মিথ্যার মত সত্য সত্যের মত মিথ্যা

dukhopakhi

Well-Known Member
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
115
Messages
1,101
Reaction score
134
Points
1,213
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
*****মিথ্যার মত সত্য সত্যের মত মিথ্যা*****

মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু





‘আমিতো এখনো দোকানে ঢুকি নাই । আরো আধা ঘণ্টা পরে ফোন দেও ।‘ নতুন ছেলেটা শাজাহান কি অবলীলায় মিথ্যা বলে, ফোনে । গলার স্বরে এতটুকু হেরফের নাই । অনেকের মতে মোবাইল ফোনের দৌলতে মানুষ আরো বেশী মিথ্যুক হয়েছে । কাওরান বাজারে সবজি কিনতে কিনতে অনায়াসে পাওনাদারকে বলা যায় ‘ভাই কাজে একটু রাজশাহী আছি । দুইদিন পরে ঢাকা ফিরেই আপনাকে ফোন দিবো । আপনার জন্য কি কিছু আম নিয়ে আসবো ?’ মোবারক সাহেব নিজেই অবশ্য এরকম মিথ্যা মাঝে মাঝেই বলেন । হোলসেলার ফোন দিলেই বলেন ‘আমিতো ভাই দোকানে নাই । পরে আইসেন । আসার আগে ফোন দিয়েন ।‘

এরকম টুকটাক মিথ্যা আজকাল ঘটমান বর্তমান জীবনেরই অংশ । সবাই বলে । তবে মোবারক সাহেব অবাক হন শাজাহানের অকারন মিথ্যা বহর দেখে । এইতো গতকাল দুপুরে খাবারের সময় মার্কেটের ফুড কর্নারে শাজাহানকে ফোনে কথা বলতে আর খাবার খেতে দেখেন । ‘বেচা বিক্রি কিছু হইছে নি’ যোহরের নামাজ শেষে অন্য আর একটা কাজ সেরে দোকানে ফিরে জিজ্ঞেস করেন মোবারক সাহেব । ‘কিছুই হয় নাই স্যার । আমিতো সারাক্ষণ দোকানেই ছিলাম ।‘ সাথে সাথেই জবাব দেয় শাজাহান । দোকানে আরো দুইজন ছিলো । ঝুলন্ত প্রশ্নটার জবাব যে কেউই দিতে পারতো । কিন্তু শাজাহানই উত্তর দিলো এবং উত্তরটা আধা-সত্য এবং আধা-মিথ্যা । তার চাইতেও বেশী খারাপ মিথ্যাটা অপ্রয়োজনীয় । বয়স্ক ইদ্রিস মিয়া সব সময় দুপুরে দোকানে থাকে । বাকি দুইজন এদিক সেদিক বসে খাবার খায় । সবাই এটা জানে ।

অবাক ব্যাপার হলো সবাই শাজাহানের মিথ্যাগুলো সহজভাবেই নেয় । এই যেমন এখন কেউ কিছুই বললো না । মোবারক সাহেবের মনে পরে চার মাস আগে এমনই এক ঝিম ধরা দুপুরে প্রথম শাজাহান আসে দোকানে । ব্যবসার অবস্থা তখন খুব খারাপ । আগের তিনদিনে বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫৭০০ টাকার । রোজার ঈদ পার হয়ে গেছে দুই মাস । খালি ক্যাশ বাক্স সামনে নিয়ে ভাবছেন দোকানটা বিক্রি করে ফাস্ট ফুড কিংবা রেস্টুরেন্টের ব্যবসা শুরু করবেন কিনা । কিন্তু ঠিক সাহসও করতে পারছেন না । ‘তন্দ্রা শাড়ী হাউসের’ আসল মালিক তন্দ্রা, মোবারক সাহেবের স্ত্রী । শ্বশুরের সূত্রে আরো দুইটা দোকানের মালিক হয়েছিলেন মোবারক সাহেব । কিভাবে কিভাবে যেনো সেদুটো এখন হাতছাড়া । ভিতরে-বাহিরে ভীষণ প্রগল্ভ বউ প্রায়ই বলে ‘তোমার যে মুরোদের অভাব সেটা আমার চাইতে বেশী জানে কে ?‘ এই কথার উত্তর দেবার মতো মুরোদ আসলেও মোবারক সাহেবের নাই ...থাকে না ।

তাই ব্যবসা বদলের চিন্তা মনের মধ্যেই ঘুরপাক খায় । কথায় কিংবা কাজে প্রকাশের সাহস হয় না । এরই মাঝে শাজাহান আসে চাকুরির জন্য । নিজের আয়-রোজগারের অবস্থাই শোচনীয় । এরকম অবস্থায় নতুন লোক রাখার প্রশ্নই আসে না । কিন্তু যিনি শাজাহানকে পাঠাইছেন তাকে অবজ্ঞা করার মত অবস্থাও মোবারক সাহেবের নাই । অঢেল টাকা আর ক্ষমতার মালিক কিছু মানব ইশ্বরওতো আমাদের জীবনকে কিছুটা ছুয়েই থাকে । প্রবল বাস্প ওঠা হাড়ির মত । নির্বিগ্নে যেতে দাও, কোনো সমস্যা নাই । কিন্তু পথে ঢাকনির বাধা হয়ে দাঁড়াও ফুসে ফুলে জগত তছনছ করার চেষ্টা করবে ।

-পড়াশুনা করেছো ? সুদর্শন শাজাহানকে জিজ্ঞেস করেন মোবারক সাহেব ।
-জ্বি স্যার । আই এ পাশ করেছি । ভরাট মার্জিত গলায় উত্তর দেয় শাজাহান । এই ছেলে শাড়ির দোকানে কেনো কাজ করবে । এরতো সিনেমায় নিদেন পক্ষে টিভিতে অভিনয় করা উচিৎ । মনে মনে ভাবেন মোবারক সাহেব ।
-শাড়ীর দোকানে আগে কাজ করেছো ?
-জ্বি স্যার করেছি ।
-তাহলে আর কি । ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ । বেতন কি দিতে পারবো বলতে পারি না । তবে চৌধুরী সাহেব যখন পাঠাইছেন তখন কাজ শুরু করে দিতে পারো ।

সেই শুরু । অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বেচা কেনা ভালো হওয়া শুরু হলো । এখনতো মাশাল্লা বেশ ভালো । শাজাহানের দৌলতেই । মিথ্যাই বলে ...এইতো ...এ আর এমন কি ।

দুই তরুণী কাস্টমারকে রং ঢং করে শাড়ী দেখাচ্ছে শাজাহান । বোঝাই যাচ্ছে এরা আসলে শাড়ী কিনবে না । দোকানে এধরনের কাস্টমারের সংখ্যাও আজকাল বেড়ে যাচ্ছে । ‘এইটা পাড় এইটা জমিন আর কুঁচির পাশে এই কাজগুলো দেখা যাবে...’ বলে শাজাহান একরকম শাড়ীটা পরেই দেখায় । দারুন সুদর্শন এক তরুন শরীরে শাড়ী জড়িয়ে ক্রেতার মনোরঞ্জনের চেষ্টা করছে, ক্যাশ বাক্সের দুরত্বে বসে দৃশ্যটা কেমন যেনো । তাই চোখ সরিয়ে নেন মোবারক সাহেব । আজকাল এত এত দোকানে মহিলা কর্মী কাজ করে অথচ শাড়ীর দোকানে মহিলা বিক্রেতা নাই বললেই চলে। ব্যাপারটা অদ্ভুত না ।

-জ্বি না ভাবী আজকেতো আমি দোকানে নাই । মাল আনতে বের হইছি । আজাইরা ক্রেতা রেখে শাজাহানকে ফোনে কথা বলতে দেখেন মোবারক সাহেব । ‘কবে আসতে পারবো পরে জানাবো ভাবী ।‘ বলে ফোন রাখে শাজাহান । দিনের মাঝে এরকম দশ পনেরোটা ফোন আসে শাজাহানের । এসবও একদম পছন্দ করেন না মোবারক সাহেব । কিন্তু অন্য অনেক ব্যাপারের মত এব্যাপারেও শাজাহানকে কিছু বলেন নাই মোবারক সাহেব ।

মালিকের বউ ফোন করা শুরু করেছে । এই খেলার এইটা নিতান্তই শুরু । শাজাহান বুঝতে পারে এখানেও তাহলে বেশীদিন চাকরি করা হবে না । তবে মালিকটা কেমন যেনো চিমসানো । এইটাই আশার কথা । সবকিছু ম্যানেজ করে কিছুদিন টিকেও যেতে পারে । এসব ভাবতে ভাবতেই সুবেশী দুই নারীপুরুষকে দোকানে ঢুকতে দেখে শাজাহান ।

-আসেন স্যার । আসেন ম্যাডাম । কি শাড়ী দেখাবো ।
-ভালো ভালো কিছু শাড়ী দেখান । কোটের বোতাম ঠিক করতে করতে ভদ্রলোক বলেন ।
-কয়েকটা কাঞ্জিভরম দেখাই । একদম লেটেস্ট বাজারে আসছে । অন্য কোনো দোকানেই পাবেন না এখন । ম্যাডামকে দারুন মানাবে । শেষ কথাটা শুনে মহিলা বেশ খুশী হন । এর পরের আধাঘণ্টা একজন নিখুত যাদুকরের মত ক্রেতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে শাজাহান ।
-এসেছিলামতো মাত্র দুইটা শাড়ী কিনতে । চারটা শাড়ী কেনা কি ঠিক হবে ? মহিলার গলার স্বরে অনুমোদনের আকাংখা প্রবল ।
-ম্যাডাম । কোনটা বাদ দিবেন । এই গাদোয়াল কিংবা এই ইক্কাট কাতানটা এত সুন্দর । আর এগুলিতো স্যারই পছন্দ করলেন । স্যারের কিন্তু পছন্দ আছে । ভরাট গলায় কিন্তু স্বরে অনেকখানি মধু মিশিয়ে বলে শাজাহান ।
-দাম একটু কম নিয়েন । ভদ্রলোক আসলেই প্রভাবিত হয়েছেন দেখে ভিতরে ভিতরে খুশী হয় শাজাহান ।
-স্যার আমাদের চাইতে কম দামে এই শাড়ী কোথাও পাবেন না । কিছুটা গাম্ভীর্য নিয়েই বলে শাজাহান ।
-মাত্র অল্প কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে যাবো এত শাড়ী কি কেনা ঠিক হবে ? নিজেকে পরিষ্কার করতে আরো একবার বলেন ভদ্রমহিলা ।
-আরে তুমি এত ভাবছো কেনো । তিনদিনে সবগুলি শাড়ীই পরতে পারবে । দেখি সব মিলিয়ে কত হলো বলেন ।

অনেকদিনের পরিকল্পনার পরে এরকম একটা ট্যুরে যাচ্ছে ওরা । বাসা, অফিস কতদিক ম্যানেজ করতে হয়েছে । সাদীরতো এত ঝামেলা নাই । আর ওর টাকারওতো কোনো অভাব নাই । আর শাড়ীগুলো আসলেও সুন্দর । মনে মনে ভাবে ভদ্রমহিলা ।

অতপর সাতান্ন হাজার টাকা বিল দিয়ে সত্যিকারের সুখ নিয়েই মিথ্যা স্বামী-স্ত্রী দোকান থেকে বের হয়ে আসেন । দোকানের মাঝেও নেমে আসে সত্যিকারের সুখ । বয়স্ক ইদ্রিস আর এক কর্মচারী সেলিম খুশী এমাসেও পুরো বেতন পাবার সুস্পষ্ট নিশানায় । মোবারক সাহেব সুখী নগদ লাভে । চল্লিশ হাজার টাকার শাড়ী কি অনায়াসেই সাতান্ন হাজারে বিক্রি হলো । আগে ভাবতেন পন্য ভালো হলে মানুষ কিনবেই । শাজাহান এসে এতদিনের সব জানা ভুল করে দিচ্ছে মোবারক সাহেবের ।

সেদিনই পকেটে বেতনের পুরো টাকা নিয়ে দোকান থেকে বের হয় শাজাহান । রাতের আকাশে তখন থালার মত এক চাঁদ । কালো ধোঁয়া কিংবা ধোঁয়ার মতই মেঘ চাঁদের মিথ্যা আলোকে যতটা কমিয়েছে তার চেয়ে বেশী অলংকৃত করেছে । হনহন করে হাটা ধরে শাজাহান । মিরপুর রোডে উঠে তারপর মোহাম্মদপুরের বাস ধরবে । প্রতিদিনের মত । সিগনালের কাছে এসে রাস্তা পার হবার জন্য দাঁড়ায় শাজাহান । সিগনালে গাড়ীর গতি কমার সাথেই রাস্তায় পা রাখে । কয়েক কদম হাটার পরেই সামনের বৃদ্ধ মানুষটা দুম করে রাস্তায় পরে যায় । একেবারে শাজাহানের পায়ের উপরেই । বাধ্য হয়েই শাজাহানকে থামতে হয় । রাস্তার উপর থেকে বৃদ্ধকে টেনে তোলে শাজাহান । সফেদ পাঞ্জাবীর সাথে মিল রেখে একমাথা সাদা চুল, প্রশস্ত কপালের নীচে চোখ জোড়া এত রাতেও কালো চশমায় ঢাকা । সব মিলিয়ে বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা বৃদ্ধের । রাস্তায় পরে থাকা হাতের লাঠিটা উঠিয়ে শাজাহান জিজ্ঞেস করে...

-ঠিক আছেনতো চাচা মিয়া ।
-হ্যা বাবা । ঠিক আছি । বললেও বৃদ্ধ এলোমেলোভাবে পা ফেলেন রাস্তায় । শাজাহান হাত ধরে বৃদ্ধকে রাস্তা পাড় করে নিয়ে আসে...আসতেই হয় ।
-চাচা বসেন একটু ।
-নারে বাবা আমি ঠিক আছি । বলেই আবার টলে ওঠে বৃদ্ধ ।
-চলেন চাচা এক কাপ চা খাই । বলে একরকম জোর করেই বৃদ্ধকে রাস্তার পাশের দোকানে নিয়ে আসে শাজাহান ।
-কয়টা বাজে বাবা । দোকানের সরু বেঞ্চিতে বসে জিজ্ঞাসা করে বৃদ্ধ ।
-রাত সাড়ে দশটা ।
-অনেক রাত । চোখে ছানি পড়ছে । ঠিকমতো দেখি না । ভাবছিলাম রাত তেমন হয় নাই ।
-আপনি থাকেন কই ।
-এইতো কাছেই । একটা মেসে । তোমার মত ভালোমানুষ এখনো দুনিয়ায় আছে দেইখা কইলজাটা জুড়াইয়া গেলো বাবা । চায়ের ওম স্বাদ মাত্র জিহ্বায় অনুভব করেছে শাজাহান । কিন্তু কইলজার মধ্যেও যেনো ওম স্বাদটা ছড়াইয়া গেলো । কতদিন পর এভাবে কেউ ভালোমানুষ কইলো...
-পরিবার নাই চাচা । এই বয়সে মেসে থাকেন যে ।
-তুমি ভালো মানুষ । কিন্তু তাও এসব কথা আমি বলতে পারবো না । চা টা খেয়েই আমি চলে যাবো ।
-বলেনই না চাচা । নিজের ছেলে মনে কইরাই বলেন না হয় ।
-খুব বেশী কিছু বলার নাই বাবা । ছোট ছেলে হওয়ার সময় স্ত্রী মারা যায় । অনেকে বলার পরেও আর বিয়ে করি নাই । সৎভাবে থেকে দুই ছেলে মানুষ করার চেষ্টা করেছি । আচ্ছা সবাইতো মানুষ হিসাবেই জন্মায় তাহলে মানুষ করার কথা বলি কেনো ?
-উত্তর জানি না চাচা ।
-যাহোক তারা কতটুকু মানুষ হইছে জানি না । তবে তারা বৃদ্ধ বাবার খবর রাখে না । আমিও খুব বেশী রাখি না ।
-চলেন কিভাবে ?
-পেনশনের টাকায় কোনোমতে চলে যায় । অসুখ বিসুখ হইলেই যা সমস্যা । যেমন এই ছানি কাটার টাকা যোগাড় হইতাছে না ।
-চাচা আজকে বেতন পাইছি । আপনার ছানি কাটার টাকাটা আমিই দিতে চাই । নিরাবেগী গলায় বলে শাজাহান । শুনে শাজাহানের হাত ধরে বৃদ্ধ । কেমন ঠান্ডা শীতল হাত ।
-বাবাজি অনেক অনেক খুশী হইছি । কিন্তু এই টাকা আমি নিতে পারবো না । বলে একরকম উঠে দাঁড়ায় বৃদ্ধ ।
-বসেন বসেন চাচা । আর এক কাপ চা খাইতে খাইতে আপনাকে একটা গল্প কই । এরপরে টাকা নিলে নিবেন না নিলে না নিবেন । দিগদারির কিছু নাই ।

আমার আব্বার নাম ছিলো ফয়জুর রহমান । মসজিদের মুয়াজ্জিন আছিলো । সব সময় সত্য কথা কইতো । এমনকি খুব খারাপ সত্য হলেও কইতো । গ্রামের সবাই ডাকতো ঠ্যাডা মৌল্ভী । এই নামে ডাকলেও আসলে গ্রামের সবাই তাকে ভয় পাইতো । শ্রদ্ধাও করতো । বাবা কেমন ছিলো বুঝাবার জন্য একটা ঘটনার কথা বলি । আমি মাদ্রাসায় পড়তাম । হাইস্কুলে ওঠার পরে বাবা আমাকে স্কুলে ভর্তি করাইয়া দিলেন । বাজার করে ফিরতে একদিন এলাকার চেয়ারম্যানের লগে দেখা । আমি আব্বার হাত ধইরা আছি । ‘পোলাডারে মাদ্রাসা ছাড়ানডা কি ঠিক হইলো মৌল্ভী । হাফেজ বানাইতা । আখেরাতে পোলা হাত ধইরা বেহেস্তে নিয়া যাইতো । ‘ শুনে আব্বা উত্তর দেন – ‘আমি কি নাপাক কাম করি নিহি যে পোলার পুণ্যি নিয়া বেহেস্তে যাইতে হইবো । এইসব চিন্তা আফনের মত মানুষরা করবো ।‘ শুনে চেয়ারম্যানের মুখ চুন হইয়া যায় । গজগজ করতে করতে সে চলে চায় । চিন্তা কইরা দেখেন এগারটা গ্রাম এর মাতব্বর মুখের উপর এইরকম কথা ।

গ্রামের বিচার আচারে আব্বার কথাই ছিলো শেষ কথা । আব্বার একটা পোষা টিয়া ছিলো । সে শুধু একটা একটা কথাই বলতো -মৌল্ভী বাড়িত নাই । আব্বা বাসায় থাকলেও বলতো । আব্বার ছেলে হিসাবে আমার ভীষণ গর্ব ছিলো । শুধু নিজের গ্রাম না আশে পাশে কোথাও গেলেও আব্বার নামটা বলার সময় কেমন যেনো বুকটা অদ্ভুত বাতাসে ফুলে উঠতো । লোকজনও নামটা শুনে সমীহ করতো । আপনে কি বুঝতে পারছেন আব্বাকে আমি কি পরিমান ভালোবাসতাম ?

প্রশ্নটা করে একটু থামে শাজাহান । চায়ের দোকানের সামান্য দূরে একটুকরা উচ্ছিষ্ট খাবার নিয়ে তখন দুই কুকুর প্রবল বচসায় লিপ্ত । নিজের ব্যবসা ঠিক রাখতে চায়ের দোকানদারকেই লাঠি নিয়ে কুকুর তাড়াতে হয় ।

বলো বাবা বলো । কন্ঠে প্রবল আগ্রহ নিয়ে শাজাহানকে জিজ্ঞেস করেন বৃদ্ধ ।

আব্বার সবকিছুই আমি নকল করতাম । হাটা, বসা, কথা বলা । আব্বা চিৎ হয়ে বাম হাত কপালের উপর দিয়ে ঘুমাতেন । আমি এখনো সেভাবে ঘুমাই । শাজাহান আবার বলা শুরু করে ।

বাড়িতে আমি আব্বা আর এক ফুপি থাকতাম । ফুপির অনেক বয়স হইয়া গেলেও সেই রান্না বান্না করতো । খুব ছোটবেলায় মা মারা গেলে আব্বা আর বিয়ে করেন নাই । এইটা নিয়েও লোকজন অন্যরকম শ্রদ্ধা করতো আব্বাকে ।

তারপর আইলো সেইদিন । এইটে পড়ি তখন । নিম্নচাপ হইছিলো । সকালের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি স্কুল ছুটি হইতে হইতে ঝুম বৃষ্টি । খন্দকার বাড়ির আলফাজ সেদিন স্কুলে যায় নাই । অনেকটা পথ তাই একাই ছাতা মাথায় হাটতে হয় । কাদা মাটির রাস্তায় কেউ নাই । কচু পাতায় নাকি পানি ধরে না । অথচ রাস্তার পাশের কচু পাতাও মাটিতে গড়াগড়ি । বাড়ির উঠানে আসতেই মিথ্যুক টিয়া চিল্লায় মৌলভী বাড়িত নাই । বারান্দায় উঠে চাল থেকে পড়া বৃষ্টির পানিতেই পায়ের কাদা ধুই । বাইরের ঘরটা পাড় হতেই আব্বার ঘর থেকে আজব শব্দ পাই । তাড়াতাড়ি ঘরে যাই । আব্বা আড়াআড়ি বিছানায় পরে আছে । সাদা কালো রোমে ভর্তি বুকটা হাপরের মত ওঠা নামা করতাছে । সাথে গলায় শব্দ । ‘কি হইছে কি হইছে আব্বা কইয়া’ কাছে যাইতেই আব্বা খপ কইরা আমার হাতটা ধরেন । আমি জোরে ফুপুরে ডাকি । বৃষ্টির মাতম ছেদা কইরা সেই ডাক পাকের ঘরে পৌছায় কিনা জানি না । ঘর ঘর শব্দে আব্বা কথা বলার চেষ্টা করেন । একটু মনোযোগ দিলেই শুনতে পারি ।

‘বাজান জীবনে আমি জাইনা শুইনা অন্যায় করি নাই । তর লগেও করতাম পারুম না । বাজান আমি আসলে তোর বাপ না । আমারে তুই মাফ কইরা দিস ।‘ ঠোটের কোনায় আরো মনে হয় দুই চারটা শব্দ বলেন আমি ঠিক শুনতে পাই না । ফুপু ততক্ষণে ঘরে আসছেন । আমাদের দুইজনের চোখের সামনেই আব্বার শরীরটা নিথর হইয়া যায় ।

এর পরে বেশ কিছুক্ষণ শাজাহান কোনো কথা বলে না । বৃদ্ধও চুপচাপ বসে থাকেন । শাজাহান নিঃশব্দে চায়ের টাকা দেয় ।

আব্বার শেষ কথাগুলো কাউরেই কই নাই । মাঝে মাঝে মনে হয় যা শুনছি ভুল শুনছি । কিন্তু বাবা ফুপুর সাথে আমার চেহারায় কোনো মিলই ছিলো না । ‘মৌলভির পুন্যিতেই এত সুন্দর ছেইলা হইছে ।‘ ছেলেবেলায় এই কথাটা অনেকবার শুনছি । আমার জীবন সেই থেকেই কেমন আউলাইয়া গেলো । সত্য মিথ্যার ফারাক বুঝি না মাঝে মাঝে । এতকাল পরে আজ আপনাকে দেইখা আব্বার কথা খুব মনে পড়তাছে । এখন এই যে আমি আপনার ছানি কাটার টাকা দিলাম আপনে এইটারে মিথ্যা মনে করলেইতো হয় । আমার জীবনের মতই মিথ্যা । বলেই টাকার প্যাকেটটা বৃদ্ধের হাতে দিয়ে শাজাহান আবার হনহন করে হাটতে থাকে ।

শিরদাড়া সটান করে দাঁড়িয়ে নকল বৃদ্ধ সেই হাটা অপলক দেখতে থাকেন । এরকম আরো অনেক মিথ্যা অভিনয় হয়তো আবারো এখানে কিংবা অন্য কোথাও করবেন । তবে কালো চশমা এবং ছানি বিহীন নকল বৃদ্ধের চোখের জল্টুকু ভীষণ সত্যি বলেই মনে হয় .. মানুষের জীবনের মতই সত্যি ।
 
Back
Top