কনক্রিটের হিসাব

dukhopakhi

Well-Known Member
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
115
Messages
1,101
Reaction score
134
Points
1,213
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
*****কনক্রিটের হিসাব*****

মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু






কুলি করার জন্য মুখে পানি দিয়েই বিরক্ত হলো রাজীব । ভীষণ লবনাক্ত স্বাদ । অথচ খুলনার পানি যে ভীষণ লবনাক্ত সেটা জানাই ছিলো । তিন সপ্তাহ আগে খুলনার পোস্টিং অর্ডারটা হাতে পেয়ে ভীষণ বিরক্ত হলো রাজীব । প্রথমে ভেবেছিলো তদবির করবে । তিন বছর আগে ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়ে নিজ মেধা আর যোগ্যতার বলেই একটা স্থান করে নিয়েছে রাজীব । সাধারন মানুষ যতই বলুক টাকা ছাড়া ডিপার্টমেন্টে কোনো কাজ হয় না রাজীব নিশ্চিত জানে মেধা আর যোগ্যতার মূল্য এখনও আছে । বেশ ভালোভাবেই আছে । এই পোড়া দেশ আর পোড়া সময়েও । তাই তদবির করলে ঢাকা থেকে যাবার সম্ভাবনাই বেশী ছিলো । কিন্তু যে প্রজেক্টে বদলি করা হয়েছে সেটা দেখেই পছন্দ হয়ে গেলো । বছরখানেক পরে যে বিষয়ে পিএইচডি করতে চায় রাজীব সেখানে এই প্রজেক্টের কাজ-ডাটা খুব মূল্যবান হতে পারে ।


অতপর এখানে আসা । চিরকালীন গোছানো স্বভাব অনুযায়ী আসার আগে খুলনা সম্বন্ধে বেশ বিস্তারিত জেনে এসেছে রাজীব । জানে একসময় শহরটার প্রান ছিলো অনেকগুলো বড় বড় জুটমিল । এখন যেগুলোর অধিকাংশই বন্ধ । তাই খুলনার জনসংখ্যা কিংবা শ্রীবৃদ্ধি তেমন হয় নাই । আরো জানে খুলনা আসলে বাংলাদেশের অংশ নাও হতে পারতো । ১৯৪১ এর সেনসাস অনুযায়ী খুলনায় হিন্দুদের বসবাস সামান্য বেশী ছিলো । আবার মুর্শিদাবাদ সহ আরো কয়েকটা মহকুমা ছিলো মুসলিম অধ্যুষিত । রাজনীতি যে বেশীরভাগ সময় নীতিহীন সেই সত্যটাই নতুন করে জানা হয় । তবে আর একটা জিনিষ জেনে খুব মজা লেগেছে । খুলনা শহরের বিভিন্ন এলাকার নাম । লবনচোরা, ময়লাপোতা, বয়রা,গোবরচাকা...



-হ্যালো । বেশ কয়েকটা রিং হবার পরে ফোনটা ধরে রাজীব ।
“কি ব্যাপার । এত দেরী করে ফোন ধরলে যে । “ ওপাশ থেকে নিশুর রাগী গলা শুনতে পায় ।
-নাহ । ফোনটা একটু দুরে ছিলোতো তাই ।
“তোমাকে না বলেছি তিন রিঙয়ের মধ্যে ফোন ধরবে । আচ্ছা তন্বীর বিয়েতে কি পরবো বলোতো । মেরুন কাঞ্জিভরম, জরী পারের কাতান নাকি নতুন কেনা লেহেঙ্গাটা ?“ চেষ্টা করেও তিনটার কোনোটার কথাই মনে আসে না রাজীবের । তাই বলে...
-তোমার যেটা ভালো লাগে সেটাই পরো না ।
“আবার । বলেছিনা যে প্রশ্ন করবো সেটারই উত্তর দিবে । সম্রাট আকবরের বাবার নাম জিজ্ঞাসা করলে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের বউ এর প্রেম নিয়া বলবে না । আর এমনতো না আমি তোমাকে সৃজনশীল প্রশ্ন করেছি । তোমাকে করেছি এম সি কিউ প্রশ্ন । ঝটপট বলে ফেলো ।“
-মেরুন কাঞ্জিভরমটাই পরো । ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে রাজীব ।
“জানতাম এটাই বলবে । ওহ শোনো না । আমার বান্ধবী যে জলি ওর না ব্রেক আপ হয়ে গেছে ।“
-তাই ? এবার বড় করেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রাজীব । ভেবেছে প্রজেক্ট রিপোর্টটা একটু পড়বে । নাহ কে জলি কোথাকার জলি কিছুই জানে না চিনে না । অথচ এখন আরো পনের বিশ মিনিট তার ব্রেক আপের গল্প শুনতে হবে । কোনো মানে আছে ?


নয় মাস আগে বিয়ে হয়েছে রাজীবের । নাহ এখনকার অধিকাংশ বিয়ের মত প্রেমের বিয়ে না । বাবা মা পছন্দ করার পর তিনদিন শুধু কিছুটা সময় কাটিয়েছিলো । তাও নিশুরই আগ্রহ ছিলো বেশী । বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে নিশু । তবে মেধা বুদ্ধি গড়পরতা । দ্বিতীয়দিনেই কথা প্রসঙ্গে তারাশংকরের উপন্যাস হাসুলি বাকের উপকথার কথা বলে রাজীব । অবাক হয়ে টের পায় বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী হয়েও নিশু উপন্যাসটাতো পড়েই নাই নামও শুনে নাই । তবে খুব বেশী অবাক হয় নাই রাজীব । সেই ছেলেবেলা থেকেই নিজের আশে পাশে সব সময়ই অতি সাধারণ মানুষ দেখেই বড় হয়েছে রাজীব । স্কুলে সেই ক্লাস ওয়ান থেকেই ফার্স্ট । দিন যত গেছে নিজেকে আরো উচ্চতায় নিয়ে গেছে রাজীব । এতটাই যে ক্লাস সেভেন এইটেই শুধু ছাত্ররা না কিছু শিক্ষকও রীতিমত সমীহ করা শুরু করে রাজীবকে । একই কারনে ঠিক সেভাবে কোনো বন্ধুও হয় নাই রাজীবের । বাসায় আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীদের মাঝেও একই রকম ইমেজ । এসএসসি,এইচএসসিতে সর্বোচ্চ ভালো রেজাল্ট করবে এটা জানা কথা ছিলো । আগেকার যুগ হলে স্ট্যান্ড করতো কিনা, করলে কততম হোতো সেটা একটা দেখার বিষয় ছিলো । গোল্ডেন জিপিএর কালেতো সেই সুযোগ আর নাই । প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ ছিলো । কিন্তু প্রথম সেমিস্টারেই যখন মগা আইয়ুব শুধু মুখস্ত বিদ্যা সম্বল করে ফার্স্ট হয় তখনই মনটা উঠে যায় রাজীবের । ঘোড়া হইয়া গরু-গাধার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতার কোনো মানে হয় না । অন্তত রাজীব তাই মনে করে ।



রাজীবের নিজের সম্বন্ধে উচ্চ ধারনা এখনও একই রকম আছে । একটুও কমে নাই । বরং বেড়েছে । নিজের জীবনের লক্ষ্যও অতি উচু । এতটাই যে মাঝে মাঝে ভেবে নিজেই রোমাঞ্চিত হয় । নিশু সাজতে ভালোবাসে, সংসার ভালোবাসে এসবে রাজীবের কোনোই সমস্যা নাই । কিন্তু বোকা বোকা কথা, অর্থহীন সময় কাটানো এসব রাজীবের কাছে অসহ্য লাগে । মনে আছে প্রেমিক বন্ধু রনি একবার বলেছিলো –‘দোস্ত কিযে ক্ষুদা নিয়া শান্তার সাথে দেখা করতে যাই । মনে হয় মাঠের সব ঘাসই খাইয়া ফেলি । অথচ তিন ঘণ্টা পরে দেখি একটা সিঙ্গারার অর্ধেক খাইছি ।‘ শুনে রাজীব বলেছিলো ‘মাঠের সব ঘাস খাইয়া ফেললে তাও কিছু লাভ হইতো লোক দিয়া ঘাস কাটাইতে হইতো না । মাঠের পাশে তিনঘণ্টা বইসা অর্ধেক সিঙ্গারা খাওয়া স্রেফ বেকুবের কাজ ।‘ আশেপাশের সবাই হেসে উঠলেও রাজীব কিন্তু গুরুত্ব দিয়েই বলেছিলো । এখন নিশুকেও বোঝাতে হবে জলি মলির নেকা নেকা প্রেম ছেকা ছেকা ব্রেকাপের গল্পে রাজীবের কোনো আগ্রহ নাই । যত তাড়াতাড়ি বোঝাতে পারবে ততই ভালো ।



খালিশপুর আবাসিকে বাসা ভাড়া নেওয়া হয়েছে । এসবই অফিসের লোক মারফত আগেই করা হয়েছে । বাসা চমৎকার । ভাড়াও খুব বেশী না । অফিসের গাড়িতেই অফিস-বাসা করা হয় । এখানে সেখানে রিক্সায় যাওয়া যায় । রিক্সা ভাড়াও বেশী না । শান্ত, ছিমছাম শহর । ভালোই লাগে রাজীবের । অফিসের ইমিডিয়েট বস আলতাফ সাহেব মাই ডিয়ার টাইপের লোক । মনে হয় আগেই রাজীব সম্বন্ধে ভালো কিছু শুনেছেন । প্রথম দিনেই হাসতে হাসতে বলেছেন ‘টেকনিক্যাল ব্যাপারে এখন থেকে তুমিই সব দেখবে । আর ম্যানেজমেন্ট ঠিকাদার দেখার জন্যতো আমি আছিই ।‘ শুনে রাজীব মনে মনে বলে সবাই ঠিকাদার দেখতে চায় । আপনিই বা ব্যতিক্রম হবেন কেনো । তবে কয়েকদিন কাজ করেই বোঝে আলতাফ সাহেব টাকা পয়সা ভালো বুঝলেও জটিল না । একা থাকে শুনে এর মাঝেই বাসা থেকে তিনদিন খাবার দিয়ে গেছেন । অফিসে রাজীব আর একজন বসের নাম শুনেছেন । সুপারিণ্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মিজান স্যার । এই অফিসেই আছেন চৌদ্দ বছর । অফিসের সবাই বেশ সমীহের সাথে ওনার কথা বলেন । এখনো দেখা হয় নাই । হঠাৎ করেই সূ্যোগ হয়ে গেলো । অফিসে ঢুকেই রাজীব দেখে এখানে সেখানে কর্মচারীদের জটলা । সিবিএ কিসব দাবী নিয়ে নাকি কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে চায় । একটু পরেই মিজান স্যারের রুম থেকে ডাক আসে । লম্বা, ফর্সা চেহারার মানুষ মিজান স্যার । মাথায় কাচা পাকা চুল ।


“জানি তুমি এসেছো সপ্তাহখানেকের বেশী । কিন্তু দেখা হয় নাই, কথা হয় নাই । আমাকে ঢাকায় একটু হেড অফিসে যেতে হয়েছিলো । যাহোক আলতাফ সাহেবতো আজকে অফিসে আসেন নাই । তাই তোমাকে ডাকলাম । চলো দেখি সিবিএর নেতারা কি বলেন ।“ এমন আন্তরিকভাবে বলেন যে মুহূর্তেই মানুষটিকে ভালো লাগে । মিজান স্যারের পিছে পিছে বড় মিটিংরুমে যায় রাজীব । মিটিংয়ের শুরুতেই এক সিবিএ নেতা নাটকীয়ভাবে বলা শুরু করেন ...
‘আমাদের স্বপ্ন হলো ...’
-একটু থামেন । শান্তভঙ্গীতে মিজান স্যার থামিয়ে দেন নেতাকে ।
-স্বপ্নতো সমবায় সমিতি করে দেখা যায় না । একা একা দেখতে হয় । যেমন ধরেন আপনার স্বপ্ন হতে পারে আজীবন সিবিএর সভাপতি থাকা । কিন্তু আপনার পাশে বসা মাহফুজ সাহেবের স্বপ্ন হতে পারে আপনাকে সরিয়ে সিবিএর সভাপতি হওয়া । এখন শুরু করেন ‘আমার স্বপ্ন হলো ...’। এমন ধীরস্থিরভাবে প্রতিটা কথা স্পষ্টভাবে বলেন যে সভার প্রতিটা লোক মনোযোগ দিয়ে শুনতে বাধ্য হয় । রাজীব দেখে কি অনায়াস দক্ষতায় মিটিং এর কর্তৃত্ব মিজান স্যার নিজের হাতে নিয়ে নেন । সিবিএর সভাপতি কিছুক্ষণ পর থেকেই জ্বি স্যার, জ্বি স্যার বলা শুরু করেন । এরপর থেকেই মিজান স্যার সম্বন্ধে একটা ভালো ধারনা তৈরী হয় রাজীবের মনে ।



পরের সপ্তাহেই নিশু আসে খুলনায় । দুই সপ্তাহের জন্য । এসেই বাসার পর্দা সব বদল করে ফেললো । ভাড়া বাসা । রাজীব কয়দিন থাকব তার ঠিক নাই । এসব অর্থহীন কাজ । তারপরও রাজীব বেশী কিছু বললো না । কিন্তু যেদিন বাড়ীওয়ালাকে ডেকে বাসার রং বদল করে দিতে বললো সেদিন আর পারলো না
-দেখো তোমার স্টুপিড কাজ,কথা আমি সহ্য করি বলে সবাই সহ্য করবে । রুক্ষ ভাবেই কথা শুরু করে রাজীব ।
“আমি কি স্টুপিড কাজ কথা বললাম ।“ অবাক গলায় উত্তর দেয় নিশু ।
-এই যে বাড়ীওয়ালাকে বলেছো রুমের সব রং বদল করে দিতে । এটা ভাড়া বাসা বাড়ীওয়ালা এই ফালতু কাজ কেনো করবে ।
“আশ্চর্য । বাড়ীওয়ালা তোমাকে এটা বলেছে ? অথচ আজ সকালেই রঙয়ের ক্যাটালগ নিয়ে এসেছিলো কোন রং আমার পছন্দ জানতে । বললো আগামী সপ্তাহেই আমরা যখন ঢাকা থাকবো তখন রং করে ফেলবে ।“ আরো অবাক গলায় উত্তর দেয় নিশু । রাজীবও বিস্মিত হয় । কথাটা রাজীব শুনেছে আসলে বাড়ীর দারোয়ানের কাছ থেকে । পরেরদিন সকালে সিঁড়িতে বাড়ীওয়ালার সাথে দেখা – ‘ম্যাডামের পছন্দের রং আগামী সপ্তাহেই করে দেবো‘ । শুনে রাজীবের বিস্ময়ের মাত্রাটা বাড়ে । ঐদিন বিকেলেই রাজীবের দাওয়াত ছিলো মিজান স্যারের বাসায় । মিজান স্যারের স্ত্রীকে দেখে অফিসের কানাঘুষা মনে পরে যায় রাজীবের । স্যারের স্ত্রীর বয়স নাকি অনেক কম এবং বেশ সুন্দরী । এই দুইটা কথা সত্যি দেখেই বোঝা যায় । তৃতীয়টা হলো স্যার নাকি বউকে ভীষণ ভয় পান । এইতো সেদিন একাউন্টেন্ট আনোয়ার সাহেব পান খেতে খেতে বলছিলেন – ‘স্যারের মানিব্যাগে ভাবীর একটা ছবি সব সময় থাকে । যখনই বিপদে পড়েন । তখনই মানিব্যাগ বের করে ছবিটা দেখেন । মনে মনে বলেন এত বড় বিপদই যখন পকেটে নিয়া ঘুরি তখন যেকোনো বিপদই সামলাইতে পারবো ।‘ সস্তা টাইপের কৌতুক । কিন্তু দেখা গেলো সবাই হাসছে । রাজীবের বস আলতাফ সাহেবও ।


কিছুক্ষণ পরেই বোঝা গেলো তৃতীয়টাও একদম মিথ্যা না । খাওয়া দাওয়ার এক পর্যায়ে নিশু আহ্লাদী গলায় বললো
“ভাবী আমার সুন্দরবন দেখার অনেক শখ । আবার ভয়ও করে । চলেন না একসাথে যাই ।“ শুনে রাজীব আবারো বিরক্ত হলো । ফালতু কথা । সুন্দরবন যাওয়া যেনো বাসের টিকিট কেটে গুলিস্তান যাওয়ার মত ।
-কেনো অহেতুক বিরক্ত করছো মানুষকে । রাজীব পাশ থেকে আস্তে করে বলে ।
‘না না অহেতুক হবে কেনো । এই শুনছো, গতবারের মত দেখো না আবার সুন্দরবন যাবার ব্যবস্থা করা যায় কিনা ।‘ ভাবী বললেন মিজান স্যারকে । রাজীব ভেবেছিলো স্যার বলবেন ‘দেখি চেষ্টা করে।‘ মানে রাজীব এই পরিস্থিতিতে তাই করতো । সেই চেষ্টা কোনোদিন শেষ হোতো না । কেউ সেই চেষ্টার খোঁজও নিতো না । অথচ মিজান স্যার খাওয়ার পরপরই ফোন নিয়ে লেগে গেলেন । এখানে ফোন করেন সেখানে ফোন করেন । এক পর্যায়ে নিশুও বলে ফেললো “স্যার আর এক সময়ে যাওয়া যাবে ।“ প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টার পরে একটা ব্যাবস্থা হলো । ছোটো লঞ্চে যাওয়া হবে । দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা । সুন্দরবনের খুব বেশী দূর যাওয়া হবে না । ব্যাবস্থা করতে পেরে মিজান স্যারকে খুব খুশী দেখালো । স্যারের স্ত্রীকে আরো বেশী খুশী । স্বামী কতটা বশংবদ সেটা দেখাতে পেরে মনে হয় । পরের শুক্রবারেই যাওয়া হলো । আলতাফ সাহেবের পরিবারসহ আরো দুইটা পরিবারও যোগ হলো । রাজীব প্রথমে নিশুর প্রতি একটু বিরক্ত হলেও ভ্রমণটা ভালোই উপভোগ করলো । বিশেষ করে মিজান স্যারের সঙ্গ ।



এর পরে মিজান স্যারের সাথে রাজীবের ঘনিষ্ঠতা আরো বাড়ে । মাঝে মাঝেই স্যার বাসায় নিয়ে যান । রাতের খাবার খেয়ে গল্প করে আবার বাসায় পৌছে দিয়ে যান । অনেক কিছু নিয়ে কথা বললেও রাজীব খেয়াল করে স্যার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলেন না । এমনকি একই ইউনিভার্সিটির ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও ইউনিভার্সিটি জীবন নিয়েও তেমন কিছু বলেন না । এরকম একদিন রাতে স্যারের বাসায় গল্প করার সময় নিশুর ফোন আসে
“শোনো কালকের সকালের টিকিট কেটে চলে আসো ।“ আহ্লাদী গলায় বলে নিশু ।
-মানে কি ?
“রিমি আমার খালাতো বোন । আমেরিকা থেকে এসেছে । তোমার সাথেতো দেখা হয়েছে । আগামী সপ্তাহেই আবার চলে যাবে । হঠাৎ ঠিক হোলো আমরা সবাই পিকনিকে যাবো । ফরিদপুর থেকে মামাও সবাইকে নিয়ে আসবেন । তোমাকেও আসতেই হবে ।“ শেষের কথাটা শুনে পিত্তি জ্বলে যায় রাজীবের । স্যারের সামনে থেকে সরে যায় ।
“নিশু এই আলাপ এই কয়েকমাসে আমি কয়েকবার করেছি ।“ চিবিয়ে চিবিয়ে কথা শুরু করে রাজীব । পরবর্তী কয়েক মিনিটে এইসব অর্থহীন,ফালতু বোকা বোকা কাজ যে রাজীবের পক্ষে করা সম্ভব না সেটা বলে দুম করে ফোন কেটে দেয় রাজীব । রাজীব স্যারের সামনে এসে বসার সাথে সাথে আবারো ফোন বাজে । নিশুরই ফোন । এবার ফোনের সুইচটাই অফ করে দেয় রাজীব ।
-মেয়েরা এত স্টুপিড হয়, স্যার । কিঞ্চিৎ বিরক্তির সাথে বলে রাজীব ।
“তোমাকে দেখে আমার বিশ বছর আগের আমাকে মনে পরে । সেই জন্যই মনে হয় তোমাকে আমি বেশ পছন্দ করি ।“ স্মিত হেসে বলেন মিজান স্যার ।
“দাড়াও তোমাকে কয়েকটা জিনিষ দেখাই ।“ বলে স্যার ভিতরে গেলেন । একটা ফাইল হাতে নিয়ে ফিরলেন ।
“এই দেখো আমার কিছু অভিশপ্ত ইতিহাস ।“ বলে তিনটা সার্টিফিকেট হাতে দিলেন । যশোর বোর্ডের এসএসসিতে অষ্টম, এইচএসসিতে পঞ্ছম,আর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে নবম । স্যারের রেজাল্ট দেখে আর সাথে অভিশপ্ত কথাটা শুনে বেশ অবাক হয় রাজীব । চোখে অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে তাকায় মিজান স্যারের দিকে ।



“আমার কিছু অতি কাছের লোক ছাড়া আমার ব্যক্তিগত বিষয় কেউ জানে না । তোমাকে বলছি কারন আমার মনে হয় তোমাকে এসব বললে তোমার উপকার হলেও হতে পারে ।“ কথা শুরু করেন মিজান স্যার ।


একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে আমি । ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া থেকে শুরু আমার চারপাশকে ছাড়িয়ে যাবার যাত্রা । এসএসসিতে যখন স্ট্যান্ড করলাম তখন নিজেকে নিয়ে নিজেরই ভীষণ গর্ব হলো । না হবার কারণও নাই । আমাদের ঐ স্কুল থেকে প্রথম বিভাগই পেতো কালেভদ্রে একটা দুইটা । সেই স্কুল থেকে স্ট্যান্ড । ডজনখানেক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হলো । গোল্ড মেডাল, নগদ টাকা আর পেলাম স্তুতির সমুদ্র । মানুষই যে মানুষকে দেবত্ব দান করে সেটা জানলাম । বাবা এক সময় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ছিলো । সেই হিসাবে আমাদের বাড়ির নাম ছিলো মেম্বার বাড়ি । কিন্তু সেসব পরিচয় গৌণ হয়ে গেলো । আশেপাশের দশ পনের গ্রামের লোক আমার নামেই আমার বাড়িকে চিনতে শুরু করলো । শুধু আমার বাড়ি কেনো । আমার গ্রামকেই চিনতো মিজানের গ্রাম হিসাবে । এইচএসসি এর পরে ব্যাপারটা আরো বাড়ে । বাজারে হাটে ঘাটে যেখানেই যাই মানুষ শ্রদ্ধা করে । বয়স্ক মানুষরাও উঠে চেয়ারটা ছেড়ে দেয় । প্রথম প্রথম লজ্জা লাগতো ভীষণ । পরে কিভাবে যেনো সহজেই অভ্যস্ত হয়ে যাই ।


এসবতো ভালোই । কিন্তু আমার মানসিকতায়ও ব্যাপক পরিবর্তন আসে । আশে পাশের অধিকাংশ মানুষকে ফালতু মনে হয়, তুচ্ছ মনে হয় । মুখে বলতাম না কিন্তু আসলে ওরকমই ভাবতাম । হয়তো কোথাও কোথাও একটু প্রকাশও করে ফেলতাম এবং আশ্চর্য যে মানুষ সেগুলো হাসিমুখেই মেনে নিতো । শত হলেও আমার মত মেধাবী ঐ এলাকায় এর আগে কেউ ছিলো না । ব্যাপারটা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পরে আরো বাড়ে । হাসিমুখেই সবাই সেটা মেনে নেয় ।



ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার সাথে সাথেই এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকুরী পাই । পরিকল্পনা হলো কয়েকবছর পরে বাইরে চলে যাবো । কিছুদিন পরেই বিয়ে করি । অনেক বড়লোকের সুন্দরী ইন্টারমিডিয়েট পাশ মেয়েকে । ইতিমধ্যে নিজের যোগ্যতাবলেই কোম্পানিতে পদমর্যাদা বেড়েছে । চিটাগং অফিসে গাড়ী বাড়িসহ পোস্টিং দেয়া হলো । বউ ছিলো সহজ সরল । আমার কাছে যা বোকামি বলে মনে হোতো । অল্পশিক্ষিত বউ প্রায়ই এখানে সেখানে ঘুরতে যেতে চায়, শপিংয়ে যেতে চায় । আমার কাছে অর্থহীন, ফালতু কাজ মনে হয় । পরিষ্কার বুঝিয়ে দেই আমাকে দিয়ে ওসব হবে না । দাড়াও আর একটা জিনিষ দেখাই তোমাকে । বলে আবার ভিতরে চলে যায় মিজান স্যার । একটু রাত হয়েছে । ভাবী বাচ্চারা মনে হয় ঘুমিয়ে পরেছেন । আগেও এরকম দুএকবার হয়েছে । বেশ কিছুটা সময় পরে মিজান স্যার আবার আসেন । হাতে একটা কাগজ আর দুইকাপ চা ।




-কাগজটা কি ? রাজীব জিজ্ঞেস করে ।
“একটা চিঠি । পড়োই না । তোমাকে যখন বলছি পুরোটাই বলি । “ বলে চায়ের কাপে চুমুক দেন মিজান স্যার ।
রাজীব চিঠিটা খোলে । ছোট চিঠি । কোনও সম্বোধন নাই । হাতের লেখা খুব খুব সুন্দর ।

আমি চলে যাচ্ছি । আপনার তুলনায় তুচ্ছ একজন মানুষের সাথে । এতটাই তুচ্ছ যে সমাজ সংসার আমাকে ছি ছি করবে । একটা অনুরোধ । নিজেকে বদলাতে না পারলে আর বিয়ে করবেন না । সেই বেচারির হয়তো আমার মত সাহস হবে না । আসলে খুব কম মেয়েরই হয় । তারা সংসারে খাট-পালং আলমারি হয়ে বেচে থাকে । সেটা যে কি কষ্টের কি দুঃখের আমি জানি । কারণ আমি গত চার বছর আপনার সাথে সেই জীবন যাপন করেছি ।

-কার চিঠি ? রাজীব জিজ্ঞেস করে ।
“আমার প্রাক্তন স্ত্রীর । আমারই ড্রাইভারের সাথে বিশ বছর আগে চলে যায় । “ নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলেন মিজান স্যার ।

“জীবনে হঠাৎ এত বড় পরাজয় । কি লজ্জা কি লজ্জা । আমার দুনিয়া মুহূর্তেই কালো আধারে ঢেকে গেলো । চাকুরি ছেড়ে দিলাম । গ্রামের বাড়িও ফিরলাম না । ঢাকায় এক বাসা ভাড়া করলাম । খুব কাছের লোক ছাড়া কাউকে ঠিকানা দিলাম না । দুইটা বছর কিছুই করলাম না । বিধাতা মেধা দিয়েছিলেন । সেই মেধাও যে অভিশাপ হতে পারে তা জানলাম । তারপর আবার কর্মজীবনে ফিরলাম । আত্মীয় স্বজনরা আবার বিয়ের জন্য বলতে থাকেন । আমি পরিষ্কার বলে দেই সেটা আর সম্ভব না । কারণ আমি বুঝতে পারি নিজেকে অনেকখানি বদলে ফেলা আমার পক্ষে সম্ভব না । “ এতটুকু বলে থামেন মিজান স্যার ।
-তারপর ? রাজীব খুব আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করে ।
“পনের বছর আগে এই খুলনা শহরেই তোমার ভাবীর সাথে দেখা হয় । আমার চাইতে বয়সে অনেক ছোট । সারাজীবন মস্তিস্ককে বেশী দাম দিয়েছি । কিন্তু হৃদয়, অনুভূতিই যে মানুষকে মানুষ করে সেটা জানলাম । আত্মীয়-স্বজন অফিসের লোক অনেকেই আমাকে স্ত্রৈণ বলে । আমি কিছু মনে করি না । অসাধারন মেধাবী সফল কিন্তু অসুখী মানুষ হওয়ার চাইতে অসফল কিন্তু সুখী মানুষ হওয়া বেশী ভালো । আমার তাই মনে হয় । “ বলে একটু থামেন মিজান স্যার ।

“তুমিতো সিভিল ইঞ্জিনিয়ার রাজীব । কতটা ইট বালু সিমেন্ট মিশালে বাড়ি শক্ত হয় জানো । অনেকেই জানে । জানাটা সহজ । কিন্তু কতটা ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সন্মান মিশালে ঘর শক্ত হয় সেটা জানা অনেক কঠিন । “ উদাস গলায় বলেন মিজান স্যার ।
 
Back
Top