- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 115
- Messages
- 1,101
- Reaction score
- 134
- Points
- 1,213
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
*****অভ্যাস*****
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
ফোনটা রাখতেই মাথা ব্যথাটা আরো বাড়ে সীমার । বিছানার পাশের টেবিল থেকে একটা ডিসপ্রিন বের করলো । তিন ঘণ্টা আগেও একটা খেয়েছে । কাজ হয় নাই । এটা খেলেও কাজ হবে না জানে । তাও একটু চেষ্টা । ফেল নিশ্চিত জেনেও পরীক্ষার আগের রাতে ছাত্র ছাত্রী যেমন চেষ্টা করে তেমন চেষ্টা । কপাল ভালো রুমে শাহেদ নাই । নাহলে একগাদা প্রশ্ন করে মাথা ব্যথাটা আরো বাড়াতো । শাহেদের আসলে দোষও নাই । উনত্রিশ বছর পাশাপাশি থাকলে একটা মানুষকে মুখস্ত করাই যায় । শাহেদের সব কিছুও সীমার মুখস্ত । এইতো গত বছর রাতে শাহেদের কাশিটা যেনো কেমন শোনালো । তিন চারদিন ধরেই জ্বর ছিলো । শাহেদকে বলতেই ‘যন্ত্রনা করবা নাতো । কাশির জন্য সারা জীবনে যতো ওষুধ কিনেছি সেই টাকা দিয়ে আর একটা ফ্লাট কিনতে পারতাম । কাশি সহ্য না হয় মেয়ের সাথে গিয়ে ঘুমাও । আমি ডাক্তারের কাছে গিয়ে আবারো এক গাদা টেস্ট করাতে পারবো না ।‘ একেবারে পাত্তাই দিলো না । রাতে ঐশীকে বললো । মেয়ে অফিস থেকে ফিরে যথেষ্টই ক্লান্ত ছিলো । তাও মায়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো ।
-তুমি নিজেই নাকি বিরাট ডাক্তার হয়ে গেছো বাবা । রাতের খাবার টেবিলে সবাই আসতেই ঐশী প্রসঙ্গ তুলে ।
-আমি ডাক্তার হতে যাবো কেনো । নিশ্চয় তোর মা কিছু বলেছে ।
-কে কি বলেছে এইটা জরুরী না । আমি রুমেলের সাথে কথা বলেছি । তুমি কাল সকালে আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছো ।
-বললেই হলো । আমার অফিস আছে না । আর রুমেল কি বোঝে । সে মাত্র মেডিক্যালের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে ।
-বাবা তুমি কি কথা শুনবে ? রুমেলকে তাহলে সিলেট থেকে আসতে বলি । দুই ভাইবোন মিলে তারপর ঠিক করি কি করা যায় ।
-ঠিক আছে ঠিক আছে । ডাক্তার যদি বলে সব ঠিক আছে তাহলে টাকা পয়সা কিন্তু তোমার মা আর তোমরা দুই ভাইবোনে দিবা । গজগজ করতে করতে বলেছিলো শাহেদ । দুইদিন পরেই টের পাওয়া গেলো নিউমোনিয়া হয়েছে শাহেদের । ‘ভাবী খুব তাড়াতাড়িই ধরা পড়েছে । এখন সহজেই চিকিৎসা করা যাবে । এই ধরনের নিউমোনিয়া অনেক সময় রোগী বুঝতেই পারে না । বুঝতে যখন পারে তখন অনেক দেরী হয়ে যায় ।‘ বন্ধুস্থানীয় ডাক্তার হারুন বলেছিলো । রাতে শাহেদ হাসতে হাসতে বলেছিলো ‘কাশির শব্দ শুনেই বুঝে ফেলো আমার অসুখ হয়েছে । আমার আর অহেতুক ডাক্তারের কাছে যাবার দরকার কি ।‘
ঠিক তেমনই এখন শাহেদ থাকলে ঠিকই বুঝতে পারতো সীমার কোনো একটা সমস্যা হয়েছে । গত এক মাস যাবতই ভীষণ চিন্তায় আছে সীমা । ঐশীর বিয়ের তারিখ ঠিক হবার পর থেকেই । এর আগেও অবশ্য গোপন দুশ্চিন্তা ছিলো ।
দুশ্চিন্তা হবার কারণও ছিলো । ঐশী দেখাশোনায় যথেস্ট সুন্দরী, পড়াশুনায় ছেলে রুমেলের মত না হলেও বেশ ভালো অথচ বিয়েটা কেনো জানি আটকে যাচ্ছিলো । বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ভাবতো পড়াশুনা শেষ হোক তারপরে হবেই । পড়াশুনা শেষ হলো, ব্যাংকে ভালো বেতনের চাকুরীও হলো তারপরও বিয়েটা ঝুলেই রইলো । শাহেদের সাথে আলাপ করতে গেলেই দুনিয়ার সব বাবাদের মতই ‘কি আর এমন বয়স’ বলে পাশ কাটিয়ে যেতো । চিন্তায় চিন্তায় প্রেশার বেড়ে গেলো । মনটা এতই দুর্বল হয়ে গেলো যে একদিন রাতে শাহেদকে বললো
-চলো রাজশাহী বড় ভাইয়ের বাসায় যাই ।
-হঠাৎ কেনো যাবো ? শাহেদ অবাক হয়ে উত্তর দিয়েছিলো ।
-বড় ভাবীর কাছে মাফ চাইতে । আমার মনে হয় ওনার অভিশাপ আছে ।
-কি বলছো ? মাফ চাইতে হবে কেনো ? আর কিসের অভিশাপ ?
-মনে নাই বড় ভাইয়ের মেয়ে দিনা যখন পালিয়ে বিয়ে করলো আমি তখন খুব রিয়্যাক্ট করেছিলাম ।
-পাগল নাকি ? সেটাতো পরিবারের সবাই করেছিলো । আর সেই বিয়েতো টেকেও নাই ।
-তারপরও । ঐশীর আজ যদি একটা পছন্দ থাকতো আমি যে কি বেঁচে যেতাম ।
-তুমিতো দেখি আসলেই পাগল হয়ে যাবে । একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাওতো । যথারীতি কোনো পাত্তাই দেয় নাই শাহেদ ।
তিনমাস আগে ঐশী নিজে থেকেই দিনারের কথা বললো । মনে মনে ভীষণ খুশী হলেও শংকা ছিলো । কিন্তু দিনারকে দেখে, খোঁজ খবর নিয়ে নিজের ভাগ্যকেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না সীমার । সরকারী কর্মকর্তা বাবা, কলেজ শিক্ষিকা মায়ের একমাত্র ছেলে দিনার । বড় বোন বিয়ের পরে আমেরিকায় । আর দিনার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে খুব ভালো বেতনে এক বিদেশী সফটওয়্যার ফার্মে চাকুরী করে । ছেলেটা দেখতেও তেমন । সব চাইতে ভালো লেগেছে ব্যবহার । আদব কায়দাতো আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্য একেবারেই নাই । সেদিক দিয়ে দিনার একেবারেই ব্যতিক্রম ।
কিন্তু সব ঠিক হয়ে যাবার পরে আবার নতুন শংকা । সব কিছু ঠিক মতো হবেতো ? কোথায় না আবার কি গন্ডগোল হয় । প্রায় প্রতিরাতেই ঘুমের মাঝে উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায় সীমার । গতরাতেই দেখলো একটা বিশাল লঞ্চ ডুবে যাচ্ছে । সারা লঞ্চে সীমা ছাড়া আর কোনো যাত্রী নাই । লঞ্চের মধ্যে এমাথা থেকে যখন ওমাথা যাচ্ছে তখন রেলিং এ বসা কালো কুচকুচে একটা কাক পরিস্কার গলায় বললো ‘লঞ্চে আপনি ছাড়া আর কেউই নাই । খামাকা দৌড়াইয়েন না ।‘ এই সময়েই প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায় সীমার । পাশে শাহেদ সুর করে নাক ডাকছে । একবার ভাবলো ডাকে । থাক । উঠেইতো বলবে তুমি একটা পাগল, মানুষের মাথায় থাকে বুদ্ধি আর আল্লাহ তোমার মাথা ভর্তি কইরা রাখছে চিন্তা আর দুশ্চিন্তায় । এইসব কথা হাজারবার শুনেছে । শাহেদতো আর মা না । ওর পক্ষে হয়তো বোঝা সম্ভবও না ।
তবে এখনকার দুশ্চিন্তাটা এত সহজে সমাধান হয়ে যাবে চিন্তাও করে নাই সীমা ।
-মা নানুকে ফোন করেছো ? রুমে ঢুকতে ঢুকতে ঐশী জিজ্ঞেস করে । পিছনে শাহেদকেও দেখা যায় ।
-হ্যা করেছি ।
-কবে আসবে ?
-কাল পরশুই আসবেতো বললো ।
-নানা ভাইও আসবেতো ?
-আসবেতো অবশ্যই । তবে এখনোতো বারোদিন বাকি । পরে আসলেই ভালো হয় না ? জবাব দেবার সময় আড়চোখে শাহেদকে একবার দেখে সীমা । গত সপ্তাহেই এ নিয়ে আলাপ হয়েছে শাহেদের সাথে । শাহেদের ছোট ভাই কানাডা থেকে সপরিবারে আসবে আগামী বৃহস্পতিবার । এমনিতেও আসতো । ঐশীর বিয়ে উপলক্ষে একটু আগে আসছে । চার বেডরুমের ফ্লাট । এত মানুষের ঘুমের জায়গা দেওয়া দুরুহ । তাই শাহেদই বলেছিলো ‘মাকে আগে আসতে বলো । বাবা বিয়ের দুইদিন আগে আসলেই হবে ।‘ সেটা বলতেই সকালে ফোন করেছিলো সীমা । মা পরিষ্কারভাবে বলে দিলো ‘তোর বাবাকে নিয়েই আমি আসছি । বুড়া মানুষ কখন কোন ওষুধ খেতে হবে আমি ছাড়া আর কেউ কি জানে ।‘ এই সমস্যা হতে পারে জানতো সীমা । মা বাবা যেখানেই যায় একসাথে যায় ।
-তোর নানা একটু পরেই আসুক না ঐশী । বাসায় এত লোকজন ওনাদের বয়স হয়েছে । ঘুমের অসুবিধা হবে । শাহেদ কথা বলে ।
-কি বলো বাবা । নানার ঘুমের অসুবিধা । এইটা কি সম্ভব ? নানারে মাছের বাজারের মাঝখানে রেখে আসলেও নাক ডেকে ঘুমাতে পারবে ।
-সেটা না হয় মানলাম । কিন্তু তোর নানা নানী সারাদিন ঝগড়া করে ? বাইরের কত মানুষ আসবে । কেমন দেখাবে না ? শাহেদ শেষ চেষ্টা করে ।
-বাবা তুমিতো আসল জিনিষই বুঝতে পারছো না । এই ঝগড়া দেখার জন্যইতো আমার দুইজনকে দরকার । সরোতো আমি আবার ফোন করি । শাহেদ হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গী করে সীমার দিকে তাকায় ।
-ঐশী বাসায় তিনদিন পরেই তোর ছোট চাচা আসবে । এত লোক ... মৃদু কণ্ঠে বলার চেষ্টা করে সীমা । পরে যাতে শাহেদকে বলতে পারে ‘আমিওতো চেষ্টা করলাম’ । এত বছরের দাম্পত্যের পরেও এখনো এই খেলা খেলে সীমা...হয়তো সবাইকেই খেলতে হয় ।
-মা ফোনটা করতে দেওতো । বিয়ে বাড়ীতে অনেক লোক আসবে, খাওয়া ঘুমের অসুবিধা হবে এইটাইতো স্বাভাবিক । ঐশী ঝাঝালো কণ্ঠে উত্তর দেয় । আশ্চর্য কথাগুলো কেমন মধুর লাগে সীমার কানে । অন্য সময় হলে মনে হতো বেয়াদবী ।
-সীমার মা আমার গামছা কই । দুইদিন পরের দুপুরবেলা । বাথরুমের ভিতর থেকে নানার বাজখাই গলা শোনা যাচ্ছে । দিনারের সাথে ফোনে কথা বলছিলো ঐশী । বাবুর আজকাল ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন না করলে হয় না । আগেতো তাও দিনে অন্তত একবার দেখা হোতো । আজ থেকে ঐশী ছুটিতে । ফোনের পরিমান হয়তো আরো বেড়ে যাবে ।
-কে চিৎকার করছে ? দিনার জিজ্ঞেস করে ।
-আমার খুব পছন্দের একজন ।
-ওহ তোমার সেই বিখ্যাত নানা সুদীর্ঘ বাহান্ন বছর যে বউ ছাড়া একদিনও থাকে নাই ।
-শোনো এইভাবে বলবা না । নানা নানী আমার কাছে আইডল । তুমিতো জানোই প্রেম ভালবাসায় আমি বিশ্বাস করতাম না । আমার কাছে মনে হতো এটা সাময়িক আবেগ । অল্পদিন পরেই চলে যায় । সেই ভয়েইতো কোনোদিন প্রেম করি নাই ।
-আজব তাহলে আমার সাথে কি করছো ।
-এতো গাড্ডু কেনো তুমি ?
-কেনো ?
-বলেছি না বিশ্বাস করতাম না ...মানে হলো পাস্ট টেন্স ।
-তাহলে তোমার প্রেম ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্যইতো আমার একটা এওয়ার্ড পাওয়া উচিত । কি দিবা বলো ? বাপরে তোমার নানার গলার আওয়াজতো ভালোই ।
-এওয়ার্ড সব আস্তে আস্তে নিয়ো । এই শোনো এখন রাখি । নানা মনে হয় বড়সড় কিছু একটা শুরু করেছে ।
ফোনটা রেখে রুম থেকে বের হয়েই মায়ের সাথে দেখা ঐশীর । কি একটা লিস্টে কাটাকাটি করছে ।
-মা নানা চিৎকার করছে কেনো ?
-তোমার নানা নানীর চিৎকার করতে কারণ লাগে নাকি ।
-তাও একটু দেখবা না ।
-আমি বাচি না আমার জ্বালায় । তুমি পারলে যাইয়া দেখো ।
মাকে পেরিয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখে রুমেল কানে একটা হেডফোন দিয়ে ল্যাপটপে কি যেনো শুনছে । ঐশীকে দেখেই দুই পাটি দাঁত বের করে কান থেকে হেডফোন নামাতে নামাতে বলে...
-আপু এই মিউজিকগুলি একটু শোন না । হলুদের অনুষ্ঠানে কি কি মিউজিক হবে ঠিক করছি । সত্তুর ভাগ ঠিক হয়ে গেছে । দুলামিয়ার সাথে আজকে আমার আর বন্ধুদের একটা মিটিং আছে । অর্থনৈতিক বৈঠক । দুলামিয়া বলতাছে তোমাকে নিয়া যাইতে । যাবা নাকি ?
-এতকিছু নিয়া চিন্তা করতাছোস নানা যে চিল্লাইয়া বাড়ি ভেঙ্গে ফেলছে । একটু খোঁজ নিতে পারলি না কি সমস্যা ।
-ধুর নানা নানীতো এমনিতেই চিল্লায়, ঝগড়া করে । বাদ দেও । বসো মিউজিকগুলি একটু শোনো ।
-আমার শোনার দরকার নাই । আমি দেখি নানীর রুমে যাই ।
-সারাটা জীবন জ্বালাইলো । গাধা মহিলা । লুঙ্গির উপরে একটা গেঞ্জি গায়ে নানা খাটের উপর বসে গজগজ করছে । নীচে দুইটা স্যুটকেস খোলা । জিনিশপত্র ছড়ানো ছিটানো ।
-কি হইছে নানী ?
-হইছে আমার জীবনরে বুইন...আমার জীবন । বাহান্ন বছর হইয়া গেলো এই জীবন ঠেইলাই যাইতাছি ।
-এই ফালতু কথা কইবা না । নানা আবার গজগজ করে উঠে ।
-কি হইছে বলবাতো ?
-নবাব সিরাজুদ্দৌলার গামছা পাওয়া যাইতাছে না । সিরাজুদ্দৌলা আবার গামছা ছাড়া গোসল করতে পারেন না । তোয়ালে দিয়া গা মুছলে ওনার গা চুলকায় । ওনার দরকার মাখনের মত মোলায়েম গামছা । নানী উচ্চস্বরেই কথাগুলি বলেন । নানার নাম সিরাজুদ্দিন । নানী রেগে গেলেই সিরাজুদ্দৌলা বলে । আর নানার রাগও তাতে বাড়ে ।
-এইটা আবার সমস্যা নাকি । গামছা আনতে ভুলে গেছো অসুবিধা কি । জিতুকে পাঠাইয়া এখনই একটা কিনে আনছি ।
-নতুন গামছা মোলায়েম হইতে কয়েকদিন লাগবে । এই কয়েকদিন সিরাজুদ্দৌলার কি হবে ?
-যতসব ফালতু কথা । জিতুকে লাগবে না আমিই যাইতাছি বলে নানা পাঞ্জাবীটা হাতে নেয় ।
এরপরে সারাদিন আরো দুই তিনবার নানা-নানীর চিৎকার চেঁচামিচি শোনা যায় । তবে ঐশীর দুইজন বান্ধবী থাকায় নানীর ঘরে যাওয়া হয় না । রাতে দিনার ফোন করাতে নানীর রুমে যেতে বেশ রাত হয়ে যায় । যথারীতি নানা শুয়ে আছে আর নানী চশমা পড়ে নানার মাথার কাছে বসে গল্পের বই পড়ছে । কি যে ভালো লাগে ঐশীর এই দৃশ্যটা । নানার নাকি খুব বই পড়ার নেশা ছিলো । রাতে বই না নিয়ে নাকি নানা ঘুমাতেই পারতো না । নানীর আবার সামান্য আলো থাকলেই ঘুম হয় না । তাই বিয়ের পরেই নানার রাতের বেলা বই পড়ার অভ্যাস কোরবানী দিতেই হয় । এখন নানা অনেক পাওয়ারের চশমা পড়েন । সেই তুলনায় নানীর চোখ বেশ ভালো । নানী প্রতিরাতে নানাকে গল্পের বই পড়ে শোনায় । নানার মতে এটা প্রায়শ্চিত্ত ।
-কি বই পড়ছো দেখি ? নানীর বিছানায় পা মুড়িয়ে বসতে বসতে বলে ঐশী ।
-দেখ না বুড়া বয়সে কি বই শোনার শখ হয়েছে । বুদ্ধদেব গুহের ‘সবিনয় নিবেদন’ । সারা বইতে খালি চিঠিতে চিঠিতে প্রেম । নানী উত্তর দেয় ।
-বইটা আমি বুড়া বয়সে কিনি নাই । কিনছি পঁয়ত্রিশ বছর আগে । তোমার কারনে পড়তে পারি নাই । নানা আধশোয়া হতে হতে বলেন । এর মাঝেই নানী বই বন্ধ করে পান ছিচুনি নিয়ে আসেন । এখন পান, সুপারি, গুড়মুরী, আর কি কি মসলা দিয়ে নানী পান ছিচুনিতে অনেকক্ষণ ধরে ছেচবেন । প্রতিরাতে গল্প করতে করতে ঐশী সেটা খাবেই ।
-আমিতো ভাবলাম আজকে তুই আসবিই না ।
-কিযে বলো না তোমরা বাসায় আছো আর রাতে তোমার এই মাদক খাই নাই এমন কোনোদিন হইছে ।
-দুলার ছবি দেখলাম । আমার খুব পছন্দ হইছে । নানা চোখে চশমা পড়তে পড়তে বলেন । শুনে সামান্য লজ্জা পায় ঐশী ।
-এই দুলা আবাহনী না মোহামেডানের সাপোর্টার ? নানা জিজ্ঞেস করেন ।
-তুমি আছো তোমার আবাহনী মোহামেডান নিয়া । এইটা কি সেই যুগ নাকি ? নানী মাঝখান থেকে ফোড়ন কাটে ।
-আমাকে আবাহনী মোহামেডান নিয়া থাকতে দিছো ? শোন ঐশী সত্যি গল্প বলি । তোর মায়ের তখন মাত্র বিয়ে দিছি । নতুন জামাই আসছে বাড়ীতে । ১৯৮৬ সাল । বিশ্বকাপ চলতাছে । ম্যারাডোনার সে কি খেলা । খেলা দেখার জন্য ২১ ইঞ্চি সনি কালার টিভি কিনে আনলাম । ফাইনাল খেলা । ড্রয়িং রুম ভর্তি লোক । তোর বাবাও আছে । খেলা শুরুর একটু পরেই তোর নানীর বেডরুম থেকে একটু পরপরই এইটা সেইটা পড়ার শব্দ হইতাছে । আমিতো জানি সমস্যা কি ? কিন্তু এত লোকের মাঝে । তোর বাবাও কিরকম ফাজিল শোন । আমাকে নিরীহ মুখে বলে ‘বাবা ভিতরে একটু দেখে আসেন না ।‘ এত মানুষের মধ্যে থেকে আমাকে উঠে যেতেই হয় । বেডরুমে যেতেই তোর নানী বলে ‘ঘুম আসে না । একটু ঘুম আসুক তারপর তুমি খেলা দেখতে যাইও ।‘
-হইছে হইছে । তোমার ঐ রাবনের সংসার চালাইয়া রাতে যদি ঘুমাইতে না পারতাম তাইলে কবে মইরা পইরা থাকতাম । মুসুরির ডাল আনতে বললে মুগের ডাল নিয়া আসছো । শ্যাম্পু বললে কন্ডিশনার । আমি বইলাই এখনো টিকা আছো ।
এভাবেই নানা নানীর সাথে বেশ কিছুটা সময় কাটায় ঐশী । দুই দিন পরেই অবশ্য নানীকে নিয়ে আবারো একটা হাঙ্গামা শুরু হয় । বিছানা থেকে নামতেই নানী নাকি মাথা ঘুরে পড়ে যায় । তখন বেশ সকাল । আগের দিন ছোট চাচা আসাতে সবারই ঘুমাতে অনেক দেরী হয়েছে । অত সকালেই নানা চিৎকার চেঁচামিচি করে সারা বাড়ী গরম করে তোলেন । মাকে নিয়ে একদিকে চিন্তাও হয় আবার এত মানুষের মাঝে বাবার এই রকম আচরণে সীমার একটু লজ্জাই লাগে । তবে রুমেল খুব তাড়াতাড়ি নানীকে হাসপাতালে নিয়ে যায় । বিকেল নাগাদ জানা যায় নানী এমনিতে ভালোই আছে তবে প্রেশার বেশ বেশী । ডাক্তাররা দুই তিনদিন হাসপাতালে থাকতে বলেছেন । বিকেলে মাকে নিয়ে ঐশী যখন হাসপাতালে যায় তখন ছোট মামাও আছেন সেখানে । মাকে দেখে বললো ‘বুবু তোমারতো বিয়ে বাড়ীর ঝামেলা । ডাক্তাররা বললো তিনদিন হাসপাতালে থাকতে । আমি এইদিক ম্যানেজ করে ফেলবো ।‘ হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় নানী আস্তে করে ঐশীকে বললো ‘তোর নানাকে অসুধগুলো ঠিকমতো খেতে বলিস । ‘
পরেরদিন নাস্তার টেবিলে নানাকে দেখে চমকে উঠে ঐশী । এক রাতেই যেনো নানার বয়স অনেকখানি বেড়ে গেছে । দুপুর নাগাদ খবর আসে নানীও হাসপাতালে ঝামেলা শুরু করেছেন । কোনোভাবেই নাকি সে আর হাসপাতালে থাকবে না । ডাক্তাররা বলছে কি একটা টেস্ট না করে কোনোভাবেই নাকি ছাড়া যাবে না । এদিকে ঐশীর আবার কিছু কেনাকাটা করতেই হবে । সারাটা দিনরাত তাই আর সেভাবে কোনো খোঁজ নিতে পারে নাই ঐশী । পরেরদিন সন্ধ্যায় নানা প্রায় জোর করেই নানীকে বাসায় নিয়ে আসে ।
-আপু নানা নানীর কার্যকলাপ যদি দেখতি হাসপাতালে । সারাক্ষণ হাত ধরে বসে আছে । একটু পরপরই নানা চিৎকার করছে । রুগী নিজেই থাকতে চাইছে না তাও জোর করে হাসপাতালে রাখবে । মগের মুল্লুক । বিকালে স্যার বললেন ‘আসলেতো তোমার নানী ডায়াবেটিক এর রুগী । এই ধরনের রুগীর অনেক সময় সাইলেন্ট হার্ট এটাক হয় । সেটা হয়েছে কিনা সেটা পরীক্ষা করার জন্যই থাকতে বলেছিলাম । ঠিক আছে নিয়ে যাও । অবস্থা খারাপ হলে তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো ।‘ রুমেল ঐশীকে বলে । পাশে থেকে সীমাও শোনে । সেই রাতে ঐশী নানা নানীর রুমে যেতেই দিনার ফোন করে । ফোন যখন রাখে তখন বেশ রাত । অতরাতে আর নানা-নানীকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা করলো না ঐশীর ।
পরেরদিন একটু দেরী করেই ঘুম ভাঙ্গে ঐশীর । খোঁজ নিয়ে শোনে নানা নানীও তখনো নাস্তা করে নাই । একটু অবাক হয় ঐশী । নানা নানীতো অনেক সকালেই ঘুম থেকে উঠেন । চায়ের কাপটা হাতে ঐশী নানা নানীর রুমের দিকে যায় । নানী তখন মাত্র বিছানা ঝাড়ু দিচ্ছে । নানা পাশের চেয়ারে বসে । দুইজনের চোখে মুখেই গাঢ় প্রশান্তির ছায়া ।
-কিরে কাল রাতে আর আসলি না ঐশী ? নানী হাসিমুখে প্রশ্ন করে ।
-দেরী হয়ে গেছিলো নানী ?
-রসের কথা বলতেতো দেরী হবেই ।
-আমার কথা বাদ দেও । তোমরা বুড়া বুড়ি হাসপাতালে যা নাটক করছো সব শুনছি ।
-আরে নাটক না । হাসপাতাল হইলো টাকা খাবার জায়গা । রুগী ধরে রাইখা টাকা নিবে । নানা স্বভাব সুলভ গজগজ করে ।
-তোমাদের দুইজনকে কিন্তু আজকে অনেক ফ্রেশ লাগছে ।
-লাগবে না দুইরাত পরে আজকেই ঠিকমতো ঘুম হলো । নানী একটু লাজুকভাবেই বলে ।
-নানী তোমাদের এত মহব্বত কই থেকে আসে ? এত বছর পরেও এত ভালোবাসা ?
-দেখো ঐশী কি বলে । নানী আরো লজ্জা পায় ।
-তুইতো দেখি আসলেই একটা বোকা । একটা মানুষ বাহান্ন বছর আর একটা মানুষের গায়ে পা তুলে ঘুমায় । এখন সেই দুইজন মানুষ একা একা ঘুমাবে কিভাবে ? এইটা ভালোবাসা নারে ঐশী । এইটা অভ্যাস । সুন্দর করে হাসতে হাসতে বলে নানা । দেখে বুকের মধ্যে কোথায় যেনো কি নড়ে ওঠে ঐশীর ।
ইশশশ এই অভ্যাসের ভালোবাসাটুকুও কি সারাজীবন পাবে ঐশী ?