- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 115
- Messages
- 1,101
- Reaction score
- 134
- Points
- 1,213
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
*****দুই মানবী*****
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
গাজীপুরের গজারি বনে এক ছোট প্যান্ডেলের নিচে বসে আছি । অফিসের পিকনিক । নিজের অফিসের না । শাহেদ ভাইয়ের অফিসের পিকনিক । শাহেদ ভাইয়ের সাথে পরিচয় বেশী দিনের না । আর এক বন্ধুর চাচাতো ভাই । আমার তিন চার বছরের বড় হবেন । চোখে মোটা চশমা, মাথার চুল সামনের দিকে পাতলা হয়ে আসছে, বিশেষত্বহীন চেহারা । মানুষটাও ছোট খাটো । তারপরেও শাহেদ ভাইকে আমার মত অনেকে শ্রদ্ধা করে । কারন মানুষটা আসলে একটা জ্ঞান সাগর । রাজনীতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য এমন কোনো বিষয় নাই যার সম্বন্ধে শাহেদ ভাই এর কোনো জ্ঞান নাই ।
কিছুদিন যাবত চাকুরী বদলাতে চাচ্ছি । শাহেদ ভাইকেও বলেছি । বলেছিলেন দেখবেন । এর মাঝে এই পিকনিক আসাতে বললেন ‘তুই আমার গেস্ট হিসাবে চল । অনেক বড় বড় অফিসার আসবেন । পরিচিত হলে কাজে লাগতে পারে ।‘ শুক্রবার দিন এমনিতেও আমি কোনো রাজকার্য করি না । তাই রাজী না হবার কোনো কারন থাকে না । আর কিছু না হলেও শাহেদ ভাইয়ের সাথে গল্পতো করা যাবে । গত আড্ডায় রবীন্দ্রনাথের প্রেম নিয়ে গল্প বলা শুরু করেছিলেন । আজকে হয়তো আরো শোনা যাবে । কিন্তু সকাল থেকেই দেখছি শাহেদ ভাই ছোটাছুটিতে ব্যস্ত । ডি, জি, এম এর মাথা ব্যথা । শাহেদ ভাই কোথা থেকে ডিস্পিরিন যোগাড় করে এনে দেন । চীফ একাউন্ট সাহেবের রৌদ্রে মাথা ঘোরে তার জন জন্য ছাতা যোগাড় করে দেন । এখন খাওয়া দাওয়া শেষে প্যান্ডেলের নিচে বসেছি শাহেদ ভাই এর সাথে । এক মিনিট পরেই জি এম আসেন
‘শাহেদ। তোমার ভাবীর খাওয়ার পরে পান খাওয়া অভ্যাস । সব কিছু এনেছে জর্দা আনে নাই । দেখো কিছু করা যায় কিনা ।“
-জ্বি স্যার । কোন ব্রান্ডের জর্দা ? তেলতেলে গলায় বলেন শাহেদ ভাই ।
‘আরে এই জঙ্গলে ব্রান্ড খুজে লাভ কি ? যেকোনো একটা পাও কিনা দেখো ।‘
-ভাবী খাবেন । যাতা জিনিষতো আনা যায় না । একটু কি হাত কচলাতে কচলাতেই বলেন শাহেদ ভাই ।
‘দেখো বাবা জর্দা পাওয়া যায় কিনা ।‘
-জ্বি স্যার দেখছি । বলেই কেমন তড়িঘড়ি চলে যান শাহেদ ভাই ।
মুখের ভিতরটা কেমন তেতো লাগে । অনেক আগে একটা বিদেশী মুভি দেখেছিলাম । কাহিনীটা এরকম । এক বাচ্চা ছেলের হিরো তার বাবা । বাবা চালের বস্তা অনায়াসে তুলে নিতে পারে, দুই হাত ছেড়ে সাইকেল চালাতে পারে এমনকি তিনটা বল নিয়ে জাগলও করতে পারে । তার বাবার চাইতে সাহসী, শক্তিশালী, বুদ্ধিমান কেউ নাই । থাকতেই পারে না । বাবা ছিলো আসলে চোর । একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ রাস্তায় দেখে দুই তিনজন লোক তার বাবাকে মারছে । চুরির অপরাধে । মার খেয়ে বাবার কিছুই হয় না । কিন্তু বাবাকে ঘিরে ছেলের দুনিয়া চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় । অতটা না হলেও শাহেদ ভাই সম্পর্কে... এতটুকু ভাবতে ভাবতে পাশের আসনে কোট প্যান্ট পরা ভদ্রলোক এসে বসেন । দেখে মনে হলো কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা । আমার শাহেদ ভাই এর উপদেশ মনে পরে ।
-খাবারটা কিন্তু বেশ ভালো ছিলো । আমি আলাপ শুরু করার চেষ্টা করি । কথাটা শুনে ভদ্রলোক আমার দিকে ঘুরে তাকালেন । চেহারায় একরাশ বিরক্তি । প্রশস্ত কপালে গুনে গুনে চারটা ভাঁজ ।
‘আপনাকেতো চিনলাম না ।‘ আমি সংক্ষেপে নিজের পরিচয় দেই । শুনে ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ আরো দুইটা বাড়ে ।
“আমি জি এম মার্কেটিং । কোম্পানিতো আসলে আমরাই চালাই । অনেকেই মনে করে সেলস গুরুত্বপূর্ণ । বোকারা মনে করে ।“
-জ্বি আমিও তাই মনে করি । মার্কেট না থাকলে বেচবে কোথায় । আমি সায় দেবার চেষ্টা করি ।
“হুমম ।“ এতটুকু বলে ভদ্রলোক কপালে ভাঁজের সংখ্যা আরো একটা বাড়িয়ে কোর্টের পকেট থেকে কিছু কাগজ বের করে সেটায় মনোযোগ দেন । পরিষ্কারভাবে বলা – ফালতু লোকের সাথে এর চাইতে বেশী ফালতু আলাপ করবো না । তাও আমি পাশে বসে উশখুশ করি । আমার উশখুশ টের পেয়েই মনে হয় ভদ্রলোক এক দুই মিনিট পরেই উঠে চলে যান ।
আমি আশে পাশে তাকাই । প্যান্ডেলের সামনের দিকের চেয়ারগুলিতে সুন্দর পোশাক পরা নারীরা স্থান নিয়েছেন । কখন যেনো সামনে একটা ছোট স্টেজও তৈরী হয়ে গিয়েছে । বুঝলাম ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান হবে । এরকম পিকনিকে সব সময় যেমন হয় । শাহেদ ভাই তখনো মনে হয় বাবা জর্দা খোঁজায় ব্যস্ত । কয়েক মিনিট পরেই মাইক্রোফোন হাতে একটু আগেই আমার পাশে বসা জি,এম কে দেখি । অনুষ্ঠান শুরু হয় । জি এম সাহেব চমৎকার কথা বলেন । অল্প সময়েই অনুষ্ঠানকে জমিয়ে তোলেন । বিশেষ করে অনুঠানে উপস্থিত সুন্দরী নারীদের খুব চমৎকারভাবে প্রশংসা করতে থাকেন । দুইটা গান হবার পরে জি,এম সাহেব নিজেই বনলতা সেন আবৃত্তি করেন । ভরাট গলায় “চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার দিশা । মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য ...” । অসাধারন লাগে । আশ্চর্য ভদ্রলোকের কপালে একটা ভাঁজও দেখা যায় না । কেমন মায়াময় প্রেমময় মুখ ।
শাহেদ ভাই এর এক তত্ত্ব এর কথা মনে হয় ।
“এই যে মোরগটা গলা ফুলাইয়া কুক্কুরু বলে ডাকে । সিংহ কেশর ফুলাইয়া গর্জন করে । কেনো ?” কয়েকদিন আগেই শাহেদ ভাই জিজ্ঞেস করেছিলেন ।
-কেনো আবার এমনিতেই । আমি উত্তর দিয়েছিলাম ।
“প্রকৃতিতে কোনো কিছুই এমনি এমনি হয় না । মোরগ কিংবা সিংহ এরকম করে মুরগী অথবা সিংহীকে খুশী করার জন্য । প্রকৃতিতে নারীকে মোহিত করার জন্য পুরুষকে সব সময়ই রং-ঢং করতে হয় ।“
-এইটা কি বললেন শাহেদ ভাই । উল্টাটাইতো এতদিন শুনছি ।
“চারিদিকে একটু তাকাইয়া দেখিস । যে পেখম তুলে নাচা নিয়া কবিরা এত কাব্য করেছেন সেটা কিন্তু পুরুষ ময়ূররাই নাচে ।“
-এসব হয়তো জন্তু জানোয়ারের জন্য ঠিক । কিন্তু মানুষ ভিন্ন । তখন শাহেদ ভাইয়ের সাথে তর্ক করেছিলাম । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শাহেদ ভাইয়ের তত্ত্ব সঠিকও হতে পারে ... এতটুকু ভাবতে ভাবতেই উপস্থাপক জি, এম সাহেব অতিথি হিসাবে আমাকে ডাক দেন । স্টেজে । আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না । তাও যেতে হয় । স্টেজে উঠে কেমন নার্ভাস লাগে । জি,এম সাহেব আমাকে কিছু একটা করতে-বলতে বলেন । সামনের সারিতে সব সুবেশী সুন্দরী নারীরা বসে । শাহেদ ভাইয়ের তত্ত্বমতে আমারতো কেশর-পেখম কিছু একটা থাকার কথা । এতটা নার্ভাস কি করবো কি বলবো বুঝতে পারি না ...অবশেষে একটা কৌতুক মনে পড়ে ...
দুই মহিলা আলাপ করছেন । ভাবী আমার শাশুড়ি ছিলেন দেবীর মত । এতটুকু শুনেই অন্য মহিলা বলে উঠেন ভাবী আপনি কি লাকী । আমার শাশুড়ি এখনও বেচে আছে । হাড় মাংস জালিয়ে খাবার জন্য । ইসসস কবে যে আমি আপনার মত বলতে পারবো ।
বলা শেষে দেখলাম অনেকেই হাসছেন । সবচেয়ে বেশী হাসছেন উপস্থাপক জি,এম সাহেব ।
“আর একটা বলেন ।“ উপস্থাপক অনুরোধ করলেন । একই রকম আরো একটা কৌতুক মনে পড়লো ...
মলি জলি প্রতিবেশী । একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মলি দেখে পাশের জলির বাসায় বেশ ভীড় । গেটের সামনে বেশ কিছু মহিলা লাইন ধরে দাড়িয়ে আছেন । কৌতুহলী হয়ে মলিও গেলো । গিয়ে জলিকে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে ।
-কাল রাতে আমার শাশুড়ি মারা গেছেন । জলি উত্তর দিলো
“হঠাৎ । কিভাবে ?” মলি জিজ্ঞেস করে ।
-আরে আমার বাসার বড় কুকুরটা মেরে ফেলেছে শাশুড়িকে ।
“ওহ । কি সাংঘাতিক । এখনতো নিশ্চয় তোমরা কুকুরটাকে রাখবে না । আমাকে দিয়ে দাও । “ মলি অনুরোধের সুরে বলে ।
-আরে সেই নিয়েইতো সকাল থেকে ঝামেলা । বাইরে যে লাইন দেখছো ঐটা কুকুরটাকে নেওয়ার লাইন । তুমিও লাইনে গিয়ে দাড়াও । সিরিয়াল আসলে পাবে ।
কৌতুকটা বলে শেষ করলাম । আবার শুনলাম অনেকেই হাসছে । যথারীতি সব চাইতে বেশী হাসছেন উপস্থাপক । কিন্তু হঠাৎ দর্শক সারি থেকে এক মহিলা উঠে দাড়ালেন ...
“এরকম কৌতুক শুধুমাত্র পাষণ্ড পুরুষরাই বলতে পারে । আপনার লজ্জা হওয়া উচিৎ । যত্তোসব ...” বলেই গটগট করে মহিলা প্যান্ডেল থেকে চলে যান । মুহূর্তে নিস্তব্দতা নেমে আসে অনুষ্ঠানজুড়ে । লজ্জায় অপমানে আমি কুকড়ে যাই ।
“এখন বাচ্চারা একটা গান করবে । “ তাড়াতাড়ি সামাল দেবার চেষ্টা করেন উপস্থাপক সাহেব । আমি ষ্টেজ থেকে কুণ্ঠিত পায়ে নেমে আসি । প্যান্ডেল থেকেও একটু দুরে চলে যাই । একটু পরেই শাহেদ ভাই আসেন ।
“ধুর তুই দেখি মন খারাপ করছোস । আরে ঐ মহিলা এমনই । কারো সাথে কখনো হেসে কথা বলেন না । ডিভোর্সি । হয়তো শাশুড়ির সাথে ক্যাচাল ছিলো । “ সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেন শাহেদ ভাই । আমি কিছু বলি না । ফেরার পথে বাসেও শাহেদ ভাই মজার মজার জিনিষ নিয়ে আলাপ করেন । আমি হু-হ্যা করেই সামিল হই । তেমন জমে না আলাপ ।
তিনদিন পরেই শাহেদ ভাই ফোন করেন ...
“লিলি ম্যাডাম তোকে একটু দেখা করতে বলেছেন ? একদিন অফিসে আয় ।”
-কোন লিলি ম্যাডাম ? আমি জিজ্ঞেস করি ।
“ঐযে সেদিন পিকনিকে তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলেন ।“
-ওহ । আমি যে একটু ব্যস্ত । বলে এড়িয়ে চাই । কয়েকদিন পরে আবারো ফোন করেন শাহেদ ভাই । এবারো ব্যস্ততার অজুহাতে এড়িয়ে যাই ।
এর প্রায় মাস তিনেক পরের কথা । ঐ ঘটনার কথা তেমন আর মনেও নাই । চাকুরীও বদল করে ফেলেছি । নতুন চাকুরীতে শুক্র শনি দুইদিন ছুটি । এক শনিবার কোনো এক কাজে মতিঝিল গিয়েছি । কাজ শেষে ফেরার পথে ভাবলাম শাহেদ ভাইয়ের সাথে দেখা করে যাই । অফিসে গিয়ে শুনি শাহেদ ভাই অফিসের কাজে পাবনা আছেন । ফিরে আসবো এমন সময় পিছন থেকে কেউ একজন ডাক দেয় ‘এই যে শুনছেন ?’
পিছনে ফিরে দেখি সেই লিলি ম্যাডাম আমাকেই ডাকছেন ।
-আমাকে ডাকছেন । কাছে গিয়ে বলি ।
“জ্বি আপনাকেই । শাহেদকে দিয়ে অনেকবার খবর দিলাম । আপনি আসলেন না । এত রাগ ?”
-না মানে ?
“এত মানে মানে করতে হবে না । লাঞ্চ টাইম প্রায় হয়ে এসেছে । চলেন ক্যান্টিনে যাই ।“ শাহেদ ভাইদের অফিসের ক্যান্টিনের খাবার বেশ ভালো । তাছাড়া এখন আবার কোনো অজুহাতে চলে যাওয়া খারাপ দেখায় । তাই যাই লিলি ম্যাডামের সাথে ।
ক্যান্টিনে ভীড় তেমন নাই । এক ফাঁকা টেবিলে বসি ।
“শুনেছি আপনি শাহেদেরও ছোট । শাহেদ আমারও অনেক ছোট । তুমি করে বলি । আপনাকেও কি তুমি করে বলতে পারি ?“
-জ্বি পারেন । আমি ছোট করে উত্তর দেই ।
“কি খাবে বলো ?”
-জ্বি আমিতো এত তাড়াতাড়ি খেতে অভ্যস্ত না । শুধু চা হলেই চলবে ।
“আরে রাখো । সিঙ্গারা সমুচা খাওয়ার জন্য পেটে ক্ষুধা লাগে না । “ অতএব চা সিঙ্গারার অর্ডার দেন লিলি ম্যাডাম ।
“প্রথমেই সরি বলে নেই । সবার সামনে সামান্য দুটি কৌতুক নিয়ে ওরকম ব্যবহার করা আমার ঠিক হয় নাই ।“
-না না ঠিক আছে । আমি কিছু মনে করি নাই । আমি প্রসঙ্গে যেতে চাই না ।
“তোমাকে আসলে খুজছি আমার একটা গল্প বলার জন্য । যেহেতু সবার সামনে আমি তোমাকে অপমান করেছি তাই এই গল্পটা আমাকে বলতেই হবে ।“ আমি কিছু বলিনা । বেয়ারা এর মাঝে চা সিঙ্গারা দিয়ে গেছে ।
“ভার্সিটিতে এসে প্রেমে পড়লাম ।“ শুরু করেন লিলি ম্যাডাম ।
“শোভন ছিলো প্রেমে পড়বার মতই এক ছেলে । ভালো ছাত্র । খুবই সুদর্শন । তার চাইতেও বড় ব্যাপার অসাধারন ব্যক্তিত্ব । শোভনকে পছন্দ করতো না এমন মেয়ে ক্লাসে খুব কম ছিলো । প্রথম দুই বছর আমার ভালো লাগা নিয়েই কেটে গেলো । টের পেতাম শোভন আমি কাছাকাছি থাকলে একটু বেশী উচ্ছসিত থাকে । একদিন শাড়ী পরে অনেক সেজে গুজে ভার্সিটিতে গেলাম । ক্লাস শেষে যথারীতি আট দশজনের এক গ্রুপ নিয়ে ক্যান্টিনে গেলাম । হঠাৎ শোভন বললো ‘আজকে আমার অনেক খুশী লাগছে । আজকে তোরা যা খাইতে চাবি তাই খাওয়াবো ।‘ এটা শোভনের স্বভাব বিরুদ্ধ । শোভন কখনোই এতটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না । আমার বেশ ভালো লাগে । তারপর সিঙ্গারা হাতে নিয়ে ওর গভীর চোখে খুশীর ছটা নিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘আজকের সিঙ্গারাটাও অসম্ভব মজা । তাই না লিলি ?’ আমার ভিতরে বাঁধ ভেঙ্গে যায় । ভাবি এই ছেলে কবে ঠিকভাবে বলবে সেই অপেক্ষায় আর থাকা সম্ভব না । পরেরদিনই লাইব্রেরীর বারান্দায় বসে মনের অর্গল খুলে দেই । সব শুনে ও বললো আমিতো জানি । আমিওতো তোমাকে অনেক ভালোবাসি । হয়তো মুখে বলি নাই । কিভাবে ঠিকভাবে মুখে বলতে হয় আমি জানি না ।“
“স্বপ্নের মত দিন কাটতে লাগলো ।“ একটু থেমে আবার শুরু করেন লিলি ম্যাডাম ।
“খুব ছেলেবেলায় বাবা মারা গেছেন । স্কুল মাষ্টার মায়ের একমাত্র সন্তান শোভন । ইন্টারমিডিয়েট থেকেই শোভন নিজের খরচ নিজেই যোগাড় করে । এসব শুনে টানটা আরো বাড়ে । একসাথে পাশ করে দুজনে চাকুরীও পেয়ে যাই দ্রুত । বিয়েও করি চাকুরী পাবার দেড় বছরের মধ্যেই । তুমি খুব বিরক্ত হোচ্ছ । তাই না ।“ কথার মাঝখানে হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন লিলি ম্যাডাম ।
-একেবারেই নাহ । আমি আসলে আপনার কথার মাঝখানে কোনো কথা বলতে চাই নাই । আমি উত্তর দেই ।
“আমার শ্বাশুড়ি আধুনিক মহিলা । তখনও চাকুরী করতেন । প্রথমে খুব চমৎকার সম্পর্ক তৈরী হয় । কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে খটোমটো শুরু হয় । আমি আর শোভন কোথাও বেড়াতে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে আসলাম । বাড়ি ফিরে দেখতাম শ্বাশুড়ি মুখ হাড়ি করে বসে আছেন । মুখে একটাও খারাপ কথা বলতেন না । আসলে কথাই বলতেন না । কেমন গুমোট হয়ে থাকতেন । এই গুমোট যে কি অসহ্য তোমরা ছেলেরা বুঝবে না ।“
-এসবতো সব পরিবারেই একরকম । উনিশ আর বিশ । আমি হেসে বলি ।
“তা ঠিক । তবে একমাত্র ছেলে বলে ব্যাপারটা খুব বেশী ছিলো । আমি শোভনকে কখনো পছন্দমতো শার্ট প্যান্ট কিনে দিতে পারতাম না । শোভনের পছন্দ নাকি উনিই সবচাইতে বেশী জানেন । খাবারের ব্যাপারেও তাই । মাঝে মাঝে অসহ্য লাগতো । শোভনকে কিছু বললে ও কেমন অসহায় এর মত চেয়ে থাকতো । নিজেরই মায়া লাগতো । এর মাঝেই আমি প্রেগন্যান্ট হই । সত্যি বলবো ঐ সময়টায় উনি এত যত্ন করলেন আমার নিজের মাও এতটা করতো কিনা সন্দেহ । আর এক কাপ চায়ের কথা বলি ।“ আবার চায়ের অর্ডার দেন লিলি ম্যাডাম ।
“এরপরে আমি অনেক কিছু মেনে নেই...নিলাম । শ্বাশুড়ি অবসর নিয়ে নাতি নিয়ে মেতে উঠলেন । কিন্তু তিন বছর আগে আসলো সেই দিন । অনেকদিন আমরা কোথাও বেড়াতে যাই নাই । সেবার চার বছরের ছেলেকে নিয়ে আমরা সাতদিন কক্সবাজারে বেড়িয়ে আসলাম । শোভনের আগ্রহই বেশী ছিলো । রাতের খাবারের শেষে চা খাওয়া শোভনের অনেক দিনের অভ্যাস । চা নিয়ে আসার পরে খুব শান্তভাবে শোভন বললো ‘আমি মায়াকে ভালোবাসি । কাল সকালে আমি চলে যাবো ।‘ প্রথমে ভাবলাম শোভন ঠাট্টা করছে । কিন্তু জানি এরকম ঠাট্টা করার মানুষ শোভন না । ‘কক্সবাজারেই বলার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি । পারি নাই ...’ আরো কি কি যেনো বলছিলো তখন শোভন । আমার কানে কিছুই ঢুকছিলো না । এর চাইতে ভূমিকম্প কিংবা অন্য কোনো বড় এক্সিডেন্ট হলেও মনে হয় আমি সহজে নিতে পারতাম । দুই চারবার যে এরকম কিছু শুনি নাই । এমন না । মায়াকেও চিনি । শোভনের অফিসেই চাকুরী করে । তবে অনেক আগে থেকেই জানি শোভনকে অনেকেই পছন্দ করে । এর আগেও আরো দুইটা মেয়েকে নিয়ে এরকম উড়া কথা শুনেছি । পাত্তা দেই নাই । আমিতো চিনি আমার শোভনকে ... হায় মানুষকে কি সত্যিই চেনা যায় । হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম । শুনে আমার শ্বাশুড়ি আসলেন । অল্প সময়েই বুঝে ফেললেন সব । ছেলেকে কিছুই বললেন না । আমাকে শক্ত হাতে ধরে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন । পরদিন সত্যি শোভন চলে গেলো । যাবার সময় সামান্য একটা কথাও বলে গেলো না । আমার আর বোধবুদ্ধি রইলো না...জীবন মৃত যাকে বলে । শ্বাশুড়ি হাল ধরলেন । অফিসে ফোন করে কিভাবে কিভাবে যেনো এক মাসের ছুটির ব্যাবস্থা করলেন । আমার নাওয়া খাওয়া সব কিছুই নিজের হাতে করাতে লাগলেন । কয়েকদিন পরে এক ঝড় বৃষ্টির রাতে আমার মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন...
আমি জানি লিলি তোমার মনের মাঝে কি চলছে । ছাব্বিশ বছর আগে আমারো এরকম হয়েছিলো । শুনে একটু চমকে যাই । হ্যা ঠিকই বলছি । শোভনতো তাও তোমাকে জানিয়ে চলে গেলো । তোমার শ্বশুর কিছু না জানিয়েই চলে গেছিলো । তোমার শ্বশুরের চাকুরিতে মাঝে মাঝেই ট্যুরে যেতে হতো । এরকম এক ট্যুর থেকেই সে আর ফিরে আসে নাই । কিছুদিন পরে শুনেছি সে অন্য যায়গায় সংসার করছে । কিযে কষ্ট কিযে অপমান । আমি ঠিক বুঝতে পারি লিলি । স্কুলের চাকুরি নিলাম । তিলতিল করে মানুষ করলাম শোভনকে । আসলে মানুষ করতে পারি নাই । আমাকে ক্ষমা কোরো লিলি । এরপরে রাতভর ওনার কষ্টের জীবনের গল্প বলে গেলেন । সেটা এতই দুংখ কষ্টের গল্প যে এক পর্যায়ে নিজের কষ্টের কথাই ভুলে গেলাম ।
তোমার শ্বশুর তোমাদের বিয়ের তিন বছর আগে মারা যায় । আমি জানি শোভন কখনোই তোমাকে বলে নাই । কিন্তু বিশ্বাস করো লিলি মানুষটাকে আমি অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি । মানুষটা যদি একবার ফিরে আসতো ... এভাবেই গল্প শেষ করেন শ্বাশুড়ি ।
এই হলো আমার গল্প । যা তোমাকে বলার জন্য খুঁজছিলাম । শ্বাশুড়ি বউ এর সংঘাতের মূল কারণ যে একই মানুষের প্রতি ভালোবাসা এটা পুরুষরা জানে না । আমার কি মনে হয় জানো । পুরুষ আসলে ভালোবাসা বোঝেই না । এখন আমার সংসার ছেলে আর শ্বাশুড়ি নিয়ে । ভাই-বোন, বাবা-মা সবাই আবার নতুন করে জীবন শুরুর কথা বলে । আমিও মাঝে মাঝে ভাবি । কিন্তু অনেক রাতে যখন বাইরে কোথাও শব্দ হয় আমি টের পাই আমার শ্বাশুড়ি কি এক ব্যাকুল চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন । কিযে মায়া লাগে । বিশ্বাস করো এখন যদি শোভন ফিরে আসে, আমি কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো না । কিছুই মনে রাখবো না । তোমার কি মনে হয় সে ফিরে আসবে ? আকুল ভালোবাসা চোখে নিয়ে লিলি ম্যাডাম আমাকে জিজ্ঞেস করেন ...