষণ তবুও আই,পি,এস দিয়ে কিছু বাতি আর ফ্যান চলছিলো । মিনিটখানেক আগে তাও বন্ধ হয়ে গেছে । নাহিদ, লুনা আর ঐশী দোতলার এই রুমে বসে আছে । তিনজনের বয়সই কাছাকাছি ...১৮,১৬,১৫ । ঐশীর আই প্যাডে একটা মুভি দেখছিলো তিনজনে মিলে । আই প্যাডের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়াতে ছবি দেখাও বন্ধ । রঞ্জু আর শান পাশের রুমে আর একটা ল্যাপটপে গেম খেলছে ।
‘ইউ নো নাহিদ ভাই হোয়াট শকড মি মোস্ট হোয়েন আই ফার্স্ট কেইম টু বাংলাদেশ ?’ ঐশী বলে চাচাতো ভাই নাহিদকে ।
‘হোয়াট?’ নাহিদ জিজ্ঞেস করে ।
‘আই ওয়াজ ওয়াকিং অন এ রোড । সাডেনলি আই ছ এ ম্যান ওয়েন্ট বিছাইড দ্য রোড এন্ড পুল হিজ জিপার ডাউন এন্ড স্টার্ট পিইং...আই ওয়াজ সো শকড । আই নেভার কুড হ্যাভ থট দ্যাট সামওয়ান ক্যান ডু দ্যাট ।‘
‘ইউ শূড কাম উইথ আস টু মাই মামি’স হাউস ।‘ লুনা বলে ঐশীকে ।
‘হোয়াই ?’
‘বিকজ দেন ইউ উইল সি এনোদার সারপ্রাইজ । ইউ নো মাই মামি’স হাউস ইজ কাইন্ড অফ এ ভিলেজ । ইন দ্য টয়লেট ইউ ক্যান সি অল দ্য সিট ইফ ইউ লুক ডাউন । অলথো মাম সেইড উই উইল নট সি দ্যাট দিজ টাইম ।‘
‘হেই উই আর অনলি টকিং এবাউট সিটস ।‘ হাসতে হাসতে বলে নাহিদ ।
‘ইয়াহ । দ্যাটস ব্যাড । এন্ড ইউ নো আই লাইক দিজ কান্ট্রি । বিউটি ইজ সো পিউর পিউপিল আর সো ক্যান্ডিড স্পেশিয়ালি ভিলেজ পিউপিল । ‘ ঐশীও হাসতে হাসতে বলে ।
‘ইউ নো হোয়াট ইরিটেট মি মোর ?’ নাহিদ বলে ।
‘হোয়াট?’ ঐশী জিজ্ঞেস করে ।
‘মাই প্যারেন্টস । দে আর ফুল অফ হিপোক্রেসী । দে টক সো মাচ এবাউট ফ্যামিলি, বাংলাদেশ । বাট একচুয়ালি দে ডোন্ট মিন হোয়াট দে সে । হোয়াই দাদী ডাইড লাইক দিজ । মাই ড্যাড, মাই আঙ্কেলস ক্যান টেক হার টু স্টেটস, কানাডা অর অস্ট্রেলিয়া ।‘
‘ভাইয়া ইউ শুড কনট্রোল ইউর এঙ্গার । দাদী ওয়ান্টস টু স্টে হেয়ার ।‘ লুনা নাহিদকে থামাবার চেষ্টা করে ।
‘দ্যাটস এ লেইম এক্সকিউজ লুনা । অ্যাকচুয়ালী দে ডোন্ট ওয়ান্ট টু স্যাক্রিফাইস দেয়ার কমফোর্ট । ড্যাড হেইট সাম বাংলাদেশী আঙ্কলস ইন আওয়ার সিটি । বাট হোয়েন দে মিট ইউ উডন্ট বিলিভ হাউ দে বিহেভ, ঐশী । দে বিহেভ লাইক ভেরি গুড ফ্রেন্ডস । আই আসকড এবাউট ইট । এন্ড হি সেইড ইট কার্টেসী । কার্টেসী মাই ফুট । ইটস হিপোক্রেসী ।‘
‘উড ইউ স্টপ ভাইয়া ।‘ লুনা আবার নাহিদকে থামাবার চেষ্টা করে । কিন্তু তার আর দরকার হয় না । বিদ্যুৎ চলে আসায় সবাই আবার মুভি দেখতে বসে যায় ।
‘বড় ভাবী তুমি হিজাব পড়া শুরু করলে কবে থেকে ।‘ রুমু জিজ্ঞেস করে ঝর্নাকে । রাতের খাবার শেষে তিন বউ মিলে হাত পা ছড়িয়ে গল্প করতে বসেছে । তিন ভাই খাওয়ার পরে আবার কোথায় যেনো গেছে । বলে গেছে একটু পরেই ফিরে আসবে ।
‘এইতো বছরখানেক । হিজাব পরার পরে ফেসবুকে কোনো ছবি দেই নাই । তাই জানো না ।‘
‘কাজে অসুবিধা হয় না ।‘ শিলা জিজ্ঞেস করে ।
‘আমিতো সরকারী অফিসে কাজ করি । উপরে উপরে তেমন অসুবিধা হয় না । তবে জানোইতো এখনকার দুনিয়া । কিছু হইলেই মুসলিমদের দোষ ।‘
‘আমি বাবা ছোট চাকুরী করি । চাকুরীও পার্মানেন্ট না । তাই ...’ রুমু বলে
‘তাছাড়া আজকাল আমার খুব ভয় করে জানো ।‘ ঝর্না আবার বলে ।
‘কিসের ভয় ভাবী ?’ রুমু জিজ্ঞেস করে ।
‘ভিন দেশে ভিন পরিবেশে ছেলে মেয়ে বড় হচ্ছে । কখন কি হয় ?’ ঝর্না উত্তর দেয় ।
‘আমরা চেষ্টা করি বাসাতেই যতটা সম্ভব পরিবেশটা ঠিক রাখতে । ঐশী, রঞ্জু ইংরেজীতে কিছু বললে আমরা জবাব দেই না । ছেলে মেয়ে নিয়ে উইকএন্ডে ইউটিউবে বাংলা ছবি নাটক দেখি ।‘ শিলা বলে ।
‘হ্যা ঐশী, রঞ্জুতো চমৎকার বাংলা বলে । তবে এসব করেও লাভ হয় কিনা কে জানে । শোনো আমাদের ওখানে কিছুদিন আগে এক ঘটনা ঘটছে । ঘটনাটা বলি । রুমু নীচতলায় একটু চায়ের কথা বলে আসো না ।‘ রুমু নীচতলায় চায়ের কথা বলে অল্প সময় পরেই আবার আসে।
‘বল ভাবী কি ঘটনা ।‘
‘আমাদের পরিচিত এক বাংলাদেশী ভাই । কাছের মানুষই বলতে পারো । সারাদিন বাংলাদেশ বাংলাদেশ করতো । কমিউনিটির সব কাজেই অসম্ভব আগ্রহ নিয়ে অংশগ্রহন করতো । সোজা কথায় তাকে চিনে না এমন কেউ নাই বাংলাদেশী কমিউনিটিতে । হঠাৎ শুনি তার ছেলে বিয়ে করেছে এক কালো মেয়েকে । ছেলেটা ফর্সা কি হ্যান্ডসাম । মেয়ের আবার পাঁচ বছরের এক বাচ্চাও আছে আগের পার্টনারের সাথে । কি অদ্ভুত জানো ভাইটা মেনেও নিলো । বিরাট পার্টি দিলো । আমরা সবাই গিয়েছিলাম । মেয়ের মা সারা পার্টিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বলে বেড়াচ্ছে – সো সুইট, সো সুইট । এক সময় আমার কাছে আসলে আমি একটু কায়দা করে জিজ্ঞেস করলাম মেয়ে ধর্ম বদল করেছে কিনা । উত্তরে বললো - নো ওয়ে উই লাভ জিসাস । বাট ইউ বাঙ্গালী পিউপিল আর সো সুইট । মাই সান ইজ ইন এ আনহ্যাপি রিলেশান । আই উইস হি ক্যান ফাইন্ড এ সুইট বাঙ্গালী গার্ল । শুনে গা জ্বলে গেলো আমার ।‘
‘এসবতো সব জায়গাতেই কম বেশী হয় ভাবী । এসব নিয়ে চিন্তা করে লাভ কি ? তাছাড়া ভালো উদহারনওতো কম নাই । আর দেশেওতো শুনি আজকাল কত কিছু হয় ।’ রুমু বলে ।
‘আমি এত কিছু বুঝি না ভাই । আমি মসজিদের ইমামের মেয়ে । আজকাল নাহিদের সাথে ওর বাবার প্রায়ই খটমট হয় । মেয়েটা চুপচাপ তবে মনে মনে কি ভাবে কে জানে । সুখে থাকার জন্য বিদেশে থাকি । কি দামে সেই সুখ কিনতে হয় আল্লাহই জানে । তাই আল্লাহ আল্লাহ করি ভাই ।‘
রাত প্রায় বারোটা । তিনভাই বাইরে থেকে ফিরে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে
‘শফিক কাজের আছে কিন্তু । কোথা থেকে এত ভালো কফি যোগাড় করলো কে জানে ।‘ মেহেদি বলে ।
‘হুমম । জানিস খুব ভালো লাগছে আজ । কতকাল পর তিনভাই সারা খুলনা ঘুরে বেড়ালাম ।‘ মাহমুদ কফির কাপ টেবিলে রাখতে রাখতে বলে ।
‘দাদা একটা জিনিষ খেয়াল করেছিস ?’ মারুফ বলে ।
‘কি?’
‘খুলনা এখনও প্রানের শহর । কিন্তু খুলনার জায়গাগুলোর নাম দেখ – বয়রা, গোবরচাকা, লবনচোরা, ময়লাপোতা...এরকম বিশ্রী জায়গার নাম অন্য কোনো শহরে আছে কিনা কে জানে ।‘ মারুফ এই কথা বলতেই মেহেদির একমাত্র ছেলে শান ঢোকে রুমে ।
‘ড্যাড, ক্যান আই হ্যাভ এ বার্গার টুমরো ।‘
‘না শান । বার্গার খাওয়া যাবে না । কাল আমি তোমাকে আইসক্রিম কিনে দেবো ।‘ মারুফ বলে ।
‘ড্যাড, হোয়াট ইজ আংকেল সেইং ।‘ শান আবার বাবাকেই জিজ্ঞেস করে ।
‘আংকেল উইল বাই ইউ আইসক্রিম টুমরো । গো টু বেড নাউ । ‘ শান চলে যায় ।
‘শানকে বাংলাটা অন্তত বলতে বুঝতে শেখা ছোট ।‘ মারুফ বলে মেহেদিকে ।
‘মেজভাই তোর এই বাংলা বাংলা জিনিষটা আমার ভালো লাগে না । এসবের কোনো মানে নাই । তাছাড়া মাতৃভাষার সংজ্ঞাও বদলানো উচিৎ আমার মতে ।‘ মেহেদি উত্তর দেয় ।
‘কিরকম ?’ মাহমুদ কৌতুহলী স্বরে জিজ্ঞেস করে ।
‘মাতৃভাষা আসলে মায়ের ভাষা না । নাহিদ, লুনা, ঐশী সবার মায়ের ভাষাইতো বাংলা । কিন্তু এই ভাষাতে কেউইতো স্বচ্ছন্দ না । এমনকি ঐশী আর রঞ্জু নিজেরা যখন কথা বলে ইংরেজীতেই বলে । তাই মাতৃভাষা হওয়া উচিৎ যে ভাষায় সব চাইতে স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যায় সেটাই । মেজভাই তুই কি মনে করিস ঐশীর ছেলে মেয়ে বাংলায় কথা বলবে ? তুই যা করছিস তা হলো নিয়তিকে একটু দুরে ঠেলে দিচ্ছিস । তাও কতটুকু পারবি কে জানে ।‘ মেহেদির কথার রুঢ় সত্যতা তিন প্রবাসী ভাইকেই চুপ করিয়ে দেয় । পাশের রুম থেকে তিন বউ এর হাসির শব্দ পাওয়া যায় । কিন্তু তা ছাপিয়ে হঠাৎ নিচ থেকে বিলাপের সুরে কান্নার শব্দ ভেসে আসে । তিন ভাই, বউরা দোতলার বারান্দায় এসে দাড়ায় ।
‘মা চুপ কর । উপরে দাদারা ঘুমাচ্ছে ।‘ শফিকের গলা পাওয়া যায় ।
‘কি করমু ঘুম আসে না । বুবু সারারাত কথা কইতো । ও বুবুউউ তুমি কইইই গেলা...’ বিলাপের সুরে কান্নার শব্দ ভেসে আসে । দুরে কোথাও একটা কুকুরও মনে হয় কেদে ওঠে । দূর সম্পর্কের এক চাচীর কান্নায় নতুন করে আপনজন হারাবার কথা মনে হয় সালেহা মঞ্জিলের বারান্দায় দাড়ানো ছয়জন মানুষের......