বোকা বোকা সুখ

dukhopakhi

Well-Known Member
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
115
Messages
1,101
Reaction score
134
Points
1,213
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
*****বোকা বোকা সুখ*****

মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু






নতুন ব্রাঞ্চে এসে সবচাইতে ভালো লাগলো পিওনকে । মাঝবয়সী মাঝারী লম্বা মানুষ । মাথাভর্তি একমাথা চুল আর মুখভর্তি একগাল হাসি । এই ব্রাঞ্চেই নাকি চৌদ্দ বছর আছেন । অফিসের সবাইতো পছন্দ করেই ক্লায়েন্টরা পছন্দ করে আরো বেশী । কিছু কিছু বড় ক্লায়েন্টের সাথেতো একেবারে ইয়ার দোস্তের মত সম্পর্ক ।

এর আগে পুরান ঢাকার এক ব্রাঞ্চে দেড় বছর ম্যানেজার ছিলাম । সারাক্ষণ টেনশনে থাকতে হোতো । কারণ বৃহস্পতিবার বিকেলেই বড় কোনো ক্লায়েন্ট এসে বলতো ‘ম্যানেজার সাহেব বিশ লাখ টাকা লাগে যে ।‘ এটা আসলে এক ধরনের আদেশই । আমাকে দিতেই হবে । ঐ এলাকায় অনেক ক্যাশের আদান প্রদান হয় । ব্যাংকের ম্যানেজাররা অনেক সময়ই এসব টাকার যোগান দেন । তবে এইসব লেনদেনের কোনো কাগজপত্র থাকে না । যেমন এই ২০ লাখ টাকা ক্লায়েন্ট ঠিকই শনিবার ফেরত দেবেন । সাথে হয়তো দশ/পনের হাজার টাকা বখশিশও থাকবে যা ব্যাংকের সবাই ভাগ করে নিবে । এরকম সব সময়ই হয়ে আসছে । কিন্তু তাও আমার শুধু ভয় করতো । যদি কোনো কারনে না দিতে পারে । যদি হেড অফিসে হিসাব মেলাতে না পারি । আশে পাশের অধিকাংশ মানুষ আমাকে ভালোমানুষ বলে । আমি নিজে জানি আসলে আমি ভীতু মানুষ । সামান্য জোরে কথা শুনলেই আমার বুক ধড়ফড় করে, ঠোঁট-গলা শুকিয়ে আসে । তবে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া তিনি আমাকে পাথরের একটা মুখ দিয়েছেন । যে মুখে রাগ-ঘৃনা-ভয় কিছুই ফুটে উঠে না । নাহলে যা দিনকাল তাতে এই যুগে আমার টিকে থাকার কথা না ।

কিছুদিন আগে শহরের অপর প্রান্তে এই ব্যাংকের ম্যানেজার হয়ে বেঁচে যাই । এই ব্রাঞ্চে এসব ঝামেলা নাই । বড় ক্লায়েন্টদের অধিকাংশই গারমেন্ট ব্যাবসায়ী । তাদের স্বল্প সময়ের জন্য ক্যাশের তেমন প্রয়োজন হয় না ।

আজকে অবশ্য পিওন কাসেম অফিসে নাই । প্রতি মাসে একবার সে শুক্র-শনিবারের সাথে মিলিয়ে আরো দুইদিনের ছুটি নেয় । পরিবারের সাথে দেখা করার জন্য । কাসেমের আবার দুই পরিবার । একজন থাকে মাগুরা আর একজন নওয়াপাড়া । নিজের মুখেই প্রথম যেদিন বলে আমি অবাক হয়ে যাই । ‘সমস্যা হয় না’ আমি বিস্মিতস্বরে জিজ্ঞেস করি । ‘স্যার সমস্যা কোন সংসারে নাই । কারোটা দেখা যায় কারোটা দেখা যায় না । তবে স্যার হাচড়া-পাচড়ি, কামড়া-কামড়ি সব কিছুর পরে টানটা থাকলে সুখ এমনিতেই আসে ।‘

কাসেমকে নিয়ে এত কিছু বললাম কারণ আমি কাসেমকে ইদানীং গভীরভাবে খেয়াল করি । একটা লোক এত রিলাক্স এত সুখী কিভাবে হয় ! আমার মনে হয় কেউ যদি কাসেমকে এসে খবর দেয় ‘আপনার বাড়ী পুড়ে গেছে’ - কাসেম হাসিমুখে বলবে ‘কাঠের বাড়ি । পুড়তেতো পারেই । কেউ মরে নাই এইটাই আসল । বাড়ি আবার বানানো যাইবো ।‘

কাসেমকে আমি মনে হয় একটু অনুসরণ করাও শুরু করেছি । একটু খুলেই বলি । প্রতিবার বাড়ী যাবার আগে কাসেম একগাল হাসি নিয়ে এসে বলবে ‘স্যার কিছু টাকা লাগবো । বাড়ী যাইতাছি ।‘ এবারো সেরকম বলায় জিজ্ঞেস করি
-প্রতিবার বাড়ি যাবার সময় তুমি টাকা ধার করো কেনো ?
-স্যার কোনোবার আমি খালি হাতে যাই না । পোলাপানের জন্য না হইলেও বউয়ের জন্য কিছু না কিছু কিনা নিয়া যাই ।
-দুই বউয়ের জন্যই কেনো ।
-জ্বি স্যার ।
-কেনো করো ?
-আমার খুব ভালো লাগে স্যার । আর একখান ব্যাপার আছে স্যার ।
-কি ব্যাপার ?
-ভাব-ভালোবাসা দেখানোরও দরকার আছে । কেউতো আর স্যার ওপেন হার্ট সার্জারি কইরা আমার বুকের মধ্যে কি আছে দেখতে যাইবো না । আমারই দরকার সেইটা দেখানোর ।

রাবুকে কবে কিছু কিনে দিছি মনে পরে না । অতএব গত বৃহস্পতিবার অফিস শেষে শাড়ীর দোকানে ঢুকলাম । শাড়ীর দাম কিছুই জানি না । তবে আজকাল বেশ কিছু একদামের দোকান আছে । সেরকমই একটা দোকান ‘নীল আঁচল’ থেকে আগুনরঙা একটা শাড়ী কিনলাম । কিন্তু সেটা নিয়ে বাসায় যেতেই হিতে বিপরীত হলো ।
-কি ব্যাপার হঠাৎ শাড়ী ? কেমন সন্ধিহান চোখে জিজ্ঞেস করে রাবু । রাবুও আর একটা ব্যাংকে চাকুরী করে । অফিস থেকে সেও ঘণ্টা দেড়েক আগে এসেছে । এতক্ষণ মনে হয় রান্নাঘরেই ব্যস্ত ছিলো । প্রতিদিনের মত ।
-এমনিতেই । পছন্দ হলো তাই কিনে ফেললাম । আমি মৃদুহেসে বলি । তারপরও রাবুর ভ্রূ সোজা হয় না । কোচকানো ভ্রূ নিয়েই শাড়ীর প্যাকেটটা খোলে । কোচকানো ভ্রূ তো আগেই ছিলোই নাকের পাটাও ফোলা শুরু করে ।
-আসলেও কি মনে করে শাড়ীটা কিনেছো সত্যি করে বলো ? উচু গলাতেই জিজ্ঞেস করে রাবু । আমি সব সময়ের মত কুকড়ে যাই । বুঝি না কি বলবো । কাসেমকে নকল করা ঠিক হয় নাই বুঝতে পারি ।
-না মানে এমনি । কোনোমতে উত্তর দেই ।
-ন্যাকামি করবা না । বুড়া বয়সে পুরান প্রেম উথলাইয়া উঠছে । আমার ততক্ষণে বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে গেছে । রাবু কোনদিক দিয়ে আক্রমন করছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না । তাই চুপ করেই থাকলাম ।
-সত্যি করে বলো তুমি মিতা না ফিতা তার কথা মনে করে কেনো নাই । নাইলে এই রঙয়ের শাড়ী কি আমাকে কখনো পরতে দেখেছো । গলার স্বর আরও এক পর্দা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করে রাবু । সাথে সাথেই ভুলটা বুঝতে পারি । মিতা আমার ইউনিভার্সিটির সহপাঠী । এক সময়ে বেশ ভালো একটা সম্পর্ক ছিলো । ওকে এরকম একটা আগুনরঙা শাড়ী গিফট করেছিলাম একবার । বিয়ের প্রথমদিকে যা হয় ...সব কিছুই খুব তরল থাকে...সেরকম এক ছূটির তরল দুপুরে কথায় কথায় মিতার গল্প করেছিলাম রাবুকে । আশ্চর্য আমি সেই কবে ভুলে গেছি । অথচ যার মনে রাখার সে ঠিকই মনে রেখেছে । শাড়ীর রংসহ । আর আমারো পোড়া চোখ । এত থাকতে এই রঙয়ের শাড়ীটাই বা পছন্দ হবে কেনো ।

সেই থেকে গত দুইদিন শীতল উত্তেজনা বিরাজ করছে । অফিসে এসে মনে হলো এসবই কাসেমের দোষ । আরে বাবা সব তত্ত্বতো সব জায়গায় সব সময় কাজে লাগে না । গরমকালের ওয়াজ শীতকালে করলে গায়ে লেপ থাকবে না এটাই স্বাভাবিক । তাহলে এত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলার দরকার কি । এসব উল্টা পাল্টা ভাবনার মাঝেই ফোন বাজে । আশ্চর্য রাবেয়া ফোন করেছে ...কখনোতো এমন হয় না ...ঝগড়ার দুই তিনদিন পরে আমাকেইতো এগিয়ে যেয়ে কথা বলতে হয় ...আমি যে বেশীক্ষণ প্রেশার নিতে পারি না

-হ্যালো ।
-এই শোনো খালেদ ভাই আসছে ।
-কোন খালেদ ভাই ?
-আরে আমার খালাতো ভাই । আমেরিকা থেকে আসতাছে ।
সাথে সাথেই আমার মনে পরলো । রাবুর খালাতো ভাই । যাকে বলে হীরের টুকরা ছেলে । মেট্রিক, ইন্টার মিডিয়েটে স্ট্যান্ড, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েও খুব ভালো রেজাল্ট । এখন আমেরিকার নামকরা এক কোম্পানিতে চাকুরী করেন । আমার বন্ধুদের মাঝে যারা পড়াশুনায় খুব ভালো ছিলো তারা আবার দেখতে শুনতে অতটা ভালো না । কিন্তু রাবুর এই খালাতো ভাই দেখতেও রাজকুমার । রাবুর সাথে একসময় বিয়ের কথাবার্তাও অনেকদুর এগিয়েছিলো । এই সংবাদটাও কোনো এক তরল মুহূর্তে রাবুই আমাকে জানিয়েছে ।
-শোনো ভাইয়া নিজে থেকেই বললো দুইদিন থাকবে । আল্লাহ চিন্তা করছো । বাজার করতে হবে । কি কি লাগবে আমি একটু পরেই টেক্সট করছি । রাবু কেমন কিশোরীর গলায় বলে । শুনে আমার ভিতরে কিছু একটা জ্বলে যায় ।

অফিস শেষে বাজার করে বাসায় ফিরে দেখি রাবু ঘরদোর ওলট পালট করে ফেলেছে । আমাদের বিছানার উপর চারটা বেড শীট ।
-দেখোনা কোন বেডশিটটা সুন্দর । ইসশশ কয়েকদিন আগে জানলেতো কিছু কেনাকাটা করতে পারতাম । রাবুর গলাটা আবারো কিশোরীর মত শোনায় ।
-কোন বিছানায় পাতবে ? আমি জিজ্ঞেস করি ।
-কেনো এই বিছানায় । এই রুম ছাড়া তোমার বাসায় আর কোনো রুমে এটাচড বাথ আছে ? কতবড় মানুষ ! তাছাড়া খালেদ ভাই খুব শৌখিন মানুষ ।
আমি আর কিছু বলি না । রাবু আবার ব্যস্ত হয়ে পরে । মাংস মেরিনেট শেষে পিঠার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে । এভাবে সব কিছু শেষে বেশ রাতে বিছানায় আসে রাবু । আমি ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকি । কিন্তু ঘুম আসে না । একটু পর টয়লেটে যাই । টয়লেট থেকে ফিরতেই রাবু বলে...
-সকালেইতো এয়ারপোর্ট যেতে হবে । এখনো ঘুমাচ্ছো না কেনো ?
-ঘুম আসছে না । আমি ছোট করে উত্তর দেই ।
-মনে হয় এসিডিটি হইছে । দাঁড়াও ট্যাবলেট দিচ্ছি । বলে বেডসাইড টেবিল থেকে ট্যাবলেট দেয় রাবু । আমিও পানির সাথে ট্যাবলেটটা খেয়ে ফেলি । কিন্তু তারপরো বুকে অন্যরকম জ্বালা হতে থাকে ।

পরেরদিন ভোরেই এয়ারপোর্ট যাই । অফিস থেকে ছুটি নেওয়াই আছে । রাবু আসে নাই । খালেদ ভাই গরুর কালাভুনা বেশী পছন্দ করে নাকি ঝাল ঝাল রেজালা সেটা নিয়ে সে ভীষণ টেনশনে আছে । সকালে উঠে সিন্ধান্ত নিয়েছে দুটাই করবে । আমি যে ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছি সেটাও নাকি সাইজে ছোট । বড় ইলিশ নাকি ‘স্বপ্ন’তে পাওয়া যায় । সেখানেও সে যাবে । ঢাকা এয়ারপোর্টে অনেক অনেকদিন পর আসলাম । বেশ পরিবর্তন হয়েছে মানতেই হবে । হওয়ারই কথা । দেশতো এখন মধ্যম আয়ের দেশ । মাথার উপরের স্ক্রিনে দেখালো একদম ঠিক সময়ে খালেদ ভাইয়ের প্লেন ল্যান্ড করেছে । আধা ঘণ্টা পরেই সুদর্শন খালেদ ভাইকে ট্রলি ঠেলে আসতে দেখলাম । কিছু কিছু লোকের কাছে সময় পরাজিত হয় । খালেদ ভাইয়ের মাথায় এখনো ঢেউ খেলানো কালো চুলের ঢল, প্রায় ছফুট লম্বা শরীরের কোথাও এক বিন্দু বাড়তি মেদ নাই । মুখের চেহারায় এমন একটা আকর্ষণ আছে যে সবাই অন্তত দ্বিতীয়বার তাকাবেই । খেয়াল করলাম পাশেই দাঁড়ানো এক বিমানবালা পর্যন্ত হা করে তাকিয়ে আছে ।
-কতক্ষণ হলো দাড়িয়ে আছো ? কাছে এসে আন্তরিকভাবেই জিজ্ঞেস করেন খালেদ ভাই ।
-বেশীক্ষণ না । আমি উত্তর দিয়ে স্যুটকেসটা গাড়ীতে উঠাতে যাই । স্যুটকেসটা বেশ ভারী ।
-আরে তুমি পারবে না আমিই উঠাচ্ছি বলে অনায়াসে গাড়ীতে ভারী স্যুটকেসটা তুলে ফেলেন খালেদ ভাই । লোকটা আসলেও দারুণ ফিট । অথচ বয়সে আমার চাইতে দুই-তিন বছর বড়োই হবেন ।


বাসায় ফিরে খালেদ ভাই স্যুটকেস খুলে বেশ কয়েকটা প্যাকেট বের করলেন । রাবু আমার ছেলে মেয়ে সবাই সেসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে । সেই ফাকে আমি আমার রুমের এটাচড বাথরুমের আয়নার সামনে দাড়ালাম । বহুদিন এভাবে নিজেকে দেখা হয় না । মাথার মাঝখানে দুইটা ডিমের কুসুমের সাইজের টাক, রংটাও কেমন তামাটে হয়ে গেছে, মুখে এখনো তেমন বলিরেখা নাই, লম্বা শরীরটাও এখনো নুয়ে যায় নাই কিন্তু মধ্যপ্রদেশের স্ফীতি খুবই দৃষ্টিকটু । তবে যেভাবেই দেখি না কেনো খালেদ ভাই যদি হয় বার্সেলোনা আমি চেষ্টা করেও ঢাকার আবাহনীর বেশী হতে পারবো না । ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসি ।
-ভাইয়া আপনি রেস্ট করেন । কতদুর থেকে জার্নি করে এসেছেন । রাবু বলে । আমিও সায় দেই ।
-না না আমি ঠিক আছি । বরং তোদের সাথে গল্প করি । খালেদ ভাই আন্তরিকভাবেই বলেন ।
-না না ভাইয়া আপনি রেস্ট নেন । তাছাড়া আমার রান্না করতে হবে । পরে গল্প করবো । রাবু একরকম জোর করেই খালেদ ভাইকে আমাদের রুমে পাঠিয়ে দেয় । তারপর ফিরে এসে আমাকে বলে । ‘চলো কিচেনে যাই’ । বাসায় মেহমান আসলে আমি এমনিতেই উৎসাহের সাথে রাবুকে কিচেনে সাহায্য করি । পেয়াজ-মরিচ কাটি, ভাজাভাজি করি, মসলা পাতিও চেক করি । কখনো কখনো নিজেই একটা দুইটা আইটেম রান্নাও করে ফেলি । ভালোই লাগে । কিন্তু আজকে কেনো জানি কিছু ভালো লাগে না ।

দুপুরে খেতে বসে আয়োজন দেখে আতকে ওঠেন খালেদ ভাই ।
-রাবেয়া তুই করেছিস কি ? যদিও আমি ভালোই খাই কিন্তু এত খাওয়া কি মানুষের পক্ষে সম্ভব ।
-বিদেশে কি না কি খাও । কষ্ট করে রান্না করেছি সব খেতে হবে । রাবু উত্তর দেয় ।
-হ্যা হ্যা ভাই শুরু করেন । আমিও সায় দেই । রাবু খালেদ ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পরিবেশন শুরু করে । মাঝে মাঝেই খালেদ ভাই আপত্তি করেন । আর আপত্তি করলেই রাবু আরো জোর করে । ‘চিংড়ির মালাইকারীতো তুমি অনেক পছন্দ করো । আর একটা নেও ভাইয়া ।‘ রাবুর কথা আমার কাছে আদিখ্যেতার মত শোনায় । তবে মুখে আমি হাসি ধরে থাকি ।
-আপনারা ট্রাম্পকেই প্রেসিডেন্ট বানাইলেন । আমি আলাপ শুরু করি ।
-শোনো দুনিয়াতে এখন একটা খারাপ সময় । সত্তর দশক পর্যন্ত পৃথিবীর নেতারা ছিলো ভিশনারী । গান্ধী, মার্শাল টিটো, আতাতুর্ক, চে গুয়েভারা এমনকি আমাদের মুজিব । দেখবা এরা আসলে শুধু একটা দেশের নেতাই না এরা এক অর্থে মানব জাতির নেতা ছিলো । আর এখনকার নেতাদের দিকে তাকাও । মনে হবে কোনো কোম্পানির সিইও । কিছুদিন কোম্পানিটা চালাইয়া যাইতে পারলেই হইলো । চমৎকারভাবে বলেন খালিদ ভাই । আমি মুগ্ধ হয়ে যাই তার দর্শন দেখে ।
-রাজনীতি বাদ দেও । তোমরা আছো কেমন ? রাবেয়া তোমার জীবন জ্বালাইয়া ছারখার কইরা দেয় নাইতো ? আমি কিছু না বলে হাসি । শোনো স্বামী-স্ত্রী নিয়া দুইটা কৌতুক শোনো
অনেকেই চাকরি ও স্ত্রীর মাঝে বেশ মিল খুঁজে পান-
এক নম্বর মিল । দু’টিই একবার নিলে ছেড়ে দেওয়া কঠিন।
দুই নম্বর মিল একটি থাকা অবস্থায় দ্বিতীয়টা নেওয়া কঠিন।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিল হচ্ছে-
এটা ছাড়া বাকি সবই ভালো লাগে।

আর একটা বলি
বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছে স্বামী-স্ত্রী। সেখানে দেখা গেল মদ খেয়ে মাতাল হয়ে নাচছে কনের বাপ। স্মার্ট স্ত্রী কানে কানে স্বামীকে বলল-
স্ত্রী : এই লোকটাকে আমি ২০ বছর আগে রিজেক্ট করেছিলাম। কলেজ লাইফে একদম মজনু ছিল আমার জন্য।
স্বামী : বলছ কী? সেই আনন্দ লোকটা এখনও ভুলতে পারেনি । কি ভাগ্যবান।

আমি খালেদ ভাইয়ের রসবোধে সত্যি মুগ্ধ হয়ে যাই । এরকম লোককে পছন্দ না করা খুব খুব কঠিন । রাবুও নিশ্চয় খুব মুগ্ধ ছিলো । এক মুহূর্তের জন্য ভাবনাটা মাথায় খেলে যায় । খালেদ ভাই আমেরিকার এক মজার গল্প শুরু করাতে আবার মনটা সেদিকে ফেরাতে হয় । এভাবেই দিনের বাকি সময়টাও উনি সবাইকে মাতিয়ে রাখেন । সন্ধ্যার পরে রাবু এসে বলে
-তুমি কালকেও ছুটি নিতে পারবা একটু ।
-তুমিতো জানো সেটা সম্ভব না । মাসের শেষ সপ্তাহ । ক্লোজিং অনেক রিপোর্ট আছে ।
-জানিতো । কিন্তু ভাইয়া গাড়ী ভাড়া করে ফেলেছে । কালকে আমাদের সবাইকে নিয়ে ঘুরতে যাবে ।
-তোমরা যাও অসুবিধা কি ?

পরেরদিন সকালবেলা আমি অফিসে যাবার আগেই সবাই হৈ হৈ করে বের হয়ে গেলো । রাবু কি একটু বেশী সেজেছে ? বুকের মাঝে আলপিনের খোঁচা নিয়েই সারাদিন অফিস করলাম । সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখি সবাই বাসায় । খালেদ ভাই তৈরী হয়ে আমার জন্য বসে আছেন ।
-আজকের রাতটা থেকে যান খালেদ ভাই । আমি বললাম ।
-থাকতে পারলে আমারো ভালো লাগতো কিন্তু সম্ভব না । সন্ধ্যার ফ্লাইটে চিটাগং যাবো । এক বন্ধুর কাছে কথা দেওয়া আছে ।

রাতের খাবারের পরে রাবু দেখি বেড্রুমে এসে খুব মনোযোগ দিয়ে পান সাজাচ্ছে । একজনের সাথে চৌদ্দ বছর থাকলে তার অনেক কিছু জানা হয়ে যায় । এই যেমন জানি রাবু খুব খুশী থাকলেই পান খায় । সারাদিনের আলপিনের খোঁচাটা আরও তীব্র হয়ে বুকে ।

-কি খবর খোকাবাবু মুখ গোমড়া কেনো ? রাবু পান মুখে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করে । এর মানে হলো রাবু আসলেই খুব ভালো মুডে আছে । কারণ ভালো মুডে থাকলেই সে আমাকে খোকাবাবু বলে ।
-কই নাতো ?
-শোনো তোমার ব্যাপার স্যাপার অন্য কেউ না বুঝলেও আমি বুঝি । তোমার কোন শ্বাসটা হতাশার কোন শ্বাসটা আশার, রাগ হলে উপরের ঠোটটা সামান্য কাপে সব আমি জানি ।
-আরে নাহ কিছু না । সারাদিন খুব মজা করলে তাই না । আমি কথা ঘোরাবার চেষ্টা করি ।
-আমার কথা বাদ তবে বাচ্চারা খুব মজা করেছে ।
-তোমার কথা বাদ কেনো ?
-সারাদিন এবং এখনো আমার অন্য কারণে খুব ভালো লেগেছে ...লাগছে ।
-কি কারণ ?
-খোকাবাবুর ঈর্ষা দেখে । জানো টের পেলাম ঈর্ষা খুব ভালো জিনিষ । নিজের গুরুত্বটা বোঝা যায় ।
-ধুর । কিযে বলো না ।
-খোকাবাবু আর ঢং কইরো না ।
-খালেদ ভাইয়ের সাথে আমি ঈর্ষা করবো । সেই যোগ্যতা আমার কই ।
-ধুর তুমি জানো না খালেদ ভাইকে কোনো মেয়েই ভালবাসতে পারবে না । ভাবীতো অতিষ্ঠ । আমাদের সব আত্মীয় স্বজনই জানে ।
-কেনো অতিষ্ঠ কেনো ? আমি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করি ।
-কেনো আবার এই বয়সেও খালেদ ভাই বাথরুমে ঢুকলে নাকি এক ঘণ্টা লাগে । আয়নার সামনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে রূপচর্চা করে । নিয়মিত জিম করে । একটা পাকা চুলও যেনো দেখা না যায় সেইভাবে কলপ করবে । ইদানীং কিছু চুল পড়া শুরু হয়েছে দেখে নাকি তার রাতের ঘুম হয় না । ঐযে গান আছে না ‘নিজের জন্য বাচা নিজেকে নিয়ে’ অনেকটা সেরকম ।
-তাই ?
-আর সে মানুষ হিসাবে যে কি বিরক্তিকর । আমরা চার কাজিনতো প্রায় সমবয়সী । উনি একের পর এক চারজনের সাথেই প্রেমের চেষ্টা করেছেন । আমার মত বাকি তিনজনেরই প্রথম দিকে ভালো লেগেছে । কিন্তু কিছুদিন যেতেই এত বিরক্তিকর লেগেছে । জানো তোমাকে গতকাল যে দুইটা কৌতুক বলেছে সেটা আমাদের চার বোনকেই পনের ষোল বছর আগে উনি বলেছেন । ভিশনারি নেতার তত্ত্বটাও আমাদের চার বোনকে বলেছেন । আরো কিছু কৌতুক আর চমকপ্রদ ফিলসফি ওনার মুখস্ত । আর একদিন থাকলেই তুমি সব শুনে ফেলতে । রিতা আপা ওনার নাম দিয়েছিলেন সার্কাসের সুন্দর বানর । তবে খালেদ ভাই মাঝে মাঝে আসলে ভালোই হোতো ।
-কেনো ?
-আমার খোকাবাবুর ঈর্ষা একটু দেখতে পারতাম । যাই বলো জেলাস খোকাবাবুকে দারুন সুন্দর লাগে । বলে হাসিতে ভেঙ্গে পরে রাবু ।
-ঢং কইরো না । দেও আমাকেও একটা পান দেও । একটু বোকা বোকা ভাবেই বলি...বলতে ভালো লাগে । বেশী স্মার্ট হলেতো আবার খালেদ ভাইয়ের মত অবস্থা হবে ...তার চাইতে এই বোকা বোকা সুখই ঢের ভালো............
 
Back
Top