- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 115
- Messages
- 1,101
- Reaction score
- 134
- Points
- 1,213
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
গোপন কাজ, মরণ ব্যাধি….
(সত্য কাহিনী অবলম্বনে)
মূল লেখকঃ ডা. আফতাব হোসেন।
(সত্য কাহিনী অবলম্বনে)
মূল লেখকঃ ডা. আফতাব হোসেন।
- কী অসুবিধা?
- পেশাবে জ্বালা।
- কত দিন?
- সপ্তা দশ দিন।
চোখ তুলে রুগীটির দিকে তাকাই। থুতনিতে এক মুঠো কাঁচা-পাকা দাড়ি। মাথায় টুপি। সামনের দাঁত দুটো নেই। বাকিগুলো পান খেয়ে কালচে লাল। মুখের চামড়া রোদে পুড়ে তামাটে। এক সময় কি রঙ ছিল কে জানে। সৌদি আরবে এ ধরণের মানুষগুলো সাধারণত সারাদিন ঘিলু-গলা রোদে ঘুরে ঘুরে রাস্তা পরিষ্কার করে। কিংবা খেজুর বাগানে ঘাম ঝরিয়ে পানি সিঞ্চন করে। চল্লিশ ডিগ্রী তাপমাত্রার লু হাওয়ায় ওদের শরীর শুকিয়ে মরুভূমি। ঝলসে দেয় হাত, পা, মুখের ত্বক। বড় মায়া হয় এই সব ভাগ্য-বিড়ম্বিত মানুষগুলোর জন্য। আদম বেপারীর খপ্পরে পড়ে ভিটেমাটি বিক্রি করে, এই গরীব মানুষগুলো এ দেশে আসে, সুখ নামের সোনার হরিণটি ধরার আশায়। ওরা শুনেছে, সৌদি আরবে আছে সোনার খনি, আছে তেলের খনি। ওরা কী করে জানবে, সে সোনা, সে তেল ওদের জন্য নয়। বরং সোনার জরিওয়ালা আলখাল্লা পড়ে, সোনার দাঁত মুখে লাগিয়ে, তেল চপচপে চেহারার সৌদি মানুষগুলো, গরীব দেশ থেকে আসা মানুষগুলোর ঘাম রক্ত চুষে একদিন কঙ্কাল বানিয়ে দেয়। বিনিময়ে মাস শেষে চার পাঁচশ রিয়াল হাতে ধরিয়ে দেয়। খেয়ে পরে মাসে দুশো রিয়ালও বাঁচাতে পারে না। সে টাকা পাঠিয়ে দেয় দেশে ফেলে আসা পরিবার পরিজনদের জন্য। যে টাকা খরচ করে আসে, সে টাকা তুলতে পাঁচ সাত বছরও লেগে যায়। কারও কারও সে টাকা আর শোধ হয় না।
এটা বাইশ বছর আগের কথা। আমি তখন সৌদি আরবে, জেদ্দা শহরে একটা প্রাইভেট পলিক্লিনিকে চাকরী করি। বাব মক্কা বদরুদ্দীন পলিক্লিনিক। কাগজে কলমে সৌদি ডাক্তার, বদরুদ্দীনের নামে হলেও আসল মালিক ইন্ডিয়ার এক ভদ্রলোক, রবি উল্লাহ। প্রখর ব্যবসায়িক বুদ্ধি তার। সৌদি আরবে কাজ করার জন্য নানা দেশ থেকে লোক আসে। তাদের আকৃষ্ট করতে রবি উল্লাহ মিশর, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে ডাক্তার এনে চাকরী দেয়। যাতে মানুষ নিজ দেশের ডাক্তারের কাছ থেকে নিজ ভাষায় কথা বলে চিকিৎসা নিতে পারে। সরকারী হাসপাতালে বিদেশীদের চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ নেই। অধিকাংশ চাকরি দাতারাও চিকিৎসার খরচ দেয় না। একবার প্রাইভেট ক্লিনিকে এলে এক মাসের বেতন চলে যায়।
সব দেশেই প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলো, রুগীর রক্ত চোষার হাতিয়ার। রুগী এলেই এক গাদা টেস্ট ধরিয়ে দেয়। ক্লিনিকেই টেস্ট করার ব্যবস্থা। সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যায়। নইলে ডাক্তারদের চাকরী রাখাই দায় হয়ে পড়ে। যাদের রক্ত ইতিমধ্যেই পুড়ে কালো হয়ে গেছে, তাদের রক্ত চুষতে বিবেক সায় দেয় না আমার। ভাগ্যিস, কথার চাতুরীতেই হোক, কিংবা চেহারা দেখেই হোক, আমার রুগীর সংখ্যা ছিল প্রচুর। তাই চাকরিটা টিকে ছিল।
সৌদি আরবের শুষ্ক তপ্ত আবহাওয়ায় যারা বাইরে কাজ করে, তাদের প্রায়ই পানি শূন্যতা দেখা দেয়। শরীর কড়া হয়ে গেলে পেশাবে জ্বালা পোড়া করতেই পারে। অনেক সময় পেশাবের নালীতে ইনফেকশনও হতে পারে। জিজ্ঞেস করি,
- জ্বরটর হয়।
- হ’ বাবা। ঘুষঘুইষা জ্বর। রাইতে রাইতে আহে।
- কত দিন?
- ওই তো, একই লগে।
আমি লোকটার হাতে হাত রাখি। ঠাণ্ডা হাত। খসখসে, রুক্ষ।
- হাত তো ঠাণ্ডা।
- ভিতরে ভিতরে আহে বাজান।
- হুম। বয়স কত?
- চল্লিশ পঞ্চাশ তো হইবোই।
আমি হেসে ফেলি। এ যেন “বয়স কত? ত্রিশ কি নব্বই” অবস্থা। তবে আমার ধারণা ষাটের নীচে হবে না। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, বাঙালী মহিলাদের মতো এখানার বাঙালী পুরুষদের বয়স কমিয়ে বলা অভ্যাস। কেন কে জানে। হয়ত দেশে গিয়ে বয়স কমিয়ে আর একটা বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে। পেশাবে জ্বালা, সাথে জ্বর জ্বর ভাব। সপ্তা দশ দিন ধরে। থার্ড ইয়ার মেডিকেল স্টুডেন্টও বলতে পারবে, পেশাবে ইনফেকশন। এর জন্য ডাক্তার হওয়া লাগে না। টেস্ট করার প্রয়োজনও পড়ে না। এন্টিবায়োটিক লেখার আগে জিজ্ঞেস করার জন্যই জিজ্ঞেস করি,
- আর কোনো অসুবিধা?
ও বাবা! চাচা মিয়া দেখি লজ্জাবতী গাছের মতো নুয়ে গেলেন। লজ্জার কী হল? আবার সেক্স বাড়াবার ওষুধ চাইবে না তো? বয়স যাই হোক, এ দেশের অধিকাংশ রুগীই, বিশেষ করে দেশে যাবার আগে, ঘুরে ফিরে সেক্স বাড়ানোর ওষুধ চায়। আমি ওদের দোষ দিতে পারি না। পাঁচ বছরে একবার দেশে যায়। পাঁচ বছরের শখ এক মাসেই মেটাতে চায়। কেমন করে বোঝাই, যতদিনই না খেয়ে থাকুক না কেন, পেট একবার ভরে গেলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আর খাওয়া যায় না। তাছাড়া বয়সের সাথে সাথে হজম শক্তিও কমে যায়। চাইলেও ঘনঘন খিধে লাগে না। চাচা মিয়া তখনও নীচের দিকে তাকিয়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলি,
- বলেন, আর কোনো অসুবিধা আছে?
- কেমনে কমু বাজান। বড় শরমের কতা।
আমার ধারণা বদ্ধমূল হয়। মুচকি হেসে বলি,
- ডাক্তারের কাছে শরম কী? বলে ফেলেন।
- কুচকিতে একটা ফোরাও হইছে বাজান।
আমি এবার শব্দ করেই হেসে ফেলি। বলি,
- ও! এই কথা? এতে লজ্জার কী আছে? ফোড়া তো হইতেই পারে। কতদিন?
- এই তো তিন চার দিন। খুব ব্যথা ডাক্তার সাব।
- ডায়াবেটিস আছে?
- না। কিছুদিন আগে টেস্ট করাইছিলাম।
- ফোড়াটা একটু দেখতে হয় যে চাচা মিয়া।
- দেখানই লাগবো? না দেইখা ওষুধ দেওন যায় না?
লোকটির সংকোচ আমি বুঝতে পারি। বড় রক্ষণশীল জাতি আমরা। ডাক্তার হলেও তার প্রায় অর্ধেক বয়স আমার। লুঙ্গী খুলে লজ্জার জায়গা দেখাতে তো লজ্জা পাবারই কথা। আমি এবার টিপিক্যাল ডাক্তারি টোনে বলি,
- না দেখে তো ওষুধ দেয়া যাবে না। ঐ বেডে শুয়ে পড়েন। যতটুকু লাগে, আমি শুধু ততটুকুই দেখব।
একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মতো চাচা মিয়া বিছানায় শুয়ে পড়েন। পড়নে সৌদিদের মত লম্বা পাঞ্জাবী। নীচে লুঙ্গী। আমি পাঞ্জাবীটাকে কোমর পর্যন্ত তুলে, লুঙ্গীটাকে নীচে নামিয়ে শুধু দুই কুচকি (inguinal region) অনাবৃত করি। এমন কিছু দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। ডান কুচকি ফুলে একটা হাঁসের ডিমের মত হয়ে আছে। উপরের দিকটা লাল। আমার কপাল কুঁচকে যায়। শুধু পেশাবের ইনফেকশনে এমনটা হবার কথা নয়। আমি কোনো কথা না বলে লুঙ্গী তুলে পায়ের আঙ্গুলের ডগা থেকে শুরু করে কুচকি পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজি, যদি কোথাও সোর্স অব ইনফেকশন পাওয়া যায়। কোথাও কিচ্ছু নেই। আমার দুশ্চিন্তা বাড়ে। দেখি চাচা মিয়া এক হাতে চোখে ঢেকে শুয়ে আছেন। আমি গম্ভীর কণ্ঠে বলি,
- আমাকে আপনার লজ্জা-স্থানও দেখতে হবে।
এবার আর অমত করেন না। মাথা নেড়ে নীরব সম্মতি জানান। আমি সম্মানের সাথেই তাকে উন্মুক্ত করি। স্তম্ভিত হয়ে দেখি মাথাটা লাল, মুখ থেকে কষানি ঝরছে। আমার যা বোঝার বোঝা হয়ে যায়। এই সৌদি আরবেই এমন রুগী প্রচুর পেয়েছি। তাই বলে পঞ্চাশোর্ধ আপাত পরহেজগার একজন মানুষকে এ হালে দেখব কল্পনা করিনি। তাকে কাপড় ঠিক করতে বলে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসি। সেও লুঙ্গী পাঞ্জাবী ঠিক করে সামনের চেয়ারে বসে। চোখ মাটির দিকে। সে কী বুঝতে পারছে, আমি কী সন্দেহ করছি? ঠিক কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারি না। লোকটার উপর ভীষণ রাগ হওয়া উচিত। অথচ কেন জানিনা, হচ্ছে না। বরং করুণা হচ্ছে। নিরাসক্ত গলায় জিজ্ঞেস করি,
- ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন?
- কি যে কন ছার। কিলিনারের চারকি করি। ফেমিলি আনমু কেমনে? মহাজনের কাছ থেইকা দুই লাখ ট্যাকা দাদন লইয়া সৌদি আইছি। দালালে তো কি কইছিল। আইসা দেহি সব ফক্কা। পাঁচ বছর হইল, সুদ গুনতে গুনতে জান যায়। আসল এহোনো শোধ হয় নাই। পাঁচ বছর বউ পোলাপানের মুখ দেহি না।
বলতে বলতে কথা থেমে আসে বৃদ্ধের। পাঞ্জাবীর হাতায় চোখ মোছেন। মিথ্যে বলছে না সে। এমনই হাজার হাজার মানুষ দালালের প্রলোভনে পড়ে, এই নির্বান্ধব মরুতে ধুকে ধুকে মরছে। বড় আবেগ প্রবণ মানুষ আমি। মানুষের চোখে পানি দেখলে কান্না চলে আসে। কোনমতে কান্নাটাকে ঢোক গিলে পেটে চালান দিয়ে জিজ্ঞেস করি,
- ছেলেমেয়ে ক’জন।
- আগের পক্ষে তিন জন। এই পক্ষে দুই জন।
শুনে হাসব না কাঁদব, বুঝতে পারি না। ভরণপোষণের মুরোদ নেই, অথচ একাধিক বিয়ে, আর ততোধিক সন্তান উৎপাদনে খামতি নেই। এবার বেশ রাগ হয় আমার। কবে বোধোদয় হবে এই নির্বোধ জাতির? কটমট করে তাকাতেই কাঁচুমাচু হয়ে বলে,
- প্রথম পক্ষ তিন তিনডা ছোডো পোলাপাইন থুইয়া মইরা গেল। তো পোলাপাইনগুলা দেখপো কেডা, আমারে দেখপো কেডা, তাই ছোডোজনরে ঘরে আনলাম। হের প্যাডেও দুইজন আইলো। আল্লায় দিলে কী করতাম বাজান?
ফ্যামিলি প্লানিং আলোচনা করার মুড নেই আমার। সময়ও নেই। সরাসরি আসল মুদ্দায় চলে আসি।
- একটা কথা জিজ্ঞেস করব। সরাসরি জবাব দেবেন। এদেশে কোনো মেয়ে মানুষের সাথে শুয়েছেন গত এক দেড় মাসের মধ্যে?
- এইডা কী কইলেন বাজান? বাপের মতন একটা মানুষরে এই কতা জিগাইতে পারলেন? তাও সৌদির মতো জায়গায়। তওবা, তওবা। আমি পাঁচ ওয়াক্তো নামাজ পড়ি।
যেন আকাশ থেকে পড়লেন তিনি। আমি জানি, সৌদি আইনে পতিতাবৃত্তির শাস্তি খুব কঠিন এবং তা পাথর নিক্ষেপে হত্যা পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু সেই সাথে এও নিশ্চিত জানি, সৌদিতে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে পতিতালয় না থাকলেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন মোড়কে চলছে পতিতাবৃত্তি। বিশেষ করে ফিলিপিনো নার্স ও ইন্দোনেশিয়া এবং আফ্রিকা থেকে যে সব মেয়েরা গৃহ পরিচারিকার (খাদ্দামা) চাকরি নিয়ে আসে, তারা দু-পয়সা এক্সট্রা কামানোর জন্য এ কাজে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি আমি এও শুনেছি, রাস্তায়, মার্কেটে, এরা বোরকা পড়ে মুখে নেকাব দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। খদ্দের মনে হলে পাশে যেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, “আগবা দুগদুগ?” (wanna sex?). রাজি হলে তাদের গাড়িতে উঠে বাড়ি চলে যায়। পর্দার আড়ালে কে কার বউ, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বুঝতে পারে না। গরীব মানুষগুলোরও মাঝে মাঝে এমন ঘোড়া রোগ হয়। পাঁচ সাত বছর পরিবার থেকে দূরে থেকে, রিপুর তাড়না সহ্য করতে না পেরে, তারাও মাঝে মাঝে ভাড়া করে নিয়ে আসে। যেহেতু এ সব কাজ লোক চক্ষুর অন্তরালে হয়, এবং এদের কোনো রেগুলার মেডিকেল চেকআপ হয় না, পায়ই এরা যৌন সংক্রামণ রোগে ভোগে এবং ছড়ায়।
ডাক্তারির সাথে সাথে আমি ফেস রিডিংও পারি। মুখ দেখে লোকটাকে বোঝার চেষ্ট করি। কেন জানি মনে হয় লোকটা দুশ্চরিত্র নয়। হয়ত কোনো এক দুর্বল মূহুর্তে, শয়তানের প্ররোচনায় দুষ্কর্মটি করে ফেলেছেন। তাই স্বীকার করতে লজ্জা পাচ্ছেন। ভুল তো মানুষেরই হয়। তাকে আর লজ্জা দিতে মন চাইল না। এবার অন্য পথ ধরি,
- দেখেন চাচা মিয়া, আপনার পেশাবের রাস্তায় আর কুচকিতে ইনফেকশন হইছে। এই ইনফেকশন এমনি জীবাণু দিয়াও হইতে পারে, আবার ওই কাজ করলেও হইতে পারে। এমনি জীবাণু দিয়া হইলে মুখে ওষুধ খাইলেই চলবে। আর ওই কাজ দিয়া হইলে মুখের ওষুধের সাথে ইনজেকশনও দিতে হইবে। এখন আপনি বলেন, শুধু ওষুধ দেবো না সাথে ইনজেকশনও দেবো।
- তাইলে বাজান ইনজেকশনও দেন।
আমি অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখি। আমার বোধহয় উকিল হওয়া উচিত ছিল। বেচারা আমার ওকলাতি কথার প্যাচে পইড়া গ্যাছে!
ক্লিনিক্যালী সে গনোরিয়া ও ক্ল্যামাইডিয়া দুই ধরণের ইনফেকশনেই ভুগছে। গনোরিয়ার জন্য পেশাবের রাস্তায় প্রদাহ এবং ক্ল্যামাইডিয়ার জন্য কুচকিতে হাসের ডিম। আমরা বলি Lymphogranuloma Venereum (LGV) কিংবা বিউবো (Bubo)। তাকে গনোরিয়ার জন্য এক শট হাই ডোজের পেনিসিলিন আর বিউবোর জন্য তিন সপ্তার ডক্সিসাইক্লিন দিই। অযথা তাকে দিয়ে আর টেস্ট করাই না। চার সপ্তাহ পর দেখা করতে বলি।
গল্পটা এখানে শেষ হলেই ভালো হত। তাহলে আর বাইশ বছর পরও সেই বৃদ্ধের স্মৃতি আমাকে তাড়া করে ফিরত না, আর এই গল্পও লিখতে হত না। এমন চিকিৎসা তো কতজনকেই দেই, ভালো হয়ে গেলে আর দেখা করে না। ওই চাচা মিয়ার দেখা করার সম্ভাবনা ছিল আরও কম। মাস পার হয়ে যায়, চাচা মিয়ার দেখা নাই। আমিও তাকে অন্য রুগীর ভিড়ে ভুলে গেলাম।
মাস তিনেক পর বৃদ্ধ একদিন হাজির। চোখ মুখ বসে গেছে। মাথাটা মুণ্ডন করা। বুঝলাম ওমরাহ করেছেন। হয়ত খোদার ঘরে যেয়ে খোদার দরবারে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। যত অপরাধই করুক, বিধাতা পুরুষ একদিন ক্ষমা করে দেবেন, এই বিশ্বাস নিয়েই তো বিধাতায় বিশ্বাসী মানুষগুলো বেঁচে থাকে। আমি হেসে বলি,
- কি চাচা মিয়া, আপনার না একমাস পর আসার কথা ছিল?
হঠাৎ বৃদ্ধ টেবিলের উপর রাখা আমার হাতটি দুহাতে চেপে ধরে বলে,
- বাজান, অনেক কষ্টে সাহস জোগাইয়া আপনের কাছে আইছি। খোদার কাছে হাজার অন্যায় কইরাও মাপ চাওয়া সহজ, কারণ খোদারে তো আর দ্যাহোন যায় না। তাই শরমও লাগে না। কিন্তু মাইনষের কাছে অন্যায় কইরা মাপ চাওয়া বড় কঠিন। বড় শরম করে। বাজান, আপনে আমারে মাপ কইরা দেন। ঐ দিন আপনেরে মিত্যা কতা কইছি। আসলেই আমি পাপ করছিলাম। মহা পাপ। আপনে বুদ্দি কইরা ইনজেকশন না দিলে আমি বাঁচতাম না।
বলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন বৃদ্ধ। ফোটায় ফোটায় তার অশ্রু আমার হাতকে ভিজিয়ে দেয়। আমি তাকে একটু কাঁদতে দেই। মনের কষ্ট দূর করার জন্য চোখের জলের চেয়ে বড় ঔষধ আর নাই। বাবার বয়সী এই লোকটার জন্য বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। আমার অন্য হাত দিয়ে তার হাত দুটোতে চাপ দিয়ে বলি,
- মাফ চাইতে হবে না। আমি কিছু মনে করি নাই। ডাক্তার আর উকিলের কাছে কিছু লুকাইতে হয় না। সময় মতো চিকিৎসা না দিলে পরে ও রোগ ভালো করা খুব মুশকিল হয়ে পড়ত। ওই পথে আর যাবেন না। ভেবে দেখেন, বউ কাছে নাই বলে এখানে আপনি যে কাজটি করলেন, আপনি কাছে নাই বলে বউও যদি দেশে বসে সে কাজটি করে, তখন কেমন হবে?
দুহাতে কান চেপে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলেন,
- তওবা, তওবা, জীবন থাকতে ওই পথে আর না। আমারে আর শরম দিয়েন না।
আসলেই লজ্জায়, অনুতাপে এতটুকু হয়ে আছেন বৃদ্ধ। আমি প্রসঙ্গ বদলাই,
- দেশে যাবেন কবে?
- এই ছয় মাস পর, আকামা (Resident Permit) রিনু কইরা যামু।
আকামা রিনিউ করার কথায় মনে পড়ে, রিনিউ করার আগে মেডিকেল চেকআপ করতে হয়। তার যৌন-বাহিত কোনো রোগ(sexually transmitted diseases) থাকলে অসুবিধা হতে পারে। মেডিকেলে আনফিট হয়ে যেতে পারেন। আনফিট হলে দেশে ফিরে যেতে হবে। তার STD Screen করা খুবই জরুরী। বস্তুত প্রতিটি মানুষেরই, যারা জীবনে কখনো দেহপসারিণীর দেহ কিনেছে, তাদের সবার STD Screening করানো জরুরী। আমি বৃদ্ধকে বলি,
- চাচা, কিছু ব্লাড টেস্ট করা দরকার।
- ক্যান বাজান? আমি তো ভালো অইয়া গেছি।
- তারপরও দেখা দরকার, আর কোনো জীবাণু রক্তে আছে কিনা।
- কত ট্যাকা লাগব?
- দু তিনশ রিয়ালের মতো
- অত ট্যাকা কই পামু বাজান? ওষুধ কিনতে যাইয়া এমনিতেই ধার কর্জ হইছে। মাসে মাসে দেশে ট্যাকা পাঠান লাগে।
হতাশ বৃদ্ধ চেয়ারে নেতিয়ে পড়ে। বুঝতে পারছি, টেস্টের টাকা জোগাড় করা তার সাধ্যের বাইরে। এই ক্লিনিকের জন্য তো কত টাকা কামাই করে দিলাম। এই অসহায় বৃদ্ধের জন্য নাহয় কিছু করি। প্যাথোলোজিস্ট আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মানুষ। তাকে ফোন করে সব বুঝিয়ে বলি ও টেস্টগুলো যাতে ফ্রি হয়ে যায়, তার ব্যবস্থা করি। বৃদ্ধকে বলি, সে যেন অবশ্যই এক সপ্তাহ পর রিপোর্ট নিয়ে আমার সাথে দেখা করে।
এবার ঠিক ঠিক এক সপ্তাহর মাথায় হাজির হন চাচা মিয়া। হাতে এক প্যাকেট সৌদি খেজুর। বুক পকেটে রিপোর্টের খামটা উঁকি দিচ্ছে। মুখে এক অদ্ভুত খুশি খেলা করছে। খেজুরের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
- গরীব মানুষ বাজান। এইটা আপনের জন্য আনলাম। না বইলেন না।
প্যাকেটটা হাতে নিতে নিতে ভাবি, ভালোবাসার উপহার, সে যতই ছোট হোক, কোনো মূল্যে কি তাকে মাপা যায়? তবু হেসে বলি,
- এ কেন আনতে গেলেন চাচা?
বৃদ্ধ ফোকলা দাঁতে হাসে। থুতনির দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
- তার আগে আমার একখান প্রশ্নের জবাব দ্যান দেহি বাজান। আপনে আমার জন্য এত করতাছেন ক্যান? আপনে জানতেন, আমি একটা খারাপ কাম করছি। তাও আপনে কিছু কইলেন না। আমারে তো আপনের গেন্না করার কতা। তা না কইরা এতগুলা ট্যাকার টেস্ট ফিরি করাইয়া দিলেন। ক্যান বাজান?
আমি বৃদ্ধের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। সেও চেয়ে আছে আমার দিকে উদগ্রীব হয়ে। তার মুখটা আস্তে আস্তে কেমন যেন আমার বাবার মুখ হয়ে যায়। আমি তাকে তা বলতে পারি না। বলতে পারি না, আমি বাবার জন্য কিছু করতে পারিনি, তাই বাবার মতো কাউকে দেখলে কিছু করতে ইচ্ছে করে। আমার চোখ জলে ভরতে চায়। আমি প্রাণপণে তা থামাতে চেষ্টা করি। প্রার্থনা করি, বৃদ্ধের সামনে যেন আমাকে কাঁদতে না হয়। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সেই বলে,
- কতা কন না ক্যান বাজান?
ততক্ষণে সামলে নিয়েছি নিজেকে। একটু দুষ্টুমির ছলে তার ভাষায় বলি,
- এই যে আপনে আমারে বাজান ডাকতাছেন, তাই।
শিশুর মতো শব্দ করে হেসে ওঠেন বৃদ্ধ। ভাঙ্গা দাঁতের ফাঁক গলে সে শব্দ ফসফস করে বের হয়। আহা, মানুষকে একটু খুশি, একটু হাসি দেয়ার মাঝে কি অনাবিল সুখ, কি আনন্দ! তার হাসি আমার মাঝেও সংক্রামিত হয়। হাসতে হাসতেই বলি,
- রিপোর্টটা দেন।
খাম বন্ধ। আমি আনমনে খামটা খুলি। পাঁচ পৃষ্ঠার রিপোর্ট। গনোরিয়া, সিফিলিস, ক্লামাইডিয়া, হেপাটাইটিস বি, সব নেগেটিভ। দেখে এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে যায় মন। হঠাৎ শেষ পৃষ্ঠায় আটকে যায় চোখ। আমার হাতে বজ্রপাত হলেও এতটা অবাক হতাম না। বজ্রাহতের মতোই রিপোর্ট হাতে বসে থাকি। এইচ আই ভি পজিটিভ। আমি যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারি না। আমাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেন বৃদ্ধ,
- কী? খারাপ কিছু ডাক্তার সাব?
কেঁপে যায় বৃদ্ধের গলা। ভুলে যান আমাকে বাজান ডাকতে। আমি শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। কেমন করে বোঝাই, মরণ ব্যাধি এইডসের ভাইরাস আক্রমণ করেছে তাকে। (বাইশ বছর আগে অনুন্নত দেশে এইডসের চিকিৎসা তখনও তেমন পসার লাভ করেনি)। কেমন করে বলি, তার সৌদিতে থাকা হবে না আর। কেমন করে বলি, মহাজনের দাদনের টাকা শোধ করা হবে না তার। কোন মুখে বলি, দ্বিতীয় পক্ষের যুবতী স্ত্রী, যে পাঁচ বছর পথ চেয়ে আছে তার, যেয়েই তার সাথে কাঙ্ক্ষিত সে মিলন হবে না আর। বেশী কথা বলার জন্য বাবা আমাকে বাচাল বলতেন। বন্ধুরা বলত কথার রাজা। সবার কথা ফুরালেও আমার ভাণ্ডারের কথা ফুরাতো না। সেই আমার কথা ফুরিয়ে যায়। আমি বসে থাকি বাক-হীন। এবার সত্যি সত্যি আমার দুচোখ ভরে পানি আসে। আমি থামাতে পারি না। বৃদ্ধ অ-সহিষ্ণু কণ্ঠে বলে ওঠেন,
- বাচ্চা পোলাপাইনের লাহান কানতাছেন ক্যান? কী রোগ হইছে আমার? আমার শইলে তো কোনো অসুবিধা নাই।
আবার সামলে নিয়েছি নিজেকে। আমাদের সামলে নিতে হয়। কাউকে মৃত ঘোষণা করতে, কিংবা কাউকে মৃত্যুর পরওয়ানা দিতে, আমাদের গলা কাঁপলে চলে না। আমি এবার অ-কম্প কণ্ঠে বলি,
- চাচা, খুব খারাপ একটা রোগ, এইডসের জীবাণু আপনার শরীরে বাসা বেধেছে। আকামা মেডিকেলে আনফিট হয়ে যাবেন। সৌদি কর্তৃপক্ষ জানতে পারলে আপনাকে অনেক জেরা করবে। খুব অসুবিধায় পড়ে যাবেন। এ দেশে আপনার চিকিৎসা হবে না। আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন দেশে চলে যান। মহাখালী হাসপাতালে এর চিকিৎসা আছে। ওরা সরকারী খরচে আপনার চিকিৎসা করবে। আর হ্যাঁ, ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া কোনো অবস্থাতেই স্ত্রীর সাথে মেলামেশা করবেন না। তাহলে তারও এ রোগ হতে পারে।
এক নাগারে কথাগুলো বলে থামি আমি। ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে আছেন বৃদ্ধ। যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না আমার কথা। হঠাৎ হেসে ফেলেন। হাসতে হাসতেই বলেন,
- এ সব কী কন বাজান? এ কেমন তরা মশকরা করতাছেন এই বুইরা মানুষটার লগে?
এখন আমি ধীর, স্থির, শান্ত। শান্ত কণ্ঠেই বলি,
- মশকরা করছি না চাচা। আমি যা বলছি, তার প্রতিটা কথা সত্য। আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। আপনি এটা মহাখালী হাসপাতালে দেবেন। নাম ঠিকানা আমি চিঠির উপর লিখে দিচ্ছি।
ঝট করে উঠে দাঁড়ান বৃদ্ধ। চিৎকার করে বলেন,
- আরে রাহেন মিয়া আপনের চিঠি। আপনের চিঠির আমি খ্যাতা পুরি। আদব লেহাজের বালাই নাই। মাগনা টেস্ট করাইছেন বইলা কী মাতা কিইনা ফালাইছেন? যা মুহে আয় তাই কইবেন? রাহেন আপনের ফিরি টেস্ট আপনের কাছে। আমি গেলাম।
বলেই হনহন করে বেরিয়ে যান বৃদ্ধ। রিপোর্ট হাতে আমি তব্ধ মেরে বসে থাকি। এমনটি করবেন তিনি, স্বপ্নেও ভাবিনি। যখন সম্বিত ফেরে, দ্রুত উঠে বাইরে আসি। কোথাও সে নেই। দৌড়ে ক্লিনিকের বাইরে যাই। বাইরে তখন রাত্রি নেমেছে। রাস্তায় হাজার মানুষের ঢল। হারিয়ে গেছেন বৃদ্ধ সেই মানুষের ভিড়ে।
তখন মোবাইল ছিল না। তার ঠিকানা রাখিনি। তার দেশের বাড়ি কোথায়, তাও জানি না। জেদ্দায় লক্ষ বাঙালীর বাস। এত মানুষের মাঝে শুধু নাম দিয়ে কাউকে খুঁজে বের করা যায় না। বৃদ্ধ আর কোনদিন ফিরে আসেনি।
বাইশ বছর কেটে গেছে। সেই বৃদ্ধের কি হয়েছিল, আমি আজও জানি না। বেঁচে আছে নাকি সেই মরণ ব্যাধিতে অকালেই চলে গেছে, আমি জানি না। সে কি দেশে ফিরে গিয়েছিল নাকি পয়সা দিয়ে আনফিট মেডিকেলকে ফিট বানিয়ে এ দেশে থেকে গিয়েছিল? আমি তাও জানি না। শরীরে এইচ আই ভি ভাইরাস নিয়ে, ছুটিতে দেশে গিয়ে, সে কি তার নিরপরাধ যুবতী স্ত্রীকেও সংক্রামিত করেছিল? আমি কিচ্ছু জানি না। যে পথ-নারী তাকে এই রোগ দিয়েছিল, সে আর কতজনের শরীরে এ মরণ ব্যাধি ছড়িয়েছিল, জানার কোনো উপায় থাকল না। একাকী কোনো গহীন রাতে যখন ঘুম আসে না, যখন ফেলে আসা পথে হেঁটে চলি, তখন সেই বৃদ্ধকে খুঁজে ফিরি। তার জন্য কিছু করতে না পারার কষ্ট আজও আমাকে কুরে কুরে খায়।
বি.দ্র. এটি একটি সামাজিক সচেতনতামূলক গল্প।