- Joined
- Dec 22, 2024
- Threads
- 115
- Messages
- 1,101
- Reaction score
- 134
- Points
- 1,213
- Age
- 40
- Location
- Dhaka, Bangladesh
- Gender
- Male
বিড়ম্বনা
মূল লেখকঃ ডা. আফতাব হোসেন।
মূল লেখকঃ ডা. আফতাব হোসেন।
টুক, টুক, টুক...
দরজা খুলতেই দেখি লিজা দাঁড়িয়ে। প্রায় উদোম শরীরে। শুধু একটা গামছা জড়ানো বুকে। আজ দুপুরেই প্রথম পরিচয়। রাত না হতেই সে এভাবে আসবে আমার কাছে, কল্পনাও করিনি। দু’চোখ কপালে তুলে বলি,
- লিজা তুমি?
- ভাইয়া গরম। খুব গরম। অঙ্গ জ্বলে যায়।
বলে লাজুক হাসে লিজা। দেখে আমার গা জ্বলে যায়। বেশ বিরক্ত হয়ে বলি,
- তা আমার কাছে কেন? দরজা বন্ধ করে এসি চালিয়ে অঙ্গ ঠাণ্ডা করে নাও।
- ভাইয়া, সেই জন্যই তো আপনার কাছে আসা।
- মানে কী?
- মানে আমার রুমের এসি চলতেছে না। সরেন। আমারে একটু ঘরে ঢুকতে দেন।
বলে অনুমতির তোয়াক্কা না করেই আমাকে ঠেলে ঘরে ঢোকে লিজা। এসির সামনে বুক খুলে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করে। আমার সামনের রুমটাই ওর। প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে অধুনা নির্মিত কাজি পুর উপজেলা পরিষদ রেস্ট হাউজ কমপ্লেক্স। এই রেস্ট হাউজে এক রাত আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব। এমন আধুনিক রেস্ট হাউজের এসি চলে না, বিশ্বাস হতে চায় না। বলি,
- চলো, দেখছি। কেন চলে না তোমার এসি।
- কোনো লাভ নাই ভাইয়া। আমি সব রকম চেষ্টা করছি। দ্যাখেন না, কেমন ঘেমে নেয়ে গেছি!
দেখি বিন্দু বিন্দু ঘাম লিজার মুখে, বুকে, শরীরে। ঘামে ভেজা চুল লেপটে আছে কপালে। আমি চোখ নামিয়ে নেই। বলি,
- তা কেয়ার টেকারকে বলেছ?
- এই গাও গেরামে কেয়ার টেকারের চৌদ্দ পুরুষেও এসি দেখে নাই ভাইয়া। সে এসির কিছু বুঝে না।
বলে হাত পা ছড়িয়ে আমার বেডে বসে লিজা। দেখে আমার চোখ সরু হয়ে যায়। এ সবের মানে কী? ও কি এই রুমে ঘুমোবার চিন্তা করছে? ভাবতেই আমার গলা শুকিয়ে যায়। বত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে বউ ছাড়া আর কারও সাথে বেড শেয়ার করি নাই। শেষে কি বয়াতি বংশের পোলার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়?
ছয় জনের টিম আমরা। রুম খালি পেয়েছি চারটি। আমি আগেই বলে রেখেছি। বেড শেয়ার করতে পারি না। তাই প্রথমেই ওরা আমাকে একটা রুম দিয়ে দেয়। দুটোতে দুজন করে আর বাকি একটাতে অবশ্যই লিজা। সেই লিজার এসিই খারাপ হল? আমার মেজাজও খারাপ হয়ে যায়। রাতের বেলা উপজেলা শহরে এসির মেকানিক কোথায় পাব?
নাড়ীর টানে সময় পেলেই খুলনা চলে আসি। আর শেকড়ের টানে যাই খালিশপুরে। যেখানে কেটেছে আমার শৈশব আর কৈশোরের নানা রঙের দিনগুলি। বায়তুল ফালাহ মোড়ে, কচি ভাইয়ের দোকানে সন্ধ্যার পরে একে একে জড় হয় অনেকে। আসে ইঞ্জিনিয়ার ফরহাদ। ছোট ভাইয়ের ক্লাসমেট। আমার চেয়ে এগারো বছরের ছোট। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও খুলনা ছাড়েনি কখনও। ঘুরেফিরে খুলনার আশেপাশেই চাকরি করে। পড়ে থাকে খালিশপুরের মাটি কামড়ে। আসে লতিফ ভাই। আমার চেয়ে তিন বছরের বড়। এক বছর হয় বিটিসিএল থেকে রিটায়ার করেছেন। আসে জুয়েল, জাকির, বাবু, আরও অনেকে। কেউ ব্যবসা করে, কেউ মাস্টারি, কেউ জুট মিলে চাকরি। সবাই প্লাটিনাম স্কুলের ছাত্র। আড্ডা জমে ওঠে। সময় পেলেই আমি ওদের কাছে যাই। ভাঙ্গা চেয়ারে বসে কাঁচের গ্লাসে লাল চা খাই। সাথে গরম গরম ডালপুরি কিংবা পিয়াজু। ওরা আমাকে চটের কথা মনে করিয়ে দেয়, মাটির কথা মনে করিয়ে দেয়, আমার শেকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
বলা হয়, দানের জন্য ধন নয়, মন থাকা চাই। ওখানে জড় হওয়া মানুষগুলো ধনে বড় না হলেও মনের দিক দিয়ে অনেক বড়। প্রকৃতির লীলাভূমি এই ব-দ্বীপের মানুষগুলোর জীবন নিয়ে প্রতি বছরই প্রকৃতি নানা খেলায় মেতে ওঠে। কখনও পানিতে ডুবিয়ে দেয়, কখনও জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নেয়, আবার কখনও বা শীতে ঠাণ্ডায় জমিয়ে মারে। ওদের মন তখন কেঁদে ওঠে। ওরা তখন নিজের সামর্থ্য মত যা পারে, তাই নিয়ে প্রকৃতির কাছে অসহায় ঐ মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে চায়। আমাকে খবর দেয়। দূরে থাকি বলে ওদের সাথে আমি যেতে পারি না। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। তবে সাধ্যমত সাহায্য করি।
এবার এসে ব্যস্ততার কারণে ওদের কাছে যেতে পারিনি। পেপারে দেখি, বন্যার পানি বাড়ছে। তলিয়ে যাচ্ছে মাঠ, ঘাট, প্রান্তর। তলিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি, বাড়ি, ঘরদোর। এমন সময় একদিন ফরহাদের মেসেজ আসে, ভাই, যাওয়া দরকার। তলিয়ে যাচ্ছে সব। সাথে সিরাজগঞ্জের যমুনার চরাঞ্চলের কিছু ছবি। পানি আর পানি। তারই মাঝে নাকে জাগিয়ে কোনমতে বেঁচে আছে গাছপালা, ঘর বাড়ির চুড়া। লিখলাম, বস তোরা, আসছি আমি।
দেখি, যথারীতি জড় হয়েছে সবাই কচি ভাইয়ের দোকানে। শুনলাম, লতিফ ভাইদের গ্রামের বাড়ি কান্তপুর তলিয়ে গেছে বানের জলে। বলা হয়, চ্যারিটি স্টার্টস ফ্রম হোম। যেতে হলে ওখানেই প্রথম যাওয়া উচিৎ। বললাম, এবার আমিও যেতে চাই তোদের সাথে। সবাই চমকে ওঠে। ভাবতে পারেনি আমিও যাব ওদের সাথে। ফরহাদ আমতা আমতা করে, ভাই, আপনি পারবেন? পরোক্ষণেই প্রমাদ গুনি। সাতার জানি না আমি। আবার ভাবি, সাঁতার জেনেও তো কতজন ডুবে যায়। আমি নাহয় না জেনেই ডুবলাম। বলি, চিন্তা করিস না। আমাকে একটা লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে রাখিস।
যেই বলা, সেই কাজ। দ্রুত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হল। শুকনা খাবার দেব। সাথে চাল, ডাল, তেল, যা আমাদের সাধ্যে কুলায়। ছয় জনের টিমও তৈরি হয়ে গেল। আমি, লতিফ ভাই, ফরহাদ, জুয়েল, আসাদ ও লিজা। সেই প্রথম লিজার নাম শুনি। আসাদকেও চিনি না। শুনে চমকে উঠি। ত্রাণ টিমে মেয়ে? আমার বিশ্বাস হয় না। জিজ্ঞেস করেই ফেলি,
- লিজা কে?
- আমার এক বন্ধু,
ফরহাদ জবাব দেয়। আমি অবাক হয়ে ফরহাদের দিকে তাকাই। বাংলাদেশের ভালোই তরক্কি হচ্ছে তাহলে? মেয়েদেরকে বান্ধবী না বলে বন্ধু বলা হচ্ছে? ভালো কথা, তাই বলে বানের পানিতে মেয়ে মানুষ নিয়ে যাওয়া? আমার সনাতন মন অস্বস্তিতে ভোগে। জিজ্ঞেস করি, আগে গেছে কখনও?
হ্যাঁ ভাই। ও তো প্রায়ই যায় আমাদের সাথে। কাশ্মীরেও তো গিয়েছিল আমার সাথে। ফরহাদ মিটিমিটি হেসে জবাব দেয়। শুনে আমার বিষম লাগার জোগাড়। ফরহাদকে আমি ভালো ছেলে বলে জানি। নম্র, ভদ্র, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। বউ পর্দা করে। শুনেছি, ফরহাদ মাঝে মাঝেই ইন্ডিয়া ট্যুরে যায়। বাচ্চারা ছোট বলে পরিবার সাথে নেয় না। তাহলে এই ব্যাপার? আমি চোখ সরু করে ফরহাদকে দেখি। ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না ফরহাদ তাহলে তলে তলে মেয়ে বন্ধু নিয়ে ট্যুরে যায়? বুঝলাম, মানুষ চিনতে এখনও আমার অনেক বাকি। তবে, মানুষের ব্যক্তি জীবনে নাক গলানো আমার স্বভাব নয়। অস্বস্তি হলেও ছোট ভাইয়ের বন্ধুর এই অস্বাভাবিক স্বভাব নিয়ে অহেতুক কৌতুহুল দেখানো সমীচীন মনে করি না। অন্যান্য কেউ এ ব্যাপারে কোনো আপত্তিও করে না। অগত্যা আমি চুপ করে থাকি।
ঠিক হল, পরের বৃহস্পতিবার যাওয়া হবে। ট্রেনে। আমরা চারজন খুলনা থেকে উঠবো। আসাদ ও লিজা যশোর থেকে উঠবে। ওরা নড়াইলে থাকে। ত্রাণ সামগ্রী আমাদের চাহিদা মোতাবেক সিরাজগঞ্জেই প্যাক হবে। তৈরি থাকবে ট্রলারে কাজি পুর যমুনা ঘাটে। বৃহস্পতিবার রাতে আমরা কাজি পুর রেস্ট হাউজে থেকে শুক্রবার সকালে স্পীড বোটে যমুনা পাড়ি দিয়ে যাব কান্তপুর গ্রামে। ওখানকার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান লতিফ ভাইয়ের আত্মীয়। সেই ত্রাণ বিতরণে সার্বিক সহযোগিতা করবেন।
সব ঠিকঠাক মতই এগুচ্ছে। সময় এগিয়ে আসে যাত্রার। জীবনে এই প্রথম বানভাসি মানুষের কাছে যাচ্ছি। অথচ আমার ভেতর উৎসাহের চেয়ে অস্বস্তি হচ্ছে বেশী। লিজা নামের কাঁটা বিঁধে আছে বিবেকের ভেতর। ছোট ভাই সমতুল্য বন্ধুদের কাছে লিজার ব্যাপারে বেশী কিছু জানতে চাওয়াও অশোভন দেখায়। আবার নিজের নাম উইথড্র করব, সে উপায়ও নাই। আবার ভাবি, মন্দ কী? ইংল্যান্ডের রাস্তায় দেখেছি, ছেলে মেয়ে পুলিশ জোড়ায় জোড়ায় রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়ায়। গল্প করতে করতে, হাসি ঠাট্টায় ওদের সময়টা বেশ কেটে যায়। মেয়েরা এখন পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে, প্লেন চালায়, নভোচারী হয়ে রকেটে চড়ে পুরুষের সাথে চাঁদে যায়, সেখানে একটি মেয়ে আমাদের সাথে বন্যা দুর্গত এলাকায় গেলে ক্ষতি কী? নিজের সংকীর্ণ মানসিকতার জন্য নিজেই লজ্জা পাই। বরং লিজার এই সাহসী পদক্ষেপের জন্য তার প্রতি এক ধরণের সমীহ ভাব চলে আসে।
বৃহস্পতিবার সকালে আমরা চারজন খুলনা ঢাকা চিত্রা এক্সপ্রেসে উঠি। বাথে শুধু আমরা চারজন। চিত্রা এক্সপ্রেস বাংলাদেশ রেলওয়ের ঐতিহ্য বজায় রেখে যথারীতি প্রায় এক ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ে। চিত্রাকে আন্তঃনগর এক্সপ্রেস কেন বলে কে জানে? সে তো সব টার্মিনালেই থামে! যেন এক কমুটার ট্রেনে চড়েছি। খুলনা থেকে যশোরের ট্রেন দূরত্ব বড়জোর চল্লিশ কিলোমিটার। মৈত্রীর পৌঁছাতে দুই ঘণ্টা লেগে যায়। এর চেয়ে সাইকেলেও তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। অথচ একটুখানি দেশ তাইওয়ানে তিনশ কিলোমিটার বুলেট ট্রেনে পাড়ি দিয়েছি দুই ঘণ্টায়। একটা দেশের উন্নতি তার যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে। আমরা দেশকে ডিজিটাল বানাচ্ছি। হাতে হাতে স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক তুলে দিচ্ছি। সাথে সাথে দিচ্ছি রাস্তায় অফুরন্ত অলস সময়, যাতে যাত্রীরা ফেসবুকে, ইন্টারনেটে সময় কাটাতে পারে। প্রতিদিন কত লক্ষ কর্ম ঘণ্টা যে রাস্তায় অপচয় হয়, তার হিসাব কেউ রাখে?
চিত্রা যশোরে পৌঁছাতেই ফরহাদ বলে, ভাই, যাই, লিজাকে নিয়ে আসি। ফরহাদের এই অতি উৎসাহ দেখে আমার গা জ্বলে যায়। লিজা যেন মহারানী যোধাবাই। সম্রাট আকবর নিজেই যাচ্ছেন তাঁকে বরণ করে আনতে। তবে অস্বীকার করব না, লিজাকে দেখার জন্য আমার ভেতরেও এক ধরণের গোপন আগ্রহ তৈরি হয়। শত হলেও পুরুষ মানুষ তো! হলাম নাহয় ষাটের বুড়ো!
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফরহাদ ফিরে আসে। মুখে যুদ্ধজয়ী হাসি। পিছে পিছে দুজন ছেলে ঢোকে। ছেলে না বলে দুজন মধ্যবয়সী পুরুষ বলাই ভালো। চল্লিশের উপরে বয়স। দুজনেরই মেদহীন সুঠাম শরীর। আমার চোখ লিজার অপেক্ষায়। ইতিমধ্যে চিত্রা আড়মোড়া ভেঙ্গে চলতে শুরু করেছে। তাহলে কী লিজা ট্রেন মিস করল? তাকিয়ে দেখি ছেলে দুটো বাকি সবার পরিচিত। তাই ফরহাদ আমার পরিচয় ওদের দেয়। প্রথম জন হাত মিলিয়ে বলে, আমি আসাদ। দ্বিতীয় জন হাত মিলিয়ে যেই বলে, আমি লিজা, অমনি আমার কয়েকটা হার্ট বিট মিস হয়ে যায়। এমন চমক বহুদিন পাইনি। অজান্তেই মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়, মানে?
হোহো করে হেসে ওঠে সবাই। বুঝলাম, সবাই আমাকে ইচ্ছে করেই অন্ধকারে রেখেছে। এমন বেকুব হইনি জীবনে। রেগেমেগে বলি, তোরা আমাকে আগে বলিসনি কেন? ফরহাদ কাঁচুমাচু হয়ে বলে, ভাই, আপনে তো জানতে চাননি, ও ছেলে না মেয়ে? যা জানতে চাইছেন, সবই তো বলছি। আমার রাগ তখনও পড়ে না। লিজাকে জিজ্ঞেস করি,
- এই ছেলে, তোমার নাম লিজা রাখছে কে?
- ভাইয়া, আব্বা। আমার বড় বোনের নাম লিপি, আর আমার নাম লিজা।
লিজার জবাব শুনে আমি আকাশ থেকে পড়ি। কেউ তাঁর ছেলের নাম লিজা রাখে, বাপের জন্মে শুনিনি। ফরহাদ বলে, ভাই, ওর ভালো নাম নাজমুল হাসান। নিজেকে লিজা বা লিজা হাসান বলে পরিচয় দেয়। আমি লিজার দিকে তাকাই, দারুণ হ্যান্ড-সাম। চওড়া বুকের পাটা। বোধহয় ব্যায়াম ট্যায়াম করে। মুখটায় সারাক্ষণ হাসি ঝুলিয়ে রাখে। আমার ভালো লেগে যায়। বলি, নিজেকে মেয়েদের নামে পরিচয় দিতে তোমার খারাপ লাগে না?
এক গাল অমায়িক হেসে লিজা বলে, না ভাইয়া। বরং ভালোই লাগে। জীবনের জটিলতায় মানুষ হাসতে ভুলে গেছে, অবাক হতে ভুলে গেছে। আমার নাম শুনে সবাই যখন অবাক হয়, সে অবাক মুখ দেখতে খুব ভালো লাগে আমার। ছেলেটা দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনই সুন্দর তাঁর বাচনভঙ্গি। আরও সুন্দর তার জীবন বোধ। ছেলেটাকে আমার মনে ধরে যায়। হঠাৎ খেয়াল করি, লিজার কাঁধে ঢাউস এক ক্যামেরা ঝোলানো। জানতে চাই,
- তুমি ফটোগ্রাফিও করো নাকি?
- শুধু ফটোগ্রাফি না ভাই, ও সকল কাজের কাজি। যে কোনো কাজে ও সবার আগে হাজির।
লিজার হয়ে ফরহাদ জবাব দেয়। এতক্ষণে বুঝতে পারি, কেন লিজা সব ট্যুরে অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটু পরেই তার প্রমাণও পেয়ে যাই। লিজা চলন্ত ব্যাকগ্রাউন্ডে আমাদের ছবি তোল, লিজা চায়ের অর্ডার দিয়ে আয়, লিজা ব্যাগটা নামিয়ে দে। কোনো কাজেই না নেই লিজার। দারুণ উৎসাহে হাসি মুখে করে যায় সব। পথে যেতে যেতে বয়সের ব্যবধান ভুলে আমরা খুব দ্রুত বন্ধু হয়ে যাই। গল্পে, আড্ডায়, হাসি, ঠাট্টায়, আমাদের পথের ক্লান্তি চলে যায়।
বিকেল চারটায় চিত্রা আমাদের সিরাজগঞ্জ মনসুর আলী টার্মিনালে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে সিএনজিতে বিশ কিলোমিটার দূরে কাজি পুর উপজেলায়। বিকেল পাঁচটা পেরিয়ে যায়। ইউএনও সাহেব আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আমাদেরকে স্বাগত জানিয়ে কেয়ারটেকার দিয়ে রেস্ট হাউজে পাঠিয়ে দেন। রুম বরাদ্দ হবার পর যেই কাপড় চোপড় খুলে ফ্রেস হতে যাব, অমনি লিজার এই এসি বিভ্রাট। এমন একটা ছেলে জুলাইয়ের এই ভ্যাপসা গরমে কষ্ট পাবে, মানতে পারি না। আবার লিজার সাথে বেড শেয়ার করব, তাও ভাবতে পারি না। এমন বিড়ম্বনায় জীবনে পড়িনি। বললাম,
- তারপরও চলো, দেখি তোমার এসির কিছু করা যায় কিনা।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও লিজা আমাকে তার রুমে নিয়ে যায়। রিমোট হাতে নিয়ে দেখি, কাজ করছে না। ডিসপ্লে অন্ধকার হয়ে আছে। খুলে দেখি ব্যাটারি নাই। ব্যাটারি কই পাই? নাসিম সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত রেস্ট হাউজ। তাই উপজেলা রেস্ট হাউজ হলেও প্রতি রুমে ফ্লাট স্ক্রিন টিবি। অবাক কাণ্ড হল, এসির রিমোটে ব্যাটারি না থাকলেও টিভির রিমোটে আছে। সেই ব্যাটারি খুলে যেই এসির রিমোটে লাগানো হল, অমনি এসি চালু হয়ে গেল। আর আমিও বেড শেয়ার করার বিড়ম্বনার হাত থেকে বেঁচে গেলাম।