- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 115
- Messages
- 1,101
- Reaction score
- 134
- Points
- 1,213
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
*****রোবট মানবী*****
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
মেজাজটা খুব খারাপ মিশুর । সি ল্যাংগুয়েজ দিয়ে একটা মাঝারী সাইজের প্রজেক্টে কাজ করছে । এই সেমিস্টারে এইটাই দুই ক্রেডিটের সেসনাল । হাসনাত স্যার ইচ্ছা করে সবচাইতে কঠিন প্রজেক্টটাই দিয়েছেন মিশুদের । ‘তুমি ফার্স্ট, শুভ, রাসেলও ভালো ছাত্র । তোমরা এই প্রজেক্ট করবেনাতো কে করবে ।‘ হাসতে হাসতে বলেছিলেন হাসনাত স্যার । আপত্তি করে নাই মিশু । করলেও অবশ্য লাভ হোতো না । স্ট্যাটিক ফাংশনের লাইব্রেরীটা প্রায় একাই তৈরী করেছে মিশু । আজকে শুভর দায়িত্ব ছিলো ঐটা টেস্ট করার । একটু কাজ করার পর ‘তুমিই টেস্ট করো আমার ভাল্লাগছে না । আর যদি না করতে পারো পরে আমি করে দেবো ।‘ বলেই ল্যাব থেকে বের হয়ে যায় শুভ । সেই থেকেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে । নবাবজাদা শাহানশাহ ‘ভাল্লাগছে না তাই উনি এখন কাজ করবেন না ‘ এবং এব্যাপারে আর কারো কোনো কথা থাকতে পারবে না । মিশুও চলে যেতে পারে এবং জানে পরে প্রয়োজন পড়লে শুভ ঠিকই কাজটা করে দিবে । কিন্তু জিদ করেই এখন কাজটা শেষ করছে মিশু । রাসেল অবশ্য কাজ করছে । তবে ওর নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত । মিশুকে সাহায্য করার সময় ওর নেই । ঘণ্টা দুয়েক পরে ল্যাব থেকে বের হয় মিশু রাসেল ।
‘শুভর কি আবার সেই কেস ?’ মিশু জিজ্ঞেস করে রাসেলকে । রাসেল মাথা নেড়ে সায় দেয় ।
‘আজিব । তিন বছরে এই নিয়া কয়টা হইলো? ‘
‘সাতটা ।‘ নির্বিকারভাবে উত্তর দেয় রাসেল ।
‘শোন । আমার একটা কাজ করে দিতে পারবি ।‘
‘কি কাজ ?’
‘আমি একটা টিশার্ট দিবো । তুই শুভকে দিবি । বলবি আমি গিফট করেছি । টিশার্টের বুকে পিঠে লেখা থাকবে ‘হৃদয় খালি আছে’ । পারবি? ‘
‘এইটা কি কইলি? কাছের বন্ধু হইয়া এমন মস্করা কেমনে করি ।‘ রাসেল অবাক গলায় বলে ।
‘মস্করা হবে কেনো ? আমার বাবা ভাড়াটে চইলা যাবার এক মাস আগে থেকেই বাসায় টু-লেট ঝুলাইয়া দেয় । শুভর প্রেমিকারা নোটিশ না দিয়াই চইলা যায় । তাই বেচারা এইরকম দেবদাস মার্কা মুখ নিয়া ক্যাম্পাসে ঘুইরা বেড়ায় । দেখতে খারাপ লাগে । এই টিশার্ট পড়লেতো বেশিদিন দেবদাস থাকতে হবে না । আর তাছাড়া এই টিশার্ট কিছুদিন পরপরই কাজে লাগবে আমাদের বাসার টু-লেট সাইনবোর্ডটা যেমন লাগে ।‘
‘শুরুটা কিন্তু তোরে দিয়াই হইছিলো মিশু ।‘
হলে ফিরতে ফিরতে মিশুরও তিন বছর আগের কথা মনে হয় । বরাবরই খুব ভালো ছাত্রী মিশু । এইচ,এস,সি এর পরে মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং দুই জায়গাতেই সুযোগ পেলো । কিন্তু বাবার অমতে ভর্তি হলো ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিংএ । বাবা চেয়েছিলো একমাত্র সন্তান মেডিক্যাল পড়ুক । মেয়েদের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং এর চাইতে ডাক্তারীই নাকি ভালো । বাবার এই কথা বলার কারনেই মনে হয় বেশী করে গো ধরলো ইঞ্জিনিয়ারিং-ই পড়বে । পড়তে এসে দেখে বাবার কথাই ঠিক । সারা ক্লাসে হাতে গোনা কয়েকটা মেয়ে । নিজের রোল নম্বর হলো ২৫ । রাসেলের ২২, শুভর ২৩ । রোল নম্বর ২৪ এক সপ্তাহ ক্লাস করার পরেই কোথায় যেনো চলে গেলো । তাই অধিকাংশ সেসনাল ক্লাসে হয় শুভর সাথে নাহয় শুভ আর রাসেলের সাথে করতে হয় । খুব অল্পদিনেই তুমি থেকে তুইতে নেমে আসে ক্লাসের সবার সাথে সম্পর্ক । কিন্তু মাথায় একরাশ কোকড়া চুল, একহারা লম্বা শ্যামলা শুভর সাথে সম্পর্কটা তুমিতেই আটকে থাকে ...এখনও আছে । হঠাৎ একদিন সার্কিটের সেসনাল ক্লাসে শুভ একটু কাপা কাপা গলায় বলে
‘মিশু তোমার জন্য না আমার কেমন জানি একটা ফিলিংস হয় ।‘ গত দুই তিন সপ্তাহ যাবত এই ভয়টাই পাচ্ছিলো মিশু । এমনিতে নাক চোখ মুখে আলাদা কোনো সৌন্দর্য নাই মিশুর । তবে বাবার টকটকে গায়ের রং এর কিছুটা আর মায়ের মিষ্টি চেহারার কিছুটা নিয়ে মিশু মোটামুটি আকর্ষনীয়া । তাই এই অল্প একটু জীবনে আগেও দুই তিনবার এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে । সেই অভিজ্ঞতা থেকেই জানে কিভাবে এসব গোড়াতেই নির্মূল করতে হয় । হাসতে হাসতে রাসেল, অভিসহ আরো কয়েকজনকে ডেকে মিশু বলে ...
‘এই তোরা শোন, শুভর নাকি আমার জন্য কেমন একটা ফিলিংস হয়, ও এখন সেটা ব্যাখ্যা করবে ।‘ অপমানে কিংবা রাগে শুভর মুখটা তখন থমথমে ।
‘কি ব্যাপার চুপ করে আছো কেনো ? নাকি কোনো সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে যেমন কি হবে বলা যায় না এটাও তেমন ।‘ প্রশ্নটা শুনে রাগে ক্ষোভে শুভ চলে যায় । সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে এর পরে অনেক কষ্ট হয়েছে মিশুর । এমন না যে শুভকে অপছন্দ করে । কিন্তু... মায়ের ফোন আসায় চিন্তাজাল ছিড়ে যায় ।
‘কবে বাসায় আসবি ?’ মা জিজ্ঞেস করে ।
‘দেখি বৃহস্পতিবার বিকেলে আসতে পারি?’ মিশু ছোট করে উত্তর দেয় ।
‘তোর বাবা আজকে আবার ...’
‘মা জানোইতো তোমাদের এসব আমি কতটা অপছন্দ করি ।‘ মায়ের কথার মাঝখানেই বলে মিশু ।
‘ঠিক আছে বৃহস্পতিবার কিন্তু আসিস । বড় চিংড়ী কেনা হইছে । তোর জন্য এখনও রান্না করতে পারি নাই ।‘
‘ঠিক আছে মা ।‘
হলে ঢুকে একটু কৌতুহলেই শুভর সর্বশেষ প্রেমিকা আইসক্রিম নিতুর রুমে যায় মিশু । আহ্লাদে ঢং করে গলে গলে পরে যায় বলে ক্যাম্পাসে নাম আইসক্রিম নিতু । নিতু রুমে নাই । অতএব ডাইনিংয়ে খেয়ে রুমে যেয়ে একটা ঘুম দেয় মিশু । বিকেলের মরা আলোয় ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসেই দেখে নিতু আর মিলি চা খাচ্ছে । নিতুর গায়ে একটা নতুন জামা ।
‘কিরে শুভ জামাটা গিফট করলো নাকি ?‘ কৌতুহলীস্বরে নিতুকে জিজ্ঞেস করে মিশু ।
‘ওর নামও আমার সামনে আর নিবি না । আমার লিস্ট থেকে ও একেবারে শিফট ডিলিট । রিসাইক্লিং বিনেও জায়গা নাই ।‘ রাগের সাথে উত্তর দেয় নিতু ।
‘এত খেপলি কেনো । নাকি মান-অভিমান ?’
‘আরে ও একটা পুরুষই না । তলে তলে অন্য কাউকে মনে হয় ভালোবাসে । আমার একটা কথাও ঠিকমতো শোনে বলে মনে হয় না । সবসময় অন্যমনষ্ক । ওর কথা বাদ । জামাটা কেমন হইছে বল । আমিই কিনছি ।‘ শেষ কথাগুলোয় আইসক্রিম নিতুকে পাওয়া যায় । গলে গলে পরা ...
‘কি বলব বুঝতে পারছি না ।‘ মিশু উত্তর দেয় ।
‘মানে কি?’
‘এখনও মাঝে মাঝে মার সাথে বসে পুরোনো দিনের সিনেমা দেখতে হয় বুঝছস । রাজ্জাক-ববিতা, আলমগীর-শাবানার সিনেমা । তোর জামার কাধের কাছে যতটা ছিড়া এতটুকু ছিড়লেই ববিতা-শাবানার ইজ্জত প্রায় চইলা যাইতো । তখন রাজ্জাক-আলমগীর এটিএম সামসুজ্জামানরে মাইরা নায়িকার ইজ্জত উদ্ধার করতো । ভাবতাছি ববিতা-শাবানা এই জামা পড়লে নায়ক কেমনে ইজ্জত উদ্ধার করবে ।‘
‘তুই কোন জামানায় আছোস মিশু?’ এতক্ষণ চুপ থাকা মিলি জিজ্ঞেস করে ।
‘কেনো?’
‘এই জামানায় নায়িকার ইজ্জত কন্ধছিড়া জামায় থাকে না । এই জামানায় নায়িকার ইজ্জত থাকে মোবাইলে । হোয়াটস অ্যাপ, ভাইবার কিংবা ম্যাসেঞ্জারে । ভিলেন পকেটে সেই ইজ্জত নিয়া ঘুইরা বেড়ায় । নায়ক শাকিব খান ঢিসুম ঢুসুম মাইরা সেই মোবাইল ইজ্জত উদ্ধার করে ।‘
‘বাপরে এত কিছু জানোস তুই মিলি । সাধে কি আর তোর নাম মাস্টারনি ।‘
‘তুইতো জানোস খালি ফার্স্ট হইতে । ক্যাম্পাসে তোরওতো একটা নাম আছে । রোমা ওরফে রোবট মানবী । শোন যেহেতু আমি মাস্টারনি এখন থেকে তোকে প্রতিদিন এক লাইন কইরা প্রেম ভালোবাসার কথা শুনামু ।‘
‘বল শুনি ।‘
‘এক লাইন না দুই লাইন বলি আজকে । ভালোবাসা হলো প্রেমিককে জাহান্নামে যাইতে বইলা সেইখানে ঠিকমতো পৌছাইছে কিনা সেটা নিয়া টেনশন করা । দুই নম্বরটা হইলো কনফুসিয়াস বলেছেন – একে অপরকে ভালোবাসো এটা কাজ না করলে অন্য একজনকে ভালোবাসো ।‘
‘এইসব কই পাস তুই মিলি ।‘ হাসতে হাসতে বলে মিশু ।
‘তবে যাই বলোস শুভটা একটা হোপলেস রোমান্টিক ।‘ মিলি বলে ।
‘বলছি না ওর নাম আমার সামনে নিবি না ।‘ ঝামটা দিয়ে বলে উঠে নিতু ।
‘তুই রাগ করস কেন । তোর হার্ড ড্রাইভ থেকেতো ও শিফট ডিলিট হইয়া গেছে । তবে এইসবে আসল লাভ হয় মিশুর ।‘
‘কি বলতে চাস ।‘ থমথমে গলায় বলে মিশু ।
‘শুভ এইসব নিয়া থাকে বইলাই না তুই বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় ফার্স্ট । মনে নাই থার্ড সেমিস্টার শুভ একটু মন দিয়া পড়লো আর রেজাল্ট কি হইলো । জিপিএ একদম পারফেক্ট ফোর ।‘
‘যা যা আমি কারো দয়ায় ফার্স্ট হই না ।‘ অনিচ্ছাসত্ত্বেও মনের তিতাটুকু কেমন জিহ্বা দিয়েও বের হয়ে যায় মিশুর । এরপরে আরো অনেক হাসি ঠাট্টা হলেও মনের তেতোভাবটা আর কাটাতে পারে না মিশু ।
শুক্রবারে বাসায় সকালে চেচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গে মিশুর । শুরু হয়ে গেছে । কুকুর বিড়ালের যুদ্ধ । সেই ছোট বয়স থেকেই দেখে আসছে । প্রথমদিকে মা বাবার এই ঝগড়ার সময়টা খুব ভয় ভয় লাগতো মিশুর । পরে গা সওয়া আর এখন ঘৃণা করে । অথচ ব্যাংক কর্মকর্তা বাবা আর কলেজের শিক্ষিকা মায়ের সংসারে আপাতদৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নাই । টাকা পয়সার সমস্যা নাই । একমাত্র সন্তান মিশুতো সব সময়ই বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করেছে । তবুও এই চলে হররোজ ... । সমস্যার শুরু নাকি বাবা মায়ের বাসর রাত থেকেই । বাবার গায়ের রং, চেহারা রাজপুরুষের মত । দাদা ছিলো স্বৈরাচারী । দাদার পছন্দে কনে একপ্রকার না দেখেই বিয়ে করতে হয় বাবাকে । বাসর রাতেই স্বপ্নভঙ্গ । সকালে দাদীকে মুখ কালো করে বাবা নাকি বলেছিলো ‘শেষ পর্যন্ত একটা কাকের ছায়ের সাথে আমাকে বিয়ে দিলা ।‘ এসবই অবশ্য দাদীর মুখে শোনা । দাদীই কাছের লোক ছিলো মিশুর । বাবা মায়ের সাথে একটু বয়স হবার পর থেকেই দূরত্ব তৈরী হতে থাকে মিশুর । বাবার সাথে তার মেজাজ-রাগের জন্য আর বিদুষী মায়ের সাথে কলেজ শিক্ষকতার জন্য । আজকাল মা বেশ চেষ্টা করে দুরত্বটা কমাবার । কিন্তু... । কিছু একটা ভাঙ্গার শব্দ হয় । নাহ আর শুয়ে থাকার মানে হয় না । কোনোমতে দুপুরটা পার করে বিকেলেই হলে ফিরে যাবো । আরতো বছর দেড়েক । আমেরিকার কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে খোজ নেয়া শুরু করেছে । কোথাও না কোথাও হয়ে যাওয়ারই কথা । তখন আর এসব দেখতে হবে না । তিতকুটা মনে ভাবে মিশু । বিকেলে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা হতেই
‘তোর না কাল বিকেলে যাবার কথা ‘ মা বাধা দেবাও চেষ্টা করে ।
‘নাহ মঙ্গলবার একটা ক্লাস টেস্ট আছে । কিছু পড়া হয় নাই ।‘
‘বাসায় বসে পড় ।‘
‘তোমার বাসায় কি পড়ার পরিবেশ আছে ।‘ বেশ রুক্ষভাবেই বলে মিশু । শুনে মা চোখ নামিয়ে নেয় ।
‘কুকুর বিড়ালের মত ঝগড়া না করে আলাদা থাকলেওতো পারো ।‘ ঝাঝের সাথে আবারো বলে মিশু । মাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাসা থেকে বেরও হয়ে আসে ।
ক্যাম্পাসে রিক্সা থেকে নেমেই রাসেলের সাথে দেখা ।
‘কই যাস । হাতে ঐটা কি ?‘ রাসেলকে জিজ্ঞাস করে মিশু ।
‘কিছু না, একটা পোস্টার । কবিতা উৎসবে যাচ্ছি । শুভ আগেই গেছে । ও ওর নিজের কবিতা পড়বেতো ।‘
‘চল আমিও যাই ।‘
‘তুই যাবি ?’
‘কেনো আমি গেলে কোনো অসুবিধা আছে ।‘
‘নাহ । অসুবিধা কি ? চল ।‘ দুজনে আড়াআড়ি মাঠের উপর দিয়ে হাটতে থাকে । মিশু কিছুটা আনমনে মৃদুকন্ঠে বলে ...
সন্ধ্যা হয়ে আসে—সন্ধ্যা হয়ে আসে
একা একা মাঠের বাতাসে
ঘুরি আমি—বসি আমি ঘাসে
ওই দূরে দেখা যায় কার লাল পাড়
প্রসাদের বউ বুঝি—পাশে বুঝি তার
প্রসাদ রয়েছে বসে-বাড়িতেছে সন্ধ্যার আঁধার
বছর আরেক হ’ল হয়েছিলো দু’জনের বিয়ে
মনে পড়ে; তারপর কুড়িয়ে-বাড়িয়ে
আজো তারা যায় নি হারিয়ে...
‘তুই কবিতা পড়স ?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রাসেল ।
‘কেনো তুই কি আমাকে অশিক্ষিত মনে করোস?’
‘নাহ । তোকে অশিক্ষিত মনে করবো কেনো । তবে তুই হইলি গিয়া রোমা । রোবট মানবী । রোবটরাও যে আজকাল কবিতা পড়ে জানতাম না ।‘ হাসতে হাসতে বলে রাসেল ।
‘কবিতা পড়ি । তবে কবি পছন্দ করি না । যেমন ধর তোদের গুরু জীবন বাবু । নামই জীবনানন্দ তার জীবনে আনন্দ কই সবইতো নিরানন্দ । প্রসাদের বউ কে নিয়েই কবিতা লিখতে হয়েছে । নিজের বউ ফিরেও তাকায় নাই । এমনকি যখন ট্রাম এক্সিডেন্টে কবি হাসপাতালে...মরন শয্যায়, তখনও লাবন্য দাশ টালিগঞ্জে অভিনয় নিয়ে ব্যস্ত । মাত্র একদিন হাসপাতালে কবিকে দেখতে গিয়েছিলেন । হাসপাতালে কবির সবচাইতে বেশী দেখাশোনা কে করেছে জানিস ? ‘
‘কে?’
‘কবি সজনীকান্ত দাশ । যে লোক জীবনানন্দকে সব চাইতে বেশী সমালোচনা করেছেন । পাগল, অকবি, পারভার্ট কত কিছু বলেছেন । সেই লোকই জীবনানন্দকে বাচাবার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য মন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়কেও নিয়ে এসেছিলেন । কি অদ্ভুত তাই না ?’
‘হ্যা অদ্ভুতইতো কবিকে পছন্দ করস না অথচ কবির পুরা জীবন মুখস্ত করে বসে আছস ।‘ হাসতে হাসতে বলে রাসেল ।
সোমবার দুপুরে ক্লাসে হঠাৎ মায়ের ফোন আসে মিশুর । ট্রাফিকের শব্দ, মায়ের কান্নার শব্দ ছাপিয়ে বুঝতে পারে বাবা হাসপাতালে । কোনোমতে কোন হাসপাতালে আছে তাও জানতে পারে । ঘণ্টা দেড়েক পরে হাসপাতালে পৌছে দেখে বাবা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আর মা মাথার পাশে বসে মাথা টিপে দিচ্ছে । মিশুর অনভ্যস্ত চোখে ভালোই লাগে দৃশ্যটা । একটু পরেই ডাক্তার মিশু আর মিশুর মাকে ডাকেন । জানা যায় আরটারী শুধু ব্লকই না বেশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে । বাইপাশ সার্জারি করতে হবে এবং তা কালকেই । কিন্তু সুগার লেভেল একটু হাই থাকাতে সামান্য রিস্ক আছে । কিন্তু দেরী করলে যেকোনো সময় কার্ডিয়াক এরেস্ট হতে পারে । ‘তোর বাবাকে এসব বলিস না’ । ডাক্তারের রুম থেকে বের হয়ে মা বলেন । কেবিনে ফেরত এসে দেখে বাবা আধশোয়া হয়ে বসে আছেন । কয়েকঘন্টার মাঝে বাবার বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে । কেমন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত চেহারা । একটু পর ডাক্তার নিজে এসে বাবাকে অপারেশনের কথা বললেন । এমনভাবে বললেন যেনো এটা ফোড়া কাটার মতই সামান্য কিছু । মিশুর ভালো লাগলো ডাক্তারকে । খবর পেয়ে অনেক আত্মীয় স্বজনও আসা শুরু করলো । এক ফাকে যখন অন্য কেউ কেবিনে ছিলো না বাবা মিশুর হাতটা ধরে আস্তে আস্তে বলেন ‘আমার যদি কিছু হয়ে যায়...তোর মাকে...’ বাক্যটা শেষ করতে পারেন না । কেমন একটা লজ্জিত হাসি দেন । মিশুর কেমন একটা অনুভুতি হয় ...এই বাবাকেতো সে চিনে না ।
বেশ রাত করে মাকে নিয়ে বাসায় ফিরে মিশু । ফিরেই আবার চলে যেতে উদ্যত হয় ।
‘কোথায় যাচ্ছিস ?’ মা জিজ্ঞেস করে ।
‘হলে । কাল সকালে একটা ক্লাস টেস্ট আছে । টেস্টটা দিয়ে আমি সোজা হাসপাতালে চলে যাবো ।‘ মিশু উত্তর দেয় । মা কেমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকেন ।
‘তুই কি আসলেও মানুষ নাকি যন্ত্র । আমি কি পেটে একটা অসম্ভব বুদ্ধিমান যন্ত্র ধরেছিলাম ।‘ তীব্র শ্লেষের সাথে বলেন মা । মিঠুর মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে যায় ।
‘মা আমি এখানে থাকলেতো কোনো লাভ নাই । আর তুমিও এখন যা করছো তা হচ্ছে গার্হস্থ্য অভিনয়, গার্হস্থ্য অর্থনীতির মত গার্হস্থ্য অভিনয় ।‘
‘কি বললি আমি অভিনয় করছি ।‘
‘হ্যা তাইতো । আর যাই হোক তুমিতো আর বাবাকে ভালোবাসো না । কিংবা বাবাও বাসে না । আমি আমার এতটুকু জীবনে সেরকম কোনো প্রমান পাই নাই ।‘ তীব্র ঝাঝের সাথে বলে মিশু । খপ করে মিশুর হাত ধরে মা ।
‘এদিকে আয়’ রাগে ফুসতে ফুসতে মা মিশুকে টেনে নিয়ে আসেন বেডরুমে । দাদার আমলের বিশাল আলমারিটা চাবি দিয়ে খোলেন । পাল্লা খুলতে একটু অবাকই হয় মিশু । একটা ছোট খাটো শাড়ির দোকানে যত শাড়ী থাকে তার চাইতেও মনে হয় বেশী শাড়ি আছে আলমারিজুরে । অধিকাংশই একদম আনকোরা, একবারো মনে হয় পরা হয় নাই । নিচের দিকের আর একটা পাল্লা খোলেন । দেশী বিদেশী ক্রিম কসমেটিক্সের ছড়াছড়ি...
‘এগুলো সব তোর বাবার কেনা । তোর বাবা সৌখিন মানুষ । চাইতো আমি জবরজং সাজুগুজু করে থাকি । এই শাড়ীটা দেখ । গত ইদেই কেনা । কোনো সুস্থ মানুষ এই বয়সে এত জমকালো শাড়ী পড়তে পারে ? তোর বাবার সাথে আমার রুচিতে মেলে না, অভ্যাসে মেলে না , মেজাজে মেলে না মিলে শুধু এক জায়গায় । তোর বাবার মত আমিও রগচটা । একটা কথা বললে দশটা কথা শোনাই ।‘ এতটুকু শুনে কেমন বিহ্বলের মত ধুপ করে খাটে বসে পরে মিশু ।
‘তোর জন্মের তিন বছর পর আমার জরায়ু ফেলে দিতে হয় । তোর দাদী নাতির আশায় তোর বাবাকে আর একটা বিয়ে করার জন্য কত চাপই না দিয়েছে । এক পর্যায়ে আমিও মত দিয়েছিলাম । কিন্তু তোর বাবা কিছুতেই রাজী হয় নাই । একবার জার্মানি গিয়েছিলো পড়াশুনা করার জন্য । এক মাস পরেই ফিরে আসে । তার নাকি দমবন্ধ হয়ে আসে ওখানে । আসল কারন ছিলো আমাকে ছাড়া সে থাকতে পারে না । তোদের মত আমরা কাকে কতটা ভালোবাসি ঠিকমতো হয়তো বোঝাতে পারি না । তাই বলে বলবি আমি অভিনয় করি ।‘ বলেই মিশুকে জড়িয়ে ধরে মা হুহু করে কাদতে থাকেন । মিশুও মাকে শক্ত করে ধরে থাকে ।
সকাল হতেই মাকে নিয়ে হাসপাতালে যায় মিশু । ঘণ্টা তিনেক পরেই শুরু হয় অপারেশন । একটু পরেই বাবার অফিসের হালিম চাচা আসেন
‘ভাবী চিন্তা করবেন না । অফিসের সবাই মহসিন এর জন্য দোয়া করছে ।‘
‘ধন্যবাদ ভাই আপনি আসছেন ।‘ মা উত্তর দেয় ।
‘কি বলেন আসবো না । মহসিন আর আমিতো প্রায় একই সময় থেকে ব্যাংকে আছি । মহসিন অবশ্য আমার চাইতে দুই ধাপ উপরের অফিসার । হিসাবমতে আমার ওকে স্যার বলা উচিৎ । আমি একবার দুইবার বলার চেষ্টাও করছি । কিন্তু মহসিনকেতো চেনেন এক ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে । এত বড় অফিসার । বলতাম শীতের দিনে অন্তত স্যুট পড় । না সে সবসময় আপনার হাতে বানানো সোয়েটার পরবে । বলতো আরাম লাগে । একদিনের জন্যও ক্যান্টিনে লাঞ্চ করতে দেখি নাই । সব সময় আপনার হাতের তৈরী লাঞ্চ ...’ এতটুকু শোনার পর মিশুর ফোন আসে । রাসেল কল করেছে ।
‘কিরে তুই কই। ক্লাস টেস্ট দিবি না ?‘ রাসেল জিজ্ঞেস করে । সংক্ষেপে বাবার অসুস্থতার কথা বলে ফোনটা রেখে দেয় মিশু । একটু দুরে হালিম চাচা তখনও মায়ের সাথে কথা বলছে ।
হাসপাতালের লম্বা বারান্দার কিনারে এক বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছে মিশু । এভাবেই ঘণ্টাখানেক যাবত বসে আছে । এর মাঝে আরো আত্মীয়স্বজন এসে পরেছে । সবাই মাকে ঘীরে কথা বলছে । ওসব শুনতে ভালো লাগছে না বলে মিশু একটু দুরে এই বেঞ্চিতে একা বসে আছে । হঠাৎ পাশে কেউ বসতেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে শুভ পাশে । রাসেলও আছে ।
‘তোর খবরটা শুভকে দিতেই বল্লো ও পরীক্ষা দেবে না । হাসপাতালে আসবে । আমিও দিলাম না । চলে আসলাম ।‘ রাসেল কৈফিয়তের ভঙ্গীতে বলে ।
‘বেশী চিন্তা করো না । সব ঠিক হয়ে যাবে ।‘ গম্ভীর গলায় বলে শুভ ।
‘আমার চারপাশের মানুষগুলো এত জটিল কেনো শুভ । একটু সহজ হলে কি ক্ষতি হোতো ?’ অনেককাল থেকে জমাট হওয়া অনেক মেঘ বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে মিশুর চোখে । নিজের অজান্তেই শুভর কাঁধে মাথা রেখে কাদতে থাকে রোবট মানবী মিশু...