মনেরও অসুখ আছে….

dukhopakhi

Well-Known Member
Community Member
1K Post
Joined
Dec 22, 2024
Threads
115
Messages
1,101
Reaction score
134
Points
1,213
Age
40
Location
Dhaka, Bangladesh
Gender
Male
মনেরও অসুখ আছে….
মূল লেখকঃ ডা. আফতাব হোসেন






সত্য কাহিনী দিয়েই শুরু করা যাক। একবার এক মহিলা এলো আমার কাছে। ত্রিশের কোঠায় বয়স। বেশ সুন্দর সুঠাম শরীর। উঠে দাঁড়িয়ে রুগীকে সম্ভাষণ জানালাম। চেয়ার টেনে সমাদরে বসতে দিয়ে বিনয়ের সাথে জানতে চাইলাম,
- বলো, তোমার জন্য কী করতে পারি?
কিছুক্ষণ কটমট করে আমার দিকে চেয়ে রইল মহিলা। তারপর তাচ্ছিল্যের সুরে জানতে চাইল,
- তুমিই ড. হোসেন?

যেন ডা. হোসেন হয়ে রীতিমত অন্যায় করে ফেলেছি। একটু চুপসে গেলাম। কোথায় কী গড়বড় হলো কে জানে? এখানে পান থেকে চুন খসলেই রুগীরা কৈফিয়ত তলব করে বসে। আর প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে সব উদর পিণ্ডি এই বুদর ঘাড়ে এসে পড়ে। অপরাধ যেই করুক, জবাবদিহি আমাকেই করে হয়। একটা বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার প্রস্তুতি নিয়ে বললাম,
- ইয়েস, দ্যাটস রাইট। আমিই ড. হোসেন।
- কী সব ডাক্তার রেখেছ? আমার রোগ ধরতে পারে না। আই ওয়ান্ট টোটাল বডি চেকআপ।

যাহ বাবা! এখানেও টোটাল বডি চেকআপ? শব্দটা এতদিন বাংলাদেশে শুনে এসেছি। ইন্ডিয়ায় তো শুনেছি টোটাল বডি চেকআপের গোল্ড, প্লাটিনাম প্যাকেজও আছে! চিকিৎসারও যে শ্রেণী বিভাগ আছে, আমাকে বোধহয় নতুন করে তা শিখতে হবে। “সব চিকিৎসা ফ্রি” এর এই দেশে বিনা প্রয়োজনে গোল্ড প্লাটিনাম তো দূরের কথা, তামা প্যাকেজ দেয়ারও উপায় নেই। আবার রুগীরাই এখানে ডাক্তারদের ভাগ্য বিধাতা। তাদের চটালেও খবর আছে। আমার তো শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। একটু সিরিয়াস হয়ে বললাম,
- আয়াম স্যরি টু হিয়ার দ্যাট। আমাকে তোমার অসুবিধাগুলো একটু খুলে বলো।
- বহুদিন ধরে সারা গায়ে ব্যথা, গিঁটে গিঁটে ব্যথা। মাথায় ব্যথা। গণ্ডায় গণ্ডায় পেইন-কিলার খাচ্ছি। কোনো কাজ হচ্ছে না। আয়াম সিওর। আই হ্যাভ গট সামথিং ভেরী সিরিয়াস। তোমরা ধরতে পারছ না। তুমি টোটাল বডি এক্সরে করে দেখো, কোথায় কী হলো।

মর জ্বালা! বাংলাদেশের মত এদেশের রুগীদেরও সেই সেই একই ধারণা? এক্সরে মেশিন দিয়ে শরীরের সবকিছু দেখা যায়। আমার রাগ হবার কথা, কিন্তু রাগ করতে পারি না। যার ব্যথা, সেই বোঝে কী যন্ত্রণা। আমি ধৈর্য ধরে তার ব্যথার হিস্ট্রি নিলাম। এ দেশে রুগীর সারা জীবনের মেডিকেল রেকর্ড কম্পিউটারে সেভ করা থাকে। এক টিপেই জানা যায়, কবে, কখন, কোথায় কী হয়েছিল। দেখলাম, তেমন কোনো রোগ বালাইও নেই তার। কিছুদিন আগে রুটিন চেকআপও করা হয়েছে। সব নর্মাল। তার এই সর্বাঙ্গে ব্যথার যুতসই কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না।

আমি অন্য পথ ধরলাম। তার ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য নেয়া শুরু করলাম। এন্ড দেন দ্যা প্যানডোরা বক্স ওপেন্ড। কিছুই ভালো লাগে না তার। ঘুম আসে না সহজে। খাওয়ায় রুচি নেই। ভালো লাগে না বই পড়তে কিংবা টিভি দেখতে। ভালো লাগে না বাইরে যেতে কিংবা শপিং করতে। ভালো লাগে না মানুষের সাথে মিশতে। জীবন তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। বেঁচে থাকার আর কোনো মানে হয় না। বুঝলাম ভীষণ হতাশা কিংবা বিষণ্ণতায় ভুগছে সে। মেডিকেলের ভাষায় আমরা Depression বলি। আর তার শারীরিক এই উপসর্গকে আমরা Somatic Symptom Disorder বলি যা এক ধরণের জটিল মানসিক রোগের বহিঃপ্রকাশ।

আমি সতর্ক হয়ে গেলাম। এই ধরণের রুগীদের মধ্যে নিজেকে কষ্ট দেয়া কিংবা নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা খুব বেশী থাকে। এমনকি আত্মহননের পথও বেছে নিতে পারে। আমাকে খুব সাবধানে এগুতে হবে। আমি তার মনের দরজায় কড়া নাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। একটু সহানুভূতি দেখাতেই খুলে গেল বুকের ভেতর অনেক দিন বন্ধ থাকা সিন্দুকের তালা। যা শুনলাম, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না মোটেই। সে জানে না তার বায়োলজিক্যাল ফাদার কে। মায়ের যৌবনের উন্মাদনার ফসল সে। পরে, মায়ের স্বামীর হাতে মানসিক ও যৌন ভাবে নিগৃহীত হয়েছে অনেক। ভয়ে, লজ্জায়, ঘৃণায় বলতে পারেনি কাউকে কিছু। তবে ভুলতে পারেনি সেই সব অপমানকর স্মৃতি। সেই থেকে বিষণ্ণতায় ভুগছে সে। বছর দুই হয় বিয়ে করেছে। তবে বিছানায় শরীর জাগে না তেমন। সেই নিয়ে স্বামীর সাথে মনোমালিন্যতা প্রতি রাতে। প্রায়ই ভাবে, মরে যাওয়াই ভালো।

বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তাকে কাঁদতে সময় দিলাম। আহা, কাঁদুক। কেঁদে কেঁদে যদি হালকা হয় বুক। না জানি কতকাল কাঁদে না সে এমন করে। আমি শুধু তার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে ভরসা দেয়ার চেষ্টা করলাম। বুঝলাম, শৈশবের সেই নোংরা অভিজ্ঞতা তার মনের গহীনে শেকড় গেড়ে আছে শক্ত ভাবে। আমরা বলি Post Traumatic Stress Disorder. যতটা জটিল ভেবেছিলাম, তার চেয়েও জটিল মনের অবস্থা তার। একটু ধাতস্থ হলে বললাম,
- খুব ভালো করেছ আমাকে বলে। এতদিন মনের ভেতর জমিয়ে রাখা না বলা কষ্টগুলো এখন ব্যথা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে তোমার সমস্ত শরীরে।
অবিশ্বাসী চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল সে। বুঝতে পারেনা, মনের ব্যথা শরীরে ছড়ায় কেমন করে? আমি ব্যাখ্যা করলাম,
- দেখো, তোমার শরীরে আসলে ব্যথা নেই। থাকলে যে পরিমাণ ব্যথার ওষুধ খেয়েছ, কোনো ব্যথা আর থাকার কথা নয়। তোমার আছে এক ধরণের ব্যথার বোধ। সেই বোধের কারণে মনে হয় সমস্ত শরীরে ব্যথা করছে।

কিছুটা বিশ্বাস ফিরে এলো তার চোখের তারায়। একটু আগ্রহী হয়ে ঝুঁকে বসল। আমি বলতে থাকি,
- দেখো, কিছুদিন আগেই তোমার রুটিন ব্লাড টেস্ট করা হয়েছে। কিছু পাওয়া যায়নি। হাড়ভাঙ্গা ব্যথা না হলে এক্সরে করে কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আর তোমার তো মাসল পেইন। তাই এক্সরে করে কোনো লাভ নেই। তোমার বরং মন খুলে কারও সাথে কথা বলা দরকার। তুমি রাজি থাকলে আমি তোমাকে একজন সাইকোলোজিস্টের কাছে পাঠাতে পারি। সে তোমার এই কষ্ট কাতর মনের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা আর একটি মনকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করবে। যে মনটা সুন্দর স্বপ্ন দেখবে। নতুন আর একটা জীবন বাঁচতে চাইবে। মনে রেখো, দেয়ার ইজ অলওয়েজ লাইট এট দ্যা এন্ড অব দ্যা টানেল।
- তুমি কোনো ওষুধ দেবে না?
- না। পেইন-কিলার খেয়ে কোনো লাভ নেই। সব বন্ধ করে দাও। আমি তোমাকে শুধু একটা ট্যাবলেট লিখে দিচ্ছি। এন্টি-ডিপ্রেসান্ট। দিনে একবার খাবে। এটা তোমার মুডকে চিয়ার আপ করতে সাহায্য করবে।

মাস তিনেক পর সে একটা বড়সড় ফুলের তোড়া নিয়ে হাজির। তিন মাসের কাউন্সেলিং (Cognitive Behavioural Therapy) নিয়ে সে প্রায় সুস্থ। সাথে এন্টি ডিপ্রেসান্ট তো ছিলই। আমাকে একটা উষ্ণ হাগ দিয়ে বলল,
- আয়াম এভার গ্রেটফুল টু ইউ ডকটর। ইউ হ্যাভ শোওন মি দ্যা নিও লাইট অব লাইফ।
সত্যি তখন সে এক নতুন মানুষ। প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর, যেন এক তন্বী তরুণী।

শরীরে রোগ হয় আমরা সবাই জানি। সে রোগের যন্ত্রণা শরীরে দেখা দেবে সেটাই স্বাভাবিক। মনের কষ্টও যে শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে, ক’জনে তা জানি? আপনি সেই শারীরিক কষ্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবেন, ডাক্তার সাহেব আপনার শরীরের আতিপাতি তন্নতন্ন করে খুঁজবে, হেন কোনো টেস্ট নেই যা না করাবে, শেষে ধরতে না পেরে পৃষ্ঠা ভরে ওষুধ লিখে দেবে। আর ধরবেই বা কেমন করে? এমন কোনো এক্সরে বা যন্ত্র তো আবিষ্কার হয়নি যা দিয়ে মন দেখা যায়। না, আমি ডাক্তারদের দোষ দিচ্ছি না। ভীষণ ব্যস্ত জীবন তাদের। অত ব্যস্ততার মাঝে ধৈর্য ধরে রুগীর জীবন কাহিনী শোনার সময় কোথায়?

এখানে রুগীদের দোষও কম নয়। আমাদের দেশে কারও রোগ হলেই সে অন্যের সহানুভূতি কিংবা করুণা ভিক্ষা করে। ইদানীং তো কিছু হলেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দোয়া ভিক্ষা করতে দেখা যায়। এরা একা একা ডাক্তারের কাছে যায় না। সাথে কাউকে না কাউে নিয়ে যায়। আর সে ডাক্তার ও রুগীর একান্ত কথোপকথনের মধ্যে কাবাব মে হাড্ডি হয়ে নাক জাগিয়ে বসে থাকে। ডাক্তারের সাথে কথা সেই বেশী বলে। যেন যার শরীর তার চাইতে সঙ্গের মানুষটার কষ্টই বেশী। আমাদের দেশে রুগীর প্রাইভেসী বলে কোনো শব্দ নেই। তাই চাইলেও ডাক্তার সাহেব একান্ত গোপন ব্যক্তিগত কোনো প্রশ্ন করতে পারে না। করলেই হয়ত শুনতে হবে,
- রোগের কথা জিগাইছেন জিগান, ঘরের খবরে কী কাম?

রুগীদেরও পুরা দোষ দিতে পারি না। মানসিক রোগকে যে এখনও আমাদের সমাজে এক ধরণের অস্পৃশ্য রোগ ভাবা হয়। ইংরেজিতে যাকে বলে Social taboo। মানসিক রোগ হয়েছে শুনলেই ভাবে বুঝি পাগল হয়ে গেছে। শাশুড়ি তো ছেলের জন্য মেয়ে খোঁজা শুরু করে দেয়। আর স্বামী বেচারা মুখে কিছু না বলতে পারলেও মনে মনে নতুন বাসর সাজানোর স্বপ্ন দেখা শুরু করে। আর প্রতিবেশী জানলে তো কথাই নেই। পাগল না হয়েও অযাচিত সহানুভূতির প্রশ্ন বাণে অচিরেই পাগল হবার জোগাড় করে দেবে। সেই ভয়েই কেউ বলতে কিংবা মানতে রাজি নয় যে তার মানসিক সমস্যা আছে। এখানে মেয়েদের কথা বললেও এটা ভাবার কারণ নেই যে পুরুষরা ডিপ্রেশনে ভোগে না। তারাও ভোগে, তবে মেয়েদের তুলনায় অর্ধেক।

হ্যাঁ। মানসিক রোগ মানেই শুধু বদ্ধ উন্মাদ কিংবা পাগল হওয়া নয়। মন তো আকাশের মতো বিশাল। সেখানে আপাত দৃষ্টিতে যা দেখা যায়, তার চেয়েও অনেক বেশী আছে যা দৃষ্টির অগোচরে রয়ে যায়। শরীরের রোগ হলে যেমন লজ্জার কিছু নেই, মানসিক রোগ হলেও তেমন লজ্জার কিছু নেই। বরং শরীরের মতো মনের রোগ পুষে রাখলে তার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে।

বহু প্রকার মানসিক রোগ আছে। এই স্বল্প পরিসরে সব আলোচনা সম্ভব নয়। যে রোগটা সহজে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়, হ্যাঁ, বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন, সেটা নিয়েই আলোচনা করব আজ। মাত্র নয়টি প্রশ্ন করুন নিজেকে। নিজেই বুঝতে পারবেন, আপনি বিষণ্ণতা কিংবা ডিপ্রেশনে ভুগছেন কিনা।

১। আপনি কি সেই সব কাজে আনন্দ কিংবা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন যে সব কাজে আগে আপনি আনন্দ কিংবা উৎসাহ পেতেন?
২। আপনার কি সারাক্ষণ মন খারাপ থাকে কিংবা হতাশ লাগে?
৩। আপনার কি নতুন করে ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে? যেমন ঘুমাতে না পারা কিংবা খুব বেশী ঘুমানো।
৪। আপনার কি খুব দুর্বল কিংবা অবসাদগ্রস্ত লাগে?
৫। আপনি কি ইদানীং ক্ষুধামন্দায় ভুগছেন কিংবা খুব বেশী খাচ্ছেন?
৬। আপনার কি নিজেকে একজন ব্যর্থ অথর্ব মানুষ মনে হয় কিংবা মনে হয় আপনি আপনার পরিবারের জন্য একটা বোঝা?
৭। আপনি কি কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না? যেমন বই পড়া, টিভি দেখা, অফিসের কাজ, ইত্যাদি
৮। আপনার চলাফেরা কিংবা কথাবার্তা শুনে অন্যরা কি এমন মন্তব্য করে যে, তোমার কী হয়েছে? কিংবা এমন লাগছে কেন? অর্থাৎ, আপনার আচরণ কিংবা ব্যবহারের পরিবর্তন কি অন্যের নজরে কাড়ে?
৯। আপনার কি মরে যেতে ইচ্ছে করে কিংবা মন চায় নিজের কোনো ক্ষতি করতে?

এবার কাগজ কলম নিন। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিন এবং নীচের মতো করে মার্কিং করুন।
কখনওই না = ০
কখনও কখনও = ১
প্রায়ই = ২
সব সময় = ৩

আপনার স্কোর যদি ৪ এর নীচে হয়, তবে ভয়ের কিছু নেই। ৫–৯ হলে দেখি কী হয় পথ অবলম্বন করা যেতে পারে। ১০-১৪ হলে আপনাকে ডাক্তারের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। আর ১৫ এর উপরে হলে আপনাকে অবশ্যই চিকিৎসা নিতে হবে। আপনার ভেতরে যদি প্রায়ই আত্মহননের চিন্তা আসে, তাহলে এখনই একজন সাইকিয়াট্রিস্টের স্মরণাপন্ন হতে হবে, নইলে যে কোনো সময় অঘটন ঘটে যেতে পারে।

বিষণ্ণতার কারণ ও প্রতিকার আলোচনা করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং বিষণ্ণতা তথা অন্যান্য মানসিক রোগের ব্যাপারে মানুষের ভেতর সচেতনতা তৈরি করাই মূল উদ্দেশ্য। মনে রাখবেন, সুস্থ মন অসুস্থ শরীরকে বয়ে নিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু অসুস্থ মন সুস্থ শরীরের ভরও সইতে নারাজ।
 
Back
Top