- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 115
- Messages
- 1,101
- Reaction score
- 134
- Points
- 1,213
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
*****বিশ্বাস আহমেদের চব্বিশ ঘন্টা*****
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
মূল লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু
হাত ঘামছে, কপাল ঘামছে, নাকের ডগাতেও ঘাম; বিন্দু বিন্দু । চারিপাশে ফিসফাস দূষণ যুক্ত নিস্তব্দতা । সাদা খাতার উপরের দিকের ডান কোনায় নাম, রোল নম্বর ঠিক মতো লেখা হয়েছে কিনা আবার দেখা হলো । ডং করে ঘণ্টার শব্দটা মনে হয় নিজের বুকের মধ্যেই হলো । স্যারেরা প্রশ্ন দেওয়া শুরু করেছেন । বিড়বিড় করে আয়াতুল কুরসি পড়া হচ্ছে । প্রশ্নটা হাতে পাওয়ার পরেও কয়েক মুহূর্ত চোখ, শ্বাস বন্ধ করে বসে থাকা । ধীরে ধীরে চোখ খোলা । মজিদের চরিত্র,নামকরণের স্বার্থকতা, ব্যাখ্যা; সব কমন পড়েছে । উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি থেকে সব মুখস্ত করা । খুশী মনে লেখা শুরু করতেই দেখেন কাগজ ফুটো হয়ে যাচ্ছে ; নিচের বেঞ্চ থেকে ছয় ইঞ্চি উপরে খাতা ; শুন্যে; লিখতে গেলেই কাগজ ফুটো । সব কিছুরই একটা ভিত্তির দরকার আছে জানা ছিলো । কিন্তু কাগজে একটা শব্দ লিখতে গেলেও যে ভিত্তির এত দরকার জানা ছিলো না । সময় চলে যাচ্ছে...মাথার তালু দিয়ে এখন ধোঁয়া বের হচ্ছে; গলা শুকিয়ে কাঠ । শুধুই হাত, কপাল আর নাক না এখন সারা শরীর ঘামছে ...
ঘাম না হলেও প্রবল অস্থিরতা নিয়ে ঘুম ভাঙ্গে বিশ্বাস আহমেদের । কয়েকটা সেকেন্ড কেটে যায় স্বপ্ন আর বাস্তবের সেতুতে । মোটা পর্দা ভেদ করে ঘরের মধ্যে আবছায়া আলো । দেয়ালের দামী ঘড়িতে ছয়টা একুশ । মোটা কাঁথার নিচেও একটু শীত শীত করে । ঝিঁঝিঁ পোকার মত খুব মিহি একটা শব্দ ঘর জুড়ে; এয়ার কন্ডিশনারের । স্ত্রী রুমার আবার গরম খুব বেশী লাগে । তাই সারারাত বাইশ ডিগ্রীতে এসি চলে । পাশ ফিরে স্ত্রীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকায় বিশ্বাস সাহেব । ফর্সা, সুন্দর, নিটোল মুখ । আলস্য কিংবা সুখের মেদে একটু ফোলা ফোলা । চব্বিশ বছর আগে মাথায় ঘন কালো চুল ছিলো । এখন অনেক পাতলা এবং অর্ধেকের মত পাকা । এই অল্প আলোতেও সিঁথির শুরুতে বেশ কিছু সাদা চুল দেখা যাচ্ছে । তবে ভুলেও বিশ্বাস সাহেব রুমাকে এই কথা বলবেন না । এমনিতেই সারাদিন বাঁধ নির্মাণে ব্যস্ত থাকে রুমা । শহর রক্ষা বাধের মত, যৌবন রক্ষা বাঁধ । লেবুর রস, কাঁচা হলুদের রস, আদার রস, পিয়াজ, থানকুনি পাতা আরো কতকিছু নিয়ে যে সে বাঁধ তৈরী হচ্ছে আল্লাহই জানে । বিশ্বাস সাহেব যদি এই সাদা চুলের কথা বলে ফেলেন তাহলে রুমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে । পরবর্তী তিন চার দিন চলবে চুলের চিকিৎসা ।
‘এরকম স্বপ্ন মাঝে মাঝে এখনো কেনো দেখি ?’ বাথ্রুমের আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে ভাবেন বিশ্বাস আহমেদ সাহেব । নবম শ্রেনী পর্যন্ত নাম ছিলো বিশ্বাস আহাম্মদ । স্কুলের নাজির স্যার খুব পছন্দ করতেন । এস, এস, সি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের সময় বদলে দিলেন । বললেন, বিশ্বাস আহাম্মদ... নাম শুনলেই মনে হয় বিশ্বাসীরা আসলে আহাম্মক । হয়তো কথাটা এযুগে সত্যিই...তোরে দেখলে আরো সত্যি মনে হয়... তাও নামের মধ্যে সাইনবোর্ড নিয়া ঘোরার দরকার নাই । এভাবেই হয়ে গেলেন ‘বিশ্বাস আহমেদ’ । ছেলেবেলা থেকেই মাথাটা একটু ধীর । মিথ্যা বলার মত মেধা ছিলো না বলেই দুম করে সত্যি কথা বলে ফেলতেন । কারণ সত্যি কথা বলার জন্য মাথা খাটাতে হয় না । সেই কারণেই বন্ধুরা আহাম্মক বলতো । বাবা ছিলেন ভীষণ রাগী । বাবাও গাধা, আহাম্মক বলে বকা তো দিতেনই মাঝে মাঝেই কপালে জুটতো চেলাকাঠের মাইর । বাবার কারণেই মূলত পরীক্ষা ভীতি ।
কিন্তু সে তো অনেক অনেক দিন আগের কথা । সরকারী জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, ঢাকা শহরে দুইটা ফ্ল্যাট, দুইটা গাড়ি, ব্যাংকে মোটা টাকা ...বিশ্বাস আহমেদ সাহেবকে তো সফল মানুষ বলাই যায় । অন্তত ছেলেবেলায় যেসব বন্ধুরা আহাম্মক বলতো তাদের অনেকের চাইতেই বেশ ভালো আছেন বিশ্বাস সাহেব । তাহলে ?
ঝকঝকে বেসিনে কুলি করে চিন্তাটাও উগরে দেন বিশ্বাস সাহেব । কি করবেন । মাথাটা যে এখনো ধীরেই চলে ।
শোবার ঘর থেকে বের হয়ে মেয়ের ঘর পার হতে গিয়ে থেমে যান । দরজাটা ভেজানো । ভিতর থেকে শব্দ আসছে । ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে এত সকালে ঘুম থেকে উঠেছে ...পরীক্ষা আছে নাকি ? ভিতর থেকে কাঁচ ভাঙ্গা হাসি ভেসে আসে....’নো হানি নট নাউ...সারারাত কথা বলছো ....’ । দ্রুত সরে আসেন বিশ্বাস সাহেব । কি শুনতে কি শুনবেন । তাছাড়া একমাত্র সন্তান মেয়ে আবার খুব সেনসিটিভ । বছর দুই আগে মেয়ের পোশাক নিয়ে একটু বলেছিলেন । তাতেই ঘুমের ওষুধ খেয়ে এক কান্ড বাঁধিয়েছিলো । স্ত্রী ভীষণ রেগে গিয়ে বলেছিলেন, জানো না মেয়ে তোমার খুব সেনসিটিভ – সাবধানে কথা বলবে । খুব ছেলেবেলায় মা বলতেন, তোর বাবা খুব রাগী -সাবধানে কথা বলবি ; আরো পরে শিক্ষক রাগী – সাবধান ; আরো পরে বস বদমেজাজী – সাবধান; আর এখন মেয়ে সুপার সেন্সিটিভ-সাবধান । এভাবেই অনন্তকাল সাবধানে চলছেন বিশ্বাস সাহেব ।
খবরের কাগজ নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসার অল্পক্ষণের মধ্যেই কাজের মেয়ে বেনু চা দিয়ে যায় । এক নজর দেখলেন বিশ্বাস সাহেব । এই সাত সকালেই বেনু বেশ পরিপাটি । ঠোটে রং, চোখে কাজল । হাটা চলায় কেমন একটা ঢং আছে । স্ত্রী রুমার ভাষায় ‘রঙ্গিলা হাটা’ । মাস তিনেক আগে বাসার ড্রাইভার আর বেনুকে নিয়ে সমস্যা হয়েছিলো । এক রাতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মুখে কি যেনো ঘসতে ঘসতে রুমা বলেছিলো
-ড্রাইভার মজনুকে বাদ দিতে হবে ।
-কেনো ? মজনু তো ভালোই গাড়ি চালায় । চুরিও তো মনে হয় করে না । করলেও কম করে ।
বিশ্বাস সাহেব অবাক হয়েই উত্তর দিয়েছিলেন ।
-উপরের তলার ফ্লাটে গিয়েছিলাম দুপুর বেলা । অনেকক্ষণ থাকারই কথা ছিলো । একটু পরেই খেয়াল করি ফোন রেখে গেছি । ফোন নিতে এসে দেখি, মজনু বেনুর সাথে জামাই বউ খেলতাছে । বুঝছো ?
একটু সময় লাগলেও বোঝেন বিশ্বাস সাহেব ।
-বুঝলে, তাড়াতাড়ি বিদায় করো ।
-মজনু কেনো ? বেনুকেই বিদায় করে দাও না । তুমিই তো বলো ওর চলাফেরা ভালো না ।
- যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলো না । চলাফেরা ধুয়ে কি পানি খাবো । এরকম বিশ্বাসী কাজের লোক কোথায় পাবো ।
হক কথা । এ যুগে অন্য সব কিছুই পাওয়া যায়...যোগাড় করা যায়...কেনা যায় কিন্তু বিশ্বাস ?! অতএব মজনুই চলে যায় ...যেতেই হয় ।
তবে বেনু সত্যি কাজের । আগে সকালের নাস্তাটা রুমাই দিতো । কোথা থেকে শুনেছে সকালের ঘুম নাকি ‘বিউটি স্লিপ’ । তাছাড়া অনেক রাত পর্যন্ত মোবাইলে খুটখাট করে রুমা । তাই সকাল নয়টার আগে কখনোই ওঠে না । এতে অবশ্য কোনো অসুবিধাও হয় না । এই যে রুটি, আলুভাজি আর ডিম দিয়ে গেলো বেনু । রুটি গুলো পাতলা, আলু গুলো একটু মোটা করে কাটা আর ডিম ভাজি করকরা ঠিক যেমনটা বিশ্বাস সাহেব পছন্দ করেন । জানেন এর পরে চিনি ছাড়া যে কফিটা আসবে সেটাও তার পছন্দ হবে ।
গাড়িতে উঠেই আবার পত্রিকার পাতা মেলে ধরেন । এটা অন্য পত্রিকা । প্রতিদিন তিনটা পত্রিকায় চোখ বুলান বিশ্বাস সাহেব । সকালে বাসার ভিতরে একটা । গাড়িতে বসে একটা ; অফিসে বসে আর একটা । একই ঘটনার তিনটা কাহিনী পড়েন । তবে আজকাল মাঝে মাঝেই ক্লান্ত লাগে । আজ যেমন লাগছে । বালিশ, পর্দা, ছাত্রহত্যার পাশে জি,ডি,পি লাফের গল্প । ফ্লাইওভারের কাছে ভয়াবহ জ্যাম; গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে ...চোখ দুটো বুঝে আসে বিশ্বাস সাহেবের ।
দেরীতে অফিসে পৌছান বিশ্বাস সাহেব । এটা প্রকল্প অফিস । আটশ কোটি টাকার প্রকল্প । চেয়ার, টেবিল এমনকি চায়ের কাপটা পর্যন্ত সব ঝকঝকে তকতকে । সামান্য মোমবাতিও উজ্জ্বল হয়ে যায় ঝকঝকে আয়নার সামনে, বিশ্বাস সাহেবের নেতানো মনটাও একটু সজীব হয় অফিসে এসে । চেয়ারে বসতে বসতেই অনিক ঘরে আসে । আধুনিক ছেলের আধুনিক নাম । নিল জিন্স, অফ হোয়াইট শার্ট, চোখে দামী ফ্রেমের চশমা । জি বাংলা টিভির কোনো সিরিজ থেকে উঠে আসা চরিত্রের মত মনে হয় অনিককে । এক বছর আগে যখন এই প্রকল্পের কর্মকর্তা হিসাবে ডেপুটেশন হলো তখন বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন বিশ্বাস সাহেব । আগেও এরকম প্রকল্পে কাজ করেছেন । তবে সেগুলো এটার তুলনায় অনেক ছোট ছিলো । দুই মাসের মাথায়ই মন্ত্রণালয়ে তদবির করে অনিককে নিয়ে এসেছেন । সেই থেকে অনেকটা স্বস্থি ।
-স্যার পরশুদিন মন্ত্রীর সাথে মিটিং মনে আছে তো ?
-আমি মনে রাখবো কেনো । তুমি আছো না ।
হাসতে হাসতে উত্তর দেন বিশ্বাস সাহেব ।
-রিপোর্ট সব তৈরী আছে । অসুবিধা হবে না । এখন স্যার এই ফাইলগুলোতে সই দেন ।
- এটা কি ? আপ্যায়ন বিল একুশ লাখ টাকা । দেখো এক কাপ চায়ের দাম না আবার হাজার টাকা লিখে রাখছে ।
-স্যার এমন কথা বলতে পারলেন । আপনাকে কোনোদিন বিপদে ফালাইছি ।
-আরে মাইন্ড করো কেনো । দিনকাল খারাপ । দেখো না বালিশ শেষ হইলেই পর্দা আসে ।
- রাখেন স্যার । আটশো কোটি টাকার প্রকল্পে একুশ লাখ টাকার চা নাস্তা খাওয়াটা কোনো বড় ব্যাপার না । মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুকে এইসব লিখে অনেকে মজা পায় । চেংড়া পোলাপান বেশী মজা পায় ।
-তারপরও সাবধানে থাকা ভালো ।
-স্যার আমার গল্পতো আপনাকে বলেছিই । খালাতো বোনের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো অনেক আগেই । যেই এক পুলিশ অফিসার পাত্র হিসাবে আসলো খালা, খালু, খালাতো বোন সব গলে গেলো । সেই পুলিশ অফিসার কিন্তু আমার চাইতে এক গ্রেড নিচের বেতন পায় । তাহলে ?
বলে ঝকঝকে চায়ের কাপে চুমুক দেয় অনিক । চশমা খুলে কাঁচ মোছে । বিশ্বাস সাহেবও কিছু না বলে ফাইলে সই করেন ।
-স্যার যে ছেলেটা ল্যাপটপ কিংবা দামী ফোন দিয়ে ফেসবুকে জ্বালাময়ী লেখা লিখছে তার ফোন কিংবা ল্যাপটপটার দাম কতো ? তার বাবা বেতন পায় কতো ? তার প্রাইভেট ভার্সিটির ফি কতো ? সাধারণ প্রশ্ন কিন্তু উত্তর নাই । দেশের ঘরের বউ যদি বলতো যে স্বামীর হারাম টাকা খাবে না ; প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়ে যদি বলতো বাবার হারাম টাকা নিবে না তাহলে এই দেশে দুদক লাগে না । সরি স্যার ফালতু কথা বেশী বলে ফেলেছি ।
-না না ঠিক আছে ।
-স্যার কাজের কথায় আসি । আপনার মেয়ে সিল্ভির কানাডা যাবার কতদুর ।
-ঠিক জানি না । এইটা ওর মামারা দেখছে । মনে হয় তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে ।
-যাক ভালো খবর । সিল্ভির যাবার সাথে সাথে কানাডাতে একটা একাউন্ট খুলতে হবে । ওর নামে একটা বাড়িও কিনে ফেলতে হবে । আগে বউ এর নামে কিনলেই হতো এখন সেটা সেইফ না । যাক এসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না । আমি তো আছিই স্যার ।
অনিকের কথায় আসলেই ভরসা পান বিশ্বাস সাহেব । ছেলেটা সত্যি কাজের ।
সন্ধ্যার একটু পরে যখন অফিস থেকে বের হচ্ছেন তখনো গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে । নিম্নচাপ হলো নাকি, ভাবতে ভাবতে গাড়িতে ওঠেন বিশ্বাস সাহেব । সিগন্যালে দাড়াতেই ফুলওয়ালী, বইওয়ালা সহ আরো কয়েকজন গাড়ির জানালায় টোকা মারে । বিশ্বাস সাহেব পাথর চোখে দেখেন, সব সময়ের মত । কিন্তু এর মাঝেই রাস্তার ফুটপাথে চোখ যায় । এগারো বারো বছরের দুই ছেলে মাটিতে বসে প্রবল আগ্রহে কি যেনো খাচ্ছে । দুজনের চেহারায় মিল আছে, হয়তো দুই ভাই । সামান্য দৃশ্য তবুও মনটা যেনো কেমন করে ওঠে বিশ্বাস সাহেবের ।
-মোতালেব মহাখালীর পানির টাংকির কাছে যাও ।
-জ্বি স্যার ।
উত্তর দিয়েই ড্রাইভার মোতালেব একটু মুচকি হাসে । বিশ্বাস সাহেব দেখেও না দেখার ভান করে । মোতালেব চালাক চতুর লোক । এর মধ্যেই খবর পেয়েছেন নজু ভাইয়ের খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছে মোতালেব । নজু ভাইয়ের মত একজন রিক্সাওয়ালার সাথে বিশ্বাস সাহেবের কি সম্পর্ক; আগ্রহ তো হতেই পারে । গুজব শুনেছেন মোতালেব নাকি অফিসারদের গোপন খবর জানার চেষ্টা করে । বিশ্বাস সাহেবের বসের স্ত্রীর কাছ থেকেই নাকি অনেক টাকা নিয়েছে মোতালেব । এসব অবশ্য গুজব, বিশ্বাস করলেও হয় না করলেও হয় । দেশটাই এমন । সবাই সবার ধান্ধায় ব্যস্ত । একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বিশ্বাস সাহেব ।
ছয়মাস আগে নিকেতনের পুলিশ প্লাজার কাছে জ্যামে পড়েছিলো গাড়ি । হঠাৎ বাইরে তাকিয়ে নজু ভাইকে দেখে বিশ্বাস সাহেব । পোড়া চেহারা, বসা গাল, কোটরাগত চোখ ...প্রায় চল্লিশ বছর পরে দেখা । তাও চিনতে পারেন বিশ্বাস সাহেব । চিনতে পারেন চুল দেখে । পাক ধরলেও এখনো মাথা ভর্তি সেই কোকড়ানো চুলই আছে নজু ভাইয়ের । নজু ভাই মনে হয় চার পাঁচ বছরের বড়ো ছিলেন । আব্বা সব সময় একজন লোক রাখতো তার নিজের ফাই ফরমাশ খাটার জন্য । নজু ভাই ছিলো সেই লোক । বিশ্বাস সাহেবের ছোটবেলার নায়ক । গাছের মগডাল থেকে ডাসা পেয়ারাটা পাড়া; পুকুরের মাঝখান থেকে প্রকান্ড শাপলা ফুলটা নিয়ে আসা । একবার তো ডাংগুলি খেলার লাঠি দিয়েই ছোট একটা সাপ মেরে ফেললেন । তাছাড়া ছিলো দরাজ গলার গান । বালক মনের নায়ক হবার জন্য এসব যথেষ্টর চাইতেও বেশী । সেই নজু ভাইকে একদিন পেয়ারা গাছের ডাল দিয়ে ভীষণ মেরেছিলেন আব্বা । বিশ্বাস সাহেবের এখনো মনে আছে – তালুই আর ক্রুম না আমারে ছাইড়া দেন বলে বার বার আব্বার পায়ে পড়ে যাচ্ছিলো নজু ভাই । কিন্তু আব্বার তখন হিতাহিত জ্ঞান ছিলো না । সেই রাতে ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখেছিলেন বিশ্বাস সাহেব । সকালে উঠে নজু ভাইকে আর দেখে নাই, মায়ের কাছে শুনেছেন বাবা নাকি টাকা পয়সা দিয়ে বিদায় করে দিয়েছেন ।
-নজু ভাই পাঁচশ টাকাই নিছিলা ?
মহাখালী টিবি গেটে বস্তির মতো দুই রুমের টিনের বাসা । বাসার সব চাইতে ভালো চেয়ারে বিশ্বাস সাহেব বসে আছেন । আগের দুইবারও এই চেয়ারেই এসে বসেছেন । সিগারেটের আগুনে চেয়ারটার দুই একটা জায়গা ফুটো । তারপরও ফোমের কারনে চেয়ারটায় বসে আরাম আছে । নজু নামে যাকে ডাকা হলো সে বসে আছে বিছানায় ।
-নওয়া ভাই আফনেরে তো সব কইছি । আবার কি কইতাম ?
-তুমি আবার বলো নজু ভাই । আমি তখন কোন ক্লাসে পড়ি ? মনে হয় ফোর । আব্বা তোমাকে যে কি মাইরটাই না দিলো ।
-কত্ত কাল আগের কথা । দোষ আমারই ছিলো । আফনের বাবা তালুই সাব যে রাগী মানুষ হেইডা তো হগলেই জানে । হাটের এক ব্যাপারী টাকা ধার নিছিলো তালুই এর কাছ থেকে । সুদসহ সাড়ে তিন হাজার টাকা নাকি তিন হাজার টাকা এইডা নিয়া গ্যাঞ্জাম । আমিও আছিলাম ঐহানে । ব্যাপারি কইলো, আপনেরে তিন হাজার টাকা এখন নগদ দিমু আর জীবনে আপনার মুখও দেহুম না । তালুই রাজী হইলো । ব্যাপারির লগে আমারে দিলো টাকাটা নিয়ে আইতে । ব্যাপারি টাকা দেবার সময় আমারে সাড়ে তিন হাজারই দিলো । দিয়া কইলো, তোর সুদখোর তালুইরে কইস ব্যাপারি ঠগের কারবার করে না । আমি ভাবলাম তালুই তো জানে তিন হাজার পাইবো, আর ব্যাপারি তো কইছে জীবনে তালুইয়ের মুখও দেখবো না । গরীব মানুষের স্বভাব । সু্যোগ পাইয়া পাঁচশ টাকা মাইরা দিলাম । ধরা খামু বোঝতে পারি নাই ।
-তাও মাত্র পাঁচশ টাকা চুরি... কি মাইরটাই না খাইছো । হাড় কি ভাংছিলো একটাও ?
-হ । হাতের একটা হাড় ভাংছিলো । তয় তালুই আমারে টাকা দিছিলো । চিকিৎসার জন্য । আফনেও তো আমার মাইয়াডার বিয়ায় ত্রিশ হাজার টাকা দেলেন । আফনে ভালা মানুষ আফনের বাবায়ও ভালা মানুষ আছেলে । আফনে এইডা ছাড়েন তো নওয়া ভাই । গরীব মানুষ,লোভে চুরি করছি, শাস্তি পাইছি । কথা শ্যাষ ।
নজু ভাইয়ের কথার পরেও একটু ঝিম ধরে বসে থাকেন বিশ্বাস সাহেব । গরীব মানুষ পাঁচশ টাকা চুরি করলে মেরে হাত ভেঙ্গে দেয়া যায়...গরীব মানুষ কত সহজে সেটা মেনেও নেয় ...আচ্ছা আটশ কোটি টাকার প্রকল্পে কত টাকা চুরি হতে পারে ...ধুর মাথা কেমন ধীর গতিতে চলছে ।
-আজকে তাইলে যাই নজু ভাই ।
বলে উঠে পড়েন বিশ্বাস সাহেব ।
বাসায় ফিরতে একটু রাত হয় বিশ্বাস সাহেবের । হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে শোনেন মেয়ে তখনো বাসায় ফেরে নাই । বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আছে ।
-মেয়ে এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকে , এটাতো ঠিক না ।
প্রসঙ্গ তোলেন বিশ্বাস সাহেব ।
-হ্যা তবে আজকাল কিছু বলি না । এই দেশে থাকবেই তো আর মাস ছয়েক । মনি বলছিলো ইউনির সব কাগজপত্র তৈরী । এম্বেসীতে দাড়াইলেই ভিসা হয়ে যাবে ।
রুমা উত্তর দেন ।
-আর দুইটা বছর পড়ে গ্রাজুয়েশনটা শেষ করে গেলে হতো না ।
-এই দেশে কি আর পড়ার পরিবেশ আছে । যত তাড়াতাড়ি যায় ততই ভালো । তুমি কিন্তু টাকা পয়সা নিয়ে কিপটামি করবে না । একমাত্র মেয়ে আমাদের । এতকিছু থাকতে মেয়েটা কষ্ট করবে কেনো ।
-ঠিক আছে ।
ছোট করে উত্তর দেন বিশ্বাস সাহেব ।
মাথার কাছে মোবাইলের টুং টুং শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় বিশ্বাস সাহেবের । পাশের বালিশেই স্ত্রী রুমার ফোন । রুমা মনে হয় টয়লেটে । আবারও টুং করে শব্দ হয় । নিজের অজান্তেই চোখ যায় । ‘দুষ্টু ছেলের মিষ্টি হাসি’ মেসেজ করেছে, ‘ইউ আর সো কিউট’ এর পরে লাল লাভ সাইন । একটু উপরেই একজন লাস্যময়ী নারীর ছবি । রুমার ছবি বলে চিনতে কষ্টই হলো । আজকাল ক্যামেরা, ফিল্টার কতকিছু আছে, ছাব্বিশ বছর ঘর করা নিজের বউকে চিনতেই কষ্ট হয় । গত কিছুদিন যাবত রুমা এইসব নিয়ে মেতে আছে । একদিন জিজ্ঞেস করলে বলেছিলো – আরে ধুর আজকাল সবাই এইসব করে ...ফান । আর কিছু না ।
রুমার কাছে এটা ফান সেটা নিশ্চিত জানে বিশ্বাস সাহেব । কিন্তু ‘দুষ্টু ছেলের মিষ্টি হাসি’ ...ধুর আমি ভাববো কেনো ...পাশ ফিরতে ফিরতে ভাবে বিশ্বাস সাহেব ।
পরেরদিন সকাল ছয়টা একুশ। আবারো স্বপ্ন দেখছেন বিশ্বাস সাহেব ।
একটু আগেই আব্বা চেলা কাঠ দিয়ে মেরেছেন । কারন বড় বুবুর বিয়ের খবরের জন্য লোক এসেছিলো । স্কুলের কাছে একজন জিজ্ঞেস করেছিলো, তোমার বাবা কি করেন ? বালক বিশ্বাস ঝটপট উত্তর দিয়েছেন, দাদন দেয় আর জমির দালালি করে । আব্বা কিভাবে যেনো সেটা শুনেছেন । ‘আহাম্মক ছেলে তোর বাপ দালাল, তোর বাপ সুদের কারবার করে । হারামখোর বাপ ব্যবসা করে বলতে পারলি না । গাধা জন্মাইছে আমার ঘরে । আহাম্মক ।‘ বলতে বলতে সে কি মাইর ।
একটু পরেই মা এসে অল্প গরম তেল দিয়ে মালিশ করে দিচ্ছেন ।
-মাইনসে এমন মারে । আমার পোলা আহাম্মক । হউক আহাম্মক । মানুষ তো । তুই আহাম্মকই থাকিস বাপ । সব সময় না হইলেও মাঝে মাঝে আহাম্মক হইস । দুইন্না ভর্তি ইন্দুর, শিয়াল আর শুয়ার । মানুষই খালি আহাম্মক ।
মায়ের কথায় নাকি গরম তেলের মালিশে বিশ্বাস সাহেবের খুব আরাম লাগে । ঘুমের মধ্যেও ঠোঁটের কোনায় হাসি দেখা যায়...