পৌনঃপুনিক

dukhopakhi

Well-Known Member
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
115
Messages
1,101
Reaction score
134
Points
1,213
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
*****পৌনঃপুনিক*****

মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু






মগবাজার থেকে মতিঝিল আসতে পুরো সোয়া ঘণ্টা লাগলো । সকাল সাড়ে সাতটার আগে বাসা থেকে বের হলে অবশ্য লাগে ২৫ মিনিট । প্রতিদিন সেরকমই বের হয় হাসান সাহেব । আজও বের হচ্ছিলো এমন সময় স্ত্রী সেলিনা এসে বলে...
-শোনো আজকে কি একটু বাজার করে দিতে পারবে । আসলে গতকালই দরকার ছিলো । ভেবেছিলাম কোনোমতে শুক্রবার পর্যন্ত চালাতে পারবো । আজকে দেখি তেল নাই, পিয়াজ আর লবণও নাই । একটু করে দিয়ে যাবে ।
-অয়নতো বাসায় আছে । ওকেই বলো না । নরম করেই উত্তর দিয়েছিলো হাসান ।
-অয়নকে দিয়েতো একটা দুইটা জিনিষ আনা যায় । এইসব বাজার কি পারবে ? সব সময়ের মত নরম ভীরু কন্ঠে বলে সেলিনা ।
-তোমার ছেলের বয়স কিন্তু একুশ । কচি খোকা না । আরো কয়েকটা কঠিন কথা বলতে গিয়েও থেমে যান হাসান সাহেব । কেমন ভীত মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে সেলিনা । আগে অনেক রাগ হলেও আজকাল কেমন মায়া হয় হাসান সাহেবের । ঐ ভীত মুখ দেখে ।
-কি কি লাগবে মুখে বলবে নাকি লিস্ট করেছো ?
-লিস্ট করা আছে ।

তারপর বাজার করে অফিসে রওনা দিতে দিতে নয়টা পার হয়ে যায় । মালিবাগ মোড়ে বিশাল জ্যাম । কারণ হলো একটা বাস আর একটা বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে লেগে গেছে । এর মাঝে একটা বাসের মালিক মনে হয় নেতাগোছের কেউ । ব্যস ...আর কি ! এসব দেখতে দেখতে ঘেন্না ধরে গেছে । হাসানের রাগটা না হয় একটু বেশী...সবাই তাই বলে । কিন্তু বেশীরভাগ মানুষের হয়তো অনুভুতিই নষ্ট হয়ে গেছে । অথবা এটাই নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে । নাহলে দিনের পর দিন এসব চলে কিভাবে !?

শাপলা চত্বরে যখন বাস থেকে নামলো হাসান সাহেব তখন ঘড়ির কাটা সকাল সাড়ে দশটা ছুই ছুই । জুলাই মাস । গরমে পিঠের দিকে শার্ট কিছুটা ভিজে গেছে । দা হাতে রাস্তার পাশে ডাবওয়ালাকে দেখে তেষ্টাটা তীব্র হয় । একবার ভাবলেন একটা ডাব কিনে খাই । কিন্তু গত মাসেই অফিসের শরীফ সাহেবের কথা মনে পড়লো । রাস্তার পাশের ডাব খেয়েই বেচারা আট দিন হাসপাতালে ছিলেন ।

তিরিক্ষি মেজাজ নিয়েই চার তলায় নিজের অফিস রুমে ঢোকেন হাসান সাহেব । আজকেও এসি কাজ করছে না । গতকাল দুইজন লোককে দেখেছিলেন কাজ করতে । ফ্যানটা ছেড়ে টেবিলে বসতেই আপার ডিভিশন ক্লার্ক জলিল সাহেব রুমে ঢোকেন ।
-স্যার এর মনে হয় আজকে একটু দেরী হইলো ?
-হ্যা কেনো কেউ খুজেছিলো ?
-খোঁজার মানুষের কি অভাব আছে । জানেন না এই অফিস ।
-জলিল সাহেব এসিটা কবে ঠিক হবে ? গরমেতো মারা যাচ্ছি ।
-কালকেতো দুইজন আসছিলো । বোঝেন না সরকারী অফিসের কাজ । দশটাকার কাজে একশ টাকার বিল বানাইবো কিভাবে সেইটাই ধান্ধা । আমি খবর নেবো নে স্যার । দুই একদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে । এখন এই ফাইলটা একটু ছাইড়া দেন স্যার । ক্লায়েন্ট অনেকদিন যাবত ঘুরতাছে ।
-ঠিক আছে রাখেন । আমি একটু দেখে আপনাকে খবর দেবো । জলিল সাহেব আপনার বড় ছেলে কোথায় পড়ছে ? ইচ্ছা করেই হাসান সাহেব অন্য প্রসঙ্গে যান । জলিল সাহেব সিবিএ এর নেতা । সে যখন নিজে ফাইল নিয়ে আসছে তখন বড়সড় কোনো ঘাপলাই আছে । এখন মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে । আর মেসির মত ড্রিব্লিং করে ব্যাপারটা পাশ কাটিয়ে যেতে হবে । এতদিনে এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন হাসান সাহেব ।
-প্রাইভেট ইউনিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে স্যার । আগামী বছরেই বাইরে পাঠাইয়া দেবো । ছোটটাও এই বছর একই ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলো ।
-খরচ কেমন ?
-মেলা খরচ স্যার । কিন্তু কি করুম । পোলাপানের ভবিষ্যৎ ... যাই তাইলে স্যার । কল কইরেন । বলে রুম থেকে বের হয়ে যায় জলিল সাহেব ।

আজকাল এক একটা ছেলে মেয়েকে পড়াবার খরচ এত বেশী ...বিশ বছর আগে কেউ চিন্তাও করতে পারতো না । নিজের একমাত্র সন্তান অয়নও একটা প্রাইভেট মেডিক্যালে পড়ছে । বাপরে যা খরচ । প্রয়াত বাবা মগবাজারের মত জায়গায় পৌনে তিন কাঠা জমি রেখে গেছিলো বলে একটু স্বস্থি । ডেভেলপারকে দিয়ে সেখানে ফ্লাট করা হয়েছে । ভাগে দুইটা পেয়েছেন । একটায় থাকেন আর একটা ভাড়া দেওয়া । এটা না থাকলে ...
-হ্যালো দাদা । ফোন আসাতে চিন্তার জাল ছিড়ে যায় হাসান সাহেবের ।
-তুই কি বিকালে বাসায় থাকবি ? ওপাশ থেকে বড় ভাইয়ের জলদগম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসে ।
-কেনো দাদা ?
-নাহ তুই বাসায় থাকলে একটু আসতাম ।
-অফিস থেকে বের হতে একটু দেরী হতে পারে । তুমি ঠিক সন্ধ্যার পরে চলে আসো ।
-গতকাল নজরুল ভাই বাসায় এসেছিলো ।
-কোন নজরুল ভাই ?
-ঐযে আব্বার কিরকম চাচাতো ভাইয়ের মেয়ের জামাই । গ্রাম থেকে আই এ পাশ করে আমাদের বাসায় আসলো চাকুরী খুজতে । যার জন্য তুই আর আমি এক মাস মাটিতে বিছানা করে ঘুমালাম । সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় আমাদের টু ইন ওয়ানটা নিয়ে যে সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান ‘দূর্বার’ শুনতো ...আব্বা এদিকে পৌনে আটটায় বিবিসি শুনবে ...কিন্তু চাচাত ভাইয়ের মেয়ের জামাই দূর্বার শুনছে ... মনে আছে ?
-খুব মনে আছে । এক মাস ঢাকা থেকে সে তার যোগ্য চাকুরী না পেয়ে গ্রামে ফিরে গিয়েছিলো । তা এসেছিলো কেনো ?
-আবারো চাকুরী । এবার তার নিজের মেয়ের জামাইয়ের জন্য । আরো কিছু মজার কথা বললো । তোকে বলবো । তোর সাথে আরো কিছু কথা আছে ।
-ঠিক আছে চইলা আইসো ।
-শোন একটা মজার জিনিষ জানলাম ।
-কি?
-হার্ট এটাকের বাংলা কি জানোস ? সন্ন্যাস রোগ । শরৎচন্দ্রের বইতে পড়লাম । অদ্ভুত না ?

এভাবেই আরো কিছুক্ষণ আলাপ করে ফোন রাখেন হাসান সাহেব । মিজান সাহেব হাসান সাহেবের বড় ভাই । ছয় ভাই বোনের মধ্যে আড়াই বছরের বড় এই ভাইয়ের সাথেই ঘনিষ্ঠতা বেশী হাসান সাহেবের । ছেলেবেলায় একসাথে খেলেছেন, বড় ভাই একটু লম্বা হলেই তার ফেলে দেওয়া শার্ট, প্যান্ট পরেছেন এমনকি ভুল করে একই মেয়ের জন্য প্রেমপত্রও লিখেছেন । বছর দুই আগে সেনাবাহিনী থেকে কর্নেল হিসাবে অবসর নিয়েছেন বড় ভাই । বড় মেয়ে বিয়ে করে আমেরিকাতে, ছেলেটাও গত বছর কানাডা চলে গেলো পড়াশুনা করতে । শান্ত, নিরুপদ্রব কিন্তু প্রায় শূন্য ঘরে বড় ভাই মিজান সাহেবের এখন অফুরন্ত অবসর । প্রায়ই ছোট ভাইয়ের সাথে দেখা করতে চলে আসেন । এমনকি এই অফিসেও দুই তিনবার এসেছেন । দাদার খুব ইচ্ছা মগবাজারে পৈত্রিক বাসায় ফিরে আসা । কিন্তু ভাবী উত্তরার বাসা ছেড়ে আসতে নারাজ । এ নিয়ে পারিবারিক টানাপোড়ন চলছে । হয়তো সে কথাই বলতে বিকেলে আসবেন দাদা ।
এরপরে অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন হাসান সাহেব । ঠিক দুপুরে হঠাৎ সেক্রেটারি আসলো অফিসে । এরকম সময়ে যা হয় অফিসজুড়ে ব্যস্ততা বেড়ে যায় । যে লোক অফিসের টেবিলে নিয়মিত ঘুমায় সেও গভীর মনোযোগে ফাইল দেখতে থাকে । হাসান সাহেব সিনিয়র অফিসার বলে সারাটা সময় সেক্রেটারির সাথে থাকতে হলো । ঠিক দুইটার সময় সেক্রেটারি বিদায় নেবার পরে আবার নিজের টেবিলে এসে বসেন হাসান সাহেব । মাথাটা কেমন ঘুরছে । বছরখানেক আগে ডায়াবেটিস ধরা পরেছে । খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম করলেই এমন হয় । কিন্তু এই হতচ্ছাড়া অফিসে নিয়ম মেনে চলাওতো কঠিন । ব্যাগটা খুলে খাবারের বক্স বের করেন । দুটা রুটি, আলু আর পটলের সাথে শিং মাছের তরকারি, কাটা ছাড়াতে যেনো সুবিধা হয় সেইজন্য মাছের মাঝখানের টুকরা গুলো যত্ন করে দেওয়া । আর একটা বক্সে শসা, টমেটো, পিয়াজ, ধনেপাতে আর কাচামরিচ । সব আলাদা আলাদা করা । আগে থেকে মিশালে নাকি সালাদের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায় । খেতে খেতে মফস্বলের মেয়ে স্ত্রী সেলিনার গভীর মমতাময় ভালোবাসা টের পান হাসান সাহেব । নিত্যকার মতো । হায় স্ত্রীর কাছে নিজের রাগ যেভাবে প্রকাশ করেছেন ভালোবাসাটুকু কি সেভাবে প্রকাশ করতে পেরেছেন ? আজকাল মনে হয় মানুষ শুধু শারীরিকভাবেই প্রতিবন্ধী হয় এমন না । মনের আবেগ প্রকাশেও অনেকের প্রতিবন্ধকতা থাকে...নিজের যেমন আছে ।

খাওয়া শেষ হতে না হতেই মোবাইল বাজে । ফোনের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলেন হাসান সাহেব । “বড় ভাবী কলিং “ ...বড় ভাবীতো সাধারনত ফোন করেন না ...করলেও সেলিনাকে করে ...তাহলে ?
-হাসান তুমি কোথায় ? ফোন ধরতেই ভাবী জিজ্ঞেস করেন ।
-আমিতো অফিসে ।
-মিজানের কি জানি হয়েছে । আমি ইউনাইটেডে যাচ্ছি ।
-কি হয়েছে দাদার ?
-ড্রাইভার আপনি রং সাইড দিয়াই যান ...তাড়াতাড়ি করেন । উত্তরের বদলে ভাবীর এই কথাগুলোই ভেসে আসে । হাসান সাহেবও আর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করেন না । দ্রুত অফিস থেকে বের হন । মতিঝিল থেকে গুলশানে আসার পথে বাকি সব ভাই বোনকেই ফোন করেন ।

হাসপাতালের সামনে সি,এন,জি থেকে নামতেই বড় বুবুর সাথে দেখা হলো । বড় বুবুর বাসা কালাচাদপুর বলে তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারছেন ।
-দাদা কই ? হাসান সাহেব জিজ্ঞেস করে ।
-আই,সি,ইউ তে নিছিলো । কিন্তু জ্ঞান আছে বলে একটু পরেই সি,সি,উ তে নিয়ে গেছে ।
-সি,এম,এইচে নিলো না কেনো ?
-বড় বউ এর মামা এইখানের বড় ডাক্তার । সেই মনে হয় বলছে । আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি । ডাক্তারতো বললো হার্ট এটাক । আরো কি জানি বলবে । তুই বুঝতে পারবি তাই তোর জন্য এইখানে দাড়াইয়া আছি ।
-ঠিক আছে চলো ।

ঝকঝকে তকতকে ডাক্তারের রুমে এসে বসেন হাসান সাহেব । ‘দেখুন উনি ডায়াবেটিক রুগী বলে হার্ট এটাকটা সেভাবে টের পান নাই । এখন উনি ভালোই আছেন । তবে অনেক সময় সাবসিকুয়েন্ট এটাক হয় এবং সাধারনত পরের এটাকগুলো প্রথমটার চাইতেও অনেক খারাপ হয় । তাই পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ ।‘ গম্ভীরভাবে বলেন ডাক্তার সাহেব । ডাক্তারের রুম থেকে বের হতেই দেখেন হাসপাতালের করিডোর আত্মীয়-স্বজনে পরিপূর্ণ । এত মানুষ...নিজের মানুষ দেখে কেমন যেনো সাহস আসে মনে হাসান সাহেবের । ‘হাসানের সাথে ফোনে অনেকক্ষণ কথা বললো । আজকালতো আমার সাথে যত কথা বলে হাসানের সাথে তার চাইতেও অনেক বেশী বলে । তারপর বললো পেটে মনে হয় গ্যাস হইছে । দুইটা মাইলান্টা দেওতো ...’ বড় ভাবী সবাইকে বলছেন । এই একই কাহিনী আরো দশ বারোবার বলতে হবে বড় ভাবীকে । কোনো একবার শুনে নিলেই হবে । তাই হাসান সাহেব সেখানে আর দাঁড়ায় না । সি,সি,ইউ এর দরজার কাছে যায় । দেখে ছোট ভাই শোভন দাড়িয়ে আছে । ‘ভিতরে বড় বুবু আছে । এখনই বের হবে । একজনের বেশীতো ঢুকতে দেয় না । তুমি যখন আসছো তুমিই আগে যাও । আমি পরে যাবো ।‘ শোভন বলে । একটু পরেই হাসান সাহেব ঢোকেন সি,সি,ইউতে । চারদিকে বড্ড বেশী সাদা । এর মাঝে দূরের কোনায় দাদা শুয়ে আছেন । হাসানকে দেখেই দূর থেকে হাসেন ।

-আসলে আমার তেমন কিছু হয় নাই । তোর সাথে সন্ন্যাস রোগ নিয়া আলাপ করলাম না । ঐটাই মনে হয় সাইকোলজিক্যালি কাজ করছে । তবে এইখানে যখন আসছি এক দুই লাখ টাকা বিল না দিয়াতো যাওয়া যাবে না । যতই তোর ভাবীর মামা থাকুক না কেনো । কাছে যেতেই বলেন মিজান সাহেব ।
-তোমাকে টাকা নিয়া চিন্তা করতে হবে না দাদা ।
-আরে নাহ টাকা নিয়া চিন্তা করি না । জানোস একটু আগে না পুরানো একটা কথা মনে করে হাসি আসলো ।
-কি কথা দাদা ।
-তুই যে লুকাইয়া লুকাইয়া আমার ক্যাসিও ঘড়িটা পড়তি আমি কিন্তু জানতাম । তুই যে ঘড়িটা পইড়া স্টাইল কইরা হাটতি । দূর থেকে দেখে আমার মজা লাগতো । মাঝে মাঝে ইচ্ছা করেই আমি ঘড়িটা ড্রয়ারে রেখে যেতাম । কতদিন ইচ্ছা হইছে তোরে একটা ঘড়ি কিনা দেই । কিন্তু তখনতো অত টাকা
...
-দাদা আমারো একটা কথা মনে হয় জানো ।
-কি?
-সবাই যে বলে আমার রাগ বেশী এর কারণ মনে হয় তুমি ।
-কি বলিস ?
-মনে নাই একবার মাথা ন্যাড়া করলাম আর তুমি একটু পর পর মাথার চাঁদিতে চাপড় দিতে ...তাই মনে হয় রাগ বেশী হয়ে গেছে ...
-তাহলে এখন চাঁদিতে চাপড় দিলে আবার রাগ পানি হয়ে যাবে । দাড়া হাসপাতাল থেকে ফিরে সোজা মগবাজার যাবো । তোর ভাবীর কোনো কথাই আর শুনবো না । তখন সকাল বিকাল তোর মাথায় চাপড় দেবো ...বলে হাসেন মিজান সাহেব । এর মাঝেই এক নার্স আসেন । ‘আপনারা এত কথা বলছেন । রোগীর ক্ষতি হবে তো । ওনাকে একটু রেস্ট নিতে দেন ।‘
-ধুর বলুক । তুই আর একটু থাক । দাদা পাত্তা দিতে চান না ।
-নাহ দাদা । আমি পরে আবার আসবো । তুমি এখন চুপচাপ শুয়ে থাকো ।

সি,সি,ইউ থেকে বের হতেই বড় ভাবী একটা ফোন ধরিয়ে দেন । ‘তানিম ফোন করছে । তোমার সাথে কথা বলতে চায় । আমি আসতে নিষেধ করছি । তুমি কথা বলো ।‘ বলে ভাবী ফোনটা দিয়ে চলে যান ।

-চাচু বাবা কেমন আছে ? সুদূর কানাডা থেকে দাদার ছেলে তানিমের গলা ভেসে আসে ।
-এখনতো ভালো আছে । তবে ডাক্তার একটা কথা বলছে । দাড়া একটু দূরে গিয়ে বলছি । একটু আড়ালে গিয়ে একটু আগে শোনা ডাক্তারের কথাটাই হুবহু বলে তানিমকে ।
-চাচু কালকে আমার একটা পরীক্ষা আছে । এটা না দিলে সময় টাকা দুইটাই নষ্ট হবে । পরীক্ষাটা দিয়েই আসি ।
-ঠিক আছে তাই কর । মুখে বললেও মনে মনে একটু বিরক্ত হন হাসান সাহেব ।

রাতে হাসান সাহেব হাসপাতালেই থাকেন । দাদা, কাছে গেলেই গল্প শুরু করেন বলে আলাদা জায়গায় থাকেন । সকালে সবাই আসলে তারপর হাসপাতাল ছাড়েন হাসান সাহেব । অফিসে একটা ফোন করে ছুটির ব্যবস্থাও করেন । তারপর বাসায় এসে ঘুমাবার চেষ্টা করেন । মনে হয় ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়েও ছিলেন । এর মাঝে সেলিনা এসে ডেকে তোলে । ‘বড় বুবু ফোন করেছে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলো ।‘ আধা ঘন্টা পরে যখন হাসান সাহেব হাসপাতালে আসেন তখন সব শেষ ।

এর তিন সপ্তাহ পরে ।

-কি বুবু ডাকছো কেনো ? বড় বুবুর বাসার ড্রয়িং রুমে বসতে বসতে বলে হাসান সাহেব ।
-এখানে বসলি কেনো ? ফ্রেস হয়ে শোবার ঘরে যা । আজকেতো খেয়ে যাবি ।
-নাহ বুবু । আজকে খাবো না । কিজন্য ডেকেছো সেইটা বলো ।
-তুই নাকি খুব অশান্তি শুরু করছোস । ফিক্সড ডিপোজিট সব ভেঙ্গে ফেলতে চাস । অয়নের সাথে খ্যাচ খ্যাচ করোস ।
-সেলিনা বলছে ?
-কে বলছে সেইটা বড় না । মিজানের মৃত্যু আমাদের সবার জন্যই শোকের । তুই না হয় একটু বেশী ক্লোজ ছিলি । তাই বইলা এই বয়সে এইসব কি শুরু করছোস ।
-বুবু ঠাণ্ডা হইয়ো বসো । তোমাকে কয়েকটা কথা বলি ।
-বল ।
-তোমার কি মনে হয় না অয়ন, তানিম এরা খুব স্বার্থপর একটা প্রজন্ম ?
-কেনো এই কথা কেনো ?
-তোমাদের কাউকে না বললেও ডাক্তার কি বলেছে সেটা কিন্তু আমি তানিমকে ভালোভাবে বলেছিলাম । সে বললো তার পরীক্ষা পরেরদিন ।
-তানিম তো আর এখানে ছিলো না । হয়তো বুঝতে পারে নাই ।
-বুবু তুমি খেয়াল কইরা দেইখো এরা কেমন যেনো । আমরা ছয় ভাইবোন ছিলাম । গ্রাম থেকে মেহমান আসলেই আমাকে আর দাদাকে মাটিতে শুইতে হইতো । সারাটা স্কুল কলেজ জীবন পার করলাম নিজের কোনো পড়ার টেবিল ছাড়া । সকালে একটা ডিম ভাজি হইলে কমপক্ষে তিনজন খাইতাম । আর এখন আমাদের ঘরে ঘরে একজন কিংবা দুইজন সন্তান । এরা কিছু না চাইতেই অনেক কিছু পায় । সেদিন আমার একটা জামা অয়নকে দিলাম । আমি মাত্র একদিন পরেছিলাম । সে মুখের উপরে বললো আর একজনের জামা কাপড় পরা নাকি আনহাইজিনিক । অথচ আমার সারাটা ছোট বেলা কাটছে দাদার জামা কাপড় পরে । এরা আসলে একটা স্বার্থপর প্রজন্ম ।
-কিসব যে বলস না । তোর সাথে...মিজানের সাথে... বাবারও তো অনেক লাগতো । মনে নাই একবার বাবা আর একটু হইলে ক্যাসেট প্লেয়ারটা আছাড় মাইরা ভাইঙ্গা ফালাইতে লইছিলো ।
-ঐটাতো অন্য ব্যাপার বুবু । বাবা মনে করতো আব্বাসউদ্দিন আর আব্দুল আলীমের পরে আর কোনো শিল্পী আসে নাই । আমি আর দাদা ব্যান্ডের ক্যাসেট কিনলে কইতো কাউয়া সঙ্গীত । ঐটাতো ভিন্ন জিনিষ ।
-আরে একই । আসল কথা হলো এদের অনেক কিছু আমাদের সাথে মিলবে না ।
-নাহ বুবু । আমি খেয়াল করে দেখেছি । অফিসের পিওনের ছেলেটাও মনে করে হাজার হাজার টাকা খরচ করে বাবা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াবে । বাবা যেভাবেই হোক পড়ায়ও । আমরা কোনোদিন এসব ভাবতে পারছি ।
-হইছে তুই যেমন তোর মত ওরাও ওদের মত । সংসারে অশান্তি করিস নারে ভাই ।

আরো তিন সপ্তাহ পরে ।

ডাক্তারের চেম্বারে হাসান সাহেব আর অয়ন বসে আছে । সব রিপোর্ট দেখে বেশ কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার মুখ তুললেন ।
-দেখুন আপনার ছেলে মেডিক্যালের ছাত্র । ও মনে হয় কিছুটা বুঝতে পারছে । আপনার স্ত্রীর যেটা হয়েছে তার নাম সি কে ডি । ক্রনিক কিডনি ডিজিস । সমস্যাটা অনেক দিনের । উনি হয়তো চেপে গেছিলেন । খারাপটা আগে বলে নেই । ওনার দুইটা কিডনিই ৭০ শতাংশ অকেজো এবং এটা চিকিৎসা করলেও ধীরে ধীরে আরও খারাপই হবে ।
-আরো খারাপ হলে সেটা আবার কি চিকিৎসা ? হাসান সাহেব প্রশ্ন করেন ।
-আমাকে পুরোটা বলতে দিন । চিকিৎসা মানে হলো খারাপ হবার রেটটাকে যথাসম্ভব ধীর করে দেয়া । তবে আসল ভালো খবরটা এখনো বলি নাই । ওনার যেহেতু ডায়াবেটিক কিংবা অন্য কোনো জটিল সমস্যা নাই এবং বয়সটাও যেহেতু মাত্র পঞ্চাশ পার হলো কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হলে উনি অনেকদিন সুস্থ থাকবেন । তুমিতো ব্যাপারগুলো কিছুটা জানো ? শেষ প্রশ্নটা ডাক্তার সাহেব অয়নকে বললেন ।
-জ্বি । কিডনি হয় একজন ডোনার কিংবা নিজের আত্মীয় স্বজন থেকে যোগাড় করতে হবে । অয়ন উত্তর দেয় ।
-এখনো তাড়াহুড়ার পর্যায়ে নাই । আগামী ছয় কিংবা নয় মাসের মাঝে কিডনি পেলেই হবে । এর মাঝে ওষুধ চলতে থাকুক ।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে হাসান সাহেব অয়নকে বলেন ‘খবরটা মাকে দিও না । বলবে ওষুধ খেলেই ভালো হয়ে যাবে ।‘ অয়ন এই যুগের ছেলেদের মত বিশ্রীভাবে কাঁধ নাচিয়ে উত্তর দেয় ।

আরো তিন সপ্তাহ পরে ।

গত এক সপ্তাহ যাবত ছুটিতে আছেন হাসান সাহেব । অবশ্য বাসার কেউ জানে না । প্রতিদিন নিয়মমতো অফিসের সময়ে বের হন । তারপর বিভিন্ন হাসপাতালে যান । বন্ধু ডাক্তার জামিলের পরামর্শে এমন করছেন । একটা নেটওয়ার্ক বিল্ডাপ করা যাতে একটা কিডনি পাওয়া যায় । আজকে অবশ্য জামিলের চেম্বারেই আসছেন ।
-তুই বুঝতে পারছিস না কেনো । তোর কিডনি ম্যাচ করলেও নেওয়া যাবে না । তুই নিজেই ডায়াবিটিক রোগী ।
-আমি ডায়াবেটিক রোগীতো কি হইছে । আমার কিডনিতো এখনো ঠিক আছে । তাছাড়া ধর এক কিডনিওয়ালা লোকের কি ডায়াবেটিক হয় না ।
-ক্রস ম্যাচ করাইতে চাস করা । কিন্তু আমি জানি তোর কিডনি কোনো ডাক্তার নিবে না । তুই এত অধৈর্য হয়ে যাচ্ছোস কেনো । বুঝলাম না । আর ভাবীর দিকের কিছু আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ কর ।
-ওর দিকের আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ একটু কম । ও নিজেই কমাইয়া দিছে ।
-কমাইয়া দিছে, তুই এখন বাড়া ।
-তুই আসলে বুঝবি না জামিল । এই দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে সেলিনা আমার কাছ থেকে তেমন কিছু পায় নাই । কথায় কথায় রাগারাগি করছি । ও মফস্বলের স্কুল মাস্টারের মেয়ে । আমার অন্য ভাইদের বউদের চাইতে সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে অনেক দুর্বল । এটা নিয়ে সব সময় ও কূন্ঠিত হয়ে থাকতো । আর তাতেই আমার মেজাজ আরো বেশী খারাপ হোতো । অয়ন জন্মাবার পাঁচ বছর পরে ওভারিতে টিউমার হওয়াতে যখন ওভারি ফেলে দিতে হলো ...সেটাও সে নিজের আর একটা দোষ হিসাবে মনে করে । প্রায় পঁচিশ বছর হয়ে গেলো ...আমি যে ওকে ভালোবাসি সেটাও মনে হয় বলি নাই ঠিকভাবে... শেষ কথাগুলো বলার সময় গলা ধরে আসে হাসান সাহেবের । জামিল একটু অবাকই হয় । হাসানকে সব সময় অন্যভাবেই দেখে অভ্যস্ত জামিল । বন্ধুমহলে হাসানের রগচটা স্বভাবের জন্য নামই ছিলো ‘ঘাউরা হাসান’ ।
-ঠিক আছে তুই ক্রস ম্যাচ করা । আর চিন্তা করিস না । একটা ব্যবস্থা হবেই । জামিল বলে ।

-তোমার কি হয়েছে ? সেই রাতেই সেলিনা হাসান সাহেবকে জিজ্ঞেস করে ।
-কই কিছু হয় নাইতো ।
-কিছু একটা হইছেই । রাতের বেলা দুই তিনবার উঠে পরো । সকালে এক এক সময়ে অফিসে যাচ্ছো । অফিসে কোনো সমস্যা ?
-আরে নাহ অফিসে আবার কি হবে । তুমি তো জানোই অফিস নিয়ে আমি বেশী চিন্তা করি না ।
-হ্যা আমিও তাই ভাবি অফিস নিয়ে টেনশন করার লোক তো তুমি না ...তাহলে ?
-আমার কিছুই হয় নাই ।
-দেখো । আমার পৃথিবী খুব ছোট । পঁচিশ বছর আগে এই সংসারে এসে নিজেকে অসম্ভব ভাগ্যবতী মনে হয়েছিলো । এখনো তাই মনে হয় । সব সময় ভয়ে থাকি তুমি, অয়ন এই নিয়ে এই যে আমার ছোট সুন্দর পৃথিবী সেখানে না আবার কোনো সমস্যা হয় ।
-তোমার এই ভয়টাই আমার দুচোখের বিষ ।
-আমি জানি । তুমি যদি আমার চোখ দিয়ে দেখতা তাহলে বুঝতে । আজকাল কতকিছু শুনি দেখি । অথচ তোমার দিকে তোমার ছেলের দিকে তাকালে মনে হয় আহা আমার দুনিয়াটা এত সুন্দর...যদি নষ্ট হয়ে যায় । ভয় তো আর এমনি এমনি আসে না । সেলিনার কথাগুলো শুনতে শুনতে জলের ধারা বুক থেকে উঠে এসে চোখের কিনারায় জড়ো হয় ।
-তোমার যত আজাইরা চিন্তা । এইসব আজাইরা চিন্তা না করে ওষুধগুলো ঠিকমতো খাইয়ো । তাইলে আমার উপকার হবে । শেষ কথাটা স্বভাবসুলভ চড়া স্বরেই বলেন হাসান সাহেব । জীবনে এই প্রথম নিজের আবেগ প্রতিবন্ধকতার জন্য তেমন খারাপ লাগে না হাসান সাহেবের ।

ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছেন হাসান সাহেব । এর পরের সিরিয়ালটাই হাসান সাহেবের । অয়নেরও আসার কথা । কোথায় নাকি আটকা পরেছে । মায়ের অসুখ । কোনো হুস আছে ছেলেটার । তবে এই স্বার্থপর প্রজন্ম থেকে বেশী কিছু আশাও করেন না হাসান সাহেব ।
-তাহলে একজন ডোনার অলরেডি পাওয়া গেছে । এখনো আরো পাঁচ-ছয়মাস সময় আছে । দেখেন আরো এক দুইজন পাওয়া যায় কিনা । ডাক্তারের কথায় চমকে যান হাসান সাহেব ।
-ডোনার পাওয়া গেছে মানে ?
-ফাইলে তো তাই লেখা । ডোনারের সব টেস্টও করা হয়ে গেছে । সব পজিটিভ । আপনি জানেন না ?
-আমি কি একটু ফাইলটা দেখতে পারি ডক্টর ।
-নিশ্চয় ।
-ফাইলের উপরেই বড় করে ডোনারের নাম লেখা । ‘অয়ন ইসলাম’ । এরপরে ডাক্তার আর কি বলে ঠিকমতো শোনা হয় না হাসান সাহেবের । হু হা করেই বাকি সময়টা পার করেন ।

চেম্বার থেকে বের হতেই হন্তদন্ত অয়নকে দেখতে পান হাসান সাহেব ।
-ইসস একটুর জন্য মিস করলাম । কি বললো ডাক্তার । ক্রিয়েটিনিন লেভেল বাড়ে নাইতো ? ডাক্তারের চেম্বারের করিডোরে হাটতে হাটতে অয়ন জিজ্ঞেস করে ।
-নাহ ।
-এত গম্ভীর হয়ে আছো কেনো । রাগ কইরো না । রাস্তায় যে কি জ্যাম আজকে চিন্তাও করতে পারবে না ।
-তুই কিডনি দিবি একবার আমাকে বলারও প্রয়োজন মনে করলি না ।
-এতে বলার কি আছে । মায়ের জন্য আমি কিডনি দেবো । আর ভুলে যাচ্ছো আমিও কয়দিন পরেই ডাক্তার হবো । এক কিডনি নিয়ে দিব্যি ভালো থাকা যায় । বলে স্বভাবসুলভ কাঁধ নাচায় অয়ন ।

কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ অয়নকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেলেন আবেগ প্রতিবন্ধী হাসান সাহেব । স্বার্থপর প্রজন্মের ছেলে অয়ন অবাক হয়ে যে একটু কাঁধ ঝাকাবে তারও কোনো উপায় থাকে না । কাঁধে যে বাবা মুখ ডুবিয়ে বসে আছেন ...
 
Back
Top