- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 115
- Messages
- 1,101
- Reaction score
- 134
- Points
- 1,213
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
***বোকা কিশোরীর বোকা ডায়েরী***
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
পর্ব-১
আজকেই এই ডায়েরিটা পেলাম । প্রিয় বান্ধবী সোনিয়া উপহার দিলো । কি সুন্দর গোলাপি কাভার । ভিতরের মসৃণ কাগজেও কেমন সুন্দর গোলাপি আবছায়া । দেখলেই লিখতে ইচ্ছে করে ।
আমার নাম আরিয়ানা শামস তরু । সামসুদ্দিন মোল্লা আর যোবেদা খাতুনের ছোট মেয়ে । কি দারুণ স্মার্ট নাম । তাই না ? অথচ সেই ছোটটি থেকেই আমার বাবা মা, ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন এবং কিছু বন্ধু সব সময় বোকা, গাধী, হাবলি এসবই বলে এসেছে আমাকে । এসব শুনতে শুনতে আমিও এখন নিজেকে বোকাই ভাবি । ভাবছি এই সুন্দর ডায়েরীটাতে এবছরের সব বোকামী লিখে রাখবো ।
ডায়েরীর প্রথমে যেহেতু কয়েকটা ফাঁকা পাতা তাই প্রথম বড় বোকামীর কথাটা লিখেই ফেলি । তখন পড়ি তৃতীয় শ্রেনীতে । দাদাবাড়ীতে একগাদা মানুষজনের সাথে গাদাগাদি করে থাকি । মায়ের সবসময়ই মেজাজ খারাপ থাকে । রুম গোছাবার এক ঘণ্টার মাঝে তছনছ । ১৭/১৮ জন খাবার খায় প্রতিবেলা । মাঝে মাঝেই মাংসের মাঝে ঝোল আর আলু ছাড়া শেষের জনের পাতে কিছুই থাকে না । মা কিভাবে কিভাবে যেনো মাঝে মাঝেই খাবারের শেষের জন হয় । মামা, খালা মাঝে মাঝে বাসায় আসে । মাকে ঐসব দিনে কেমন যেনো লাগে । আমি যখন লুকিয়ে আপার সুন্দর ঘড়িটা নেই কিংবা অনির খেলনা নেই...ঐসব দিনে মাকেও ঠিক সেরকম লাগে ।
আমার কিন্তু খুব ভালো দিন যায় । সকালে দাদা স্কুলে দিয়ে আসে । মা কিংবা দাদা নিয়ে আসে । সারাদিন খেলি, বকবক করি । কখনো বড় আপার সাথে, বেশীরভাগ অনির সাথে । অনি আমার চাচাত ভাই । আমার চার মাসের ছোট । কিন্তু যা দুস্টু । দুষ্টু হলেও ভালো বন্ধু ।
সেদিন বাবা মা কোথায় যেনো গিয়েছে । চাচীর রুমে অনির সাথে খেলছি । চাচী বিছানায় শুয়ে চিত্রালী পড়ছে । হঠাত চাচী আমাকে বললো
-যাতো তরু তোর মায়ের মেকাপ বক্সটা এনে দে । মা চাচী প্রায়ই এ ওর মেকাপ বক্স ব্যাবহার করে । তবে আগের রাতেই মাকে গজগজ করতে শুনেছি ...’পটের বিবি শিউলি । সারাদিন আছে সাজগোজ নিয়ে । আমার পছন্দের লিপস্টিকটা শেষ করে ফেলেছে । তরু যখন তখন আমার মেকাপ বক্স চাচীকে দিবি না । দিলে তোর হাড় ভেঙ্গে ফেলবো । ‘
“ আমি পারবো না । “ আমি চাচীকে উত্তর দেই ।
-কেনো মা নিষেধ করেছে । চাচী জিজ্ঞেস করে । আমি না মিথ্যা বলতে পারি না । আজকাল তাও একটু চুপ থাকতে শিখেছি । আগে তাও পারতাম না । তাই সহজেই স্বীকার করি ।
-তোর মা আমাকে নিয়ে আর কি বলেরে । চাচী আবার জিজ্ঞেস করেন ।
“আমি জানি না ।“ অনির ট্রেনটা চালু করতে করতে আমি উত্তর দেই ।
-বল না । তোকে অনেকগুলো মিমি চকলেট দেবো । ইসসস একেবারে দুর্বল জায়গায় হাত । মিমি চকলেট খুব পছন্দ । কিন্তু দাঁত নষ্ট হয়ে গেছে বলে গত তিন/চার মাসে এক কামড়ও খাইতে পারি নাই । গত সপ্তাহেই অনির কাছ থেকে একটু নিয়েছিলাম । মা দেখতে পেয়ে খেতেতো দিলই না । অহেতুক কিছু চড়-চাপড়ও কপালে জুটলো । তাই যখন ড্রয়ার থেকে আস্ত তিন প্যাকেট মিমি বের করলো চাচী ...
“তুমি আর কাউকে বলবে নাতো চাচী ?” আমি জিহ্বাটা চেটে জিজ্ঞেস করি ।
-পাগল হয়েছিস । এটাতো তোর আর আমার ব্যাপার । চাচী আশ্বস্ত করেন । আগেও চাচীকে টুকটাক অনেক কিছু বলেছি । কখনো সমস্যা হয় নাই ।
“মা তোমাকে ঢংগী আর নেকা বলে ।“ চাচীর দেয়া মিমিতে প্রথম কামড় দিতে দিতে বলি ।
-তাই ?
“হ্যা । বাবাকে মা বলে শিউলির মত নেকা ঢংগী আমি জীবনেও দেখি নাই । “
-আর কি বলেরে ?
“বলে তুমি নাকি অনেক সেলফিস । খাবার সময় নিজে, অনি আর চাচু কি খেলো সেটাই শুধু দেখো । আর কারো কথা চিন্তা করো না । অথচ বাসার কোনো কাজই করো না । মেহমান আসলে অনেকেই মাটিতে ঘুমায় । তুমি নাকি কখনোই নিজের বিছানা ছারো না ।“ এরকম আরো কিছু বলে গেলাম । বিভিন্ন সময়ে মা বাবার আলাপ শুনে যা মনে এসেছে তাই বললাম ।
সেই রাতে মা বাবা মনে হয় অনেক রাতে বাসায় ফিরেছে । আমি আগেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম । সকালে ঘুম থেকে উঠেই বুঝলাম মারাত্মক কিছু হয়েছে । কেমন গুমোট পরিবেশ । ছোটরা মনে হয় এসব বেশী বুঝতে পারে । স্কুলে যাবার পথে বড় আপা শুধু বললো ‘হাঁদারাম তুই আবার ঝামেলা পাকাইছোস ।‘ আমি জিজ্ঞেস করলাম “কি ঝামেলা ?” কোনো উত্তর পেলাম না । দাদাকেও কেমন বিষণ্ণ লাগলো ।
স্কুল থেকে ফেরার কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য বুঝতে পারলাম ।
“হাদী মানুষের কাছে বানাইয়া বানাইয়া কথা বলবি আর মানুষ সেসব নিয়া আমার সাথে ঝগড়া করবে ।“ মা অনেক জোরে জোরে চিৎকার করছে আর আমাকে স্কেল দিয়ে মারছে । আশ্চর্য চিৎকার যত জোরে মার তত আস্তে । এতই আস্তে যে ঠিকমতো ব্যাথাও পাচ্ছি না ।
“গাধী তুই যে বানাইয়া বানাইয়া কথা বলস সেটাতো সবাই জানে । তুই মিমি কত খাবি হারামীর বাচ্চা ।“ শেষ কথাটা বলার সময় একটু জোরেই মারেন । আশ্চর্য আমিতো কখনো মিথ্যা বলতেই পারি না । অথচ সবাই জানে আমি বানাইয়া বানাইয়া কথা বলি ... । এর মাঝেই সব সময়ের মত দাদা আসেন ।
‘তোমরা দুই বউ ঝগড়া করো । এর মাঝে বাচ্চাদের মারো কেনো ?’ বলেই আমাকে নিয়ে যান ।
এর মাসখানেক পরেই ছোট চাচী আলাদা বাসায় চলে যান । তিনমাস পরে আমরাও বাবার অফিসের কোয়ার্টারে যাই । বহু বহুদিন আমার মন খুব খারাপ ছিলো । ভাবতাম আমার বোকামিতেই এমন হলো । পরে অবশ্য অনি বলেছে চাচী নাকি বলেছে ‘হাদী তরুর জন্য ঝাগড়াটা হলো । তাইতো ঐ দোজখখানা থেকে মুক্তি পাইছি ।‘ মাকেও কোয়ার্টারে আসার পরে বলতে শুনেছি ‘গাধীটার উপর তখন মেজাজ খারাপ হলেও ঐ কারনেই কিন্তু বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাইছি ।‘
আমার মা চাচীর এখন দারুণ দোস্তি । দুজনে ম্যাচিং শাড়ী পরে সব পারিবারিক অনুষ্ঠানে যায় । একসাথে হলেই এখন তারা সেইসব দিনের গল্প করেন । সেদিনও চাচী বলছিলেন “ইশশ ভাবী মাঝে মাঝেই পুরোনো দিনের কথা মনে হয় । আমারতো আর ছেলে মেয়ে হলো না । একসাথে সেসব দিন কি মজারই না ছিলো । সেইসব দিন যদি আবার ফিরে পাইতাম ।‘ মাও আন্তরিকভাবে সায় দেন । আমার দীর্ঘদিনের মনো কষ্ট অনেকটাই কমে ।
ফেব্রুয়ারী ১৫ ২০১৭ বুধবার
এই বছরের প্রথম গাধামির গল্প । গতকাল ছিলো ভ্যালেন্টাইন্স ডে । আমার জন্য না হলেও অনেকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিলো । আমি কলেজ থেকে বাসায় এসে পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম । শুধু নতুন কেনা মহাদেব সাহার কবিতার বই পড়েছিলাম কিছুটা সময় ...
আর কিছুই হই বা না হই
হই যেন ঠিক হৃদয়বোধ্য
এই যে বুকে অশ্রু-আবেগ,
জলের ধারা অপ্রতিরোধ্য;
আকাশে এই মেঘ জমে আর
পাতায় জমে শিশির কণা,
এই জীবনে তুমি আমার
যা কিছু এই সম্ভাবনা ।
সকালে কলেজে আসার পর থেকেই কে তার বয়ফ্রেন্ড/প্রেমিকের কাছ থেকে কি গিফট পেলো আর কি দিলো সেই গল্পই শুনে চলেছি । কোথায় কোথায় যুগলে ঘুরলো সেসবও শুনলাম । আমি আর সোনিয়া শুধু শুনেই চলেছি । আমাদের দুজনেরই একটু মন খারাপ । আমার কম । সোনিয়ার বেশী । টিফিন টাইমে ক্যান্টিনে বসতে বসতে সোনিয়া বললো...
-আমাদেরকে কোনো ছেলে কোনোদিন পছন্দ করবে না । তাই নারে তরু ।
“ধ্যেত । না করলে না করবে ।“ আমি উত্তর দেই ।
-নারে আমার মনে হয় এটাই হবে । তুইতো সাজগোজ কিছুই করোস না । আমিতো ইদানীং বেশ সাজগোজ করি । তবে এখনও ন্যাকা ন্যাকা ঢঙ্গী কথা বলতে পারি না । ছেলেরা নাকি ন্যাকা ঢঙ্গী মেয়েদেরই বেশী পছন্দ করে ।
“তুই কি শুরু করলি ।“ আমি এতটুকু বলতে বলতেই তুলি আর রুনা হাজির ।
‘দেখ দেখ রুনা ওর বয়ফ্রেণ্ডকে কি ছবি পাঠাইছে ।‘ তুলি খলবলিয়ে বলে । আমরা হুমড়ি খেয়ে রুনার মোবাইল দেখি । এরকম ছবি বিদেশের সিনেমার ম্যাগাজিনে দেখেছি । কাপড় যতটুকু আছে তা শরীর ঢাকার চাইতে প্রদর্শনেই বেশী ব্যবহৃত ।
“রুনা তুইনা হিজাব ছাড়া কোথাও বের হস না । তুই এইরকম ছবি কেমনে তুললি । এই ছবি আবার বয়ফ্রেণ্ডকেও দিলি ।‘ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি । আমার অবাক হওয়া একেবারেই আমলে না নিয়ে রুনা বলে ‘ছবিটা কিউট না’ ।
“আমার কাছে কিউট লাগতাছে না বরং বেহায়া নির্লজ্জ লাগতাছে ।“ আমি উত্তর দেই । শুনে রুনার গাল লাল হয়ে যায় । লজ্জায় না – রাগে ।
‘তুই নিজেরে কি মনে করস । সতী । তোর কোনো ছেলেবন্ধু নাই । কোনোদিন হবেও না । কেনো জানোস ? এই ফালতু সতীপনার জন্য । তোরে সারা কলেজে কি বলে জানোস ? ‘হাবলি তরু’ সংক্ষেপে হাত । চল তুলি মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেছে ।‘ বলে গটগট করে চলে যায় রুনা আর তুলি ।
“তুইতো দেখছস ছবিটা । আমি কি মিথ্যা বলছি ? বলতো ।“ আমি সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে অসহায়ের মত বললাম ।
-তোর সমস্যাটা কি জানোস ? মন আর জিহ্বার মাঝে মগজ নামে আমাদের একটা ফিল্টার আছে । কোন কথা বলা যাবে আর কোন কথা বলা যাবে না সেটা আমাদের ফিল্টার ঠিক করে দেয় । তোর সমস্যা হইলো হয় তোর ফিল্টার নাই অথবা কাজ করতাছে না । মগজতো আর পালটানো যায় না । নাহলে বলতাম ফিল্টার বদলাইয়া ফেল । রুনারেতো চিনস । সারা কলেজে এখন তোর নামে যাতা বলবে । তোর সাথে থাকায় আমার নামেও কিছু বলে কিনা কে জানে । রুনা সত্যিকারভাবেই চিন্তিত হয়ে যায় ।
২৩শে মার্চ ২০১৭ বৃহস্পতিবার
আজকেরটা অবশ্য ছোট বোকামি । মানে আগের বোকামির তুলনায় । রুনাকে পরে সরি বলে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছি । এখনও পুরো ম্যানেজ হয় নাই । আজকে রুনার জন্মদিন ছিলো । দামী একটা লিপস্টিক গিফট করেছি । আশা করছি সামনের রবিবারেই কলেজে রুনার হাসিমুখ দেখতে পারবো ।
যাহোক আজকের বোকামিটা বলি । কলেজ থেকে ফিরে দেখি পাশের ফ্লাট আর নিচতলার ফ্লাটের আন্টি বাসায় বসে গল্প করছেন । দুইমাস আগে আমরা এই ফ্লাটে এসেছি । নিজেদের ফ্লাট । এক কোটি তেত্রিশ লাখ টাকা দাম । মাঝে মাঝেই আশে পাশের আন্টিরা এসে গল্প করেন । মাও যান মাঝে মাঝে । আমি সালাম দিয়ে ভিতরে চলে গেলাম । কলেজ থেকে ফেরার পর আমার ভীষন ক্ষুদা লাগে । তাড়াতাড়ি গোসল করে খাবার টেবিলে এসে দেখি আন্টিরা তখনও গল্প করে চলেছেন । খাবার টেবিলে বসেই ।
‘ভাবী আমার ছেলেটারতো আগামী বছরই এস,এস,সি পরীক্ষা । কিযে চিন্তায় আছি । ছেলেটার ব্রেইন ভালো কিন্তু একেবারেই পড়তে চায় না । আজকালতো গোল্ডেন না পাইলে ভালো কলেজে ভর্তিই হতে পারবে না ।‘ এক আন্টি শুরু করেন । অন্য আন্টিও বলেন তার মেয়ের জন্য কয়টা টিচার রেখেছেন । তাও মেয়ে পড়ে না বলে আক্ষেপ করতে থাকেন । আমি চুপচাপ শুনছিলাম ।
-ভাবী তরুও খুব মেধাবী । কিন্তু এত আলসে । আর আছে রাজ্যের গল্প আর কবিতার বই । পড়ার বই যতটা না পড়লেই না ততটুকু পড়ে । বলতে বলতে আমি ক্লান্ত । আমার মা শুরু করেন ।
“আমি পড়িতো মা ।“ আমি ছোট করে বলি ।
-ছাই পড়ো । মা মুখ ঝামটা দেন । আমার মেজাজটা হঠাৎ খারাপ হয়ে যায় ।
“এত পড়েই বা কি লাভ মা । পরীক্ষার আগে আনিস আংকেলতো প্রশ্নপত্র এনে দিবেনই । মনে নাই মেট্রিক পরীক্ষার আগে আনিস আংকেল এর দেয়া সব প্রশ্নপত্রই একদম ঠিক ছিলো । তাই টেনশন কইরো না ।“ এতটুকু বলাতেই দেখি মায়ের ফর্সা মুখটায় নিমিষেই আধার নেমে এলো । বুঝতে পারি আবার একটা গাধামি করে ফেলেছি । আর কোনো কথা না বলে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে টেবিল ছাড়ি ।
-তোমার গাধী মেয়ের জন্যতো পদে পদে ছোট হইতে হয় । বাবা অফিস থেকে ফিরতেই মা শুরু করেন ।
‘কি হয়েছে’ ? বাবা জিজ্ঞেস করেন । মা সবিস্তারে আমার গাধামির বর্ণনা দেন ।
‘বাদ দেও । আজকাল সবাই জানে প্রশ্নপত্র কিনতে পাওয়া যায় । এটাই এখন স্বাভাবিক ।‘ বাবা ব্যাপারটা হাল্কা করে ফেলেন । আমি হাফ ছেড়ে বাচি ।
২১শে এপ্রিল ২০১৭ শুক্রবার
আজকে প্রায় গাধামি করে ফেলেছিলাম । শেষ মুহূর্তে কোনোমতে সামলানো গেছে ।
বড় আপা মেডিক্যাল কলেজের ফার্স্ট ইয়ার থেকেই সাজু ভাইকে ভালোবাসে । আমি যেমন জানি আমার মনে হয় বাবা মাও ব্যাপারটা অনুমান করতে পারেন । সাজু ভাই পছন্দ করবার মতই ছেলে । লম্বা, সুদর্শন । তবে আমার যেটা সব চাইতে ভালো লাগে তা হলো ওনার সেন্স অফ হিউমার । হঠাৎ এমন একটা কথা বলবে যে হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে যায় । ওনার বাবাও আমার বাবার মত সরকারী অফিসার । আমার মনে হয় ওনার পরিবারও বড় আপার কথা জানে ।
কিন্তু গত তিন চার মাস যাবত শুভ্র ভাইয়াকেও দেখি প্রায়ই আমাদের বাসায় আসেন । শুভ্র ভাইয়াও চমৎকার ছেলে । আপা আর সাজু ভাইয়ের সাথে একসাথেই পড়েন । অনেক অনেক বড়লোকের ছেলে । ঈদানীং আপাকে অনেক অনেক দামী গিফটও করছেন । এইতো দুই সপ্তাহ আগেই অনেক দামী একটা ঘড়ি গিফট করলেন । বন্ধু বন্ধুকে গিফট করতেই পারে । তারপরও আমার কেমন জানি লাগে । আপার সাথে আমি সেরকম ফ্রি না । তাও জিজ্ঞেস করেছিলাম ...
-শুভ্রর কয়েকদিন আগে একটা ব্রেক আপ হয়েছে । তাই মানষিকভাবে ওকে একটু সাপোর্ট করছি । ছেলেটা কিন্তু দারুণ । আপা উত্তর দিয়েছিলো ।
“সাজু ভাই কি জানে ?” আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ।
-সব কথা সবার জানার দরকার কি । আর ও এমনিতেই একটু পিউরিটান । সেজন্যই বেশ বোরিংও ।
“আপা সাজু ভাইকে প্রথম দেখেই তোমার ভিতরে অন্যরকম কিছু কি হয়েছিলো? “ সুযোগ পেয়ে আমি জিজ্ঞেস করি ।
-তুই এমনিতেই একটা গাধা । গল্প, কবিতা পড়ে পড়ে আরো গাধা হয়ে যাচ্ছিস । শোন ঐসব সিনেমা গল্পেই হয় । রাজকন্যা ভিখারী পুত্রের প্রেমে পরে । বাস্তবে আজকাল সবাই হিসাব করে প্রেম করে । ছেলে কেমন, ট্যালেন্ট আছে কিনা । পরিবারের অবস্থা কেমন সব দেখে । খবরদার কোনো উল্টা পাল্টা ছেলের সাথে আবার জড়াইয়া যাইস না । শেষের কথাটা আদেশের সুরে বলে আপা । শুনে আমার কেমন জানি লাগে । আজকালকার সব প্রেমই কি এমন ? কি জানি ?
আজকেও শুভ্র ভাই এসেছিলো । আপা দেখলাম তৈরীই ছিলো । শুভ্র ভাই আসতেই বের হয়ে গেলো । যাবার সময় আমাকে বলে গেলো ...
-আমার ফোন বন্ধ থাকবে । সাজু আসতে পারে । বলবি চাচীর বাসায় গেছি । শুভ্রর কথা বলবি না । খবরদার বোকামি করবি না ।
আপা চলে যাবার ঘণ্টাখানেক পরেই সাজু ভাই আসেন । আমিই দরজা খুলি
-কিরে ফুলপরী (সাজুভাই আমাকে ঐ নামেই ডাকেন) কেমন আছিস ? ম্যাডামকেতো আজকাল ফোনে পাওয়াই যায় না । কই ম্যাডাম কই ?
“আপাতো শুভ্র ভাই” ...এতটুকু বলতেই মনে পড়লো আপা পইপই করে শুভ্র ভাইয়ের নাম বলতে নিষেধ করেছেন । আসলেও সোনিয়া ঠিক বলে । আমার মন আর জিহ্বার মাঝে মগজ নামের কোনো ফিল্টার নাই ।
“শুভ্র ভাই সকালে ফোন দিয়েছিলো (এইটা আসলেও সত্যি) । আপা চাচীর বাসায় গেছে । ফিরতে নাকি দেরী হবে ।“ কোনোমতে সামাল দেই । তারপরও দেখি সাজু ভাই ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন ।
৯ই এপ্রিল ২০১৭ রবিবার
আজকেরটা অবশ্য বড় । বোকামিটা অবশ্য করেছি গত শুক্রবার । কিন্তু জানা গেলো আজকে ।
বাবা অফিস থেকে ফিরেই কেমন গুম হয়ে ছিলেন । সাধারণত বাবা অফিস থেকে ফিরলেই বাসায় প্রান ফিরে আসে । আমাকে জিজ্ঞেস করবেন ‘আমার বোকা মেয়েটার কলেজ কেমন হলো ?‘ আপা বাসায় থাকলে বলবেন ‘আমার প্রেশারটা মনে হয় আজকে হাই । একটু মেপে দেখতো ।‘ আপা বলবেন - তোমার প্রেশার মাপতে পারবো না । সব সময়ইতো নরমাল পাই ।
‘বাবারটাতো সব সময়ই নরমাল পাস । আর অন্য লোকেরটা মাপতে গেলেই তোর যন্ত্রে ঠিক হাই ধরা পরে । তোর প্রেশার মাপার যন্ত্রে ‘বাবা’ নামে কোনো সেন্সর আছে কিনা দেখতো ।‘ বাবা গম্ভীরভাবে বলবেন ।
আজকে এসবের কিছুই করেন না বাবা । রাতে আমরা সবাই এক সাথে খাই । অনেক দিনের নিয়ম । মায়ের চালু করা নিয়ম । খাবার টেবিলেই বাবা আমার বোকামিটা বললেন
‘তোমার হাদী মেয়ের বোকামিতে অফিসেওতো অপদস্থ হওয়া শুরু করেছি ।‘ বাবা বেশ রাগের সাথে মাকে বললেন ।
“আমি আবার কি করলাম ।“ বেশ ভয়ের সাথে বলি ।
‘কি করেছিস । গত শুক্রবার সেলিম সাহেবের মেয়ে শান্তাকে কি বলেছিস ।‘
“কি বলেছি ?”
‘তুই বলস নাই । বাবা লটারি পেয়েছে । আর লটারির টাকা দিয়েই এই ফ্লাটটা কিনেছে ।‘ এইবার মনে পরলো ।
‘জানো অফিসের সবার সামনে সেলিম সাহেব দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে বললো – কি ব্যাপার সামসুদ্দিন সাহেব এতগুলো টাকা লটারি থেকে পেলেন । কিছুই জানাইলেন না । ফ্লাট কিনে ফেললেন ।‘
‘সেলিম সাহেব এমনিতেই আমার পোস্টিং নিয়ে জেলাস । এত লজ্জা পাইছি সবার সামনে তোমার গাধি মেয়ের জন্য ।‘ একটু থেমে বাবা আবার বলেন । বাবা সত্যি অনেক দুঃখ পেয়েছেন ।
আমার খুব খুব খারাপ লাগে । কিন্তু আমার কি দোষ । এক কোটি তেত্রিশ লাখ টাকা দিয়ে ফ্লাট কেনার পরে আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম –বাবা এত টাকা কোথায় পেলে । বাবাই হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলো ‘লটারি থেকে‘ ।
আমারও বিশ্বাস হয়েছিলো । কারন বাবা প্রায়ই লটারির টিকিট কেনে । তাছাড়া বাবা বেতন পান সত্তর হাজার পাঁচশ টাকা । তাও মাত্র কয়েকবছর আগে সরকারের কি একটা পে কমিশনের পরে । ঐ সময়ে বাবা হিসাব করে বাসার সবাইকে খুব খুশী গলায় অংকটা বলেছিলেন । আমিতো অংকে অনেক ভালো । ঐ টাকা বেতন পেয়ে এক কোটি তেত্রিশ লাখ টাকা জমাতেতো অনেক অনেক বছর লেগে যাবার কথা ।
তাছাড়া বাবা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন । আজকাল তাহাজ্জুদের নামাজও মিস করেন না । বাবাকে কখনো কোনো অন্যায় করতে দেখি নাই । আমি কিভাবে অন্য কিছু ভাববো ?
বাবাকে খুব ভালোবাসি । এত খারাপ লাগছে । আমি কেনো এত বোকা হইলাম ...