- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 115
- Messages
- 1,101
- Reaction score
- 134
- Points
- 1,213
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
*****নারী-পুরুষ, মানুষ-মানুষ*****
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
সকালে অফিসে প্রথম কাপ চা নিয়ে মাত্র বসেছি এমন সময় ক্যারল ইগান আসলো টেবিলে । ক্যারল কানাডিয়ান । বাংলাদেশে আছে বছর তিনেক । সিডার উপদেষ্টা হিসাবে আছে এই অফিসে । নিজের চেষ্টায় বাংলা শিখেছে । এখন বেশ ভালোই বাংলা বলতে পারে । প্রাথমিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর বললো
“তোমার কাছে একটা ফেভার চাই মোস্তাফিজ ।“
-কি ফেভার ?
“আমার বন্ধু লিনা একটা প্রজেক্ট চালাচ্ছে । সিডার টাকাতেই । ওর সপ্তাহে একদিন পাঁচ/ছয় কিংবা আট ঘণ্টার আইটি সাপোর্ট দরকার । শুক্রবার হলেও অসুবিধা নাই । বরং সুবিধা ।“
-ওহ । অফিস কোথায় ?
“কাছেই বনানীতে ?”
-তাহলে অসুবিধা নাই ।
“আগেই হ্যা বলো না । শি ডাজন্ট হ্যাভ এনাফ মানি ফর দিস । শি ক্যান পে ইউ অনলি হান্ড্রেড এন্ড ফিফটি টাকা পার আওয়ার ।“ কেমন লজ্জা লজ্জা গলায় বলে ক্যারল । মনে হয় বান্ধবীর দারিদ্র্যতায় নিজেই ভীষণ লজ্জিত ।
আমিও একটা ঢোক গিলে ফেললাম । নাহ লজ্জায় না, মনের খুশী চেপে রাখতে । মগজের ক্যালকুলেটারে হিসাব শেষ এক নিমিষেই । পাঁচ ঘণ্টা মানে সাড়ে সাতশো, ছয় ঘণ্টা মানে নয়শো আর আট ঘণ্টা মানে বারোশো টাকা...সপ্তাহে মাত্র একদিন কাজ করে...উফফ ভাবা যায়!! তখন সারা মাস শেষে বেতন পাই সাড়ে ছয় হাজার । ক্যারল অবশ্য তা জানে না । চালের কেজি দশ টাকা থেকে মাত্র বারো টাকায় পৌছেছে । আচ্ছা এটা কি লিখলাম । শায়েস্তা খানের আমলে টাকায় আটমন চাল পাওয়া যেতো এই বাক্যটা মনে হয় আমাদের কলিজার মধ্যে গেথে গেছে । তাই দুই সময়ের তুলনা করতে গেলেই চালের দাম বলে ফেলি । চালের বাইরেও মানুষের অনেক খরচ আগে হোতো না এখন হয় । যেমন ধরুন মোবাইল বিল । তবে আমি এই তুলনা ঠিক মনে করি না সম্পুর্ন ভিন্ন কারনে । প্রাইমারী স্কুলে হঠাৎ হঠাৎ আটআনা দিয়ে একটা দুধমালাই আইসক্রিম কিনে খাবার মত বেহিসেবী বড়লোক হয়ে যেতাম । সেই আটআনার দুধমালাই আইসক্রিমের সাথে চকবার আইসক্রিমের কি কোনো তুলনা হয় । দামের কথা বাদ দিন আমার সেই জিহ্বাটাইতো নাই । কি লিখতে কি লেখা শুরু করলাম, মূল কাহিনীতে ফিরি ...
-ঠিকানাটা দাও ক্যারল । আর কবে থেকে যেতে হবে জানিও । মনের খুশী চেপে রেখে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বললাম ।
এভাবেই ক্যারলের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে শুক্রবার বনানী ২৩ নম্বর রোডের অফিসে যাই । ক্যারলের বান্ধবীর নাম আসলে সেলিনা রহমান । ডেপুটি টিম লিডার । তিনিই অফিসের সব । । কানাডিয়ান টিম লিডার তিন মাসে একবার সপ্তাহ দুয়েকের জন্য আসেন । প্রজেক্টটা নারীর ক্ষমতায়ন এর উপর । ধামরাইয়ের কোনো এক গ্রামে ফিল্ড অফিস আছে । এসবই রিসেপসনিস্টের কাছ থেকে দশ মিনিটের মধ্যেই জেনে গেলাম । দশ মিনিট পরেই সেলিনা রহমানের রুমে ডাক পড়লো । গড়পরতা বাঙ্গালী নারীর চাইতে বেশ কিছুটা লম্বা সেলিনা রহমান । পরে আছেন জিন্স আর একটা গেঞ্জি । দুটোই শরীর কামড়ে ধরা । মাথার চুল ছেলেদের মত ছোট করে কাটা । প্রসাধন বিবর্জিত মুখটা বেশ রুক্ষ লাগে ।
“তোমার নাম মোস্তাফিজ ।“ জিজ্ঞেস করেন সেলিনা রহমান । গলার স্বরটা অবশ্য মিষ্টি ।
-জ্বি । আমি ছোট করে উত্তর দেই ।
“তোমার বয়সতো অনেক কম । আমি ভেবেছিলাম ক্যারল অভিজ্ঞ কাউকে পাঠাবে । যাহোক বশীর সাহেবের কাছে একটা লিস্ট থাকবে । প্রতি শুক্রবার এসে কাজগুলো করবে ।“ বলেই উনি বশীর সাহেবকে ডাকেন । আমি বশীর সাহেবের সাথে রুম থেকে বের হয়ে আসি । প্রথম কাজই হলো ১৫টা ডস মেসিনে উইন্ডোজ আর মাইক্রোসফট অফিস লোড করা । ‘এই সামান্য কাজের জন্য এত অভিজ্ঞ্রতার কি দরকার’ মনে মনে বলি । ঘণ্টাখানেকের মাঝে টের পাই সারা অফিসে পুরুষ কর্মচারী মাত্র তিনজন । বশীর সাহেব, বিমল বাবু আর টিবয় মানিক । শুক্রবার অফিসের সবচাইতে ব্যস্ত দিন । কারন ফিল্ড অফিস থেকে সবাই এইদিন আসে । এই অফিসে বেতনও সাপ্তাহিক । শুক্রবারেই দেওয়া হয় । মানিক ছেলেটা কথা খুব বেশী বলে । একটু পরপর এসে বলবে...
“স্যার চা নিয়ে আসি ।“
-আগের চা-ই তো এখনও শেষ হয় নাই । আমি উত্তর দেই ।
“তাহলে স্যার কফি নিয়ে আসি ।“
-নাহ লাগবে না ।
“স্যার আমাকে কিন্তু কম্পিউটার শিখাইতে হবে ।“
-আচ্ছা । আমি আনমনে উত্তর দেই ।
“স্যার জিগাইলেন না কম্পিউটার শিখে কি করবো ?”
-কি করবে ?
“কেনাডা যামু স্যার । টিম লিডার পল এর সাথে কথা হইছে স্যার । পল বলছে কম্পিউটার শিখতে ।“
-ও আচ্ছা । আমি আবার আনমনে উত্তর দেই ।
“স্যার কেনাডায় নাকি মদের দোকান সব সময় খোলা থাকে । চাল ডালের মত মদ কেনা যায় । পলের বউ আসছিলো গতবার । হুরপরীর মত দেখতে ।“
-ও আচ্ছা । এই মেসিনের ফ্লপি ড্রাইভটা মনে হয় ঠিকমতো কাজ করছে না । সেইদিকে খেয়াল করতে করতে বলি ।
“স্যার গরীব মানুষ বেহেস্তে যাই কিনা ঠিক নাই । হুরপরী, মদ এইসব দেখার জন্য স্যার আমার কেনাডা যাইতেই হবে । ম্যাডামরেও এক ফাকে বলছি । স্যার, ম্যাডাম এর সাথে কিন্তু একটু সাবধানে চইলেন । সাংঘাতিক মহিলা ।“
-কেনো ? মানিকের শেষ কথাটা আমাকে কৌতুহলী করে তোলে ।
“দুইবার বিয়া করছে স্যার । দুই বেঢারেই লাত্থি মাইরা বাইর কইরা দিছে । আরো অনেক কিছু আছে । এইখানে আইছেন যখন সব জানবেন ।“ আরো একটু কৌতুহলী হই । কিন্তু মানিকের কাছে তা প্রকাশ করি না ।
পরের শুক্রবার অফিসে গিয়ে বশীর সাহেবের সাথে দেখা করি । মধ্যবয়স্ক বশীর সাহেব চশমার ফাক দিয়ে একবার আমাকে দেখে বলেন “বসেন।“ আমি সামনের চেয়ারটায় বসি ।
“আপনি গত শুক্রবারে টাইমশীটটা ঠিকমতো পুরন করেন নাই । লিখেছেন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা । আসলে আপনি অফিসে এসেছেন ১০টা ১২ মিনিটে আর অফিস থেকে বের হয়েছেন ৩টা ৫৬ মিনিটে । “ গম্ভীর গলায় বলেন বশীর সাহেব । আসলে এত খেয়াল করে টাইমশীট পুরন করি নাই । খুব অপমানিত হই । লোভনীয় টাকার অংকটাও অপমানে প্রলেপ দিতে পারে না । থমথমে গলায় বলি ...
-দিন ঠিক করে দিচ্ছি । আর চা-কফি খেতেও মনে হয় আধা ঘণ্টা নষ্ট হয়েছে । সেটা বাদ দিয়েই আমাকে পেমেন্ট করবেন ।
“এই যে ছোট ভাই রাগ করে ফেললা । আমি শুধু নিয়ম নীতির কথা বলেছি । আজকালতো কেউ এসব মানতে চায় না ।“ প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বশীর সাহেব বলছেন ।
-আমিতো নিয়ম নীতি মানতেই চাইছি । আমি স্বাভাবিক হতে পারি না ।
“মানিক দুই কাপ ফার্স্ট ক্লাস কফি নিয়া আয় । ছোট ভাইয়ের মাথা যেনো ঠান্ডা হয় ।“ আবারো হাসতে হাসতে বলেন বশীর সাহেব । কথা, হাসি সব আন্তরিক লাগে । ক্ষোভটা আর ধরে রাখতে পারি না । খুব সহজেই বশীর সাহেব বশীর ভাই হয়ে যান। ঐ অফিসে এরপরে বশীর ভাইয়ের সাথেই সবচাইতে বেশী সময় কাটাই । একাউন্টেন্ট আলেয়া ম্যাডাম অফিসে ছিলো না ঐদিন । বশীর ভাইয়ের কাছে পেমেন্টের খামটা রেখে গেছেন । পেমেন্টের খাম আর কাজের লিস্ট নিয়ে ঐদিনের মত কাজ শুরু করি । দুপুরে লাঞ্চ করি বশীর ভাইয়ের সাথে । দারুন অমায়িক লোক । অথচ প্রথমে কি ভেবেছিলাম...
পরের সপ্তাহে অফিসে যেতেই বশীর ভাই বলেন । আমার কম্পিউটারতো অন-ই হয় না । আজকে এইটাই নাম্বার ওয়ান প্রায়োরিটি তোমার । যাও আলেয়া ম্যাডাম এর সাথে দেখা করে এসে কাজ শুরু করে দেও । একাউনটেন্ট আলেয়া ম্যাডাম এর রুমে যাই । বয়স্ক মহিলা । টেবিলে কোনো কাগজপত্র নাই । একদম পরিষ্কার । শুধু এক কিনারে তিন চারটা ধর্মীয় বই দেখি ।
“আপনার কথা শুনেছি । আমি অবশ্য কম্পিউটার ব্যবহার করি না । আমার সহকারী করে । বসেন । আর এই তবারক দুইটা খান ।“ বলেই পাশের টেবিল থেকে একটা ছোট পিরিচ এনে আমার সামনে রাখেন । পিরিচে সাদা রঙয়ের দুইটা তবারক ।
“তাকাইয়া আছেন কেনো । আমার পীরবাবার তবারক । জানি আপনাদের জামানার ছেলে মেয়েরা এসব বিশ্বাস করে না । মিষ্টি মনে করেই খেয়ে ফেলুন ।“ আমি কথা বাড়াতে চাই না । তাই পিরিচ থেকে তবারক দুটো নেই ।“বিসমিল্লাহ বলে চোখ বন্ধ করে একটা নিয়ত করুন । তারপর মুখে দিন ।“ তাই করি । মানে করার ভান করি । কারন নিয়ত কি করবো খুজে পাই না । এরপরে প্রতি সপ্তাহেই চোখ বন্ধ করে দুইটা তবারক খাবার পর পেমেন্টের খাম হাতে পাইতাম । ঐ অফিসের সবারই তাই করতে হতো ।
বশীর ভাইয়ের ডেস্কে এসে একটু ঘাটাঘাটি করে বুঝলাম হার্ড ডিস্ক গেছে । বশীর ভাইকে জানালাম । “আমারো তাই সন্দেহ হইছিলো । কপাল ভালো ব্যাকআপ নেওয়া আছে । তাহলে আগামী সপ্তাহে সব সফটওয়্যার লোড কইরা দিও । এর মাঝে আমি হার্ড ডিস্ক আনাইয়া রাখবো । তুমি তাহলে অন্য কাজ করো ।“ অন্য কাজেই ঐদিনটা পার করি ।
পরের সপ্তাহে অনেকক্ষণ কাটাতে হয় বশীর ভাইয়ের ডেস্কে । অপারেটিং সিস্টেমসহ অনেক কিছু লোড করতে হয় । বশীর ভাই পাশে বসে টুকটাক গল্প করতে থাকেন ...
“বিয়া শাদীতো করো নাই ?”
-জ্বি না ।
“মেয়ে দেখতে গেলে অনেক কিছু খেয়াল করবা ? খালি মুখ আর গায়ের রং দেইখা গইলা যাইয়ো না ।”
-যেমন ?
“প্রথমে আসো পায়ের পাতা । পায়ের পাতা কেমন সেটা দেখেও অনেক কিছু বোঝা যায় ।“
-তাই নাকি ? একটু তাচ্ছিল্যের সাথে বলি আমি ।
“তোমাদের মিয়া এই সমস্যা । দুই পাতা পইড়া মনে করো সব জাইনা গেছো । শোনো যা বলতাছি সব হইলো শাস্ত্রের কথা । শাস্ত্র তৈরী হয় হাজার হাজার বছরের মানুষের সম্মিলিত জ্ঞান থেকে । ফালতু জিনিষ না ।“
-না না বলেন বশীর ভাই । মুখটা সিরিয়াস করে বলি । বশীর ভাইও সিরিয়াস মুখ নিয়ে শুরু করেন । পরবর্তী ঘণ্টাখানেক হাসের মত পায়ের পাতা যাদের সেইসব মেয়েরা কেমন হয় জানলাম । পা যাদের খুব ছোট তারা কেমন হয় তাও জানলাম এমনকি পায়ের বৃদ্ধাগুলি ছোট, বড়, মাঝারী কি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে তাও জানলাম । এতটুকু জানতে জানতে লাঞ্চের সময় চলে আসলো । লাঞ্চের পর আবার বশীর ভাইয়ের ডেস্কে এসে কাজ শুরু করলাম ।
“নারীর পশ্চাৎদেশও কিন্তু খুব গুরুত্বপুর্ন ।“ বশীর ভাই আবার বলা শুরু করেন । আমি একটু চমকে যাই । বশীর ভাই পাত্তাই দেন না । নিস্পৃহগলায় নারীর শ্রেনীবিভাগ করতে থাকেন পশ্চাৎদেশের আলোকে । মেডিক্যালের প্রফেসররা মনে হয় এভাবেই এনাটমির ক্লাস নেন । একটু পরেই বশীরভাইয়ের ডেস্কে কাজ শেষ হয় । নারীর শ্রেনীবিভাগ ঐ পর্যন্তই জানা হয় ।
এভাবেই সময় যায় । বিমলবাবু খুবই মৃদুভাষী লোক । কথা বলেন খুব কম । হাসেন বেশী । ফিল্ড থেকে দুই তিন সপ্তাহ পরপর আসেন মরিয়ম খালা । সবাই তাকে খালাই বলেন । দারুন মুখরা রমণী । অফিসের বস সেলিনা ম্যাডাম সম্বন্ধে অনেক মুখরোচক কথা শুনি । মরিয়ম খালার মুখেই সব চাইতে বেশী শুনি...
“ম্যাডামের গাড়ী আছে । তাও মাঝে মাঝে টেম্পুতে অফিসে আসে । বোঝো না কেনো ? খালেক সাহেব পরহেজগার মানুষ ছিলো । অফিসে দরজা বন্ধ কইরা কি করলো বেচারা চাকুরীটাই ছেড়ে দিলো । যে মহিলা দুই দুইজন স্বামীকে ডিভোর্স করে সেতো এমন হবেই ।“ শেষ বাক্যটাই আসল । ঐ সময়ে এরকম ভাবা যেতো না । এর মাঝে একদিনই আমার কাজ করতে হয়েছে সেলিনা ম্যাডামের সাথে । কোনো একটা রিপোর্ট ওপেন হচ্ছিলো না । একটু ঘেটেই বুঝতে পারলাম ফ্লপি ডিস্কটায় বেশ কিছু ব্যাড সেক্টর আছে ।
-এই ফাইলের আর কোনো কপি কি কোথাও আছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম ।
“নাহ । এটা খুব খুব দরকার । দেখো কিছু করতে পারো কিনা ।“ তখন নর্টন কমান্ডার নামে একটা ইউটিলিটি সফটওয়্যার খুব জনপ্রিয় ছিলো । কপালগুনে ঐ সফটওয়্যারটা দিয়ে ফ্লপি ডিস্কটা ঠিক করা গেলো । খুব খুশী হলেন ম্যাডাম ।
প্রতি শুক্রবারেই অফিস শুরু হয় আলেয়া ম্যাডামের রুমে । আজকাল তবারকের সাথে দুই একটা গল্পও শুনতে হয় । তার পীরবাবা কোন ক্যান্সার পেসেন্টকে ভালো করে দিছেন । কোন দম্পত্তি বিয়ের ১৭ বছর পরে ছেলের মুখ দেখেছে সেই গল্প শুনি । তেলতেলে মুখে এসব শুনতে ভালো লাগে না । তবে আলেয়া ম্যাডামের দেওয়া টাকার খামটা খুব খুব ভালো লাগে । লাঞ্চে বশীর ভাইও যথারীতি জ্ঞান দিতে থাকেন...
“এই যে বিমল সাহেবকে দেখো সাত চরেও রা করে না । সব সময় হাসি হাসি মুখ । এদেরকে কখনো বিশ্বাস করবা না ।“
-কেনো বশীর ভাই ।
“আরে মালাউন । মালাউনদের কখনো বিশ্বাস করা যায় ? শোনো আমার বাবার সব চাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো সমীর চাচা । সমীর চাচা অনেক জমি একরকম জোর করেই বাবার কাছে বিক্রি করলো । বাবাও ভাবলো দাম যখন অনেক কম কিনেই ফেলি ।“
-দাম কম কেনো বশীর ভাই ।
“আরে হিন্দুদের জমির দাম অনেক কমই হয় । তুমি দেখছি কিছুই জানো না ।“ তারপরো কেনো কম হবে বুঝি না । তবে আর কোনো প্রশ্ন করি না ।
“হঠাৎ একদিন বাবা শুনেন সমীর চাচা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছেন । ভারতে । কেউ জানে না কখন গেলেন । বাবা যখন বললেন সমীর চাচার অনেক জমি কিনেছেন তখন দেখা গেলো গ্রামের আরো দুইজনের কাছে একই সম্পত্তি সমীর চাচা বিক্রি করে গেছেন । কিযে ঝামেলা হলো এরপর । বাবার কষ্টের টাকার অনেকটাই নষ্ট হলো । কিছু জমি অবশ্য পেয়েছেন । তার দাম এখন অনেক ।“
পরের শুক্রবার অফিসে ঢুকেই পুলিশের গাড়ী দেখতে পারলাম । শুনলাম আলেয়া ম্যাডাম অফিসের পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে লাপাত্তা । আরো বিস্তারিত জানার জন্য বশীর ভাইয়ের ডেস্কে গেলাম । উনিও নাই । বিমলবাবু নাকি রোড এক্সিডেন্ট করে কোন ক্লিনিকে আছেন । বশীর ভাই নাকি সেটা নিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করছেন । ঘণ্টাখানেক পরে সেলিনা ম্যাডাম সবাইকে ডাকলেন । খুব সংক্ষেপে বললেন আজকে কারো পেমেন্ট করা যাচ্ছে না । তবে আগামী সপ্তাহে পেমেন্ট করা হবে । বকেয়াসহ । এখন থেকে আর ক্যাশ দেওয়া হবে না । সব হবে চেক পেমেন্ট । আশ্চর্য একবারো আলেয়া ম্যাডামের কথা তুললেন না । দুপুর নাগাদ বশীর ভাই এলেন অফিসে ।
“বুঝলা মানুষটার অবস্থা যে এত খারাপ বুঝা যায় না । বাসায় বসার মত একটা চেয়ারও নাই । মফশ্বল শহরে পাঁচ ভাইবোনের সংসার সেই চালায় । এইখানে নিজের সংসারতো আছেই । ক্লিনিকের প্রাথমিক বিলতো আমি দিছি । দেখি সেলিনা ম্যাডামের সাথে কথা বলে আর কিছু করা যায় কিনা । বিকালে আমার সাথে যাইও । কাছেই ক্লিনিক ।“ অতএব অফিস ছুটির পর যাই ক্লিনিকে । বিমল বাবুর দুই পাই প্লাস্টার করে উপর দিকে টানানো । কিন্তু মুখের হাসিটা ঠিক আগের মত আছে ।
“বশীর সাহেব যা করলেন এই কয়দিন নিজের ভাইও এতটা করে না । এই ঋণ যে কিভাবে শোধ করবো ।“ মৃদু কন্ঠে বলেন বিমল বাবু ।
-সুস্থ হইয়া অফিসে একদিন ফিস্ট দিয়েন তাইলেই শোধ হইয়া যাবে । কি বলো মোস্তাফিজ ? হাসতে হাসতে বলেন বশীর ভাই ।
পরের সপ্তাহে অফিসে ঢুকেই শুনতে পেলাম সেলিনা ম্যাডাম তলব করেছে । রুমে ঢুকতেই বললেন “প্রজেক্ট রিপোর্ট জমা দিতে হবে তিন সপ্তাহের মধ্যে । তুমি আগামী দুই সপ্তাহ আমাকে সাহাযা করবে রিপোর্টটা তৈরী করতে ।“ পরবর্তী দুই সপ্তাহ সেলিনা ম্যাডামের সাথে কাজ করলাম । কাজের প্রতি এতটা একনিষ্ঠ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি । আমি মূলত বেশ কিছু এক্সেল গ্রাফ তৈরী করে সেটা ওয়ার্ড ডকুমেন্টে লিঙ্ক করেছি । অনেক ডাটা ফরমাটিং এও সাহায্য করেছি । তবে মূল কাজটা ম্যাডাম নিজেই করেছেন ।
এর মাসখানেক পরে সেলিনা ম্যাডাম আবার ডাক দিলেন । রুমে ঢুকতেই বললেন দরজা বন্ধ করতে । আমার কেমন অস্বস্থি হলো । এই অফিসের প্রাক্তন কর্মচারী খালেক সাহেবের গল্পটাই মূল কারন...অস্বস্থির । তারপরো দরজা বন্ধ করলাম । ম্যাডাম একটা টিনের বাক্স বের করেন । সেখান থেকে একটা চুরুট বের করে লাইটার দিয়ে ধরান । এই এতটা সময় উনি একবারো আমার দিকে তাকান নাই ।
“তুমি কি চুরুট খাও?” আমাকে জিজ্ঞেস করলেন । এবারো আমার দিকে না তাকিয়ে ।
-জ্বি না । আমি ছোট করে উত্তর দেই ।
“তোমাকে ডেকেছি একটা খুশির সংবাদ শেয়ার করতে । আমাদের প্রজেক্ট রিপোর্টটা সিডা খুব পছন্দ করেছে । আরো ফান্ডিং পাওয়া গেছে । । বেশ কিছু অসহায় নারীর উপকার হবে । তবে এবার সব কাজ হবে ফিল্ডে । এই অফিসটা থাকবে না ।“ শেষ কথাটা বলার সময় প্রথমবারের মত আমার দিকে তাকান ।
“কি ব্যাপার । তুমি ঘামছো কেনো ?” একটু অবাক গলায় জিজ্ঞেস করেন সেলিনা ম্যাডাম ।
-কই নাতো ? তাড়াতাড়ি বলার চেষ্টা করলাম ।
“ওহ তুমি খালেক সাহেবের গল্প শুনে ফেলেছো ? ছিঃ ছিঃ আমারই ভুল । এখান থেকে বের হলেই তোমাকে অনেকগুলো অস্বস্তিকর প্রশ্ন শুনতে হবে । দাড়াও চুরুটটা নিভাচ্ছি, তুমি দরজা খুলে দেও ।“ দরজাটা খুলতেই মরিয়ম খালাকে দেখতে পেলাম । মনে হলো দরজার কাছেই দাড়িয়ে ছিলো । আশে পাশে আরো কিছু মহিলাকে দেখতে পেলাম । সবাই হঠাৎ করেই যেনো কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো । আমি আবার চেয়ারে এসে বসলাম ।
“দরজার আশে পাশে অনেকজনকে দেখলে তাই না ?”
-জ্বি মানে । আমি ইতস্তত করি ।
“আমি জানি । ভাগ্য ভালো আমার মনে পরেছে । এদেশের অধিকাংশ মহিলাদের জীবনে-শয্যায় উত্তেজনাকর কিছু ঘটে না । তাই অন্যের জীবনে-শয্যায় তাদের এত বেশী উকিঝুকি দিতে হয় । খালেক সাহেবকে দরজা বন্ধ করে আমি আসলে বরখাস্ত করি । কারণ এই প্রজেক্টের দুইটা মেয়েকে উনি কুপ্রস্তাব দিয়েছিলেন । অফিস থেকে যাবার আগে উনি কি একটা প্রচার করে গেলেন । কি আশ্চর্য জানো সবাই সেটাই বিশ্বাস করলো । এমনকি সেই দুইটা মেয়ে পর্যন্ত । সুফী মানুষের মত চেহারা । আর আমি দুইবার ডিভোর্সি । খালেক সাহেবের কথা বিশ্বাস করাই স্বাভাবিক । আমি অনেক আগে থেকেই এসব পরোয়া করি না ।“ এতটুকু বলে কলিংবেল বাজান সেলিনা ম্যাডাম । মানিক আসলে দুইকাপ কফির কথা বলেন ।
“আজকে মনটা খুব ভালো । তোমার সাথে কথা বলতে বেশ ভালো লাগছে । আচ্ছা খালেক সাহেবের ঘটনা ছাড়া আর কি শুনেছো আমার সম্বন্ধে ।“
-না মানে তেমন কিছু না । আমি বলতে চাই না ।
“থাক বলতে হবে না আমি জানি কি শুনেছো ।“ সরল একটা হাসি দিয়ে বলেন সেলিনা ম্যডাম ।
“আমার মা বছরের দশ মাসই অসুস্থ থাকতো । আমি ছিলাম মায়ের একমাত্র সন্তান । আমি ক্লাস নাইনে থাকতে বাবা আর একটা বিয়ে করেন । তারপর থেকে মা শুয়ে শুয়ে শুধু আমাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখতেন । বাবা পনের দিনে এক মাসে একবার আসতেন । মাসের খরচাপাতি দিতে । বাবাকে অপছন্দ করতাম । কিন্তু ঐসব দিনে মাকেও ভীষণ ঘৃণা করতে ইচ্ছা হোতো । বোকা মায়ের বিবর্ণ গালে ঐ দিনগুলোতেই রঙয়ের ছোপ দেখা যেতো । বাবাকে নিয়ে কিছু বললেই মা বলতো ‘মানুষটা খারাপ না ‘। আমার অসহ্য লাগতো । আচ্ছা আমি যে মাঝে মাঝে টেম্পুতে অফিসে আসি জানোতো ?“ গল্পের মাঝেই জিজ্ঞেস করেন সেলিনা ম্যাডাম ।
-জ্বি শুনেছি ।
“মুখরোচক কোনো গল্পও শুনেছো নিশ্চয় । বাদ দেও উত্তর দিতে হবে না । আমি জানি । আমি সাত সকালে টেম্পুতে উঠি গার্মেন্টস এর মেয়েদের দেখার জন্য । নারী স্বাধীনতার নেত্রী বলতে তোমরা জানো তসলিমা নাসরিনের কথা । গত সপ্তাহের কথাই বলি । গার্মেন্টস এর অনেকগুলো মেয়ের সাথে এক টেম্পুতে উঠেছি । এক কর্নারে এক বয়স্ক মানুষও উঠেছেন । হঠাৎ ১৪/১৫ বছরের এক মেয়ে চিৎকার করে ‘পাছায় চিমটি কাটেন ক্যান বুড়া মিয়া । কবরে এক পাও দিছেন তাও হাউস যায় না । চল শেফালী এখানেই নাইম্মা যাই । খবিশ বুইড়ার শইলেও কি গন্ধ ।‘ তুমি যদি দেখতা বুড়ার চেহারা । তসলিমা নাসরীন সাতবার জন্ম নিলেও এমন কাজ করতে পারবে না । দশ বছর পরে তুমি অন্য বাংলাদেশ দেখতে পারবে । অন্তত আমি তাই স্বপ্ন দেখি । “ এর মাঝে মানিক কফি দিয়ে যায় ।
“বয়সের নিয়মে প্রেমেও পড়লাম । একবার না দুইবার । কপাল খারাপ দুইবারই দুইজন অসৎ শুয়োরের সাথে । আমার এসব নিয়ে কোনো আক্ষেপ নাই অবশ্য । নিজেকে নিয়ে এত কথাও কখনো বলি না । আজকে মনটা বেশ ভালো বলেই বললাম ।“
এর অল্পদিন পরেই অফিসটা বন্ধ হয়ে যায় । ধামরাইয়ের ফিল্ড অফিসের ঠিকানা অবশ্য জানতাম । কিন্তু কখনো যাওয়া হয় নাই । এর আট বছর পরে সেলিনা ম্যাডামের সাথে আবার একবার দেখা হয় । দুই মিনিটের জন্য । অফিসের কাজে লন্ডন যাবো । এয়ারপোর্ট রোডে ভয়াবহ জ্যামে পড়লাম । এয়ারপোর্ট পৌছালাম অনেক দেরীতে । সিকিউরিটি চেক করে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে শুনি আমার নাম এনাউন্স হচ্ছে । মোটামুটি একটা দৌড় দিচ্ছি গেটের দিকে । হঠাৎ শুনি কে যেনো ডাকছে “এই মোস্তাফিজ এই মোস্তাফিজ ।“ পিছনে ফিরে দেখি জিন্স টপস পড়া এক মহিলা আমাকে ডাকছেন । কোলে দেবশিশুর মত এক ছেলে । প্রথমে চিনতে পারি না । হাসি দিতেই চিনতে পারি ।
-সেলিনা ম্যাডাম কেমন আছেন ? কোথায় যাচ্ছেন । ছেলেটা কে ? তাড়াহুড়ায় অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেলি ।
“বাবা এত প্রশ্ন । কানাডা যাচ্ছি । ভালো আছি । আর এইটা আমার ছেলে পূর্ণ ।“ এতটুকু বলাতেই আমার নাম আবার শুনতে পাই – এনাউন্সমেন্টে । সেলিনা ম্যাডামও শুনতে পান ।
“ও তোমার ফ্লাইট মনে হয় ছেড়ে চলে যাচ্ছে । যাও আবার কোথাও দেখা হবে ।“ বলে বিদায় দেন সেলিনা ম্যাডাম । আমিও দ্রুত গেটের কাছে যাই । গেটে ঢুকবার আগে একবার পিছন ফিরে তাকাই । ছেলে কোলে একটু লম্বা চুলের সেলিনা ম্যাডামকে বেশ লাবন্যময়ী লাগে । লাগবেইতো । মায়েদের চাইতে বেশী লাবণ্যময়ী আর কেউ কি আছে ...