ফেরার জায়গা

dukhopakhi

Well-Known Member
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
115
Messages
1,101
Reaction score
134
Points
1,213
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
*****ফেরার জায়গা*****

মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু






-ভাবী তোমরা এখন কোথায় ?
-এইতো টাঙ্গাইলের কাছে ।
-তোমরাতো তাহলে প্রায় পৌছেই গেছো । আমরাতো মাত্র কালিয়াকৈর পার হলাম । এত্ত জ্যাম । ছোট ভাইয়া কি পৌছে গেছে? ওরাতো চিটাগং থেকে ট্রেনে আসবে ।
-আমি জানি না । আমার সাথেতো কথা হয় নাই ।
-ঠিক আছে আমিই ফোন করছি । যাক তবুও অল্প সময়ে ফোনটা ছাড়লো জানু । মনে মনে ভাবে নাজু । প্রতিবারের মতই ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জে যাচ্ছে ঈদ করতে সবাই মিলে । সিরাজগঞ্জ নাজুর শ্বশুরবাড়ি । ঢাকা থেকে ফজরের নামাজের পরপরই রওনা দিয়েছে বলে তেমন জ্যামে পরে নাই । ছেলে দুইটাকে টেনে হিঁচড়ে তুলে হুমায়ুনকে সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত করে অত সকালে বের হতে পেরেছে । সংসারের সব কিছুতেই এমন করতে হয় নাজুকে । মনে হয় বাকী তিন সদস্য সংসারে মেহমান । যত দায় নাজুরই । মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে । আবার এটাও সত্যি যে এসবের মাঝে আনন্দই পায় নাজু । ছোট ছেলেটাতো বলেই ‘মা একদিন চিৎকার চেচামেচি না করলে পৃথিবীটাই আর ঘুরতো না । পৃথিবী ঘোরেই মায়ের চিৎকার চেচামিচির ভয়ে ।‘

গাড়ী টাঙ্গাইল শহরে ঢুকছে । সামনের সীটে হুমায়ুন ঘুমে । আল্লাহ ঘুমও দিয়েছে হুমায়ুনকে । যেকোনো জায়গায় যেকোনো অবস্থানে ঘুমাবার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে হুমায়ূনের । ‘মিজান জানোতো কোন দোকান থেকে চমচম কিনতে হবে ?’ ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে নাজু । ‘জ্বি ম্যাডাম । স্যার টাকা কোন দোকান সব ঠিক কইরা দিছে । একটু সামনেই দোকান ।‘ মনে মনে হাসে নাজু । হুমায়ুন পারেও । নিজের ঘুমের যাতে কোনো ব্যাঘাত না হয় সেজন্য আগে থেকেই সব কিছু ঠিক করে রেখেছে । পাশের সীটের দুইজনও ঘুমে । ওরা অবশ্য ছেলেমানুষ । এত সকালে উঠে অভ্যস্ত না । এতটুকু ভাবতে ভাবতেই আবারো ফোন বাজে । যথারীতি ছোট ননদ জাহানারা ওরফে জানু । এই নিয়ে মনে হয় দশবার ফোন করলো
-ভাবী ছোট ভাইদের ট্রেনও নাকি লেট । দেখবা ওদের আগেই আমরা পৌছে যাবো ।
-তোমরা এখন কই ?
-জানি নাতো ভাবী । খেয়াল করি নাই । দাড়াও ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করি ।
-থাক জিজ্ঞেস করতে হবে না । কিছুক্ষণ পরেতো এমনিতেই দেখা হবে ।
-ভাবী তোমাকে একটা কথা বলা হয় নাই ।
-কি কথা ?
-ঐযে আমাদের পাশের ফ্লাটের মিসেস চৌধুরী যে লন্ডন গেলো ।
-জানু এই গল্প সামনা সামনি শুনবো । বলে কোনোমতে ফোনটা রাখে নাজু । একটু বিরক্তও হয় ।

অবশ্য একটু পরেই বিরক্তিটা আর থাকে না । গাড়ী ততক্ষণে এলেঙ্গায় চলে এসেছে । মনে আছে বিয়ের পর প্রথম দুই বছর আর একটু সামনে থেকেই ফেরীতে উঠতে হোতো । যমুনা ব্রিজ তখনো হয় নাই । অনেক সময় লাগতো । একবারতো ফেরী চরে ৪ ঘণ্টা আটকে ছিলো । আজকাল নাকি অনেকেই দিনে ঢাকা গিয়ে আবার এক দিনেই সিরাজগঞ্জ ফিরে আসে । একটা সেতু যে একটা জনপদের জীবন কিভাবে পাল্টে দেয়...
-মা ব্রিজ কি পার হয়ে এসেছি ? বড় ছেলে ইমনের প্রশ্নে বাস্তবে ফেরে নাজু ।
-নাহ সামনেই । ছোট করে উত্তর দেয় নাজু । ততক্ষণে ছোট ছেলেও জেগে উঠেছে । এমনকি সামনে হুমায়ূনের নড়াচড়াও টের পাওয়া যাচ্ছে ।
-শোনো বাড়ী যাবার আগে তোমার প্রিয় সরার দই কিনতে যাবো । একটু ঘুরপথ হবে । তাও বাড়ী চলে গেলে আরতো তেমন বের হওয়া হয় না । সামনের সিট থেকে ঘাড় ঘুড়িয়ে বলে হুমায়ুন ।
-সরার দইতো শুধু আমারই প্রিয় । দরকার নাই । একটু রাগের সাথেই উত্তর দেয় নাজু ।
-সব কথাকেই আজকাল বাঁকাভাবে দেখো । মিজান দইয়ের দোকানে যাওতো । বলে সামনের দিকে ঘোরে হুমায়ুন । হুমায়ুন এর এই সামান্য অভিমানটুকু বেশ লাগে নাজুর । সংসার, অফিস আর সবচাইতে বড় অভিশাপ যানজট সামলে এসব রাগ অভিমানের সময়ওতো আজকাল পাওয়া যায় না । হায়রে ...

এর তিন ঘণ্টা পরেই সিরাজগঞ্জ শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দুরে মমতাজ মহলে মোঘল সাম্রাজ্যের সমাবেশ ঘটে । এলাকার মানুষ ঠাট্টা করে এই বাড়ীটাকে তাই বলে । তিন ভাই এর নাম হুমায়ুন, জাহাঙ্গীর, বাবর । সব চাইতে ছোট বোনের নাম জাহানারা । মায়ের নাম মমতাজ । বাবা শাজাহান অবশ্য মারা গেছেন ১৬ বছর আগে । এবার অবশ্য মেজ ছেলে জাহাঙ্গীর আসে নাই । বাকীরা এসেছে সপরিবারে । বিশাল বাড়ীটা গমগম করছে মানুষের ভীড়ে ।


-ফরিদ । এই ফরিদ । কোথায় গেলি ? মমতাজ বেগমের গলায়ও বাড়তি সুখ উপচে পড়ছে । এমনিতে উনি বেশ ভারিক্কি মহিলা । গার্লস হাই স্কুলের হেড মিস্ট্রেস ছিলেন দীর্ঘদিন । ওনার ধারনা ছিলো ছেলেমেয়েদের সাথে কখনো হাল্কা হতে নাই । তাহলে ছেলে মেয়ে লাই পেয়ে যায় । আর লাই পেলে বাদরই মাথায় ওঠে আর ছেলে মেয়ে যে কোথায় উঠবে কে জানে ।
-মা এখনো সবকিছু কি ফরিদকে দিয়েই করান ? ওতো সবকিছু থেকেই পয়সা সরায় । হুমায়ূন বলে ।
-ফরিদতো চেনা চোর । একশ টাকা থেকে পাঁচ টাকা সরাবে জানি । নতুন কাউকে দিলে আরো বেশী সরাবে কিনা তাতো জানবো না । আর তাছাড়া এতদিন ধরে করে । একটা আন্তরিকতাও কিন্তু আছে বাবা হুমায়ূন আলী । সব সময়ের মত শান্ত ধীর কণ্ঠে বলেন মমতাজ বেগম । সব ছেলেমেয়েকেই উনি পুরো নাম ধরে ডাকেন । এমনকি সব চাইতে ছোট মেয়ে যাকে সবাই জানু বলে ডাকে তাকেও তিনি জাহানারা বেগম নামেই ডাকেন । অথচ তিনিই আবার নিজের নাতি নাতনীদের পটলা, কুটু, কেতকী এরকম অদ্ভুত নামে ডাকেন । নাতি নাতনিরা দাদী-নানী বলতে অজ্ঞান । তাই তারা কিছু মনে করে না । কিন্তু আধুনিক বৌমারা পছন্দ করে না এসব নাম । অবশ্য শ্বাশুড়ীকে অপছন্দের কথা বলার চিন্তাও করে না কেউ । তাদের সাথেও উনি একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলেন ।

একটু পরেই বাড়ির বিশাল উঠানে একগাদা ডাব নিয়ে হাজির হয় ফরিদ । একটার পর একটা ডাব দ্রুত কেটে সবাইকে দিতে থাকে ফরিদ ।
-এত ডাব কোথা থেকে আনলি ফরিদ । ছোট ছেলে বাবর জিজ্ঞাসা করে ।
-আপনারা এতদিন পরে আসবেন যোগাড় যন্ত্র সব আগে থেকেই করা থাকে ছোট মিয়া ।
-শুধু ডাবের যোগাড় করলেইতো হবে না । আমার কিন্তু কিছু জিনিষ লাগবে । ছোট বউ উর্মি বলে ।
-জানিতো ভাবী । আপনার লিস্ট দিয়েন, বড় ভাবী আর ছোটবু দিছে । বিকালে হাটে যাইবেন নাকি ছোট মিয়া ? ঈদতো পরশুদিন । আজকের হাট জমজমাট হইবো ।
-আশ্চর্য আসতে না আসতে সবার এত কিছুর দরকার পরে । নিজের মনেই বলে উর্মি । কিন্তু পাশে থাকা বাবর আর ফরিদ ঠিকই শুনতে পায় ।
-ঠিক আছে যাবো । উর্মির কথা যেনো শুনতেই পায় নাই এমনভাবে বলে বাবর ।

-ভাবী মেজ ভাবীকে সেদিন এক ভদ্রলোকের সাথে যমুনা ফিউচার মার্কেটে দেখলাম । রাতের খাবারের পরে জানু নাজুর সাথে গল্প শুরু করে । এর মাঝে সুগন্ধি জর্দা দিয়ে একটা মিষ্টি পানও মুখে দিয়েছে জানু ।
-তাই নাকি ? মাথার চুল আচড়াতে আচড়াতে উত্তর দেয় নাজু ।
-ওরাতো এবার আসলো না । কোনো সমস্যা নাইতো? আজকাল কতকিছু শুনি, দেখি । আমার বান্ধবী ইরাকেতো চেনো । ১৭ বছর সংসার করার পরে ওর চাইতেও দুই বছরের ছোট এক লোকের সাথে চলে গেছে ।
-জানু তুমি সিরিয়ালটা একটু কম দেখো । শান্তা, আমি, উর্মি- আমরা তিন বউই চাকুরী করি । বাইরের কত লোকের সাথে মিশতে হয় । দেও পানটা দেও । ফরিদ কোথা থেকে যে এত মজার মজার জিনিষ যোগাড় করে আনে ।
-সব দোষ সিরিয়ালের । মুখ ভার করে জানু উত্তর দেয় ।
-সেটা না । তবে কোন সিরিয়ালে নাকি দেখাইছে শ্বাশুরী শয়তানি করে বউকে বিষ খাওয়াইছে । আর সেই বিষ খেয়ে বউ প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছে ।
-কি বলো ভাবী । দারুণ মজাতো । নাম কি ? কোন চ্যানেলে দেখায় ?
-জানু তুমি এখনও বোকাই রয়ে গেলে । এটা সিরিয়াল নিয়ে একটা কৌতুক । তাও বোঝো না ।
- সব দোষ সিরিয়ালের । এক সময় আমার সব ভাইদেরকে দেখেছি পাগলের মত ডালাস আর ডাইনেস্টি দেখতে । ঐগুলো কি সিরিয়াল না ? ঐখানেওতো কুট কাচালীই দেখাইতো ? নাকি ইংরেজীতে কুট কাচালী করলে সেটা আর কুট কাচালী থাকে না ।
-বাহ তুমি দেখছি ভালো যুক্তি দিতে শিখেছ ?
-আমার ছেলে মেয়েকে দেখি হ্যারি পটার নিয়ে পাগল । অথচ ঠাকুরমার ঝুলির গল্প কোনোভাবেই পড়বে কিংবা শুনবে না । দুইটাইতো ফ্যান্টাসি ।
-আরে আমিওতো এভাবে ভাবি নাই । নাজু সত্যিই বিস্মিত হয় ।
-মনে আছে জানু তোমাকে একটা ছেলে চিঠি দিলো । তোমাকে না দেখলে সে খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না । অনেক রাতে আমাকে তুমি ঘুম থেকে উঠালে । ‘খেতে ঘুমাতে না পারলে ছেলেটাতো মারা যাবে ভাবী’ ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললে আমাকে । হাসতে হাসতে বলে নাজু ।
-মনে আছে ভাবী । তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি । কতইবা বয়স । তবে তোমরা আমাকে যত বোকা ভাবো আমি কিন্তু অত বোকা নই । আমার শুধু খুব বোকা বোকা কিছু স্বপ্ন ছিলো । বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানু ।
-হ্যারে জানু শফিক কি কোনো কাজই করে না এখন ?
-কোন দিনই বা করলো । করবেই বা কিভাবে ? রোদে গেলে তার মাথা ধরে । মেঘ থাকলে তার সাইনুসাইটিসের ব্যাথা ওঠে । আর যদি এক ফোটা বৃষ্টি মাথায় পরে থাহলেতো এক সপ্তাহ শুয়ে থাকবে । শ্বশুর যে কেনো এত সম্পত্তি রেখে গেলো মাঝে মাঝে রাগ হয় । লোকটা দিনকে দিন আরো সাইকো হয়ে যাচ্ছে । আজকাল অন্য রুমে থাকে কারন এক রুমে থাকলে নাকি জীবানু থেকে ইনফেকশন হতে পারে । আমি সিরিয়াল দেখবো নাতো কি করবো ভাবী । শুনে মনটা একটু খারাপই হয় নাজুর ।
-মন খারাপ কোরো না । তোমার চমৎকার দুইটা ছেলে মেয়ে আছে । টাকা পয়সার সমস্যাও নাই । এর চাইতেও খারাপ দিন কত মানুষ পার করছে । নাজু সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে ।

এর তিন ঘণ্টা পরে নাজুর দরজায় টোকা দেয় জানু
-ভাবী একটু বাইরে আসো । কথা আছে ।
-কি কথা কাল সকালে বলা যেতো না । কাচা ঘুম ভাঙ্গাতে একটু বিরক্ত হয়েই বলে নাজু ।
-শোনো না আমার কানের দুলজোড়া পাচ্ছি না । তোমার এখান থেকে যাবার পরে উর্মি ভাবী এসেছিলো আমার রুমে । সেতো আবার নবাবের বেটি । কাজের লোক ছাড়া চলাফেরা করতে পারে না । তাই কাজের লোকটাও ছিলো । এখন উর্মি ভাবীকে কি জিজ্ঞেস করবো ? বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাজু । মানুষ আসলেও তেমন বদলাতে পারে না ।
-শোনো জানু এত রাতে আর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না । আমি নিশ্চিত কাল সকালেই তুমি খুজে পাবে । আর না পেলে আমিও খুজবো । এখন ঘুমাতে যাও ।

পরেরদিন সকালেই বাড়ির উঠানে ভীড় । বড় এক রুই মাছ তখনো কানকো ওঠা নামা করে প্রানের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে । হুমায়ূনের শরীর তখনো ভিজে চুপচুপে । আশেপাশের অনেকের শরীরেই কাদা মাটি লেগে আছে ।
-দাদী শোনো । বাবাতো জালটা টানতাছে । মাছটার গায়ে মনে হয় অনেক শক্তি ছিলো । বাবা ছোট চাচু আর ফরিদ চাচুকে চিৎকার করে ডাকতাছে । ফরিদ চাচু দৌড়ে গিয়ে জালটা ধরতেই বাবা ধুম করে পুকুরে পরে গেলো । বাকীটুকু আমি বলি ইমন ছোট ভাই ছোটনকে থামায় ।
-আমরা সবাই এমনকি শফিক ফুপাও ছাতি মাথায় পুকুর পাড়ে গেছি । বাবা যে পানির তলে গেলো আর ওঠে না । ছোটনতো চিৎকার শুরু করে দিছে । অনেকক্ষণ পরে সবার প্রথমে বাবার ভুড়ি ভেসে উঠলো । তারপরেই বাবা সবার গায়ে কাদা ছিটাইয়া দিছে । হাসতে হাসতে বলে ইমন ।
-এতটুকু সময়তো কিছুই না । তোর বাবা এক ডুবে পুকুরের এই মাথা থেকে সেই মাথা যেতে পারতো ছেলেবেলায় । বাবর ভাতিজা ইমনকে বলে ।
-দাদা, এই যে শরীরে কাদা লাগলো । আবার ইনফেকশন হবে নাতো ? জানুর স্বামী শফিক খুব চিন্তিত ভাবে জিজ্ঞেস করে ।
-তুমি চুপ করো । এর মাঝেও ইনফেকশন । আর পারি না । মুখ ঝামটা দিয়ে বলে জানু ।
-চিন্তা কইরো না শফিক । ফরিদকে দিয়ে এন্টিসেপ্টিক সাবান নিয়ে আসবো । গোসল করলে ইনফেকশন হবে না । ফরিদ পাল্লাটা আনতে এত দেরী করছে কেনো ? মাছটা ওজন করতে হবেতো । হুমায়ূন বলে ।
-কালকে কোরবানী আজকে এতবড় মাছ ধরলি । অসুবিধা নাই । মাছের মাথাটা দিয়ে মুড়িঘণ্ট করবো । বাবর আলীতো মাছের মুড়িঘণ্ট খুব পছন্দ করে । মমতাজ বেগম বলেন । সবাই খেয়াল না করলেও হুমায়ূন খেয়াল করে কথাটা শুনেই স্ত্রী নাজুর মুখটা কালো হয়ে যায় । আরো পরে একটু আড়াল হতেই...
-আচ্ছা একটা জিনিষ বলোতো । তুমি কি আসলে এই বাড়ীর ছেলে ? নাজু ঝাপিয়ে পরে হুমায়ূনের উপর ।
-কেনো এই কথা কেনো ? হুমায়ূন বুঝেও না বোঝার ভান করে ।
-কারন এই সংসারে তোমার কোনো দাম নাই । তুমি বড় ছেলে করোও সবচাইতে বেশী অথচ নাম সবচাইতে বেশী বাবরের ।
-বাদ দেওতো মা ছোট ছেলে বলে বাবরকে একটু বেশী আদর করেন । হুমায়ূন এড়িয়ে যেতে চায় । কিন্তু রাতে খাবার টেবিলে নাজু মাছের টুকরা ছুয়েও দেখে না ।
-এত বড় একটা মাছ রান্না করলাম । তুমি এক টুকরা নেও নাজনীন । শ্বাশুরী মমতাজ বেগমও অনুরোধ করেন ।
-ইদানীং বড় মাছ খেলে আমার এলার্জি হয় মা । বলে এড়িয়ে যায় নাজু ।
-কই মা গত সপ্তাহেওতো বাবা বড় একটা ভেটকি মাছ কিনে আনলো । আমরা সবাই খেলাম । নাজুর ছোট ছেলে ছোটন বলে । খাবার টেবিলে একটু অস্বস্থি নেমে আসে । মমতাজ বেগমের মুখটা কালো হয়ে যায় ।
-তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমাও ছোটন । কাল কিন্তু খুব সকালে নামাজ । হুমায়ূন সামাল দেবার চেষ্টা করে ।

ঈদের দিন সকালে সোহরাব চাচা আসেন । দুই ভাই হুমায়ূন আর বাবরের সাথে দেখা করতে । সোহরাব চাচা বাবার বন্ধু ছিলেন ।
-তোমরা সবাই এত ভালো আছো । মাকে এখানে ফেলে রেখেছো কেনো ? সোহরাব চাচা আলাপ শুরু করেন ।
-আমরাতো কত বলি । মা রাজী হয় না । হুমায়ূন উত্তর দেয় ।
-এইটাতো বাবা দায়সারা উত্তর । এই বয়সে ভাবীর কথা তোমরা শুনবা কেনো । এইযে আমার ছেলেরে কত কইরা বললাম আমার কিছু লাগবো না । কিন্তু দেখো ৬০ হাজার টাকা দিয়া এই ফোন পাঠাইছে । এরপরে ছেলের নানা গুনকীর্তন করতে থাকেন । দুইভাইই এই গল্পে একটু বিরক্ত হয় । দুই বছর আগেই সোহরাব চাচার এই ছেলে ছিলো মাদকাসক্ত । ইটালী পাঠাবার জন্য সব ভাইরা মিলে সোহরাব চাচাকে প্রায় লাখখানেক টাকা দিয়েছিলেন ।
-চলেন চাচা গরু কাটা দেইখা আসি । বাবর সোহরাব চাচাকে নিয়ে বের হয়ে যায় । হুমায়ূন স্বস্থি বোধ করে ।

সন্ধ্যায় তিন ভাই বোন মিলে যমুনা নদীর বাধে যেতে চায় । কিন্তু মমতাজ বেগম রান্না নিয়ে তখনো ব্যস্ত । তাই কোনো নাতি নাতনীও যায় না । অগত্যা তিন ভাই বোন স্বামী আর স্ত্রী সহ বেড়িয়ে পরে । বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ফিরতে ওদের বেশ রাত হয় । যখন সবাই ফিরে তখন নিকানো উঠানে বিশাল পাটি পেতে মমতাজ বেগম সব নাতি নাতনীদের নিয়ে বসে আছেন । নাতি-নাতনীরা কেউ ঘাড়ের কাছে কেউ কোলে কেউ হাতের কাছে । দৃশ্যটা একটু দূর থেকে দেখে হুমায়ূন, বাবর আর জাহানারার খুব ভালো লাগে । কিন্তু মনের অজান্তেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসও বের হয় । আহারে মাকে কখনো এতটা কাছে পায় নাই কোনো ভাইবোন যতটা নাতি-নাতনীরা পাচ্ছে । আসলের চাইতে সুদের উপর মানুষের মায়া কি সমসময়ই বেশী হয় ?

পরেরদিন সকালেই ইমন গাছ থেকে পড়ে হাত ভাঙ্গলো । মমতাজ বেগম ইমনকে পটলা বলেন । দাদী পটলাকে নিয়ে যতটা ব্যাতিব্যস্ত হলেন নাজু কিংবা হুমায়ূন অতটা হলেন না । কারন ইমন কয়েকদিন পর পরই কোনো না কোনো অঘটন ঘটায় । শারীরিক মানসিকভাবে ইমন বেশ শক্ত পোক্ত । কিন্তু ঐদিন বিকেলেই ছোটনের পায়ে একটা খেজুর কাটা বিধে গেলো । নাজু অস্থির হয়ে গেলো ছোট ছেলেকে নিয়ে । কাটা আগেই বের করা হয়েছে তাও শহরের ডাক্তারকে নিয়ে আশা হলো । ডাক্তার সামান্য ব্যাথার ওষুধ দিলেন । রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে মমতাজ বেগম তেলের বাটি নিয়ে নাজুর ঘরে আসলেন । এটা উনি সব সময় করেন এক একদিন এক এক বউ কিংবা মেয়ের মাথায় তেল দিয়ে দেন । ঐ সময়েই একটু মন খুলে কথা বলেন মমতাজ বেগম ।
-নাজনীন কি দিনটাই না গেলো । পটলার হাত ভাঙ্গল, কুটু কাটা বিধাইলো ।
-জ্বি মা । ছোটনের কাটাটা আর একটু বেশী ঢুকলে সমস্যা হয়ে যেতো ।
-পটলার হাত ভাঙ্গাতে কষ্টটা কিন্তু বেশী পাইছে । তোমরাতো যাও নাই । হাতটা যখন সেট করেছে পটলার দুই চোখ দিয়া কষ্টে পানি বের হয়ে গেছে । অথচ ছেলেটা একটা শব্দও করলো না । অথচ তুমি সামান্য কাটা বেধা নিয়ে কুটুর জন্য পাগল হয়ে গেলে ।
-মা ইমন আর ছোটন কি এক । ছোটনটাতো খুব দুর্বল ।
-আমিওতো তাই বলি এক না । জানো বাবর আলীরও ছোট বেলায় খুব অসুখ হোতো । তারপর তোমার অফিস কেমন চলছে । এরপরে সম্পূর্ণ অন্য আলাপে চলে গেলেন মমতাজ বেগম । কিন্তু নাজনীন ঠিকই বোঝে মা কেনো ইমন ছোটনের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন ।

পরের দিন সকালে নাস্তার পরেই সবার চলে যাবার কথা । কিন্তু বাচ্চারা বিদ্রোহ করে বসলো । কেউই যাবে না ।
-দাদা তোমরা যদি দুইদিন পরে যাও আমিও তাহলে ঢাকা হয়েই চট্টগ্রাম যাবো । বাবর বলে ।
-ভালো হবে রে ছোট ভাই । সবাই একসাথে ঢাকা গেলাম । জানু উল্লসিতভাবে বলে ।
-কিন্তু আমি অফিস থেকে ছুটি পাবো কিনা জানি নাতো । নাজু বলে ।
-সেই সমস্যাতো আমারও ভাবী । উর্মি বলে ।

কিছুক্ষণ পরে নিজেদের রুমে নাজু হুমায়ুনকে বলে
-আমি দুইদিন বাড়তি ছুটি নিয়েই এসেছিলাম । এখানে আসলে প্রতিবারইতো এমন হয় । খবরদার এই কথাটা আবার কাউকে বলতে যাইও না । দেখোনা উর্মি কি ঢং করে অফিসের বসকে ফোন করলো ।

একইরকম আলাপ চলে বাবরদের রুমেও
-ছুটি আসলে আমি আরো কয়েকদিনের নিয়ে এসেছি । বসকে এমনিতেই ফোন করলাম । ভাবী একটু বড় চাকরী করে বলে কত ডাট দেখায় দেখো না । বাবরকে বলে উর্মি ।

আরো দুইদিন পরে সকালের নাস্তায় সবাই বসেছে । মমতাজ বেগম যথারীতি নাতি-নাতনী পরিবেষ্টিত ।
-মা আপনিও আমাদের সাথে চলেন । হুমায়ূন বলে ।
-হ্যা মা আপনিও চলেন । আপনি এখানে একা থাকন । লোকজন আমাদেরকে খারাপ বলে । সেদিনতো সোহরাব চাচা অনেকগুলো কথা শুনিয়ে গেলো । বাবরও সায় দেয় ।
-বাবা বাবর আলী তোমরাতো জানো আমি কখনো লোকের কথায় ভয় পাই নাই । তোমাদেরকেও সেই শিক্ষাই দিতে চেষ্টা করেছি । মমতাজ বেগম শান্তভাবে বলেন ।
-তারপরও মা । আপনার বয়স হয়েছে । এখানে একা থাকা ঠিক না । হুমায়ূন একটু জোর দিয়েই বলে ।
-দেখো বাবা আমি আসলে এখানে ভালোই থাকি । তাছাড়া তোমরা সবাই ব্যস্ত । আমি মা । আমি জানি তোমাদের একটা ফেরার জায়গা দরকার । যে জায়গায় গেলেই শান্তি পাওয়া যায় । যাওয়ার যায়গা তোমাদের অনেক আছে...অনেকেরই থাকে । আমি যতদিন বেচে আছি ততদিন এই বাড়ী তোমাদের ফেরার জায়গা হয়েই থাকুক । মমতাজ বেগমের শান্তভাবে বলা কথাগুলো কেমন শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় সবার মনে .........
 
Back
Top